
তার যাত্রা শুরু হয়েছিল উর্দ্ধমুখে, মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে। সূর্যের তীব্র তাপে উত্তপ্ত ভূমি তাকে ত্যক্ত করেছিল, ভোরের শিশিরবিন্দু হয়ে সবুজ ঘাসের শীর্ষলগ্না হয়ে থাকার আনন্দ তাই দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। এখন, এই মধ্যাহ্নে, একটি ধূলিকণিকা বুকে করে নিঃসীম নীলাভ আকাশের দিকে সে ভেসে উঠছে, নীচে পড়ে রইল দগ্ধ প্রান্তর, রৌদ্রে জ্বলে যাওয়া অরণ্য। এ যাত্রাপথ নির্বিঘ্ন নয়, এ পথে আছে দুশ্চরিত্র বায়ু, যা তাকে গতিভ্রষ্ট করতে পারে, আছে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের দুর্জয় পৌরুষ যেখানে সে তুষারবন্দী হতে পারে নিমেষে। আর আছে উচ্চতার আনুপাতিক তাপমানের হ্রাস, যা ক্রমশই তাকে শ্লথ থেকে শ্লথতর করছে। কিন্তু এই যাত্রা তার নিয়তি, কারণ প্রকৃতি যুগযুগান্ত ধরে জল স্থল অন্তরীক্ষে এই মহাকায় চক্র ঘুরিয়ে চলেছে, এই ওঠা নামার উপর জগৎ নির্ভর, পৃথিবীর মানুষ এর কাছে নতজানু হয় সে তো নগন্য অতিক্ষুদ্র জলকণা মাত্র।
অন্তরীক্ষে আকাশ ক্রমশ গাঢ় নীল হয়, কৃষ্ণাভ নীল। আরও উপরে নক্ষত্রপুঞ্জ ক্রমশ স্পষ্ট হয়। এখন তার গতি প্রায় স্তব্ধ হয়েছে। এই উচ্চতায় বহু নীচে পড়ে থাকা পৃথিবী দিকচক্রবালের কাছে ঢালু হয়ে নিঃসীম শূণ্যে অন্তর্হিত হয়েছে, সবুজে নীলে কতগুলি আল্পনার মত পড়ে থাকে মানবজমি। অল্প নীচে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এখানে ওখানে অলসভাবে ভাসে। সে ভাবে, এই নগণ্য কণার এতদুর আসার কি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য আছে? এই বিপুল জলচক্রের মধ্যে তার কি ভূমিকা?
তীব্র শীত এখানে। তাপমাত্রা শূণ্যাঙ্কের নীচে। আশে পাশে উপরে নীচে যতদুর নজর চলে তারই মত অজস্র জলকণা এই মহাব্যোমে স্তম্ভিত হয়ে কোনো অভাবিত ভবিষ্যতের প্রহর গুনছে। অকস্মাৎ তরঙ্গের মত দুলে উঠল তারা। না, কোন বাতাসের দোলা নয় – নীচ দিয়ে চলে যাচ্ছে অতিকায় উড়োজাহাজ, তার গর্ভ থেকে আসছে শব্দোত্তর তরঙ্গ, সেই অদৃশ্য তরঙ্গ বিপুল শূণ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে দ্রুত আর সেই তরঙ্গে অগনিত জলকণাগুলি দুলছে। সে-ও দুলতে থাকে।
এই সময়স্তব্ধ খেলা চলতে চলতে জলকণাগুলি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে থাকে। প্রথমে ধীরে, একটি দুটি, তারপর অচিরেই তুমুল আলোড়নে কম্পিত হতে হতে তারা মহাজাগতিক মিলনে আবদ্ধ হতে থাকে। সে তার বুকের মাঝে ধুলিকণাটুকু আঁকড়ে ধরে, ঐটুকুই হল জন্মের স্মৃতি, মাটির টান। নিঃশব্দে আরও অসংখ্য জলকণা তার সঙ্গে মিলিত হয়। অনু পরমাণুর মধ্য দিয়ে পার্থিব সঙ্কেত ছুটে যায়, এইবার মেঘের জন্ম হবে।
চারিদিক ঝাপসা হয়ে আসে, আলো কমে আসে। সেই আবছায়া অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকায়। চারিদিকে হা হা করে পাক খায় জলজ বাতাস। তারপর কোন অলঙ্ঘ্য নির্দেশে মাধ্যাকর্ষণ এসে টান মারে গভীর অন্তর। পতন শুরু হয়। প্রথমে ধীরে তারপর তীব্রগতিতে শুরু হয় পৃথিবীমুখী যাত্রা। চূড়ান্ত গতির প্রাবল্যে সে ফের বিচ্ছিন্ন হয়, বাতাস তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যেখানে তার উৎপত্তি সেখান থেকে বহুদুরে, অন্যদেশে, অন্য এক সময়ে সে ঝরে পড়ে। পড়তেই থাকে।
##########
কৃষকের মেয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখছিল বৃষ্টি আসছে। এমন সময়ে টপ করে তার গালে এসে পড়ল একফোঁটা জল। মেয়ে আপনমনে হেসে গাল মুছল। এবার তাকে ধান রুইতে হবে।
<<<<< অণুগল্প সিরিজে ফিরে যান