দশটাকা

আমার জিয়ানি ভার্সিসের মানিপার্সে খুচরো টাকা থাকে না। পয়সাও না। পার্স মোটা হয়ে গেলে আমার বসতে অসুবিধে হ্য়। এমনিতেই দুটো ডেবিট কার্ড, দুটো ক্রেডিড কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, স্মার্ট কার্ড এসব তো থাকেই এর উপরে আধার, প্যান আর অফিসের আইডি এসব মিলে পার্স বেশ পুরুষ্টু। সুতরাং বড় নোটের ক্যাশ ছাড়া সেখানে আর কিছু রাখি না আমি। কিন্তু আমার পার্সে একটা দশটাকার নোট থাকে সব সময়।

পুরোনো একটা দশটাকার নোট। একে আমি না পারি খরচ করতে, না পারি ফেলতে। মাঝে মধ্যে নোটটা বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি, তারপর আবার পার্সের মধ্যে রেখে দিই। এই দশটাকার নোটটা আমার পার্সের মধ্যেও থাকে আবার মাথার মধ্যেও থাকে। একটা কাঁটার মত নোটটা আমার মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে।

এ নোটটা নিয়ে আমি কি যে করব ভেবে পাই না।

বছর দু তিনেক আগে একদিন ডালহৌসির দিক থেকে আলিপুর আসছিলুম। তখন সবে সন্ধে হয়েছে। রেসকোর্সের ওদিকটায় আকাশে যেন আগুন লেগেছে। গাড়ির স্টিরিওতে গান শুনতে শুনতে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের মুখটায় ট্রাফিক লাইটে দাঁড়াতে হল। এই লাইটটা অনেকক্ষনের। এই ফাঁকে এখানটায় বেলফুল আর ঝাড়নওলা, একটু খারাপ হয়ে যাওয়া চেরির প্যাকেট বিক্রেতা কিংবা মা শীতলার ছবি দেখিয়ে ভিক্ষে করা বাচ্চারা গাড়ির জানলার কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর, কিন্তু মুখ বুজে বসে থাকা ছাড়া কিছু করারও নেই।

ছেলেটা জানলায় এসে টোকা মেরেছিল। ভ্যাবলা মত মুখ, ধুলোটে চুল আর ছেঁড়া জামায় একেবারে টিপিক্যাল বাচ্চা ভিখিরি। চোয়াল শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে বসেছিলুম। মন বিরক্তিতে ভরে যাচ্ছিল। ভিক্ষাবৃত্তি আমাদের সমাজের একটা অভিশাপ। আর বাচ্চাদের ভিক্ষে করতে দেখলে আমার অন্ধ একটা রাগ হয়। বসে বসে ভাবছিলুম কতক্ষনে ছেলেটা বিদেয় হবে।

কিন্তু বাচ্চাটা জানলায় টোকা দিয়েই যাচ্ছে। ড্যাশবোর্ডের ট্রেতে পার্কিং দেওয়ার জন্য সবসময় কিছু খুচরো থাকে। গত্যন্তর না দেখে একটা দশটাকার নোট গাড়ির কাচ নামিয়ে ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিতে গেছি, অমনি ছেলেটা রিনরিনে গলায় বলল, আংকল আপনার গাড়ির পেট্রল ট্যাপের দরজাটা খোলা!

হাঁকরে ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আলো সবুজ হয়ে গেল। আমার হাতে দশটাকার নোটটা তখন বেশ ভারী ঠেকছে।

সেই থেকে ঐ দশটাকার নোটটা আমার পার্সেই পড়ে আছে। ওটা নিয়ে কি যে করি ভেবে পাই না।

<<<<<< অণুগল্প সিরিজে ফিরে যান

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!