চসার মাঠ

আপনে কি কখনো চসার মাঠের দিকে গেছ? দুশো তিরাশি নম্বর বাস নন্দদার চাদোকানের সামনে নামিয়ে দিলে রাস্তার একপাশে গোটা কয়েক চালার দোকান, টায়ার সারাইএর কারখানা আর কিছু ঝোপঝাড়ের পিছন দিয়ে ভোঁমার্কা নীল আকাশের গায়ে আঁকা ছবির মত কতগুলো উঁচু উঁচু বাড়ি দেখতে পাবে, তাদের মাথার উপর আবছা মত দেখবে ভগবানের আঙুলের মত কটা ক্রেন, ঐ যে গো, কি বলেনা টাউনশিপ না উপনগরী, সেসব হচ্ছে ওখানে। কলকেতা শহর লম্বায় বাড়তে বাড়তে কুকুরের ন্যাজ হয়ে গেছে, এবার আড়ে বহরে বাড়তে বাড়তে পূবপানে এসে ঐখানটায় থুম্বো হয়ে বসে জিরোচ্ছে। রাস্তার ধারে ভিক্ষের বাটি তুলে মাটি কাটার মেশিন দাঁড়িয়ে আছে, তাও দেখতে পাবে, এই রাস্তা কেটে চওড়া করতেছে, নাম দিয়েছে বাইপাস। 

নন্দদার সঙ্গে কথা বোলোনি, ঐ রাস্তার গভ্ভে ওর ঘরপুকুর গেছে, কাউন্সিলার বাবুকে ধরে এই চাদোকান খুলে কোনমতে বেঁচেছে, এই দোকানের পিছনেই দরমা আর পেলাস্টিক দিয়ে ঘেরে ঘিরে বৌ বাচ্চা নিয়ে থাকে। বেজায় রেগে থাকে ও, একথা ওকথায় তোমাকে ঠিক শোনাবে ওর কাহিনী আর বলবে, শালা পাসই নাই, তার কিসের বাইপাস? 

এসবে ভুলোনি। এরা সব হাটুরে লোক, উন্নয়ন বোঝে না। রাস্তার ওধারটাতে যদি তাকাও তাহলে দেখতে পাবে একেবারে আকাশ ওইখানে যেখানে মাটিতে গিয়ে মিশেছে সেখান পর্যন্ত জলাজঙ্গল। আগে চাষবাস হত, এখন লোকে আমিন দিয়ে জমি মাপিয়ে পলোট করে রেখেছে। উন্নয়ন রাস্তা পেরিয়ে এল বলে, তখন দেখবে জামির মোল্লার খেল। দশহাজার টাকা বিঘের লোনা জমি সব পাঁচলাখ টাকা কাঠায় বিকোবে। যদি ভাব একটাও গাছ নেই কেন, সবই খালি বুকউঁচু ধুঁধুরলের ঝোপ, এহেহে কি বোকা গো তুমি, চাষের জমিতে গাছ হয় কখনো? 

তো ঐ আসমানজমিন জলাজঙ্গলের মধ্যেই আছে চসার মাঠ। দশবছর আগে জলাজঙ্গলের খানিকটা বুজিয়ে ইরিগেশেন বাবুরা ক্যাম্পো করেছিল, তাদের এস্টোর আর অপিস ছিল ওখানটায়, তার পাশে গাঁয়ের ছেলেপিলেদের আব্দারে ভলিবল মাঠ বানিয়ে দিয়েছিল তেনারা। কিন্তু কেউ কোনদিন ওখানে ভলিবল খেলেনি। তারপর বাবুরা ক্যাম্পো তুলে নিয়ে চলে গেল, খালি মাঠটা একা পড়ে রইল। বাবুরা একটা ঘাসকাটা মেশিন দিয়ে মাঠটা চসত বলে, সেইযে লোকে বলত চসার মাঠ চসার মাঠ তখন থেকেই নামটা আছে । 

নন্দদার চা দোকানের ঠিক উল্টোদিকে যেখানটায় লোকে গাড়ি থামিয়ে পেচ্ছাপ করে, ঠিক সেখান থেকে একটা শুঁড়িপথ ধরে মনসা আর ধুঁধুল ঝোপের খোঁচা খেতে খেতে এঁকে বেঁকে যদি মিনিট দশেক হাঁটতে পারো, তাহলেই চসার মাঠে পৌঁছাবে তুমি। চসার মাঠে আছে এ তল্লাটের একটিই বিরিক্ষ। সে এক পেল্লায় অসত্তো গাছ, বুঝলেনি? সে গাছের বয়সের গাছপাথর নেই। এত পুরোনো যে গাছের গায়ে লতা উঠেছে। ইরিগেশান বাবুদের একজন ঐ গাছ কাটতে গিয়ে ভেদবমি করে মরেছিল, তারপর কতকগুলো বউ গিয়ে তার গায়ে লাল সুতো বেঁধে দিয়ে এল, ব্যাস সে বিরিক্ষ ঠাকুর হয়ে গেল আর কি! যদি চসার মাঠে যাও তাহলে ঐ বিরিক্ষদেবতাকে পোনাম কোরো । তুমি মোছলমান হলেও ক্ষতি নেই, ও গাছে ওরাও মাথা টেকে। একবার কলকেতার কি একটা বেজ্ঞান কেলাব থেকে কটা বাবু আর প্যান্টপরা একটা মেয়েছেলে এয়েছেল, তারা বলে নাকি সেকোলার, ধম্ম টম্ম মানে না, তো তাদেরও কি পোনামের ধুম, ঐ লেডিজ কালো চশমা মাথায় তুলে হাঁটুগেড়ে নম করে গেল। তুমিও কোরো, ও জঙ্গলের মাঝে কে দেখতে যাচ্ছে?  তবে সাবধান। চসার মাঠে বিরিক্ষ দেবতার সেবাইত হল লেলিন মন্ডল। সে শালা বদ্ধ পাগল। ও বলে ও নাকি ঐ অসত্তো গাছের কেয়ারটেকার। ওর সঙ্গে লেগোনি, ও খাঁড়া কাঁধে বিরিক্ষ পাহারা দেয়। বাসন্তি হাইওয়ের ওদিকটায় দুএকটা পুরোনো গ্রাম এখনো আছে, সেখানকার লোক বলে ও নাকি নকশাল ছিল। একবার সিপিএমের লোক ওকে মেরে আধমরা করেছিল, তখন থেকেই নাকি পাগল। কিন্তু শালা গাছ ছেড়ে নড়লোনি, বুঝলে? জামাকাপড় ছিঁড়ে আধল্যাংটা, বুক অবদি দাড়ি হয়ে গেল, তবু লেলিন মন্ডল গাছের দারোয়ানি বন্ধ করল না। করেই যাচ্ছে। ওকে একটু সাবধান। ভয় পেয়োনি, একটুখান দুরে থাকবে, কিচ্ছু করবেনি। সবাই ওকেও ভক্তিশোরেদ্ধা করে। শালা সিপিএম চলে গিয়ে তিনোমুল এসে গেল, তবু লেলিন মন্ডলকে কেউ নড়াতে পারলোনি? অ্যাঁ? কম কথা? 

এখন হল কি, চসার মাঠে কেউ পলোট করতে পারে নি। জামির মোল্লাও পারেনি। চসার মাঠের কোনাকুনিতেই বিরিক্ষ দেবতার থান। লোকের বিশ্বেস, কি আর করা যায়? মোল্লাসাহেব সৌখিন লোক, চেক লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবী, ফেজটুপি পরে, চোখে সুর্মা লাগিয়ে একবার ঝোপজঙ্গল ঠেঙিয়ে লেলিন মন্ডলের সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন, ব্যাটা খাঁড়া কাঁধে চসার মাঠে কুচকাওয়াজ শুরু করে দেল, অমন করলে বৈষয়িক কথা বলা যায়? মোল্লা সাহেব, যা শালা তুই জাহান্নামে যা বলে রাগ করে চলে গেলেন, আর পলোটও হল না চসার মাঠে। যাগগে, এসব কথা ভুলেও নন্দদাকে বোলোনি। একেই রেগে থাকে সবসময়, গালমন্দ করে দেবে।দোকান দেওয়া ইস্তক লোকটা জমির দালালি শুরু করেছে। বিড়বিড় করে বলে, সব বেচে দেব। আমার ঘর গেছে, ফেলাট হবে। এই চা দোকানটা হোটেল হবে। কাউন্সিলার ওকে উন্নয়নের মন্ত্র দিয়েছে। রাত জেগে নন্দদা সিন্ডিকেটের ইঁট বালি খালাস করায়। লেলিন মন্ডলের উপর ও হাড়ে হাড়ে চটা। এই একটা বাজে লোকের জন্যে অ্যালাকার বদনাম হয়। নন্দদা তক্কে তক্কে আছে, কি করে লেলিন মন্ডলকে সাইজ করা যায়। তুমি বহিরাগত, তোমার এসবের মধ্য পড়ে লাভ কি?

দুই

তারচেয়ে শুন আপনাকে একটা গল্প বলি। একদিন পাঁউ পাঁউ করতে করতে দশটা কালো কাচঢাকা গাড়ি এসে নন্দদার চা দোকানের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে গেল। তখন বেলা দশটার দিকে, জায়গাটায় তেমন লোকজন নেই, রাস্তার কাজও কেন জানি বন্ধ। গাড়িগুলো থেকে টপাটপ কালো চশমা পরা গাঁট্টাগোঁট্টা সাফারি পরা কতকগুলো লোক নেমে চারদিকে চাং মাং করে দেখতে লাগল, একটা লোক এসে নন্দদার চা দোকানের বাঁশের বেঞ্চিতে বসা তিন চারটে খদ্দের কে এমনভাবে দেখতে লাগল যে লোকগুলো তো ভয়ে কাঠ। নন্দদা বেজায় রেগে থাকে সবসময়, তার খদ্দেরদের একটা মুশকো লোক এসে ভয় দেখাচ্ছে, সে বেজায় চটে গিয়ে বলতে লাগল, আপনে চা খাবেন কি? সাফারি পরা লোকটা নন্দদাকে দেখতে লাগল, কিছু বলল না। নন্দদা হাটুরে লোক, সে আর কি কম্যান্ডো চেনে, না গরমেন্ট বোঝে? নইলে ঘাড়টা একটু জিরাফের মত বাড়ালেই দেখতে পেত, পাশের চালা দোকানগুলোতে, টায়ার কারখানাতে সব জায়গাতেই অমন সাফারি পরা, কালো চশমাপরা লোক ঢুকে চারদিক দেখছে। একটা ফেলাগ লাগানো গাড়ি থেকে একজন সাদা পাঞ্জাবী পাজামা পরা লোক নেমে দরজা খুলে দাঁড়াতেই গাড়ি থেকে মুখ্যমন্ত্রী নামলেন। অমনি একজন সাফারি পরা মুশকো তেনার মাথায় ছাতা খুলে ধরল। আরেকটা গাড়ি থেকে নামল কালো কোট পরা একটা চিনাম্যান, আর তার পিছু পিছু বেদম ফর্সা হাফপ্যান্ট পরা এক মেমসাহেব। তেনাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলতে লাগলেন আর জলাজঙ্গলের দিকে হাত দেখিয়ে কি যেন বলতে লাগলেন। নন্দদা পেপারে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেখেছে, এদিক ওদিকেও অনেক পোস্টারেও তো তেনাকে হাতজোড় করা ছবিতে দেখা যায়, সে তো সশরীরে মুখ্যমন্ত্রীকে দেখে উত্তেজনায় কেঁদে ফেলে আর কি! তার খদ্দেরগুলো চা বিস্কুট ফেলে ফ্যালফ্যাল করে দেখতে লাগল। 

এমন সময় লোকাল কাউন্সিলার সাহেব এসে নন্দদাকে বলল, হ্যাঁরে নন্দ, চসার মাঠটা কি ঐ দিকে? নন্দদা খুব রেগে আছে বলে সাবধানে গলা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ। দিদি কি চসার মাঠে যাবেন নাকি স্যার? 

কাউন্সিলার সাহেবও নিচু গলায় বললেন, আমি কি অত জানি? তবে নগরায়ন দপ্তরের মিনিস্টার এসেছেন, তিনি বলছিলেন প্রশাসন চসার মাঠের ওদিকটায় এয়ারপোর্ট করবে। নন্দদা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আরো রেগে গিয়ে বলতে লাগল, তাহলে তো ফের আমাকে তুলে দেবে, নাকি? 

সেকথা শুনে কাউন্সিলার সাহেব হিস হিস করে বললেন, নন্দ, মুখ বন্ধ রাখ, বুঝলি? বেআইনীভাবে দোকান দিয়েছিস, আমি দেখেও দেখছি না। তাবলে জনস্বার্থের চেয়ে তোর চাদোকান বড় হল? 

এইসব কথা যখন হচ্ছে তখন একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটল। একটা গাড়ির ছাত ফুস করে ফাঁক হয়ে গেল আর একটা খেলনার মত পাখা লাগানো মেশিন বোঁ করে সেখান থেকে বেরিয়ে জলাজঙ্গলের উপর উড়ে উড়ে ঘুরতে লাগল। একটা লোক টিভির মত একটা মেশিন বার করে ধরল আর চিনাম্যান, মেমসাহেব, সাদা পাঞ্জাবী এমনকি মুখ্যমন্ত্রীও সেই টিভিটার উপর ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলেন। নন্দদার একজন খদ্দের উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলে ফেলল, ও শুকুর মিঞা, ওটা কি গো, খেলনা হেলিকপ্টারের মতন? 

শুকুর হল কার্পেন্টার মিস্ত্রী, সে আইটিআই পাশ করেছে, রোজ কলকেতায় কাজ করতে যায়। সে সব দেখে শুনে বলল, না। ওটা হল ডোরোন। কলকেতায় পুলিশ পূজোর সময় ডোরোন উড়িয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে নজরদারী করে। 

-এখেনে পূজো হবে নাকি? মোছলমানেদের পাড়া তারা মেনে নেবে? 

-চুপ কর। এসব সাম্পোদায়িক কথা বলা ভালো নয়। দেশে একটা সম্পিতির বাতাবরণ আছে। 

-না না। পূজো করলে পতিবাদ করতে হবে। 

-বেশ করবে। পূজো করলে তোর বাপের কি? 

কাউন্সিলার সাহেব ভীষণ মুখভঙ্গি করে নীচু গলায় বললেন, চোপ। একটা কথা বললে পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখাব। চা খেয়েছিস, বাড়ি চলে যা। 

কিছুক্ষণ পরে গাড়িগুলো যেমন এসেছিল, তেমনি চলে গেল। কাউন্সিলার সাহেবও তেনার ইস্কুটার চালিয়ে চলে গেলেন। গাড়িগুলো চলে যেতেই নন্দদার দোকান যে কে সেই। নন্দদা বিড়বিড় করে বলতে লাগল, এবার আমাকে পায় কে? সব বেচে দেব শালা। আমার চাদোকানের জায়গায় চাউমিনের হোটেল করব, ঠান্ডা মেশিন লাগানো। লোকে পেলেন থেকে নেমে আমার হোটেলে বসে খাবে। 

শুকুর বেমক্কা বলে বসল, নন্দদা, যদি লেলিন মন্ডল এসে তোমার হোটেলের সামনে খাঁড়া কাঁধে নেত্য করে? তখন? নন্দদা খুব রেগে গিয়ে বলল, শুকুর এমন কথা বললে আমার দোকানে খবরদার আসবিনি।

তিন

শুকুরকে নাহয় ধমক দিলে চুপ করে থাকে নয় শাঁকালুর মত দাঁত বার করে হাসে। আপনে কি ভাবছ সকলেই এমন চুপচাপ নন্দদার হম্বিতম্বি মেনে নেয়? সিন্ডিকেটের বালিকাত্তিককে একবার লেলিন মন্ডল খাঁড়া নিয়ে তাড়া করেছিল সে টানা আধঘন্টা ছুটে বাসন্তি হাইওয়েতে উঠে একটা ট্রেকার ধরে ক্যানিং চলে গেছিল। তারপর একসপ্তাহ বাদে সে যখন ফিরল তখন থেকে লেলিন মন্ডলকে খুব মানে। তার কাছে একবার লেলিন মন্ডলের কুখ্যাতি করায় সে নন্দদাকে বলেছিল, তুমি ওর খাঁড়াটে দেখেছ? ঐটি নিয়ে তোমার দোকানে এলে তোমার ইয়ে হয়ে যাবে। 

-তবেরে শালা, লেলিনের সাপোর্টার, তোর সিন্ডিকেট ব্যবসা আমি জানি নে? রাতে বালিতে জল মেরে লোক ঠকাও। খবরদার আমার দোকানে আসবিনি। বলতে বলতে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে নন্দদা রাজেন পোদ্দারের চায়ে তিন চামচ চিনি দিয়ে ফেলে সে কি হুলুস্থুলু। রাজেন পোদ্দারের সুগার, সে চায়ে কোনদিন চিনি খায় না, এক চুমুক দিয়ে থু থু করে ফেলে সে লাফাতে লাগল, আমার দুশো হয়ে গেল। একশ আশি ছিল, আমার দুশো হয়ে গেল। 

সেই সুযোগে বালিকাত্তিকও বলে গেল, কাউন্সিলার সাহেবকে বলে সে নন্দদার বারোটা বাজিয়ে দেবে। এরা সব হাটুরে লোক, মেলা ঝগড়াঝাটি করে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল, লেলিন মন্ডলকে কেউ চসার মাঠ ছাড়া করাতে পারে নি কোনদিন, গাছের দারোয়ানিও বন্ধ করাতে পারে নি। মুখ্যমন্ত্রী চলে যাবার পর লোকে নানারকম কানাকানি করতে লাগল। সকাল সন্ধে সবাই নন্দদার চা দোকানে জুটে গুলতানি করে, তারা পাঁচকথা বলতে লাগল। কেউ বলে এইবার চসার মাঠেও উন্নয়ন হবে, আবার কেউ বলে ওখানে এয়ারপোর্ট হলে আশে পাশে সব উঁচু বাড়ি তৈরী বন্ধ হয়ে যাবে। বালিকাত্তিক চিন্তায় পড়ে গেল। এদিকটায় কেউ ছোট বাড়ি টাড়ি করতে আসেই না। সব বড় বড় পোমোটার, সবাই সিটি বানাচ্ছে। যা সাপ্লাই ওখানেই। সেসব বন্ধ হয়ে গেলে তো কেলো। শেষে একদিন শুকুর এসে বলল, ওখানে ছোট প্লেনের এয়ারপোর্টই হবে। কাগজে বেরিয়েছে। বলছে সেই এয়ারপোর্টের নামও নাকি ঠিক। ইস্ট ক্যালকাটা এয়ারপোর্ট। সকলে সে কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আবার তুমুল তর্ক জুড়ে দিল। এসব তর্কাতর্কি নন্দদার ভালো লাগে না, সে এমনিতেই রেগে থাকে, এর উপরে এইসব তর্কে সে ভীষণ চটে গিয়ে জোরে জোরে চামচে দিয়ে চিনি গুলতে গিয়ে একটা গেলাস ভেঙ্গে ফেলল। 

এরপর শুরু হল সার্ভেয়ার বাবুদের আসা। তারা রোজ গাড়ি করে এসে কাঁধে যন্তর নিয়ে ধুঁধুল ঝোপ ভেঙ্গে জলাজঙ্গল, পতিত জমি, পলোট করে ফেলে রাখা জায়গা মাপতে লাগল। এ চত্তরে নন্দদা ছাড়া চা বিস্কুট কি নিদেনপক্ষে ডিমটোস্ট খাবার জায়গা নেই। পাশের চালাগুলোতে একটা মুদিদোকান, একটা সাইকেল রিপিয়ার আর একটা টায়ার রিসোলিং দোকান। সার্ভেয়ার বাবুদের মাঝে মাঝেই নন্দদার দোকানে আসতে হয় চা খেতে। একদিন এক গুঁফো সার্ভেয়ার বাবু চিনি ছাড়া চা খাচ্ছে দেখে রাজেন পোদ্দার তার পাশে গিয়ে বসে বন্ধুত্বপূর্ণ হেসে বলল, কত? 

-কি কত? 

-ফাস্টিং কত? 

– একশ চল্লিশ। 

-ও কোন সুগার না। আমার একশ আশি। 

সার্ভেয়ার বাবু গম্ভীর হয়ে রইল। এসব হাটুরে লোকের সঙ্গে ফিজুল কথা সে বলবেই বা কেন? কিন্তু রাজেন পোদ্দার তস্য ঘুঘু। সে এসব মাইন্ড না করে বলল, কিসের মাপ হচ্ছে স্যার? 

সার্ভেয়ার চুপ করে রইল। 

-বলতে বারণ থাকলে বলবেন না। কিন্তু ওখানে এয়ারপোর্ট হবে বলছে। 

-হতে পারে। 

-ছোট প্লেন? 

-ছোট বড় জানিনা। মাপার অর্ডার, মাপছি। 

-না না, সে তো হক কথা। তবে অনেকটা অ্যালাকা তো তাই বলছিলুম। 

-কি বলছিলেন? 

-না ইয়ে মানে ওখানে তো চাষের জমি আছে লোকের। তারা দেবে? 

সার্ভেয়ার উঠে চলে গেল। নন্দদা এতক্ষণ কথাবার্তা শুনছিল, সার্ভেয়ার বাবু চলে যেতেই সে আবার রেগে গেল। আমার খদ্দেরটাকে তাড়িয়ে দিলেন তো? বলে নন্দদা চোখ পাকাতে লাগল। নন্দদা সবসময়ে রেগে থাকে বলে কেউ আর তাতে কিছু মনে করে না। রাজেন পোদ্দার অমায়িক হেসে বলল, হাতে পায়ে কালো এস্পট, বলে কিনা একশ চল্লিশ সুগার। যত গুলবাজি। 

-আপনে আনকা লোকের সঙ্গে কথা বলেন কেন? ও কি মাপছে জেনে আপনের কি? 

-নন্দ তুমি চা বেচছ বেচ। এসব ব্যাপার তুমি বুঝবে না। 

একথা শুনে নন্দ রেগে আগুন হয়ে উনুনে কয়লা দিতে লাগল। বেঞ্চে বসা শুকুর বলল, খালি চাষের জমি না। ওখানে পলোট করা জমিও আছে। জামির মোল্লা অনেক পলোট কিনে রেখেছে। এসব পেতে গেলে তো কিনতে হবে, মা মাটির সরকার তো অধিগ্গেরন করবে না। 

রাজেন পোদ্দার মাথা নেড়ে বলল, দেখ গিয়ে কিনেই নিয়েছে বোধহয়। নইলে তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি। 

সার্ভেয়ার বাবুদের কেরদানি বেরিয়ে গেল চসার মাঠে গিয়ে। একদিন সকালে হুড়মুড় করে তারা ঝোপ ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠতে লাগল। কাঁধে মেশিন নিয়ে একটা লোক পড়ে মরে আরকি! তাদের গাড়ি হুশ করে বেরিয়ে গেল আর ঝোপজঙ্গল ভেঙ্গে লেলিন মন্ডল বেরিয়ে এসে রাস্তায় উঠে দুহাতের মুঠি আকাশে তুলে বাজের মত গলায় বলল, জয় মা বিরিক্ষবাসিনী! ফের ইদিকে এলে কুচি কুচি করে কাটব। লেলিন মন্ডলের গায়ে একটা খাকি রঙের শার্ট যার একটা দিক ছিঁড়ে ফালাফালা। পরনের প্যান্টটায় তাপ্পি মারা। বাতাসে তার বুক ছাপানো দাড়ি উড়ছে। কিন্তু তার হাতে কোন খাঁড়াফাড়া নেই। সে নন্দদার দোকানে বসে থাকা লোকগুলোর দিকে চেয়ে দাঁত বার করে হাসল। রাজেন পোদ্দার যাই কাজ আছে বলে চলে গেল আর রামসুখ কয়লাওয়ালা পরে পয়সা নেব বলে সাইকেল চালিয়ে কেটে পড়ল। নন্দদা এই ব্যাপার দেখে রেগে দোকান বন্ধ করে দেবে ভাবছে, লেলিন মন্ডল টুক করে ধুঁধুলজঙ্গলে ঢুকে গেল ফের।

চার

সার্ভেয়াররা চলে যাওয়ার পর কিছুদিন শান্তি। লেলিন মন্ডল ভ্যানিশ হয়ে গেল আর নন্দদার চা দোকানে গুলতানিতেও ভাঁটা পড়ল। বাইপাস চওড়া করার কাজ মোটামুটি শেষ, মাটিকাটা মেশিনগুলো বারুইপুরের দিকে চলে গেল, ওদিকে নাকি নতুন কাটাকাটি হবে। আপনে যদি কখুনো গাড়ি করে এই রাস্তা ধরে আমতলা কানেক্টারের দিকে গেছেন, তো নিশ্চয় দশহাত ছাড়াছাড়া দুতলা উঁচু পোস্টার দেখেছেন। পোস্টারগুলোয় সব সুন্দর সুন্দর লোক আর মেয়েছেলেদের ছবি দেওয়া, সেসব ছবিতে হয় মেয়েছেলেরা ল্যাঙট পরে সাঁতার কাটছে নইলে বুড়োবুড়িরা বাগানে বেড়াচ্ছে। লোকে দম ধরে অপেক্ষা করে আছে কতদিনে এই অ্যালাকাতে অমন বাড়ি হবে। শুকুর সবসময় খুঁত ধরে, সে বলে ঐ বাড়িগুলোতে যত লোক থাকবে সব বহিরাগত, তাদের সবাইকার গাড়ি আছে – এ অঞ্চলের হাফগেরস্থ লোক ওখানে থোড়াই থাকবে! এইকথায় নন্দদার খুব রাগ হয়, আরে কত লোকের কাজ হবে ভাব! নিজে তো অটো টেরেন ঠেঙিয়ে কলকেতায় কাজ করতে যাস। ঐ বাড়িগুলো হলে কাজের লোক লাগবে না? দারোয়ান, ঠিকে কাজের মেয়েছেলে, মিস্তিরি – এসব তো লাগবে নাকি? ঐ বাড়িগুলোয় তোরা থাকতে পারবি? তারচেয়ে সেই তালে ছিটেবেড়া, দরমার ঘরগুলো পাকা করে নেওয়া যাবে, কালার টিভি হবে ঘরে ঘরে, দোকানগুলোর বিক্রিবাটা বাড়বে। ও শালা শুকুর এসব বোঝে কিনা সন্দেহ! 

নন্দদার দোকানের প্রায় উল্টোদিকে ঐরকম দোতলা উঁচু একটা পোস্টারের টাকচার তৈরী হতে লাগল। কিছু ওয়েল্ডার মিস্ত্রী বাঁশের ভারা বেঁধে দিনকয়েকের মধ্যেই লোহার অ্যাঙ্গেল জুড়ে জুড়ে এক পেল্লায় পোস্টার বানিয়ে ফেলল। মিউনিপ্যালিটির বাবুরা এসে তদারক করে গেল সেই বিশাল পোস্টার। কিন্তু তাতে কোন বাড়ির ছবি নেই, সুন্দর সুন্দর লোকের ছবি নেই, খালি আছে রাশি রাশি লেখা। সাইকেল রিক্সাওয়ালা, ভানরিকশ লোড করে নিয়ে যাওয়া সব্জিওয়ালা, আর মুটেমজুরের দল কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই লেখা পড়ার চেষ্টা করতে লাগল। নন্দদা যেহেতু জমি কেনাবেচার দালালি শুরু করেছে, সে বোঝে যে ঐ পোস্টারে আসলে জমির দাগ খতিয়ান নম্বর লেখা আছে। ঐ পোস্টারটা একটা নোটিশ। দুটো পঞ্চায়েত আর একটা মিউনিপ্যালিটি মিলে সাড়ে চারশ একর জমি নগরোন্নয়ন দপ্তরকে হস্তান্তর করেছে সেইকথা ঐ নোটিশে বলা আছে। দাগ খতিয়ান মিলিয়ে যাদের বাস্তু বা শালিজমি ঐ সাড়ে চারশ একরের মধ্যে পড়েছে, তাদের দলিল আর ট্যাক্সোর কাগজ নিয়ে বিএলআর অপিসে যেতে বলছে। নন্দদা জানে দুচারটে ছাড়া কারুর কাছে কোন কাগজই নেই। যা দলিলপত্তর আছে সব জামির মোল্লার। ঐ সাড়ে চারশ একরের মধ্যে কি চসার মাঠ আছে? কে জানে? ফের লোকজন গুনগুন করতে শুরু করল। 

রাজেন পোদ্দারের পাকাবাড়ি বাইপাসের উল্টোদিকে, ঐ সাড়ে চারশ একরে সে নেই। কিন্তু এলআইসির এজেন্ট বলে সে বড় বড় কথা বলায় ওস্তাদ। চিনিছাড়া লাল চা খেতে খেতে সে বলল, তিনশ একর তো জামির মোল্লাই কিনে রেখেছে। বাকি যা আছে কারুর কোন কাগজপত্তর আছে নাকি যে বিএলআর অপিসে যাবে? ওসব হিসেব হয়ে আছে।

 রামসুখ অনেকদিন হল বিহার থেকে বাংলায় চলে এসেছে, সে বাংলা পরিস্কার বোঝে, তবে ভাল বলতে পারে না। অনেক আগে সে মোষের খাটাল চালাত টালিগঞ্জে। জ্যোতিবাবু সেসব তুলে দিতে এদিকে এসে কিছুদিন দুধের ব্যবসা করেছিল তারপর কয়লার ব্যবসা ধরেছে। এখন সে সোনালী ফ্রেমের চশমা আর প্যান্ট শার্ট পরে, তার ছেলেরা নাকি বিটেক পাশ, পাটনায় চাকরি করে। রামসুখ বাঁশের বেঞ্চিতে বসে খড়কে দিয়ে কান খোঁচাচ্ছিল, সে মুরুব্বীর মত বলল, ভালো হোবে। পিলেন আসবে। 

রাজেন পোদ্দার মুখ বাঁকিয়ে তাকে বলল, পিলেন আসলে তোর কি ভালো হবে রে রামসুখ? পিলেন কি কয়লায় চলে? 

-আমি কোয়লার বেবসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি। মুবাইল দুকান দিব। পিলেন থেকে নেমে লোক রিচাজ কোরে লেবে। 

-একে বলে খোট্টার বুদ্ধি। ওরে পিলেনের লোক আইফোন নিয়ে ঘোরে, তোর দোকানে থোড়ি না আসবে। 

আজকে শুকুর নেই, ফলে রাজেন পোদ্দার চালিয়ে খেলছে। দোকানের এককোনে বসে বালিকাত্তিক নোটবইয়ে বালির মাপ চেক করছিল; সে বলল, রাজেনদা, এয়ারপোর্ট মানে তো গরমেন্ট পোজেক্ট তাই না? 

রাজেন পোদ্দার বিজ্ঞের মত হেসে বলল, গরমেন্ট আর কিছু করে না। এতো সিঙ্গাপুরের কোন কোম্পানি নিজের খরচায় বানাচ্ছে। কাগজে পড়িস নি? বালিকাত্তিকের মুখ হাঁ হয়ে গেল। সে বলল, সে কি? আমাদের দেশে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট বানাবে কেন? 

রাজেন পোদ্দার তখন তাকে ফরেন ইনভেসমেন না কি বোঝাতে লাগল। বলল সে তো আম খাবে, আমগাছ গুনে তার কি লাভ? নন্দদা এসব কথার মানে তেমন বুঝতে পারছিল না বলে রেগে যাচ্ছিল। এই লোকগুলো তার দোকানে বসে একটা করে চা নিয়ে আড্ডা মারে, ক পয়সা হয় তার? একটু কাজের কথা বললে তো সে এনামুলের পুরোনো বাড়িটা বিক্রি করিয়ে দেবার কথাটা পাড়তে পারে। তাছাড়া গোবিন্দপুরে দুকাঠা ছ ছটাক জমিও বিক্রি আছে। সে সবে কারুর মন নেই। খুব চটে গিয়ে সে বলল, এইবার লেলিন মন্ডল হুড়কো খাবে। শালাকে কানের গোড়ায় মেরে উচ্ছেদ করে দেবে নিশ্চই। উত্তরে রাজেন পোদ্দার কি একটা বলতে যাচ্ছিল শুকুর কোত্থেকে তার বাইকে করে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, নন্দদা একটা চা দাও দিকি। একটা সাংঘাতিক খবর আছে! কি খবর? শুকুর বাইক থেকে নেমে দোকানে ঢুকে বলল, আরে পার্টির ছেলেরা নাকি পলোট মালিক আর চাষীদের গিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। বলছে এই বেলা জমি বেচে না দিলে গরমেন্ট নিয়ে নেবে। বালিকাত্তিক বলল, ভ্যাট। মা মাটি মানুষের সরকার, জমি নেই দরকার। সব বাজে কথা। 

শুকুর চায়ের গেলাস তুলে নিয়ে বলল, বাজে কথা? তাহলে পাঁচপোতায় জমিরক্ষা কমিটিও কি বাজে কথা? সকলে হাঁ হয়ে গেল। তলে তলে এতদুর? চসার মাঠেও কি আন্দোলন হবে নাকি?

পাঁচ

দাবানলের আগুনের মত চারদিকে চাউর হয়ে গেল যে জলাজঙ্গলের যেসব জমি পলোট করা আছে, যেগুলো এখনো পলোট করা নেই, একসময় চাষ হত কিন্তু এখন পতিত তাদের মধ্যে দুএকটা ছাড়া সব খাসজমি। শুধু যেগুলো জামির মোল্লা অলরেডি কিনে নিয়েছে সেগুলো নাকি মালিকানাভুক্ত। খাসজমি মানে গরমেন্টেরই সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত। লোকে এ নিয়ে ক্রমশ গজল্লা করতে লাগল। এই গজল্লা সভাগুলোতে যারা মধ্যমনি তাদের অনেককেই অ্যালাকার লোক ঠিকমত চেনে না। তারমধ্যে কাঁচাপাকা দাড়িওলা একটা লোক আর একজন তাঁতের শাড়িপরা লেডিজ প্রায় সব গজল্লাতেই ঘুরে ফিরে থাকে, তারা যে একদম বহিরাগত তা সকলেই পরিস্কার বুঝতে পারে। একদিন নন্দদা দোকানের বাজার করতে জুলপিয়া গেছিল, সেখানে সে দেখল ম্যারাপ বেঁধে মিটিং হচ্ছে। মঞ্চের পিছনে সোনালী রঙের কাপড়ে লেখা আছে পাঁচপোতা জমিরক্ষা কমিটি, গোটা কয়েক লোক মাইক নিয়ে ভাষণ দিচ্ছে। সেই মঞ্চেও কাঁচাপাকা দাড়ি আর তাঁতের শাড়ি বসে আছে দেখা গেল। জুলপিয়ার একটা দোকান থেকে নন্দদা চা আর বিস্কুটপাতি কেনে, অনেকদিনের চেনা দোকান, মালিকও চেনাশোনা। নন্দদা এর কাছ থেকে হেড়ে হাবড়ে টাকা ধার নেয়। অধীর হাজরা খুব ভালো লোক, পয়সার জন্য বেশি তাগাদা দেন না। নন্দকে দেখে অধীর হাজরা মুচকি হেসে বললেন, নন্দ ভেতরে এসে বস। বাইরে যা চিল্লাচ্ছে কোন কথাই শুনতে পাব না। 

লোকগুলো কোথাকার? নন্দদা বলল। সকালের রোদে আর মাইকের আওয়াজে তার খুব রাগ হতে লেগেছে। 

-ঐ এয়ারপোর্টের জমি নিয়ে আন্দোলন করছে। আশেপাশেরই লোক। 

-ঐ যে চশমাপরা পাকা দাড়িওলা লোকটা, ও কি স্থানীয় লোক? 

অধীর হাজরা একটু ঝুঁকে দেখে নিয়ে বললেন, ও বাবা, ও তো মস্ত লোক। আলোক চাটুজ্যে। তুমি ওকে চেন না? 

-না। সিপিএমের লিডার? 

-আরে না না। ও মনেহয় নকশাল। পুলিশ ধরে আর জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায়। গোটা বাংলায় যেখানে যত জমিসংক্রান্ত কাচরা, সবেতে ও থাকে। ঐ যে গো ইলেকট্রিকের টাওয়ার নিয়ে ঝামেলা হল না, ওখানেও ছিল। জঙ্গলমহলের লোক। 

নন্দদা এত খবর রাখে না। সে ভাসা ভাসা জানে পশ্চিমবঙ্গে জমি নিয়ে খুব ঝামেলা। এখানে বড় শিল্প নাকি করা খুব কঠিন। লোকে জমি দেয় না। কিন্তু ঐ লোকটা ঝামেলা পাকাতে জঙ্গলমহল থেকে এতদুর চলে এসেছে? আর ঐ লেডিজ? দামী শাড়ি পরে আছে? নন্দদা জিজ্ঞেস করল। 

-ওর নাম শর্মিলা চ্যাটার্জি। আলোকের বউ। 

নন্দদা এমন অবাক হল যে কয়েক মুহুর্তের জন্য তার রাগ পড়ে গেল। কি জিনিষ মাইরি! শালা কত্তা গিন্নী গরমেন্টের পোঁদে লাগবে বলে সেই পুরুলিয়া থেকে এতদুর চলে এসেছে। নমস্য। 

এমন সময় দুটো কিশোর মত ছেলে অধীর হাজরার দোকানের সামনে এসে নন্দদাকে বলল, কাকা একটু সাইন করে দিন। একটা খাতা থেকে ছেঁড়া পাতার বান্ডিল, তাতে ত্যাড়াব্যাঁকা হাতের লেখায় কিছু সই। একশো সতের নম্বর সইএর জায়গাটা খালি। একটা ছেলে ডটপেন বাড়িয়ে দিল নন্দদার দিকে। নন্দদা বান্ডিলটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন ওখানে তার ফাঁসির অর্ডার লেখা আছে। শুকনো গলায় সে বলল, কিসের সই? 

-গণসাক্ষর কাকা। বলল ছেলেটা। 

-কিসের গণসাক্ষর? 

যেই না এইকথা বলা, ছেলেটা দুলে দুলে দম দেওয়া পুতুলের মত বলতে শুরু করল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন সিঙ্গাপুরের চাংগি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করে বর্তমান সরকার পাঁচপোতার বৃহত্তর অঞ্চল তাদের হাতে তুলে দিতে চলেছে। এতে লক্ষ লক্ষ লোক জমিহারা হবে, তারা তাদের রুটি রোজগারের শেষ সম্বলটুকুও হারাবে। লুম্পেন সরকারের এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা যে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলছি, এই গণসাক্ষরের মাধ্যমে – 

নন্দদা পট করে বলে বসল, তোমরা কি সিপিএম? 

পার্ট ভুলে গিয়ে সামনের ছেলেটা বু বু করতে লাগল। পিছনের ছোঁড়া গম্ভীর গলায় বলল, এর মধ্যে সিপিএম কংগ্রেস আসছে কেন? এটা মানুষের প্রতিবাদ। 

মানুষের প্রতিবাদ যে কি করে পার্টির ঝান্ডা না ধরে হবে, সেটা অনেক চেষ্টা করেও নন্দদা বুঝতে পারল না। সরকার মানে তো একটা পার্টি। তার কাজের বিরোধিতা সাধারণ মানুষ কি করে করবে? বিরোধিতা প্রতিবাদ করবে সেই পার্টি যারা পাওয়ারে নেই। এরা কারা রে বাবা? অধীর হাজরা বান্ডিলটা টেনে নিয়ে সই করে দিয়ে বললেন, হয়েছে? যাও এবার, কারবার করতে দাও। ছেলেদুটো নন্দদাকে মাপতে মাপতে চলে গেল। 

-তুমি এত বেকার কথা বাড়াও কেন নন্দ? অধীর হাজরা বললেন। 

নন্দদা ততক্ষণে ফের রেগে গেছে; সে রাগ চাপতে চাপতে বলল, এয়ারপোর্ট হলে তো অ্যালাকার উন্নয়ন হবে। এ শালারা তো সবেতে কাঠি করে! অধীর হাজরা দার্শনিকের মত বললেন, আমাদের হাতে কিছু নেই নন্দ। তিনি যদি না চান, হবে না। নইলে সই নিয়ে কচু হবে। বুঝলে না? নন্দদা রাগ চাপতে না পেরে বলতে লাগল, আমারও ঘর গেছে রাস্তার জন্যে। তাবলে সেটা কি জনস্বার্থের চেয়ে বেশি হল? এরা তো ঘোঁট পাকিয়ে উন্নয়ন এস্তব্ধ করে দিতে চায়। এর পোতিবাদ করবোনি? 

অধীর হাজরা হাসতে লাগলেন। তিনি বললেন, তুমি কি ভাবছ ঐ সই দিয়ে কিছু হবে? তুমি এত বোকা? শোন নন্দ, গরমেন্ট যা চায় তাই হয়। ঐ যে জমিরক্ষা কমিটি দেখছ, ওর প্রেসিডেন্ট গত পঞ্চায়েতে তৃণমূলের টিকিট পায় নি। তাই লাফাচ্ছে। কিছু বেশি পয়সা পেলেই ডিগবাজি খাবে। কটা তেঁএটে নকশাল আছে, তাদের হয় ঠেঙাবে নয় পুলিশ তুলে নেবে। তুমি কি কিছু খবর রাখ না, নাকি? 

নন্দদা বিচ্ছিরি নিমপাতা চেবানো মুখ করে বলল, তাইলে এটা ডেরামা? 

-তাছাড়া আর কি? এটাও করতে না দিলে তো কলকেতার বুদ্ধিজীবিরা বলবে গণতন্ত্র ধ্বংস করা হচ্ছে। ছাড়ো। বল চা কতটা লাগবে? আর তোমার দুহাজার বাকি আছে। আজ হাজার খানেক অন্তত দিও। সাইকেলে মাল লোড করে নন্দদা ঘর ফিরতে ফিরতে ভাবতে লাগল, জমি গেলে রুটি রুজি যাবে? শালা তোরা জমি চাষ করিস? সবাই পলোট করিয়ে বসে আছিস কে বেশি দাম দেবে তাকে ঝেড়ে দিবি। ঐ চাঙ্গা না চাঙ্গি ওদের চেয়ে বেশি দাম জীবনে পাবি শালারা? পোতিবাদ মারাচ্ছে! সাইকেল চালাতে চালাতে নন্দদা বিড়বিড় করতে লাগল, তোদের জমি? কাগজ দেখাতে পারবি? আমার ট্যাক্সো দেওয়া ঘরপুকুর নে নেল, আর হাতে পঞ্চাশ হাজার ধরিয়ে দিল, তখন কে পোতিবাদ করেছিল রে ঢ্যামনার দল? পড়ন্ত বিকেলের ঠান্ডা বাতাস লেগে নন্দদার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল আর সে আরও বেশি বেশি রেগে যেতে লাগল।

ছয়

নন্দদার চা দোকানের উল্টোদিকে দুটো জনসভা হয়ে গেল একমাসের মধ্যে। লোকাল কাউন্সিলার সিরাজুল আলম বাবু, সে সাদা পাঞ্জাবী পাজামা পরে বুকে ব্যাজ লাগিয়ে প্রথমটার তদারক করল। সিরাজুলের সঙ্গে যে বাইকবাহিনী ঘোরে তারা বেশিরভাগই সিন্ডিকেটের ইঁটবালি সাপ্লায়ার – বালিকাত্তিকও বাইকে ঝান্ডা বেঁধে মিছিল টিছিল করল। কিন্তু চসার মাঠের সামনের বাইপাস রাস্তায় আর তেমন ঘর গেরস্তি কই, ফলে প্রথম সভাতে তেমন লোক হল না। পাতা চেয়ারগুলোয় আশে পাশের বিল্ডিংগুলোর রাজমিস্ত্রী আর ঢালাইমিস্ত্রীরাই এসে বসে পড়ল। বাবু ছোট হাতি চাপিয়ে আশে পাশের গাঁ থেকে কিছু লোকজন আনল বটে কিন্তু তারা সাতটা বাজতে না বাজতেই কেটে পড়ল। এই সভাতে কলকেতার থেকে যেসব নেতা এসেছিলেন, তেনারা জোর গলায় বললেন, অ্যালাকার কারুর থেকে কোন জমি জোর করে নেওয়া হবে না। তবে যারা বিনা প্রমানেই বছরের পর বছর এখানে জমি দখল করে আছে কিন্তু চাষবাষ না করে বেআইনীভাবে জমি বিক্রি করে দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একজন প্রবীণ নেতা বুঝিয়ে বললেন, এখানে এয়ারপোর্ট হলে অ্যালাকার চেহারাই পাল্টে যাবে, বহু মানুষের কাজ হবে। কিছু লোক চিৎকার করে উন্নয়নের পক্ষে স্লোগান দিল। কিন্তু রাত আটটার পর, উপস্থিত জনসাধারণের অনুরোধে প্রথমে কিছু গানবাজনা ও পরে ডিজে চালিয়ে নাচ হল। এর রিপোর্ট হয়ে গেল নবান্নে, ফোনে ফোনে নাচ গানের ছবি ঘুরতে লাগল। দ্বিতীয় জনসভায় সিরাজুল বাবুকে সাইড করে দেওয়া হল। এতে যুবনেতা, পঞ্চায়েত মন্ত্রী ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী এসে সভা করলেন। টেরাকে করে দুরদুরান্ত থেকে বহু লোক আনা হল আর সকাল থেকে দু কিলোমিটার রাস্তার ধারে এত রবীন্দ্রসঙ্গীত হল যে নন্দদা পর্যন্ত রাগ টাগ ভুলে গুনগুন করে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গাইতে লাগল। এই মিছিলে অ্যালাকায় বহিরাগত এসে যে অশান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টায় আছে তা বিষদে বলে তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত না হবার জন্য জোরালো অনুরোধ করা হল। টিভির লোক এসে ছবি তুলল বেশ কিছুক্ষণ। তারা নন্দদার চা দোকানে চা বিস্কুট খেয়েছিল বলে, শুকুর তাদের জপিয়ে নন্দদার দোকানের ছবিও তোলাল। একজন টিভিকোম্পানীর লোক, রাজেন পোদ্দারকে ধরে কিছু বাইট নিল। রাজেন পোদ্দার এমনিতে যতই প্যাচাল পাড়ুক না কেন, টিভি ক্যামেরার সামনে বলল অ্যালাকার সকল নাগরিকবৃন্দরা নাকি এয়ারপোর্টের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সে আরও কিছু বলত হয়ত, কিন্তু পিছন থেকে ক্যামেরার দিকে হাসি হাসি মুখ করে এত লোক এসে ঠেলাঠেলি করতে লাগল যে ক্যামেরাম্যান ছবি তোলা বন্ধ করে দিল। এই দুটো জনসভার মাঝে পাঁচপোতা জমিরক্ষা কমিটি একদিন মিছিল বার করল। তাদের মিছিলেও খুব লোক যে হল তা নয়, তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল ডিশ লাগানো ভ্যান এসে এই মিছিল সরাসরি টিভিতে দেখাল। মিছিল যখন নন্দদার চা দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছে শুকুর বলল, টিভির লোকগুলো কি সেয়ানা দেখেছ? 

রামসুখ দোকানের ভিতরে বসে পেটাই পরটা খাচ্ছিল। সে বলল, কে সেয়ানা আছেন? 

নন্দদা একমনে মিছিল দেখছিল। মিছিলে লোক বেশি নয় কিন্তু সকলেই আশেপাশের গ্রাম থেকে এসেছে। এরা কি সিরাজুলের জনসভাতেও ছিল? সে রাগতস্বরে শুকুরকে বলল, বেশি চালাকি করবিনি শুকুর বুঝলি? তুই ছুতোর মিস্ত্রী টিভির কি বুঝিস, অ্যাঁ? 

রাজেন পোদ্দার শুকুরকে বলল, সেয়ানা বলছিস কেন? 

-ভালো করে দেখ, দুর থেকে তুলছে না। কাছ থেকে দেখাচ্ছে খালি। 

-বটে? কিন্তু কেন? 

-কি জানি। মনে হচ্ছে শালারা দেখাতে চাইছে না যে মিছিলে শখানেকের বেশি লোক নেই। এরা অ্যান্টি গরমেন্ট বোধহয়। 

মিছিল চলে যাবার পর সকলে আবার তর্ক জুড়তে যাবে,খান দশেক বাইক, তার সবকটাতে দুটো করে চ্যাংড়া মত ছেলে বসে আছে গাঁ গাঁ করে বারুইপুরের দিক থেকে মিছিল যে দিকে গেছে সেদিকে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ বাদেই দুম দাম করে বোমার শব্দ হতে লাগল। শুকুর রাস্তায় উঠে দেখবার চেষ্টা করতে লাগল কি হয়েছে আর রাজেন পোদ্দার নন্দদাকে এসে বলল, কত হয়েছে রে নন্দ? বাড়ি যেতে হবে। 

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বালিকাত্তিকের বাইক নন্দদার চা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। বালিকাত্তিক গলা নামিয়ে বলল, নন্দদা ঝাঁপ ফেলে দাও। ঝামেলা হচ্ছে। রাজেন পোদ্দার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গোবিন্দপুর মোড়ের আগে না পরে? 

মোড়ের উপরে। কেউ বেরিও না। বলে বালিকাত্তিক বাইক ঘুরিয়ে অকুস্থলের দিকে চলে গেল। ঝপ করে নন্দদার চা দোকানের ঝাঁপ পড়ে গেল। রামসুখ তার আগেই তার সাইকেল দোকানের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। দোকানের ভিতর রাজেন পোদ্দার, শুকুর, রামসুখ আর দুজন ফেলাইং কাস্টোমার ঘামতে লাগল। ছিটে বেড়ার ঝাঁপ, তার ফাঁক দিয়ে শুকুর উঁকি মেরে দেখতে লাগল বাইরে কি হচ্ছে। নন্দদা দোকানের পিছন দিকে তার ফ্যামিলিকে দেখতে গেল। রাস্তা দিয়ে কিছু লোক দৌড়ে গেল। এরা জমিরক্ষা কমিটির লোক বলে মনে হচ্ছে। এরপর গেল গোটা দুয়েক বাইক। রাজেন পোদ্দার শুকুরের ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি মারছিল। সে শুকনো গলায় বলল, বাইকের পেছনে বসা ছেলেটার হাতে ওটা কি রে শুকুর? 

-মাংসকাটা কাতান। শুকুর বলল। 

রাজেন পোদ্দার বেঞ্চে বসে পড়ে বলল, পুলিস কে ফোন কর কেউ। এতো দাঙ্গা লেগেছে। রামসুখ মোবাইল ফোন বার করে বলতে লাগল, বাবুয়া দোকান বনধো করিয়ে দে। কোই বাহার মত যানা। নন্দদার ঘরের ভিতর থেকে গ্যাঁ করে বাচ্চা কাঁদতে লাগল। সকলে চুপ করে বসে রইল। বাইরে কি হচ্ছে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। ছিটেবেড়ার দোকানঘরের মাথায় টিনের চাল। ঘরের ভিতর গরম নামতে লাগল। রাজেন পোদ্দার প্রথমে জল খেল, তারপর মিনিট দশেক বাদে বলল, শুকুর নন্দর ঘরে কি টয়লেট আছে? বাথরুম পেয়েছে। আধঘন্টা বাদে নন্দর ছিটেবেড়ার ঝাঁপের বাইরে খচরমচর করে শব্দ হতে লাগল। শুকুর ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে যাচ্ছে বাইরে কে, একদিকের ঝাঁপ তুলে লেলিন মন্ডল দাড়িওলা মুন্ডু ভেতরে ঢুকিয়ে চোখ পিটপিট করে দেখতে লাগল এদিক ওদিক। তারপর সে বাজখাঁই গলায় বলল, জয় বিরিক্ষদেবতা। রক্ষে কর বাবা!

সাত

দশপনের মিনিট বাদে দোকানের ঝাঁপ তুলে সকলে দেখল লেলিন মন্ডল প্রমাণ সাইজের খাঁড়া কিরিকেট ব্যাটের মত দোলাতে দোলাতে বাইপাসের রাস্তা পেরিয়ে ধুঁধুল জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। এতক্ষণ সে নন্দদার চা দোকান পাহারা দিচ্ছিল। সবাই বুঝল যে লেলিন মন্ডলের দশহাতের মধ্যেও কারুর আসার সাহস হয়নি। 

এই ঘটনায় নন্দদা এতই বিচলিত হল যে সে কদিন রাগতেও ভুলে গেল। ঘটনার পরদিন গাড়ি করে পুলিশ এসে বাইপাসের ধারে চুপচাপ সারাদিন বসে রইল। ননন্দার চা দোকান ছাড়া এ রাস্তায় কারুর গতি নেই। মেজবাবু কনস্টেবল পাঠিয়ে খান কুড়ি চা আনিয়ে খেলেন। ফাঁক পেয়ে নন্দদা কনস্টেবলকে ধরল। 

-স্যার? 

-হ্যাঁ বলুন। চা কত করে? 

-তিনটাকা করে স্যার। এখন থাক না, পরে দেবেন? 

-ঠিক আছে। সন্ধে পর্যন্ত আছি। 

-স্যার? 

-আবার কি? 

-কাউকে অ্যারেস্ট করবেন না? 

কনস্টেবলবাবু চুপ করে রইল। তারপর কি ভেবে বলল, সেটা প্রসাশন ঠিক করবে। আমাদের ওয়াচ ডিউটি। 

রাজেন পোদ্দার স্কুটারে করে নন্দদার দোকানের দিকে আসছিল, নন্দদা পুলিসের সঙ্গে কথা বলছে দেখে স্কুটার না থামিয়ে সোজা বারুইপুরের দিকে চলে গেল। কনস্টেবল গাড়িতে ফিরে যাবার কিছুক্ষণ পর মেজবাবু গোছের একজন নন্দদার দোকানে এসে চারদিক দেখতে লাগল। বেলার দিকে এমনিই নন্দদার চা দোকানে খদ্দের বেশি থাকে না, আজ একজন খদ্দের এসে পেটাই পরটা চাইছিল, সে জিনিষ ছিল না বলে নন্দদা তাকে ডিমভাজা, ডাল আর আলুচোখা দিয়ে এগমিল করে দিয়েছে। মেজবাবু সেদিকে তাকিয়ে বলল, চারজন লোকের ভাত হবে? 

বৌকে বুঝিয়ে নন্দদা কদিন হল চার পাঁচজনের মত এক্সট্রা ভাত আর সবজি বানাচ্ছে। মন্দ বিক্রি হচ্ছে না। সে মেজবাবুকে খাতির করে বসিয়ে বলল, ভাত ডাল ডিমভাজা আর আলুচোখা ছাড়া কিছু হবে না স্যার। দেব? 

মেজবাবু বাঁশের বেঞ্চিতে বসে সিগারেট ধরিয়ে বলল, তাই দাও। কত করে? 

-তিরিশ টাকা স্যার। আপনারা পঁচিশ দেবেন। চারটে তো? 

-দাও। আচ্ছা একটা কথা বল দেখি? 

-বলুন স্যার? 

-এখানে একটা পাগল অস্ত্র নিয়ে ঘোরে? 

নন্দদা গলায় থুতু আটকে বিষম খেল। সে সামলে নিয়ে বলল, অস্তর? মানে বন্দুক? 

-না। একটা কাটারি বা খাঁড়া? 

লেলিন মন্ডলের কথা বলছে নির্ঘাৎ। লেলিনকেই অ্যারেস্ট করবে রে! নন্দদার মনে পড়ে গেল, বোমাবাজির দিনে লেলিন তার দোকান পাহারা দিয়েছিল। সে ঢোঁক গিলে বলল, না তো স্যার। মেজবাবু হাত তুলে গাড়ি থেকে কাউকে ডাকল। একটা খুব টাইট জামা আর প্যান্ট পরা ছোকরা মত পুলিস এসে মেজবাবুকে বলল, বলুন স্যার। মেজবাবু সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, দত্ত, ঐ টায়ার রিসোলিংএর লোকটা কি একটা খাঁড়াওলা পাগলের কথা বলছিল না? 

-হ্যাঁ স্যার। লেলিন মন্ডল। 

-ইয়েস। লেলিন মন্ডল। তুমি লেলিন মন্ডলকে চেন? 

নন্দদা পড়ল ফাঁপরে। পুলিস ঠিক খোঁজ খবর করে বার করে নেবে। শালা লেলিন তো বিখ্যাত লোক। সে একটা মাঝামাঝি গোছের উত্তর দিল, ও লেলিন? ও তো বদ্ধ পাগল স্যার! 

-অস্ত্র নিয়ে ঘোরে? 

-আমি দেখিনি স্যার। 

-গতকাল তোমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল? 

-না তো স্যার! 

-যখন ঝামেলা হচ্ছিল? বোমা পড়ছিল? 

-তখন আমি দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলাম স্যার। 

এইসব কথা যখন হচ্ছে তখন বালিকাত্তিক বাইকে করে এসে হাজির। দত্তবাবু তার দিকে চেয়ে ফ্রেন্ডলি হাসল। সিন্ডিকেটওয়ালারা লোকাল থানাকে রসেবশে রাখে। মেজবাবুও তাকে চেনে মনে হল। নন্দদা ভাবতে লাগল, কালকের অ্যাকশানে কি বালিকাত্তিক ছিল? সে কি পুলিসকে ম্যানেজ করে রেখেছে? মেজবাবু বলল, কাত্তিক, লেলিন মন্ডলটা কে রে? 

বালিকাত্তিক খুব তুচ্ছুতাচ্ছিল্য করে ঠোট উলটে বলল, পাগলা ভিখিরি স্যার। বেকার মাল। মেজবাবু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, এখানকার লোকজন একেবারে থার্ডক্লাশ। সব শালা বাড়িয়ে কমিয়ে বলে। দত্ত, সার্ভেয়ারদের একটা পাগল তাড়া করেছে বলে রিপোর্ট হয়েছিল না? দত্তবাবু ঘাড় নেড়ে বলল, ডায়েরী নিইনি। নামটাম কিছু বলতে পারছিল না, আর চলে যাবার জন্যে তাড়া করছিল। তবে সার্ভেয়াররা খানিকটা জায়গা নাকি মাপতে পারেনি, পাগলটা খাঁড়া নিয়ে তেড়ে এসেছিল বলে। 

নন্দদা আর বালিকাত্তিক চুপ করে রইল। মেজবাবু দত্তবাবুকে বলল, একে চারটে ভাত বলে দিলাম। এখানে আর কিছু পাওয়া যাবে না। শালা কি ভাটের ডিউটি, সারাদিন গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বসে থাকো। 

বালিকাত্তিক ‘আসছি স্যার’ বলে চলে গেল। পুলিশরা পালা করে খেল। প্রথমে দুজন কনস্টেবল, তারপর মেজবাবু-দত্তবাবু। খেতে খেতে মেজবাবু নন্দদাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি? 

-আজ্ঞে নন্দদুলাল হাজরা। 

-নন্দদুলাল তুমি এই অঞ্চলে কতদিন আছ? 

-জন্ম থেকে আছি। কেন স্যার? 

-চসার মাঠ কোথায়? 

এইবার নন্দদা নিশ্চিত হল যে পুলিশ জমি নিয়ে যে বাওয়াল হচ্ছে তাতে জড়িত। নিশ্চই উপর থেকে কোন অর্ডার এসেছে। সে নিরীহ মুখ করে বলল, ঐ ধুঁধুল জঙ্গলের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা স্যার। যে কোন সিভিক পুলিশ বলে দেবে। 

মেজবাবু আর দত্তবাবু মুখ চাওয়াচাউই করল। তারপর মেজবাবু বলল, ওখানে কি কোন মন্দির আছে? দরগা আছে? 

বিরিক্ষদেবতা আছে। কিন্তু নন্দদা সেটা চেপে গিয়ে বলল, না তো স্যার। 

দত্তবাবু মেজবাবুকে বলল, দশ তারিখে ডিএম অফিস থেকে এডিএম আসবে, তার আগে জায়গাটা একবার দেখে নিলে হয় না? মেজবাবু আলুচোখা দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বলল, কে দেখবে? তুমি আর আমি? ছমাস ধরে ফোর্স চাইছি ছটা সিভিক পুলিশ দিয়েছে। ঐ দিনই দেখব। 

দত্তবাব ব্যাজার মুখে ঘাড় নেড়ে বলল, আর একটা মোটে ভেহিকেল। কুড়ি স্কোয়ার কিলোমিটার এরিয়া। 

মেজবাবু বলল, এডিএম সাহেবকে ম্যাপ ধরে ধরে দেখাতে হবে, কোন কোন জায়গা থেকে রেসিস্টেন্স আসছে। বোঝ! তুমি চার মাস আর আমি দুমাস। ওসি সাহেব ক্লোজ হয়ে আছেন। এ বালের চাকরি ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচি। নন্দদুলাল? 

-আজ্ঞে স্যার? 

-আরেকটু আলুচোখা হবে?

আট

যেমন হয় আর কি, এসব আন্দোলন ফান্দোলন বেশিদিন টেঁকে না। যে ডেভেলাপার এয়ারপোর্ট করবে, তারা পয়সার থলে লোড করে এনেছে। শোনা গেল জামির মোল্লার সঙ্গে অলরেডি চুক্তি হয়ে গেছে। মোল্লাসাহেবের আঙুল ফুলে কলাগাছ। তিনি কলকেতায় ডেভেলাপারের আপিসের কাছেই ঠান্ডা মেশিন লাগানো আপিস দিলেন। বেশ কিছু জমিমালিক, যাদের সঙ্গে জামির মোল্লার সদ্ভাব নেই, কিন্তু জমি পলোট করিয়ে রেখেছিল তারা সরাসরি ডেভেলাপারের কলকেতার আপিসে গিয়ে জমি হস্তান্তরের চুক্তি করে এল। পাঁচপোতা জমিরক্ষা কমিটি ডিগবাজি খেয়ে লোককে বোঝাতে লাগল, গরমেন্ট যখন জমি কেড়ে নিচ্ছে না, জমির যখন ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে এবং লোকে যখন স্বেচ্ছায় তা বিক্রি করতে চায়, তাতে মানুষের আপত্তির কি থাকতে পারে? মানে যা হয়, সবই মানুষের নামে কিনা – তা সে আন্দোলন করে ঘাড় মুচড়ে পতিত জমির দাম দুগুনো তুলে নেওয়ার জন্যেই হোক কিংবা উন্নয়নের বাজারে পঞ্চাশ বছরের খাজনা না দেওয়া দখলী জমি পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট বলে বিক্রি করে দেওয়াই হোক। সবই মানুষের জন্যে। জলাজঙ্গলের হাওয়ায় পয়সা উড়তে লাগল। লোকে বলতে লাগল ওসব ফেলাট বাড়ির বিল্ডাররা নাকি এত পয়সা জীবনে দিত না। জামির মোল্লার জমিগুলোর সবটা একলপ্তে নয়, এখানে ওখানে কাঠাছটাক ফাঁকফোঁকর আছে, তিনি বিএলআর অপিসের বৃদ্ধ মুহুরীকে ধরে সেসব জমির হিস্টিরি খুঁজে বার করতে লাগলেন। বেশিরভাগেরই কোন মালিক খুঁজে পাওয়া যায় না। মুহুরী বলল এইখান দিয়ে দুআড়াইশো বছর আগে আদিগঙ্গা বইত, তার মজে যাওয়া পাড়ে লোকজন ইচ্ছেমত বসে গেছে – যারা হুঁশিয়ার লোক ছিল তারা দেশ স্বাধীন হবার পর পাট্টা করিয়ে নিয়েছিল – কাগজপত্র তাদেরই কিছু কিছু আছে, বাকিরা স্রেফ ভোগদখল করছে। মোল্লাসাহেব ধরে ধরে ফাঁকগুলো বোজাতে লাগলেন। জমি বিক্রির এই প্রবল হাওয়ার মাঝে ত্যাড়া হয়ে বসে রইল চসার মাঠ, মাঠের কোনে বিরিক্ষদেবতা আর তার সেবাইত লেলিন মন্ডল। মুহুরী চসার মাঠের কথায় কথায় এক অদ্ভুত গল্প ছাড়ল, যা শুনে শুকুর একদিন উত্তেজিত হয়ে নন্দদার দোকানে এসে হাজির। 

এখানকার মন্ডলরা নাকি লতায় পাতায় সব জ্ঞাতি গুষ্টি। তুমি কি একথা জান নন্দদা? দোকানে বসেই সে বোমা ফাটাল। 

নন্দদার আজকে এক ডেগচি দুধের তলা লেগে গেছে, খদ্দেররা চায়ে দুধপোড়া গন্ধ পেয়ে সমানে কমপেলেন করছে, সে এমনিতেই রেগে আছে, শুকুরের মুরুব্বী মার্কা কথা শুনে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, তাতে তোর কিরে শুকুর? তুই কি গয়ার পান্ডা যে লোকের বংশলতিকের খোঁজ রাখবি? 

রাজেন পোদ্দার সকাল থেকে নন্দদার দোকানে এসে বসে থাকে। পোদ্দার গিন্নী তাকে বাজারে পাঠায়, বাজার যাবার পথে একটি ঘন্টা সে নন্দদার দোকানে গাবাবেই। খবরের কাগজ মুড়ে রেখে সে বলল, কার থেকে শুনলি? 

-তারক মন্ডল। বিএলআর অপিসের মুহুরী। বলছে সে নিজেও নাকি ওই গুষ্টির লোক। শুকুর বলল। 

-হতেই পারে। আমি ছোটবেলা থেকেই শুনেছি এখানকার মন্ডলরা নাকি পুরোনা জমিদার ফ্যামিলির লোক। 

-বিশু মন্ডল? যে নাকি মোছলমান ফকির হয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছিল? 

-ঘর ছেড়েছিল কিনা জানিনা। তবে মুসলিম মেয়ে শাদি করে আখড়া স্থাপন করেছিল। দেখ গে যা তুই তাদের বংশধর কিনা? 

রামসুখ খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, যিনি রাম আছেন তিনিই খোদা আছেন। নন্দদা রাগে গসগস করতে করতে বলল, মুহুরী বলেছেন, মাতা কিনেছেন। ওসব আমরাও জানি। মোগল আমলের আগে থেকে এ তল্লাটের মালিক ছিল বিশু মন্ডল। সবাই জানে। সে পোতেপ রায়ের কাছ থেকে জমির খেলাত পেয়েছিল। সবাই জানে। 

রাজেন পোদ্দার খানিকটা ভেবে বলল, পোতেপ রায় মানে কি প্রতাপাদিত্য রায়? 

রামসুখ বলল, তিনি কে আছেন? 

-প্রতাপাদিত্য সুন্দরবনের রাজা ছিল। 

শুকুর ঘাড় নেড়ে বলল, হতে পারে। এ অ্যালাকা তো আসলে সুন্দরবনই ছিল। 

রাজেন পোদ্দার দার্শনিকের মত বলল, এসব ইতিহাস সব সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে রে শুকুর। আর দশবছর পর এখানে সারা ভারতবর্ষ এসে ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকবে।  সবাই চুপ করে ভাবতে লাগল সেটা ভাল হবে না মন্দ হবে। জটিল ব্যাপার বটে!

হঠাৎ শুকুর বলল, রাজেনদা, লেলিন মন্ডল কি বিশু মন্ডলের বংশধর? 

রামসুখ বিজ্ঞের মত বলল, উনি বংশধরই হোবেন। রিয়াসত থেকে ওহি খাঁড়া পেয়েছেন! নন্দদা আনমনা হয়ে গেল। শালা পাগলা লেলিন নাকি জমিদার বংশ। ভগবানের কি লীলা। একসময় হয়ত লোক ওর বাপ পিতেমোর পায়ে পড়ত। আর এখন দেখ কি অবস্থা। 

ইদানীং নন্দদা লেলিন মন্ডলকে আর সাইজ করার কথা ভাবে না। একটা পাগল ভিখিরি, গাছ ধরে পড়ে আছে, থাক না! সবই কি শালা শহর বানাতে হবে? চসার মাঠই থাক না। ক্ষতি কি? সে জেনেছে তার বৌ লুকিয়ে বিরিক্ষদেবতার গায়ে লালসুতো বাঁধে। মুরুখ্যু মেয়েমানুষ, যদি সুতো বাঁধে বাঁধুক না। উন্নয়নকে কি সব খেতে হবে? নন্দদা ছটফট করে মনে মনে। জমিজিরেতের দালালের মনে এসব ভাবনা আসা উচিত নয়,সে জানে। কিন্তু আসে। 

এডিএম সাহেব এলেন না, তাঁর বদলে এসডিও সাহেব এলেন। একটা সাদা বোলেরো গাড়ি থেকে নেমে চোখে সানগেলাস সেঁটে তিনি লোকজন নিয়ে ধুঁধুল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সোজা চসার মাঠে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে ফোর্স। কিছু হাটুরে গাঁয়ের মানুষ একটু দুরে দাঁড়িয়ে রগড় দেখতে লাগল। দোকানে বউকে বসিয়ে নন্দদাও দুর থেকে দেখতে লাগল কি হয়। এসডিও সাহেবের দল যখন চসার মাঠে গিয়ে পৌঁছল তখন বেলা বারোটা বাজতে চলেছে। জষ্ঠি মাসের গরমে চারদিক তেতে তাওয়া হয়ে আছে। পুরো তল্লাটে কোন গাছ নেই, যতদুর চোখ যায় বুক সমান উঁচু ঝোপঝাড়। আকাশের দিকে তাকালে চোখ পুড়ে যাবার অবস্থা। এসডিও সাহেব প্রায় ছেলেমানুষ, তিনি জিন্সের প্যান্ট আর সাদা জামা পরে আছেন, তাঁর জামা ঘামে গায়ে লেপ্টে আছে। তাঁর সঙ্গে কাগজ বগলে দু তিন জন আমলা, সকলেই আধবুড়ো, একজন আমলা এমন ঘেমেছে যে মনে হচ্ছে এখুনি হাটঅ্যাটাক হয়ে পড়ে মরে যাবে। আরেকজনের চশমা নাকের ডগায় নেমে এসেছে, সে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বিড় বিড় করছে। ফোর্স যে সঙ্গে এসেছে তারা বন্দুক বয়ে বয়ে ক্লান্ত। চসার মাঠে পৌঁছেই তাদের চোখে পড়ল বিশাল অশত্তো গাছ, সকলেই হুড়মুড় করে তার ছাওয়ায় গিয়ে ঢুকল। মজা দেখা পার্টি একটু দুরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নখ খেতে লাগল। 

ছায়াতে একটু দম নিয়ে ফোর্সের এক খাকি পোষাকপরা পুলিশ বলল, এই ভিড় হাটাও ভিড় হাটাও। গরমেন্টের কাজ হচ্ছে। সে কথা শুনে মজা দেখা পার্টি দু পা পিছিয়ে   গিয়ে মন দিয়ে ঝোপঝাড় পরীক্ষা করতে লাগল। ত্রিসীমানায় লেলিন মন্ডলকে দেখা যাচ্ছে না। নন্দদা ভাবতে লাগল, শালা লেলিন মন্ডল গেল কই? এসডিও সাহেব ঘেমো চশমাকে বললেন, এটাই সেই জমি? 

-হ্যাঁ স্যার। 

-বিএলআর থেকে কে এসেছেন, দাগ খতিয়ান কনফার্ম করুন। 

একজন রোগা লম্বা বকের মত দেখতে লোক একটা হাতে একটা নকশা নিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে মাঠের একটা কোনে ঘুরতে লাগল। তখন এসডিও সাহেব বললেন, ও কি হচ্ছে? নস্যির ডিবে পড়ে গেল নাকি? 

লোকটা খ্যানখেনে গলায় বলল, না স্যার, এখানে ইরিগেশান একটা মার্কা বসিয়েছিল। সেটা খুঁজছি। 

-কিসের মার্কা? 

-স্যান্ডস্টোনের স্যার। তাতে দাগ নাম্বার দেওয়া আছে। এই বলে লোকটা ঘাড় বাঁকিয়ে নকশা দেখতে লাগল। 

এসডিও সাহেব এদিক ওদিক দেখে বললেন, কই এখানে মন্দির মসজিদ কিছু নেই তো? সব ভুলভাল রিপোর্ট। সার্ভের কে এসেছেন, জায়গা মাপুন। 

দুটো লোক টেপ হাতে মাঠের মাঝখানে গিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। কোথা থেকে মাপবে? বক বলতে লাগল, গাছের পশ্চিম দিকে কুড়ি ফুট দুরেই পাথরটার থাকার কথা স্যার। ওটা একটা কর্নার। কর্নার না পেলে মাপ করা মুশ্কিল।

মজা দেখা পার্টির লোক ঝোপ ঝাড় তুলে তুলে দেখতে লাগল। এসডিও সাহেব রাগত স্বরে বললেন, এই জন্যেই প্রফেশনাল সার্ভেয়ার এমপ্লয় করেছিলাম। এখন পাথর না পেলে আর কাজ হবে না? 

-ওটা পাথর নয়। ও হল আদিগুরু। উনি কি মাটিতে পড়ে থাকার বস্তু? অন্তরীক্ষ থেকে বাজখাঁই স্বর ভেসে এল। 

সবাই চমকে উঠে দেখে, অশত্তো গাছের নিচু ডালে বসে লেলিন মন্ডল পা দোলাচ্ছে। ডালের নিচে লতাপাতার ফাঁকে একটা সিঁদুর মাখা বিগ্রহ। লোকে বোধহয় ধুপটুপ জ্বালে, সামনেটা কাল হয়ে আছে। 

বক ছুটে গিয়ে পাথরটা ভাল করে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, এই তো লেখা আছে ডি একশ কুড়ি। স্যার ল্যান্ডরেকর্ডের পাথরকে ঠাকুর বানিয়েছে স্যার! 

এসডিও সাহেব হাঁ করে লেলিন মন্ডলকে দেখতে লাগলেন। লেলিন একটা ঢোলা প্যান্টুলুন পরে আছে, তার খালি গা। ঝাঁকড়া চুলে আর বুক অবদি দাড়িতে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ কাপালিক। সে গাছের ডালের উপর থেকে জলদগম্ভীর স্বরে বলছে, জয় বাবা আদিগুরু, জয় মা বিরিক্ষবাসিনী, জয় বিরিক্ষদেব! উচাল চাল দে বাবা ভক্তের পক্ষে, শত্তুর নাশ করো গরীবের রক্ষে! এই বলে সে এক লাফে গাছ থেকে নেমে এসডিও সাহেবকে প্রণাম করতে লাগল। ফোর্সের দুজন লোক ঝোপে হিসি করতে গেছে, একজনই পড়েছিল, সে রাইফেলের বেল্ট ধরে টানাটানি করতে লাগল, কোথাও আটকে গেছে। এসডিও সাহেব বললেন, এ কে? মজা দেখা পার্টি গুনগুন করে বলতে লাগল, সেবাইত সেবাইত। লেলিন মন্ডল!

নয়

এসডিও সাহেব কিছুক্ষণ লেলিন মন্ডলকে মাপলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি খাঁড়া নিয়ে লোকজনকে থ্রেটেন মানে ভয় দেখিয়ে বেড়াও? লেলিন মন্ডল তারচেয়েও গম্ভীর গলায় উত্তর দিল, ওটি যে সে খাঁড়া নয় বাবা। ওর নাম বজ্রকোষ। বিশ্বম্ভর মন্ডল ফকির হয়ে যাবার আগে ঐ খাঁড়া মা বিরিক্ষবাসিনীর কাছে গচ্ছিত করে গেছে। 

ততক্ষণে যে ফোর্সগুলো হিসি করতে গেছিল তারা ফিরে এসেছে। নাকেচশমা আমলা তাদেরকে বলল, সরকারী কাজে বাধা দিচ্ছে। একে চালান করুন। ফোর্স তিনজন বন্দুক ঘাড়ে লেলিন মন্ডলকে বলল, হ্যান্ডস আপ!! এসডিও সাহেব খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান মশাই। একি সিনেমার শুটিং হচ্ছে নাকি? তারপর তিনি লেলিন মন্ডলকে নরম গলায় বললেন, বিশ্বম্ভর মন্ডল মানে বিশু মন্ডল ওরফে বিশুপীর? 

-এঁজ্ঞে হ্যাঁ। 

-সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশক! স্ট্রেঞ্জ! তুমি কি করে জানলে? 

লেলিন মন্ডল দুহাত মাথার উপরে তুলে প্রণামের ভঙ্গি করে বলল, জয় বাবা বিশুপীর, জয় বিরিক্ষদেবতা। এঁজ্ঞে তিনি যে আমার পিতেমোর তস্য পিতেমোর বাপ গো! 

যে আমলার ঘেমেনেয়ে হাটঅ্যাটাকের অবস্থা হয়েছিল, সে এসডিও সাহেবকে এসে ফিসফিস করে বলতে লাগল, রাউডি এলিমেন্ট স্যার। এর নামে রিপোর্ট আছে। লোকাল পিএস-ও একে খুঁজছে। কথা না বাড়ানোই ভাল। 

এসডিও আমলার দিকে তাকালেন পর্যন্ত না। তিনি লেলিন মন্ডলকে বললেন, ঐ বজ্রকোষ না কি, ওটি কি তুমি পরিবার সুত্রে পেয়েছ? 

-এঁজ্ঞে হ্যাঁ। 

-এ জমি তোমার? 

-না। এ জমি বাবা বিরিক্ষদেবতার আর মা বিরিক্ষবাসিনীর। 

-মানে এই অশ্বত্থ গাছের? 

-এ সাধারম গাছ নয় গো বাপ। এ হল বিরিক্ষদেবতা। এঁর মধ্যে ডিহি মদনমল্লের আত্মা আছে। বিশুপীর মরে এতে মিশেছে, মাআসিফা মরে এতে মিশেছে। আমি এদের কেয়ারটেকার।

এইসব কথাবার্তা যখন হচ্ছে তখন ধুঁধুল ঝোপ ভেঙ্গে হাঁফাতে হাঁফাতে থানার মেজবাবু, চোঙা প্যান্টপরা এসআই দত্ত,আর একজন কনস্টেবল এসে হাজির হল। নন্দদার খেয়াল হল মজা দেখা পার্টিতে আরও অনেক লোক এসে জুটেছে। দুচারজন ঘরের বৌঝিও হাজির। নন্দদা ভাবতে লাগল তার বৌও না দোকান বন্ধ করে এসে হাজির হয়। বৌএর বদলে জঙ্গল ভেঙ্গে শুকুর আর বালিকাত্তিক এল। শুকুর বলল, গ্রাম ভেঙ্গে লোক আসছে নন্দদা। জামির মোল্লাও আসছে শুনলাম। মেজবাবু এসডিও সাহেবকে বলল, স্যার ডিএম সাহেব অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট সই করে দিয়েছেন। আমরা একে তুলে নেব। 

এসডিও সাহেব লেলিন মন্ডলের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, তোমার কোন কাগজপত্র আছে? লেলিন মন্ডল বাজখাঁই গলায় বলল, দেবতার আবার কাগজ কিসের? পীরের কি কাগজ লাগে? 

এসডিও সাহেব বললেন, খাতায় কলমে না দেখাতে পারলে এই জমি সরকারের লেলিন। এ জায়গা পরিস্কার করে এয়ারপোর্ট হবে। তোমাকে অন্যজায়গায় মন্দির করে দেওয়া হবে। লেলিন মন্ডল চোখ পাকিয়ে বলল, মন্দির? মন্দির দিয়ে কি হবে? বাবা বিরিক্ষদেবের কি ব্যবস্থা হবে? 

-গাছ কেটে ফেলা হবে। নিচুগলায় বললেন এসডিও।

লেলিন মন্ডল আকাশপানে চেয়ে পশুর মত হুঙ্কার দিয়ে বলল, রক্ষে কর বাবা, রক্ষে কর। এই বলে সে পোঁ করে দৌড়ে গাছে চড়ে, লতা পাতার ফাঁক থেকে প্রমান সাইজের খাঁড়া বের করে আনল। এসডিও সাহেব দু পা পিছিয়ে গেলেন, আমলারা সটান উল্টোদিকে ঘুরে দৌড় দিল আর ফোর্স লেলিনের দিকে বন্দুক তাক করতে লাগল। লেলিন মন্ডল চিৎকার করে বলল, তোমরা ভাবছ গাছ। তোমরা তো কত গাছই কেটেছ। এই গঙ্গাজোয়ারের বন তোমরা কেটে সাফ করেছ। সেই সব কাটা গাছ, এই মাটিতে মরা সব লোক, শুকিয়ে যাওয়া আদিগঙ্গা, সব ধারণ করে আছেন দেবতা। দেখবে, দেখ তবে! এইবলে সে খাঁড়া দিয়ে গাছের গায়ে এক কোপ মারল, গাছের ছাল উঠে গিয়ে সেখান থেকে গাঢ় লাল রঙের রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। চারদিক নিঃশব্দ হয়ে গেল একেবারে। তারপর কারা যেন বলে উঠল, সুবহানাল্লাহ! তারপর আরও কিছু লোক জয়ধ্বনি দিয়ে বলল, জয় বাবা বিরিক্ষদেবতার জয়, জয় মা বিরিক্ষবাসিনীর জয়! মেজবাবু চেঁচিয়ে বলল, ধর শালাকে। ফোর্সের লোক লেলিন মন্ডলের পা ধরে টেনে নামিয়ে চেপে ধরে কিল চড় মারতে লাগল। নন্দদা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ছুটে গিয়ে পুলিশের থেকে লেলিন মন্ডলকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। আর সেই সময়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। বৌ ঝি, জোয়ান মদ্দ, বুড়ো ছোঁড়ার দল গিয়ে সেই লতাপাতা মোড়া অশত্তো গাছ জড়িয়ে ধরল। আশে পাশে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল গাঁয়ের লোক, তারা বলতে লাগল, এই গাছ দেওয়া হবে নি। সেবাইতকে ছেড়ে দাও। জামির মন্ডল এসে এসডিওকে হাতজোড় করে বললেন, আমরা তো আমাদের জমি দিয়েছি স্যার! এই চসার মাঠ আর ঐ গাছটা ছেড়ে দেন। অনেক মেহেরবানি হবে। 

এসডিও সাহেব ভাবলেশহীন মুখ করে তাকে বললেন,বেশ তাহলে ডিএম  সাহেবের কাছে পিটিশন দিন। দেখি কি করা যায়। তারপর তিনি সঙ্গের লোকজনকে বললেন, চলুন সবাই। এই জমিতে ডিসপিউট আছে। 

একসঙ্গে দুশো লোক জয়ধ্বনি দিতে লাগল। সে চেঁচামিচিতে কান পাতা দায়।

########## 

এয়ারপোর্ট হল না। কি কারণে জানি সিঙ্গাপুরের কোম্পানি পিছিয়ে গেল। তবে একটা অবাক ব্যাপার হল। প্রায় হাজারবিশেক লোকের সই করা একটা পিটিশন গেল ডিএম আপিসে, রাজেন পোদ্দার তার মশকো করে দিল। সেই পিটিশনে সিন্ডিকেটের লোকও সই দিল আবার জমিরক্ষা কমিটির পান্ডারাও সই দিল। নন্দদার বউ অশত্তো গাছে লালসুতো বেঁধে এককেজি বাতাসা রেখে এল গাছের গোড়ায়। একদিন শুনশান দুপুরে নন্দদা দোকান বন্ধ করতে যাচ্ছে, ঝোড়োকাকের মত শুকুর এসে বলল, নন্দদা একটু চা খাওয়াও না! নন্দদার সকাল থেকে তেমন বিক্রিবাটা হয়নি বলে মাথা গরম হয়ে আছে, সে খ্যাচম্যাচ করে বলল, দোকান বন্ধ করছি দেখছিস না? কে এলেন খাঞ্জা খাঁ! চা করতে হবে। শুকুর মনমরা মুখ করে বলল, একটা খাওয়াও না। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে গো! 

-কেন? কি হল? 

-তুমি শোনোনি? লেলিন মন্ডল নিপাত্তা। খাঁড়া পড়ে আছে, লোকে তাতে সিঁদুর ফিঁদুর মাখিয়ে পূজো করতে লেগেছে। 

নন্দদা চুপ করে চা করতে লাগল। দুরে বাইপাসের উল্টোদিকে ধুঁধুল ঝোপের উপরে নীল আকাশ যেন জ্বলছে, কোথাও একটুকরো মেঘ নেই। আর বহুদুরে ঘুরে ঘুরে উড়ছে কটা চিল। নন্দদা জানে লেলিন কোথাও নিপাত্তা হয় নি। সে নিশ্চয়ই তার বাপপিতেমোর মতঐ অশত্তো গাছে মিশে গেছে। চসার মাঠ সাক্ষী।

[শেষ]

<<<<< বড়গল্প সংকলনে ফিরুন

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!