গনাপাগলার মৃত্যুরহস্য

বিডিও

রানীগঞ্জের রানী কে ছিলেন জানা নেই। কিন্তু আমি সত্তরের দশকে যখন এই কয়লা শহরের বিডিও ছিলাম তখন এখানকার রাজা ছিল কয়লা মাফিয়ারা। তখনও আসানসোল দুর্গাপুর ডেভেলপমেন্ট অথরিটির জন্ম হয় নি, রানীগঞ্জ বীরভূম জেলার আসানসোল মহকুমার দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে একটি গঞ্জ শহর ছিল। এই শহরের বিশেষত্ব ছিল কয়লা। এখানে দেশের প্রথম কয়লা খাদানের পত্তন হয়েছিল যেটির মালিক ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। রানীগঞ্জে পোস্টিং হতে একটি অপ্রত্যাশিত রকমের বড় ব্রিটিশ আমলের বাংলো পেয়েছিলাম। পঁচাশি  সালে সরকারী মাইনে বলার মত ছিল না। তখন সদ্য বিবাহ হয়েছে, স্ত্রীর কাছে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তাকে এনে এই বাংলোয় তুলেছিলা

গনার মৃত্যুর পর রানীগঞ্জ থানা বীরভূম জেলাকোর্টে নামকাওয়াস্তে একটা মামলা রুজু করেছিল। মামলা বেশিদুর এগোয়নি, কারণ গনার মৃত্যুর একমাত্র সাক্ষী মালতীর বয়ান অসংলগ্ন ছিল। সে এলাকার এক ওয়াগন ব্রেকারের নামে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ এনে নিজেকে গনার মৃত্যুর জন্য দায়ী দাবী করছিল। না পাওয়া যাচ্ছিল অভিযুক্তর হদিশ, না অন্য কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ। বছর খানেকের মাথায় জজসাহেবে বিরক্ত হয়ে কেস ডিসমিস করে দেন। রানীগঞ্জ থানায় গনার ফাইলটা বন্ধ করে উপরে লিখে দেওয়া হয়, অ্যালেজড হোমিসাইড নট প্রুভেন। চার্জশিট রিজেক্টেড। উইটনেস মেন্টালি আনসাউন্ড। কেস ক্লোজড। এই কয়লা শহরে বছরে দুচারটে খুনজখম জলভাত, পুলিশও কয়লা মাফিয়াদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলত। এক কথায় এর মানে হল, গনার মৃত্যুটা রহস্যাবৃতই থেকে গেছিল। আর তাতে কারুর কিছু যায় আসে নি। হয়ত আমার কাছেও তাই থেকে যেত, যদি মালতী আমার বাংলোর কাজের লোক না হত। আর রানীগঞ্জের এসিপি অর্জুন তেওয়ারী আমার বন্ধু না হত।

আমার স্ত্রী সুলগ্না বেজায় শহুরে মেয়ে। রানীগঞ্জের বাংলোয় উঠে প্রথমটায় সে মহাউৎসাহে জালালায় পর্দা ইত্যাদি লাগাল বটে কিন্তু এত বড় বাংলো পরিস্কার রাখা তার একার কর্ম নয়। চৌকিদার গৌরাঙ্গের থেকে জানা গেল বিডিও কুঠিতে রানীগঞ্জের কেউ কাজ করে না। ব্রিটিশ আমল থেকে এই বাংলোয় যাবতীয় গেরস্থালী কাজের লোক মদন বাউড়ি। মদন এখন বৃদ্ধ হয়েছে সুতরাং তার মেয়ে মালতীই এখন এখানে কাজ পাবার হকদার। মালতী আগের বিডিওর কাছেও কাজ করেছে। আমরা যদি চাই তো মালতীকে ডেকে দেওয়া যেতে পারে।

এক রবিবারে মালতীকে ডাকা হল। কথাবার্তা সুলগ্নাই বলল বটে, কিন্তু আমরা স্বামী স্ত্রীতে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মালতী এই সংসারের ঘরদোর ঝাড়পোঁছ থেকে শুরু করে বাজারহাট এমনকি কাচাকাচিও করতে রাজি। বিনিময়ে সে একটু বেশি মাইনে চাইছে। বেশি মানে তার কাজের অনুপাতে হয়ত ন্যায্য কিন্তু আমার মাইনের তুলনায় একটু কষ্টকর। সুলগ্না কাজ কমিয়ে রফা করার চেষ্টা করল, মালতী অনড়। ঐ মাইনেই তার চাই নতুবা আপনা হাথ জগন্নাথ।

এটি নেহাতই সাংসারিক ঝামেলা। যেটা আমাদের ভাবাল সেটা হল মালতীর ভাবগতিক। মেয়েটি দেখতে ছোটখাটো, কিন্তু তার শরীর থেকে একটা বন্য যৌনতার অদৃশ্য বিকিরণ আসছে। বছর পঁচিশেক বয়সের এই মেয়েটির গায়ের রং ফর্সা আর চোখজোড়া কটা। ছোট কাঁচুলী আর দেহাতী শাড়ি তার দুর্বার যৌবনকে বিজ্ঞাপিত করছে যার সঙ্গে মিশে আছে একপ্রকার বেপরোয়া ভাব। সুলগ্না একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ হল। কলকাতায় হলে একে ধুলোপায়ে বিদেয় করা হত। রানীগঞ্জে পরিস্থিতি অন্যরকম। এখানকার সংস্কৃতি দোআঁশলা, ধানবাদ হয়ে বিহার থেকে আগত মানুষ এখানকার বাঙ্গালীদের না ঘরকা না ঘাটকা করে ছেড়েছে। অন্য লোক এলেও কি আর এরচেয়ে ভাল হবে? দু চার দিন দোনামনা করে মালতীকে কাজে লাগানো হল।

দেখতে যেমনই হোক, মালতীর কাজ নিয়ে অভিযোগ করার কোন জায়গা পাওয়া গেল না। সে যেমন দ্রুত, তেমনই দক্ষ। রান্নাতেও সে সুলগ্নাকে সাহায্য করতে লাগল। দুদিনেই পুরো বাংলোটি মালতী ঝেড়ে পুঁছে তকতকে করে ফেলল। সুলগ্নার থেকে জানা গেল, কাজের সঙ্গে মালতীর মুখও নাকি সমানে চলে। সে রানীগঞ্জের জে কে নগরের গেজেট। সকলের খোঁজখবরই নাকি তার কাছে থাকে। এতে অবশ্য আমার খানিকটা লাভই হল। বিডিওর কাজের একটা বড় অংশ জনসংযোগ। সেখানে আগাম খবর আমার কাজে লাগে।

মালতী আমার বাংলোয় কাজ করতে শুরু করার মাসচারেক বাদে একদিন রাত নটা নাগাদ আমার বাংলোর বসবার ঘরের ফোন বাজতে লাগল। ফোনের ওপারে অর্জুন তেওয়ারী। অর্জুন আদতে বিহারের লোক, কাজের খাতিরে তার সঙ্গে আমার সখ্যতার সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু অর্জুন তো এত রাতে ঘরে ফোন করে না!

“ডিসটার্ব করলাম কি? মুখার্জিদা একবার কোতোয়ালী আসতে হবে যে!” অর্জুন স্পষ্ট বাংলায় বলল। তার গলায় চাপা উত্তেজনা।

কি হল অর্জুন? এত জরুরী যে এখুনি যেতে হবে? বিরক্তি গোপন করে বললাম। অবশ্য বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। বিডিওর কাজে থানাপুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়।

অর্জুন জানাল একটি মৃতদেহ সনাক্তকরণের জন্য আমাকে প্রয়োজন। “হোমিসাইড কেস। তিনশ দুই লাগবে।” অর্জুন বলল।

“কিন্তু আমাকে আইডেন্টিফিকেশানে লাগছে কেন? মৃতব্যক্তি কি আমার চেনা?”

অর্জুন একটু ইতস্তত করতে লাগল। “আপনার একটো স্টেটমেন্ট নিতে হবে দাদা। ডেডবডিটা গনাপাগলার।” বলল সে।

গনাপাগলা খুন হয়েছে! শিরদাঁড়ার মধ্যে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। গনাপাগলা খুন হলে মালতীকে নিয়ে টানাটানি হবে। আর মালতী আমার কাজের লোক। ব্যাপারটা ঘোরালো।

ফোন রাখতে দেখা গেল সুলগ্নার মুখে উদ্বেগ। অর্জুনের সঙ্গে আমার বার্তালাপ সে শুনেছে। মালতীকে নিয়ে চোরা একটা আশঙ্কা আমাদের বরাবরই ছিল। সেটা যে এতদুর গড়াবে আমরা কেউই আশা করিনি।

আমার সরকারী গাড়ি বাংলোর লাগোয়া গ্যারেজেই থাকে। ড্রাইভারের বাসাও বাংলোর আউট হাউসে। তৈরী হয়ে গাড়ি ডাকিয়ে রওনা হতে কিছুটা সময় গেল। কোতোয়ালী আমার বাংলো থেকে মিনিট পনেরোর পথ। গাড়িতে বসে দেখতে লাগলাম রানীগঞ্জ শহরের আলো আঁধারি ঘেরা রাস্তা হু হু করে সরে যাচ্ছে। কিছু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। বাদুলে বাতাস এসে মুখে লাগল আর আমি মনে মনে মালতীর কথা ভাবতে লাগলাম।

মালতী

রানীগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশনের থেকে একটা রাস্তা লেভেলক্রসিং পেরিয়ে জে কে নগরের দিকে গেছে। জে কে নগর রানীগঞ্জের অফিসপাড়া। স্কুল, হাসপাতাল, দোকানপত্র, ব্যাংক আর সরকারী অফিসগুলি এখানে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে। লেভেলক্রসিং এখন বন্ধ। মেলট্রেন পাস না হওয়া পর্যন্ত লেভেলক্রসিংএ জমে থাকা ভিড়ে লঝঝড়ে লাইনের বাস, মালবোঝাই ম্যাটাডোরভ্যান আর মোটরবাইক দাঁত ঘষতে থাকে। এই যানবাহনের ভিড়ে মিশে থাকে অপেক্ষারত মানুষ। তাদের অবজ্ঞা করে এখুনি ধাতব ঝন ঝন শব্দ তুলে সম্রাটের মত মেলট্রেন পাস হবে আর বাধ্য প্রজা গঞ্জশহরের মানুষ হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। চড়চড়ে রোদ উঠেছে, অসহ্য গুমোট গরমে শরীরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে ঘাম। লেভেলক্রসিংএর ডান্ডাটির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মালতী। তার একহাতে বাজারের থলি। অন্যহাত দিয়ে আঁচল তুলে সে হাওয়া খায়। মালতীর শরীর ঘামে চকচকে, তার অন্তর্বাস ভিজে ব্লাউজের উপর ফুটে উঠেছে। বাইকে বসা মাঝবয়সী পুরুষ সেই অন্তর্বাসের দিকে চেয়ে দ্বিগুন বেগে ঘামতে থাকে।

ট্রেন পাস হয়ে গিয়ে লেভেলক্রসিংএর ডান্ডা উপরে উঠে যায়। মালতী দুলকি চালে লেভেলক্রশিং পেরিয়ে ষ্টেশন রোড ধরে হাঁটতে থাকে। দুদিকে হরেক কিসিমের দোকান, ভিড় করে মানুষ কেনাকাটায় ব্যস্ত, ভিড় ঠেলে গাড়ি, ঠেলা আর সাইকেল রিক্সা চলেছে মরিয়া গতিতে। এই হট্টগোলের মধ্যে মালতীর নিরুদ্বেগ হেঁটে যাওয়া মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ তল্লাটে মালতীকে যাবতীয় রিক্সাওয়ালা, দোকানদার আর ছোটখাট ছিঁচকে চোরডাকাত ভুপির প্রেমিকা হিসেবে চেনে। ভুপি রানীগঞ্জের কয়লা সাইডিংএর ওয়াগন ব্রেকারদের চাঁই। ফলে মালতীর রুপযৌবন দুর থেকে দেখার বস্তু, তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বিপদ্জনক। মালতী ভীড়ের মধ্যে হাঁটতে থাকে। তার নিতম্বের দোলা ষ্টেশন রোডের মানুষজনের প্রতি অতি উত্তেজক এক চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ নেবার সাধ্য কারুর নেই।
ষ্টেশন মোড় থেকে রাস্তা ঘুরে জে কে নগরের দিকে গেছে। এখানে রাস্তা অনেক চওড়া, ভিড়ও পাতলা হয়ে এসেছে। ফুটপাথের ধারে চায়ের দোকানের জটলা থেকে জনা তিনেক চোয়াড়ে চেহারার যুবক মালতীকে দেখে হাত নাড়ল। লম্বামত হাড়গিলে একটি ছেলে হিন্দি সিনেমার হিরোদের মত চোঙ্গা প্যান্ট পরে আছে। সে এগিয়ে এসে মালতীর দিকে দুটি রঙ্গিন পাতলা কাগজের সিনেমার টিকিট বাড়িয়ে দিয়ে হাসল।

“একতলার পিছনের সিট মালুদিদি।”

মালতী টিকিটগুলি খুঁটিয়ে দেখে ইষৎ বিরক্তির সুরে বলল, “ব্যালকনি পাওয়া গেল না?”

চোঙ্গা প্যান্টপরা ছেলেটা অপরাধীর মত মুখ করে বলল, “টিকিট তোলা খুব কঠিন হয়ে গেছে। পুলিশ ব্ল্যাকারদের ধরে চালান করে দিচ্ছে মালুদিদি।

মালতী ব্লাউজের ভিতর থেকে একটি ছোট্ট ব্যাগ বার করে টিকিটদুটি ভরে ব্যাগটি আবার বুকের মধ্যে চালান দিল। চোঙ্গা প্যান্ট মালতীর বক্ষবিভাজিকার থেকে নজর সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাগ ভাগ্যবান।

থলি তুলে মালতী আবার হাঁটা দিতে যাচ্ছে, ছেলেটি পিছন থেকে ডাকল, “মালুদিদি?”

ভ্রু নাচিয়ে মালতী তার দিকে তাকাতে ছেলেটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল, “পুলিশকে পয়সা তো বরাবর দিই দিদি। শ্বশুরা তবু কেন এমন কিচাইন করছে? ভুপিদাদাকে একটু বল না দেখতে?”

“ঠিক আছে। বলব।

মালতী আবার হাঁটতে শুরু করে। কিছুটা হাঁটার পর ব্যাংকমোড়ের পাশ দিয়ে একটা সরু গলি বিডিও বাংলোর পিছনে পৌঁছেছে। এই গলিতে সাইকেল ছাড়া কিছু ঢোকে না। গলির পাশে আস্তাকুঁড়, তাই ভদ্দরলোকও এ রাস্তা ধরে না। এ রাস্তা বিডিও বাংলোর মেথর চাকরদের যাতায়াতের জন্য নির্ধারিত। মালতী এই গলিতে ঢুকে অভ্যাসমত থলি নামিয়ে আঁচল ঘুরিয়ে হাওয়া খেল। তারপর মুখের হাতের ঘাম মুছে থলি তুলে শেষ কয়েকগজের হাঁটা দিতে গিয়ে আচমকা গলির মোড়ে রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার প্রায় বুকের উপর গিয়ে পড়ল।

ষন্ডামার্কা লোকটির মুখ দাড়িতে আচ্ছন্ন। মাথায় লম্বা ময়লা চুল। পরনের পোশাক শতচ্ছিন্ন, শুধু বোঝা যায় কোনো কালে গায়েরটি জামা ছিল এখন হাতাগুলি অদৃশ্য। হাফপ্যান্টটি নোংরা আর তাপ্পিমারা। গলায় শুকনো ফুলের মালা। ছেঁড়া নোংরা জামাকাপড়ের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে সবল পুরুষালী শরীর। মোটা ভ্রুর নীচে একজোড়া তীব্র চোখে মালতীর দিকে তাকিয়ে লোকটা হাসল।

মালতীর মত ডাকাবুকো মেয়েও এমন চমকে উঠেছিল যে তার বুক ধকধক করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে সে দুপা পিছিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখল। এই গলিটা নির্জন। খুব জোরে না চেঁচালে এখান থেকে কেউ কিছু শুনতে পর্যন্ত পাবে না। লোকটার মতলব কি?

বিডিও বাংলোর গেট পেরিয়ে মালতী থলি নামিয়ে কলতলায় চটি খুলে পা আর হাতমুখ ধুল। বিডিওবৌদি এসে মালতীকে দেখে বললেন, “ফের দেরী করেছিস। দাদা ডালভাত খেয়ে চলে গেল।”
বিডিওবৌদিকে মালতী খুব পছন্দ করে। বৌদি তাকে মাঝেমাঝেই উপরি সিনেমা দেখার পয়সা দেয়। আগের বিডিওগিন্নির মত এই বৌদি কিটকিটও করে না। উনি ওনার বইপত্তর আর গানবাজনা নিয়েই থাকেন। একটুআধটু চালটা চিনিটা সরালে ধরতেও পারেন না। এমনকি ওনার বকুনিটাও মিঠে।

মালতী দ্রুত দক্ষ হাতে রান্নাঘর পরিষ্কার করে ঘর মোছার কাজে লাগে। বৌদি সকালসকাল জামাকাপড় ধুয়েছেন। সেগুলি ছাতের তারে টাঙ্গানোর ফরমাশ আসতে থাকে। দেখতে দেখতে বিডিও বাংলোর ছাতে উজ্জ্বল রৌদ্রে সারি সারি রঙ্গিন কাপড় পতাকার মত দুলে ওঠে। দাদাবাবুর শার্টগুলো সব সাদা। ঐগুলি সাবধানে মেলতে হবে।

ছাতের আলসে থেকে মালতী দেখতে পেল গনাপাগলা এখনও বিডিও বাংলোর পিছনের গলিতে ল্যামপোষ্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে রাগে গরগর করতে থাকে। বিডিওবৌদি চুলে চিরুনী চালাতে চালাতে পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে রে লোকটা? বাপরে কি মুশকো!”
মালতী বিরক্তিতে জোরে জোরে ভেজা জামাকাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দিল, “ওর নাম গনাপাগলা। এ তল্লাটে থাকত দশ বছর আগে। তারপর কোথায় পালিয়েছিল। জোয়ানমদ্দ হয়ে ফিরেছে। চাউনি দেখনা, যেন গিলে খাবে!”

বিডিও বৌদি হি হি করে হাসেন। ঐ পাগলকে মালতীর এত ভয়?

“কেন রে? তোকে ভাল লেগেছে না কি?” ঠাট্টার ছলে বলেন তিনি। তাতে মালতী আরও রেগে গিয়ে মুখ ভেংচে বলে, “মরণ!”

“দাদার সাদাজামাটা সাবধানে মেলবি। দাগ লাগলে রাগ করেন।” এই বলে বিডিও বৌদি ছাত থেকে নেমে যান। মালতী দেখল গনাপাগলা ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি মুচকি হাসছে নাকি? ভূপিকে বলতে হবে ব্যাপারটা।

ভূপি

ষ্টেশন মোড়ে বাবুলালের পানের দোকানের সামনে ভিড় লেগেই থাকে। বাবুলালের দোকানটি ছোট। একটা মনিহারী দোকান আর দুধের ডিপোর মাঝখানে একফালি ফাঁকের মধ্যে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে থাকা এই পুরোনো দোকানের বহু খদ্দের। বাবুলাল বিহারী, তার কথায় এখনো দেহাতী টান কিন্তু বাঙ্গালী বাবুদেরও সে পান খাইয়ে মাত করে রেখেছ

ছুটির দিন। বেলা ক্রমশ দুপুরের দিকে গড়াচ্ছে। বাবুলালের দোকানের সামনে মাষ্টারমশাই দাঁড়িয়ে ফাঁক খুজছেন তার পানের ফরমাশ পেশ করার জন্য। মাষ্টারমশাই এ অঞ্চলের হাইস্কুলের থেকে অবসর নিয়ে প্রাইভেট টিউশনি করেন। চোখে পুরু চশমা, মাথাজোড়া টাক আর ধূতি পাঞ্জাবিতে তিনি তার নীতিবাগীশ চেহারাটি বজায় রেখেছেন। একটু ফাঁক পেয়ে তিনি গম্ভীরচালে বাবুলালকে বললেন, “এবার আমারটা বানাও।”

বাবুলাল দেঁতো হেসে বলল, “জি মাষ্টারমশাই।” মাষ্টারমশাই বাংলাপাতায় খয়েরছাড়া পান খান। বাবুলাল পানে সবে চুন লাগাতে শুরু করেছে, মাষ্টার মশাইয়ের কাঁধের উপর দিয়ে একটা হাত বাবুলালের নাকের ডগায় টস করে তুড়ি মারল।

“পান।” বলল ভূপি। ভূপির পরনে চকচকে ডগকলারের শার্ট আর বেলবটম প্যান্ট। তার চোখে শস্তা সানগ্লাস। ভূপির কানঢাকা চুল অমিতাভ বচ্চনের মত করে কাটা যদিও সে মোটেই অতটা লম্বা নয়। তার চোয়াড়ে মুখে অবিমিশ্র ক্রুরতা আর তার ভাবভঙ্গিতে একটা ফিল্মি কেতা। ভূপিকে দেখে বাবুলাল মাষ্টার মশাইয়ের পান ফেলে আরেকটা পানে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় খয়ের লাগাতে শুরু করল। ভুপির দিকে চেয়ে সে আনুগত্যের দরবিগলিত হাসি দিয়ে বলে, “ফটাফট দিয়ে দিচ্ছি ওস্তাদ।”

মাষ্টারমশাই প্রতিবাদের সুরে বললেন, “একি! আমি কখন এসেছি। আমারটা আগে না দিয়ে -”

ভূপি মাষ্টারমশাইএর গায়ের উপর অসভ্যের মত ঝুঁকে পড়ে জিভ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করে বলল, “আপনার আগে পান চাই?”

“চাইই তো।” মাষ্টার মশাই জেদী ভঙ্গিতে বললেন। তাঁর মুখে চরম বিরক্তি।

ভূপি তার প্যান্টের পকেট থেকে একটি ক্ষুর বার করে নাটকীয় ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে খুলে দেখতে লাগে। দুপুরের রোদ্দুর ক্ষুরের ধারাল ফলার উপর পড়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বাবুলাল আর মাষ্টারমশাই দুজনেই ক্ষুরটির দিকে গভীর মনোযোগে দেখতে লাগলেন। ভূপি সরল ভঙ্গিতে বলল, “কিন্তু আমার যে একটু তাড়া আছে মাষ্টারজি! লো এক্সকিউজ মি বোল দিয়া।” এইবলে সে খিক খিক করে হাসতে লাগল। মাষ্টারমশাই প্রথমে একপা পিছোলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনি প্রায় অর্ধেক দৌড়ের ভঙ্গিতে ষ্টেশন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ভূপি ক্ষুরটি ধীরে সুস্থে ভাঁজ করে পকেটে চালান দিয়ে বাবুলালের দোকানের ঠিক সামনে থুতু ফেলে বলল, “শালা চুহা।”

খদ্দের ভাগিয়ে দেওয়ায় বাবুলাল খুব চটেছে। কিন্তু ওপরে ওপরে সে রগড় করে হাসতে লাগল। একহাতে অন্যহাতের কনুই ধরে সে পানটি ভূপির দিকে বাড়িয়ে বলল, “রেডি ওস্তাদ।”

ভূপি পান মুখে ফেলে মুখ বিকৃত করে বলল, “এঃ ঝাঁঝি পান। লোক ঠকাস বাহাঞ্চোৎ!” বাবুলাল উত্তেজনার চোটে ভূপিকে বাংলা পাতা দিয়ে বসেছে। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি আবার পান সাজতে গিয়ে খয়েরের ডিব্বা উলটে ফেলল। মুখে সে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, “গোস্তাখি মাফ বস। আবার বানিয়ে দিচ্ছি।”

গোটা তিনেক পান পকেটে পুরে ভূপি ফের হাত বাড়িয়ে বলল, “চুনা।”

বাবুলাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আতঙ্কে তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। ভূপি কর্কশ কন্ঠে ধমক লাগিয়ে বলল, “আবে অকল কে অন্ধে। চূনা দে।”

পানের ডগায় চুন লাগিয়ে বাড়িয়ে দিতে দিতে বাবুলালের চোখে প্রায় জল এসে গেল। ভূপি জিভে চুন ছুঁইয়ে বলল, “মাল্তী এসেছিল কি?”

“না ভুপিভাই। এলে কি বলব?”

“বলবি আজকে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা হলে সোজা যেতে। দেরী হলে আমি ফুটে যাব।” বলল ভূপি।
“বলে দেব মহারাজ।” বাবুলাল তদগত হাসি হেসে বলল। ভূপি সানগ্লাসটা খুলে জামার হাতায় মুছে আলোতে তুলে পরীক্ষা করতে করতে বলল, “ভুলে যাস না বাবুলাল।” এই বলে চোখে সানগ্লাস এঁটে সে হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।

বাবুলাল মালতীকে বিলক্ষণ চেনে। দিনে বারদুয়েক সে বাবুলালের দোকানে খৈনি কিনতে আসে। এখানে তার সঙ্গে মালতীর খবর আদান প্রদান হয়। যদিও বিপজ্জনক, তবুও মালতীর সঙ্গে মনে মনে বাবুলাল আদর সোহাগ করে থাকে, বছরে একবার স্ত্রীসংসর্গ তারপক্ষে যথেষ্ট নয়। দোকানের দেয়ালে সিক্তবসনা সিনেমাবনিতার ক্যালেন্ডার ছবি দেখতে দেখতে বাবুলাল পানে খয়ের মেশাতে থাকে।

গনা

স্টেশন রোডে একটা কালো রাস্তা চৌমাথায় এসে পা ঝেড়েছে। পিচের রাস্তা এমনিতেই কালো হবে, তাতে কিছু আশ্চর্যের নেই। কিন্তু এই রাস্তাটি তার দুইধার মায় রাস্তার ধারের ঝোপঝাড় আর গাছপালাকেও কালো করে রেখেছে। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর কয়লা বোঝাই ট্রাকগুলি এখানে এসে চোমাথা পার করে ওপাশে ক্রাশার প্ল্যান্টের দিকে চলে যাচ্ছে। এখানে রাস্তার ধুলোও কালো, এমনকি রাস্তার ধারের চা দোকানের চায়ের ভাঁড়েও কয়লাগুঁড়ো ভাসে। এই অঞ্চলের লোকেদের এ জিনিষ গা সওয়া হয়ে গেছে। মোড়ের উপর প্রচুর দোকানহাট আর তাতে ভিড় করে আছে দেহাতি মানুষ। এই রাস্তাটির চালু নাম কয়লা সড়ক।

কয়লা সড়কের চৌমাথায় জনার্দন মিশিরের মুদিখানা। এই দোকান এই এলাকার সবচেয়ে পুরোনো আর যাবতীয় গৃহস্থালী দ্রব্যের সবচেয়ে বড় বিপনী। কথিত আছে মিশিরের দোকানে যা নেই, গোটা রানীগঞ্জে তা নেই। তেল, নুন, আটা, মশলা থেকে স্নো পাউডার আলতা চিরুনী, সবই পাওয়া যায় এই দোকানে। ভোরবেলায় এই দোকান খোলে আর রাত দশটা পর্যন্ত খরিদারি চলে। দোকানের সামনে সর্বদা ভিড়, সবাই চায় তার মালটা আগে দেওয়া হোক। ইদানিং জনার্দন কেক পাঁউরুটি বেচতে শুরু করেছে, সেই সব খাদ্যবস্তু দোকানের সামনে ডালায় লাগানো থাকে।

আজ সকালে মিশিরের মুদিখানার সামনে অন্তত জনাবিশেক ক্রেতা হাত বাড়িয়ে মালের ফরমাশ করছে। তিনটি কর্মচারী দৌড়ে ছুটে লিষ্টি মিলিয়ে মাল নামাতে ব্যস্ত। জনার্দন মিশির বসে আছে একটি উঁচু পাটাতনে। তার সামনে একটি কাঠের ক্যাশবাক্সো কাম ডেস্ক। নাকের ডগায় চশমা এঁটে মিশিরজি ফর্দের ওপর দাম ফেলছে আর মাঝে মাঝে হেঁকে বলছে, “গুপ্তাজির মসুর ডালটা বড় দানা দিয়েছিস?” বা “দত্তবাবুর উনিশদফা মাল কিসে যাবে? মুটে বুলাও।” একজন মাঝবয়সী মহিলা অনেকক্ষণ ধরে ঘ্যানঘ্যান করে একটি বিশেষ সাবানগুঁড়ো সম্পর্কে অভিযোগ করছিল, মিশিরজি তাকে হাতজোড় করে বলল, “সাবুন দিয়ে কেচে যদি পরিস্কার হচ্ছে না তো নুতন জামা কিনিয়ে লিন। এ বুধুয়া, কি সাবুন দেখে পয়সা ফিরৎ করে দে।” মিশিরের কন্ঠস্বর তার দেহের অনুপাতে হাস্যকর রকমের সরু।

চারপাঁচ জন ক্রেতা একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে “আমারটা দাও, আমারটা দাও” বলে। এতে জনার্দন মিশির একটুও বিচলিত হয় না। এত চেঁচামিচির মধ্যেও তার ঠোঁট দুটি জপের মত নড়ছে। ভাল করে খেয়াল করলে শোনা যাবে সে বিড়বিড় করছে “আট আট আট আর চারে বারো বাবো বারো বারো আর তিন পনের পনের পনের…..”

এই জটলার পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে গনাপাগলা। আজ সে কোথাথেকে কুড়িয়ে এনে একটা কাগজের টুপি মাথায় পরেছে। একহাতে দাড়ি টানতে টানতে এই ত্রস্তব্যাস্ত খরিদারি পর্যবেক্ষণ করছে গনা। মিশির তাকে কিছুক্ষণ আগে একটা দশপয়সা দিয়েছিল, সেটি নিয়ে গনাপাগলা রাস্তা পেরিয়ে গাছতলায় হনুমানজির থানে দিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে এসেছে। জনার্দন মিশির একটু গলা তুলে গনাকে বলল, “যাবি না গায়ে গরম পানি দিব?”

গুটি গুটি পায়ে গনা কেক বিস্কুটের ডালার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্যাংলা মত বুধুয়া মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে গনাকে বলে, “এই যা ভাগ। শালা পাগলা।” গনা তার দিকে দৃকপাত না করে একটি বিস্কুটের প্যাকেট তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। তার এই স্পর্ধা দেখে বুধুয়া তার হাত থেকে প্যাকেটটি কেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই গনা হাত দিয়ে তাকে আলতো ধাক্কা দিল। সেই সামান্য ধাক্কাতেই বুধুয়া দোকানের ভিতর চিৎ হয়ে উল্টে পড়ে আর হট্টগোল বেধে যায়। মিশির পাটাতন থেকে উত্তেজিত সরু গলায় চেঁচিয়ে বলে, “আরে শুয়ারের বাচ্চা, মাল রাখ।”

মিশিরের লোকজন হৈ হৈ করে ডালা কাউন্টার টপকে আসতে যাচ্ছে এমন সময় গনাপাগলা রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে কয়লা সড়ক ধরে ছুটতে আরম্ভ করল। মিশির উত্তেজনার চোটে পাটাতনের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বুধুয়ার কান টেনে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকল, “আরে নালায়েক!! তোর সামনে থেকে মাল তুলে পালাল?” খরিদ্দাররা মহা উৎসাহে “চোর, চোর!! পাকড়ো পাকড়ো” বলে গনার পিছনে ছুটতে শুরু করে।

কয়লা সড়ক থেকে পোস্টাফিসের গলি, সেখান থেকে চকবাজারে এসে পড়ল গনা। চকবাজার জনাকীর্ণ এলাকা, এখানে তার পশ্চাৎধাবনকারীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। একমুখ হাসি নিয়ে গনা ভিড় ঠেলে, সাইকেল উল্টিয়ে, মানুষ গুঁতিয়ে চকবাজার পার হয়ে খাদান বস্তির দিকে দৌড়ে যায়। ঐখানে তার ঘর। ঐখানে তার মা আর সরসতিয়া বসে আছে বিস্কুট খাবে বলে।

খাদান বস্তির জনশূন্য রাস্তায় ঢুকতেই কয়েকটা লোক একটা ঝুপড়ির থেকে বেরিয়ে এল। তাদের একজন ছুটন্ত গনার পায়ে ল্যাং মারতেই গনা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। তার মুঠো থেকে বিস্কুটের প্যাকেট পড়ে যায় রাস্তার ধুলোয়। গনা সেই প্যাকেটের দিকে হাত বাড়াচ্ছে এমন সময় একজোড়া ছুঁচোলো জুতো পরা পা প্যাকেট আগলে দাঁড়াল। গনাপাগলা প্যাকেটটি ধরতে যেতেই সেই পাজোড়া ফুটবল খেলার ভঙ্গিতে প্যাকেট সরিয়ে নেয়। গনাপাগলা চোখ কুঁচকে মাথা তুলে দেখে খুব চকড়াবকড়া জামা, বেলবটম প্যান্ট আর চোখে সানগ্লাস পরা ভূপি তাকে দেখছে।

“এই লে।” বলে ভূপি জুতো দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট গনার দিকে ঠেলে দিল। গনা হাঁচড় পাঁচড় করে প্যাকেট ধরতে যেতেই ভূপি ড্রিবলিংএর ভঙ্গিতে প্যাকেট সরিয়ে নেয়। গনাপাগলা হামাগুড়ি দিয়ে যতবার প্যাকেট ছিনিয়ে নিতে যায় ততই ভূপি খেলতে থাকে। ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসা লোকগুলো খ্যা খ্যা করে হাসে। কিছুক্ষণ খেলার পর ভূপির আশ মিটে গেলে সে জুতোর গোড়ালি দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেটটা মাড়িয়ে গুঁড়ো করে দেয়। তারপর সদলবলে সে চলে যায় চকবাজারের দিকে।

গনা রাস্তার ধুলোয় উবু হয়ে বসে প্যাকেট খুলে খুঁজে দেখে একটা বিস্কুটও আস্ত আছে কিনা। কিছুটা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বিস্কুট মুখে দিয়ে গনাপাগলা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। এই দৃশ্য দেখার মত লোক এই রাস্তায় তেমন নেই। নইলে অবাক হয়ে তারা দেখত যে একটা মুশকো দাড়িওলা ভিখিরি লোকের দু চোখ দিয়ে জলের ধারা মুখের ময়লা ধুয়ে নামছে। তার দাড়িতে লেগে আছে বিস্কুটের গুঁড়ো আর সেই লোকটা বিড়বিড় করে বলছে, “এ মা। বদমাস লোগ বিস্কুট খারাপ করে দিয়েছে। এ মা, উয়াদের পিট।”

মেঘ করলে যেমন ছায়াছায়া হয়ে যায় চারদিক তেমনি রাস্তা মিলিয়ে গিয়ে আবছাআবছা ঘরের উঠোন দেখা যায়। মাথায় যন্ত্রনা নিয়ে গনেশ উঠোনে পা ঠুকে বলল, “এ মা। খেতে দে। ভুখ লেগেছে।”

মা বলল, “হাত ধুয়ে লে বেটা। গরম গরম লিট্টি দিব।”

“গরম দিবি। আগে আমাকে দিবি। সরসতিয়াকে সবসময় আগে দিস কেন?” রাগ করে বলে গনেশ।

“অমন বলে না, ছি। বহেন হয় না তুমার?” মা বলে।

মাটির উনানের গনগনে আগুনের উপর জালে সেঁকা হচ্ছে লিট্টি। উনানের গর্তে ঢোকানো কাঠকুঠরি জ্বলছে দাউ দাউ করে। আর জ্বলছে গনেশ মাহাতোর পেট। কিন্তু লিট্টি হতে কি এতক্ষণ লাগে নাকি? উনানের আগুন বাড়তে থাকে। মাথা ব্যথাও বেড়ে চলে গনেশের। সে বিড়বিড়াতে থাকে, “এ মা। আগুন বাড়িছে। পানি দে।” আগুন কিন্ত বেড়েই চলে। ক্রমে সেই আগুন চরিদিকে ছড়িয়ে যায়। তারপর যেন সারা দুনিয়াটাই জ্বলে ওঠে আগুনে। একে তো মাথায় যন্ত্রণা তার উপরে ধোঁয়ায় গনেশের দম আটকে আসে। সে চিৎকার করে খুঁজতে থাকে আর হাঁকতে থাকে “সরসতিয়ারে!! মা, এ মা!!” কেউ উত্তর দেয় না শুধু চড়চড় পড়পড় করে ঘরদোর জ্বলে যাওয়ার শব্দ হতে থাকে। লিট্টির গন্ধের পরিবর্তে ভেসে আসে মাংসপোড়া গন্ধ। সেই আগুনের মধ্যে ছায়ামূর্তির মত কারা যেন নৃত্য করে।
খাদান বস্তি দাউ দাউ করে জ্বলছে। এই বস্তির লোকগুলো নতুন খনির জন্য জায়গা ছাড়ে নি। গনেশ মাহাতোর বাপ বিশ্বনাথ মাহাতো হাঁড়িয়া খেয়ে খেয়ে মরে যাবার আগে বলেছিল, “খাদান বস্তিতে যাদের জন্ম, খাদানই তাদের খায়।”

গনাপাগলা উদভ্রান্তের মত নয়া বস্তিতে ঘুরে ঘুরে ঘর খোঁজে। ঐখানে মা আর সরসতিয়া আছে। আর সরসতিয়ার সঙ্গে খেলতে এসেছে মদন বাউড়ির মেয়ে মালতী। মালতী নিশ্চয়ই জানে মা আর সরসতিয়া কোথায় গেছে।

অর্জুন

অর্জুন কোতোয়ালীর দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। আমার গাড়ি রানীগঞ্জ সদর থানার চৌহদ্দিতে ঢুকতেই সে সিগারেট ফেলে এগিয়ে এল। ঘড়িতে রাত প্রায় দশটা, এই সময় কোতোয়ালী চত্তর সাধারনত শুনশান হয়ে যায়। আজ থানার স্তিমিত আলোয় এখানে ওখানে কিছু পুলিশ দেখা যাচ্ছে, থানার সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুলিশ ভ্যান। সাদাপোষাকে থাকলেও অর্জুনকে দেখে চিন্তিত মনে হল।

“কোথায় সনাক্তকরণ হবে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“এখানেই হবে, মর্চুয়ারী থেকে আনা হচ্ছে।” অর্জুনের গলায় ক্লান্তি ধরা পড়ল।

অর্জুন তেওয়ারী সেই বিরল জাতের পুলিশ অফিসার যাদের আমরা সচরাচর সিনেমায় দেখে থাকি। বছর দুয়েক আগে রানীগঞ্জ কোল মাইনসে কয়লা চুরির বখরা নিয়ে মাফিয়াদের গ্যাংওয়ারে জনাচারেক খুন হয়েছিল, তাদের একজন ছিল পুলিশ সাবইন্সপেকটার। এই চুরির চক্র যতটা গভীর ততটাই দীর্ঘ – লোকে বলে ওয়াগন ব্রেকারদের লুঠের কমিশন অনেক ওপরতলা পর্যন্ত যায়। রানীগঞ্জ সদরের প্রশাসন এই মাফিয়াদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলে। কিন্তু পুলিশ খুন হলে কর্তাদের টনক নড়ে, তাই বিহার সার্ভিসের এই বাছাই করা আইপিএস অফিসারটিকে এখানে পাঠানো হয়েছিল কয়লা মাফিয়াদের দৌরাত্ম সামলানোর জন্যে। অর্জুন গত দুবছর ধরে কয়লা মাফিয়াদের সঙ্গে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। রানীগঞ্জে সে এখন মূর্তিমান ত্রাস। মৃদুভাষী এবং চোখে চশমাপরা ভদ্রজনোচিত অর্জুনকে দেখে একথা বিশ্বাস করা কঠিন।

কোতোয়ালীর গাড়িবারান্দায় অর্জুন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।

“টেনসনে আছো মনে হচ্ছে?” সিগারেট নিতে নিতে বললাম আমি।

“হুঁ। আমার পিছনের ঘরটায় বসি চলেন।”

“আইডেন্টিফিকেসান?”

অর্জুন অন্যমনস্কের মত সিগারেট টানতে টানতে বলল, “সে এখনো আধঘন্টা দেরী হবে। অন্য কথা আছে।”

বিডিও হিসাবে জানি অর্জুনের পিছরের ঘরটির বিশেষ মাহাত্য আছে। ঘরটি ছিমছাম, গুটিকয় সোফা আর একটি বড় টেবিলে সাজানো – আপাত নিরীহ চেহারার এই ঘরটি জেলাপুলিশের আনঅফিসিয়াল মন্ত্রনাকক্ষ। এখানে অনেকসময় বিশেষ পদ্ধতিতে বেয়াড়া সন্দেহভাজনদের জেরা করা হয়ে থাকে। দরজার কাছে প্রহরারত গুঁফো কনস্টেবলটিকে দুকাপ চায়ের ফরমাশ করে অর্জুন আমাকে ঘরটিতে এনে বসাল।

“ব্যাপারটা একটু খুলে বল অর্জুন।” আমি সন্ধিগ্ধ গলায় বললাম। কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছিল যে কেবল একটি মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্যে আমাকে এখানে ডাকা হয়নি।

“আপনি কেসটা জানেন?” অর্জুন সজোরে সিগারেট টানতে টানতে বলল।

“না। কি হয়েছে?”

অর্জুন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে সোজা কাজের কথায় চলে গেল। সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ রোঁদের কনস্টেবল বিডিও বাংলোর পরিচারিকা মালতী বাউড়িকে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় রেলওয়ে সাইডিংয়ের কাছে আবিস্কার করে। মালতীর জামাকাপড় ছেঁড়া ও হাতেগায়ে আঁচড়ানো কামড়ানো দাগ ইত্যাদি থেকে তাদের ব্যাপার সুবিধের লাগেনি। উপরন্তু মালতী স্বয়ং তাদের পায়ে পড়ে থানায় যাবার জন্যে জোরাজুরি করছিল। কান্নামিশ্রিত অসংলগ্ন বক্তব্য থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছিল যে রেলওয়ে সাইডিংএ কেউ একজন খুন বা জখম হয়েছে এবং মালতী সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এমতাবস্থায় তাকে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়। সাড়ে আটটায় বক্তারনগর কোলসাইডিংয়ে কয়লা খালাশ করতে গিয়ে ওয়াগন থেকে একটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। সম্ভবত এই মৃতদেহটির কথাই মালতী বলছিল।

দরজা ঠেলে থানার মালবাবু চা নিয়ে আসাতে অর্জুন চুপ করে গেল। যতক্ষনে মালবাবু টেবিলের উপরে চায়ের কাপ আর লেড়ো বিস্কুট রেখে খাতিরদারি করছেন, আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম – পুলিশের কাছে, বিশেষত রানীগঞ্জের পুলিশের কাছে, এইরকম খুনজখম সাধারণ ব্যাপার। এ নিয়ে কিছুদিন ধরপাকড় চলে তারপর সবাই সেসব ভুলেও যায়। মৃতদেহটা যদি গনারও হয়, তাতেই বা কি যায় আসে? শুধু মালতীর জড়িত থাকার ব্যাপারটা অস্বস্তিকর বটে। মালবাবু চা দিয়ে চলে যাবার পর আমি অর্জুনকে সেটাই বললাম। “মালতীর বক্তব্য কি?”

অর্জুন আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর সে চিন্তিত স্বরে বলল, “মালতী বলছে ঐ খুন সে-ই করেছে।”

আমার হাত থেকে চা চলকে পড়বার উপক্রম হল। মালতী গনাকে খুন করেছে? ঐ ছোটখাটো চেহারার মেয়েটি একটু বন্য স্বভাবের হতে পারে কিন্তু গনাপাগলা মুশকো পালোয়ান – তাকে সে কাবু করবে কি করে? সুলগ্না বলছিল বটে গনা নাকি মালতীকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছিল ইদানীং। এ নিয়ে আমরা আলোচনাও করেছি। অনেক সময় মানসিক অপ্রকৃতিস্থ মানুষ যৌন তাড়নায় নাচার হয়ে ওঠে। মালতী নিজেও এ নিয়ে চিন্তায় ছিল। আমি শুনেছি মালতীর একটি মাস্তান বয়ফ্রেন্ড আছে, ফলে তাকে এমনিতে কেউ ঘাঁটায় না। গনা এমন কি ঝামেলা করছিল যে মালতী ওকে খুন করতে যাবে? আমি মাথা নাড়তে লাগলাম। “অন্য কোন গল্প আছে অর্জুন।” বললাম আমি।

অর্জুন তেতো হাসি হেসে বলল, “একদম আছে। অ্যাটেম্টেড রেপ আছে। চেপে যাওয়া খুনী আছে। কোল নেক্সাস আছে।”

আমি অর্জুনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। অর্জুন বলে যেতে লাগল, “ব্যাটাছেলে হলে দুমিনিটে কথা বার করে নিতাম মুখার্জিদা। কিন্তু একে মেয়েছেলে তারপর মলেস্টেসান ভিকটিম। একটু প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে।”

“খুনটা কে করল?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“যদি খুব ভুল না করি তো ভুপিন্দর শর্মার লোকজন।”

“মালতীর প্রেমিক?”

অর্জুনের মুখ কঠিন হয়ে গেল। সে বলল, “তিন মাস ধরে ট্র্যাপ করছি কোল মাফিয়াদের এই লিঞ্চপিনকে ধরার জন্যে। বিহারে দুটো বার্গলারি আর একটা রেপের চার্জে ধরা পড়েও বেরিয়ে গেছে। এটাকে না ধরা গেলে কিছুতেই সাফসুতরা করা যাবে না। কিন্তু প্রাইম উইটনেস নিজে চার্জ নিয়ে নিচ্ছে। একদম হিস্টেরিক উওম্যান।”

আমি চুপ করে রইলাম। এটা পুলিশ ওয়ার্ক। অর্জুন তেওয়ারী আমার দিকে ঘুরে বসে বলল, “মালতী বাউড়ি তোমার কাছে এজাহার দিতে চাইছে।”

এইবার আমার প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাবার মত অবস্থা হল। মালতীকে কাজে লাগাবার দিন থেকে এইরকম একটা ঝামেলার ভয় আমাকে তাড়া করেছে। এতদিনে তা সত্যি হল। আমি প্রতিবাদের সুরে বললাম, “আমি কি করে এজাহার নেব? এটা তো পুলিশের কাজ!”

অর্জুন ঝুঁকে পড়ে বলল, “মুখার্জিদা বিডিওর ম্যাজিস্টেরিয়াল পাওয়ার আছে। ডু মি দিস ফেভার। তুমি যদি চাও আই উইল কিপ দিস আউট অফ রেকর্ডস। দাদা না বোলো না।”

রাত ক্রমশ বাড়ছে আর ক্লান্তি এসে চেপে ধরছে। বুঝতে পারছিলাম অর্জুনের অনুরোধ ফেলা মুশ্কিল। মাথার মধ্যে দিনের ঘটনাক্রম ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি এই ঝামেলাটির থেকে বাইরে না ভিতরে কোথায় বেশি নিরাপদ ভাবতে লাগলাম।

“মালতীকে কে রেপ করতে যাচ্ছিল?” কৌতুহল বশত জিজ্ঞাসা করলাম অর্জুনকে।

“বলা মুশকিল। আই ও বলছে গনা। আমি সিওর নই।” সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে বলল অর্জুন। বাইরে ভারী গাড়ির আওয়াজ হল আর সঙ্গে চাপা গুঞ্জন। মর্গ থেকে গনাপাগলার দেহ এসে পড়েছে মনে হয়। অর্জুন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এই ঘরেই ওয়েট করুন দাদা। আমি আপনাকে ডেকে নেব।”

“মালতী কোথায়?” শুধোই আমি।

“জেনানা ফাটকে। মেয়ে পুলিশ নেই তাই থানার মেথরানী সঙ্গে আছে। একটু স্যুইসাইডাল স্টেটে আছে। গুডলাক মুখার্জিদা।

গলা শুকিয়ে তেষ্টা পেতে লাগল আমার। এই সময় সুলগ্নার পরামর্শ পেলে ভাল হত।

মিটিং

রানীগঞ্জ কোল সাইডিংয়ে সন্ধে নামছে। সূর্যের পড়ন্ত আলোয় দৈত্যাকৃতি কোল ওয়াশারিগুলি দুরে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কনভেয়ার বেল্টের লম্বা ছায়া পড়ে থাকা কোল সাইডিং সুনশান, এখানে ওখানে কাটা রেকগুলোর ওয়াগন দাঁড় করানো। সাইডিংয়ের এককোনে অধুনা পরিত্যক্ত পুরোনো কেবিনঘর, সেই কেবিনঘরের সামনে সানবাঁধানো উঠোনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে গোটাকয়েক লোক। পলেস্তারাওঠা পাঁচিলে হেলান দিয়ে ঘাসের শিস দাঁতে নিয়ে ভুপি লোকগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে। এরা তার ওয়াগন ভাঙ্গার দল – রানীগঞ্জ থেকে বক্তারপুর হয়ে বোকারোর দিকে যে লাইন চলে গেছে একসময় ভূপির দল সেখানে রাজত্ব করত। কিন্তু গত কয়েক মাসে তার রমরমা কমে গেছে উদ্বেগজনক ভাবে। আগে প্রায় রোজই অ্যাকশান লেগে থাকত, এখন অনেক ভেবেচিন্তে কাজে নামতে হয়। রানীগঞ্জের নতুন এসিপি আসার পর থেকে ক্রমাগত পুলিশ কোল সাইডিংয়ে হানা দিচ্ছে। লোকটা পয়সা নেয় না আর চূড়ান্ত সিকিউরিটিতে থাকে। এই এসিপির পরামর্শে কয়লার ওয়াগনগুলোতে এখন পাহারাদার চড়ে বসে থাকে। ভূপির দলের বেশ কিছু সদস্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে এদিকে ওদিকে সটকে পড়েছে। রেলের আর পুলিশের ইনসাইডাররাও মোটামুটি নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। ভূপির দলনায়কের ভূমিকা নিয়ে ইদানীং চাপা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। একটা বড় হাত না মারতে পারলে দল টিকিয়ে রাখাই মুশ্কিল হয়ে পড়তে পারে। সামনে বড় একটা অ্যাকশানের পরিকল্পনা আছে ভূপির, আজ কথাটা পাড়তে হবে। কিন্তু ভূপির ডান চোখ নাচছে; সবাই এমন চুপচাপ কেন?

“শিউনন্দন কোথায়?” কর্কশ গলায় বলল ভূপি। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। শিউনন্দন ঠাকুর রেলওয়ে কোম্পানীর ট্যালি ক্লার্ক। দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে সে ভূপির দলকে কয়লা রেকের আগাম খবরাখবর সরবরাহ করে আসছে। এছাড়া সে সিগন্যাল কেবিনকেও ম্যানেজ করে থাকে যাতে গাড়ি দাঁড়িয়ে গিয়ে কাজের সুবিধে হয়। শিউনন্দনকে ওয়াগন ব্রেকারদের পরিভাষায় খোঁচড় বলা হয়। আজকের মিটিংয়ে তার থাকার কথা।

ভূপির ডেপুটি জগন্নাথ পান্ডে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শিউনন্দনকে আজ দুপুরে পুলিশ উঠিয়ে নিয়েছে ওস্তাদ।” এইকথা শুনতেই চারদিক থেকে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।

“খামোশ!” ভূপি গর্জিয়ে ওঠে। সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলে সে কোমর থেকে মুঙ্গেরী ওয়ান শটার বার করে নাটকীয়ভাবে দেখতে দেখতে ঠান্ডা গলায় বলল, “কে তুলল? অর্জুন তেওয়ারী?”

“হ্যাঁ ওস্তাদ।”

ভূপি দ্রুত চিন্তা করতে থাকে। শিউনন্দন না থাকলে অসুবিধা হয়ে যাবে একথা ঠিক কিন্তু এত বড় রেক আর এমন সুবিধাজনক সময়ে সামনের কয়েকমাস পাওয়া যাবে না। এছাড়া ভূপিকে একটা চ্যালেঞ্জ দেওয়া হচ্ছে, সেটা না নিয়ে পিছিয়ে গেলে দল ভেঙ্গে যাবে। এই অ্যাকশানটার জন্যে সে মুঙ্গের থেকে বন্দুক আর টোটা আনিয়েছে, দরকারে দু চারটে বডি ফেলে দিতেও সে পিছপা নয়। কিন্তু শিউনন্দনের অ্যারেস্ট কি আরও বড় কোন ফাঁদের ইশারা? এই অ্যাকশানের প্ল্যান সে আর শিউনন্দন ছাড়া আর কেউ জানে না। শিউনন্দন আর পি এফের লোকজনকে ফিটিং করে রাখবে বলেছিল। অর্জুন তেওয়ারী যদি তাকে থার্ড ডিগ্রী দিয়ে কথা করা করে নেয়? ভূপির ডান চোখ তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে লাগল। এই অ্যাকশানটাও ছেড়ে দিতে হবে ভাবতেই ভূপির মাথায় খুন চেপে যায়। কেউ একটা ভিতরের খবর বাইরে করে দিচ্ছে! কে করছে?

“শিউনন্দনের সঙ্গে আমি ছাড়া আর কে কথা বলেছে? জগন্নাথ?” ভূপি ঘড়ঘড়ে গলায় বলল। জগন্নাথ সজোরে মাথা নেড়ে না বলতে লাগল। দলের লোকজন অস্বস্তিতে এধার ওধার তাকায়। সকলেরই পকেটে টান, কাজকর্মের গল্প নেই – যদিবা একটা মিটিং হল, সেখানেও পুলিশের ছায়া। এখন তো মনে হচ্ছে ভূপি সবাইকে সন্দেহ করতে লাগবে। সকলে ব্যাজার মুখে উসখুস করতে থাকে। জগন্নাথ উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। ভূপি উঁচুগলায় নেতার ভঙ্গিতে বলল, “আমাদের ভিতরে কেউ গদ্দারি করছে, এখন সব অ্যাকশান বন্ধ। কে গদ্দারি করছে আমি ঠিক জেনে নেব আর সে কুত্তার মওত মরবে। এখন সবাই ফুট।”

একজন দুজন করে দলের লোকজন আসন্ন সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মিশে যেতে থাকে। কেউ কেউ স্পষ্টতই হতাশ, তারা গুজগুজ করে নিচুস্বরে ভূপির সম্পর্কে নিন্দাসূচক কথাবার্তা বলে। তাদের নেতা খালি বনঢনকে ঘুরে বেড়ায় আর ইশক লড়ায় – কাজের কাজ কিছু করতে পারে না। এদিকে পুলিশ ক্রমশ জাল গুটিয়ে আনছে। জগন্নাথ আর ইকবাল বলে এক গ্যাসকাটার ছোকরা দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভূপি চোখ নাচিয়ে বলল, “কি?”

জগন্নাথ ইকবালকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “বল কি বলবি।”

ইকবাল ইতস্তত করছে দেখে ভূপি কর্কশ গলায় বলে, “আবে বোল।” ইকবাল মাটির দিকে চেয়ে বলল, “সর্দার বলছিলাম কি মালতীদিদি তো বিডিওবাংলোয় কামকাজ করে।”

“হাঁ। তো?”

ইকবাল কুন্ঠিতস্বরে বলে, “বিডিওসাহেব অর্জুন তেওয়ারীর দোস্ত। মালতীদিদিকেও সাবধান করে দিও।”

জগন্নাথ সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। আরও দুএকজন অস্পষ্টস্বরে ইকবালকে সমর্থন করে। অন্যসময় হলে ভূপি এইকথা বলার জন্যে ইকবালের জিভ ছিঁড়ে নিত, কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। দলের মধ্যে তার অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। অ্যাকশান ছাড়া গুন্ডা বদমাশের দল নিয়ন্ত্রন করা যায় না। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও ভূপি থমকে গেল। ক’দিন আগেই সে ম্যাটিনিশো সিনেমা দেখেছে মালতীর সঙ্গে। ঠিক কি কথা বলেছে সে?

মালতীর সঙ্গে কথোপকথন মনে করতে গিয়ে ভূপির তীব্র যৌন উত্তেজনার কথা মনে এল আগে। চিত্রধনু সিনেমাহলের পিছনের ফাঁকা সিটে মালতীর সঙ্গে গাঘেঁষাঘেঁষি করে বসে সে যা করছিল তাতে কথাবার্তার প্রয়োজন ছিল না বিশেষ। গত দু এক মাস ধরে মালতী বিয়েশাদীর কথা বলে যাচ্ছে, ভূপির সে ব্যাপারে উৎসাহ নেই, শুধু ব্লাউজের ফাঁকে হাত ঢোকানোর জন্যে কিছু মন রাখা কথা বলতে হয় তাই বলা। সেইসব কথা মনে করা মুশ্কিল, স্মৃতিতে শুধু যুবতী শররীরের উত্তাপ আর দৃঢ়কোমল স্পর্শের আনাগোনা।

“আমার বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের এখনো হল না।” উরুসন্ধির দিকে ভূপির অগ্রসরমান হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলছিল মালতী।

“হবে হবে জানেমন। আমাদেরও হবে।” দেঁতো হাসি হেসে বলেছিল ভূপি।

“সে তো একবছর ধরে শুনছি। শাদির মুরোদ থাকলে কি আর সিনেমাহলে মেয়েমানুষের জামার তলে হাত দিতে হয় রাজা?”

মালতীর এই নখরা ভূপিকে পাগল করে। তারও এবার দাঁড়ে বসার সময় হয়েছে। খোঁচা খাওয়া শেয়ালের মত সে মালতীর উপর ঝুঁকে পড়ে হিসহিস করতে করতে বলে, “আর একটা হাত মারতে পারলেই তোকে নিয়ে পালাব।”

“কবে?” মালতী ফিসফিস করে আর ভূপির কানের লতিতে জিভ বোলায়। ভূপির মনে হয় তার সমস্ত শরীরে আগুন লেগে গেছে। সে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে, “শিউনন্দনের টিপস যদি ঠিক হয়, সামনের গুরুবারে বড় অ্যাকশান।”

“দুর। কয়লাচোর কোথাকার!” মালতী হাসতে থাকে।

“কেউ জানে না জানেমন, দু ওয়াগন তামার তার আছে। একটা ঘোরাতে পারলেই কেল্লা ফতে।”

ভূপির মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। এতো দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাচ্ছে। বাঘের ঘরেই তাহলে ঘোগের বাসা? এর আগে যে কৃপারাম মাহাতো ধরা পড়েছিল, তার কথাও তো সে মালতীকে বলেছিল! কিংবা রামানন্দ যেদিন ওয়াগনের তালা কাটতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরল, তার কথাও মালতী জানত!

রাত্রির অন্ধকার নেমে এসেছে কোল সাইডিংএ। চারদিক নির্জন, সবাই চলে গেছে। আকাশে একফালি চাঁদের আলোয় রুপোলী সাপের মত রেললাইনগুলি দুদিকে বিস্তৃত। ভূপিন্দর শর্মা এক প্রাগৈতিহাসিক নেকড়ের মত চাঁদের দিকে মুখ তুলে গুঁগিয়ে উঠে বলল, “মা কসম, তোকে আমি ছাড়ব না।”

মালতী

সাড়ে এগারোটার সময় সনাক্তকরণের ডাক এল। গুঁফো কনস্টেবল কানে পৈতে জড়িয়ে আমাকে মুর্দাঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দুর থেকে দেখি অর্জুন লম্বা বারান্দার শেষপ্রান্তে একজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে। কাছে যেতে সে অফিসারটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, “এ হল অবনী হালদার, আই ও। আপনার সঙ্গে যাবে।”

রানীগঞ্জ পুলিশ মর্গ থানার থেকে কয়েক মিটার দুরে। অতীতে এই মর্গটি থানার সংলগ্ন ছিল, এখন এরই চালু নাম মুর্দাঘর। এইরকম আইডেন্টিফিকেশান বা অপঘাতে মরা মানুষের দেহ পরিবারের লোকজনের হাতে দেওয়ার জন্যে এখন এই ঘরটি ব্যবহার হয়। থানার পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মুর্দাঘরের চত্তরে পড়তেই ঝাঁঝালো ওষুধমেশানো বিজাতীয় গন্ধ এসে ঝাপটা মারল। পকেট থেকে রুমাল বার করে নাকে দিচ্ছি দেখে অবনী হালদার বলল, “গলাকাটা মড়া, মোটেই দেখবার মত বস্তু নয়।

মুর্দাঘরে একটা লোহার গুর্নীর উপর চটে ঢাকা দেওয়া মৃতদেহ। ঢাকার তলা থেকে একজোড়া নিস্প্রান পা বেরিয়ে রয়েছে। অবনী হালদার ক্লিপবোর্ডে লাগানো একটি কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “টিক দেওয়া জায়গায় সই করুন। নামের বানান দেখে নেবেন।” পুলিশ আমাকে বরাবর অবাক করে। অপরাধ, মৃত্যু ও চোর ছ্যাঁচড় ঘাঁটতে ঘাঁটতে এদের একটা সময়ে একেবারে সাধু সন্ন্যাসীদের মত নির্লিপ্ততা আসে। অবনী হালদারকে দেখে মনে হচ্ছিল সে বুঝি জমিজমার দলিল সই করাচ্ছে।

কাগজে সই করতেই, গুঁফো কনস্টেবল রাম রাম বলতে বলতে চটের পর্দা সরিয়ে মৃতদেহের মুখ উন্মুক্ত করে দিল। গনাপাগলার দাড়ির জঙ্গলের মধ্যে গলার কাটা দাগ তেমন বোঝা যাচ্ছে না তবে তার মাথায় পোস্টমর্টেমের ব্যান্ডেজ করা। কালিঝুলি মাখা অর্ধনীমিলিত চোখে গনাপাগলার মৃতদেহ যেন শান্তির ঘুম দিচ্ছে। পাশ থেকে অবনী হালদার নিরাসক্ত স্বরে বলল, “নিয়মমাফিক শুধোতে হয় তাই বলছি, এই ডেডবডি আপনি সনাক্ত করছেন?”

“হ্যাঁ।”

“এই ব্যক্তিকে আপনি চিনতেন?”

“হ্যাঁ।”

“নাম?”

“পুরো নাম জানা নেই। লোকে গনাপাগলা বলত।”

“গনেশ মাহাতো। ঠিক আছে হয়ে গেছে। এখানে আরেকটা সই করুন।” অবনী হালদার কাগজ বাড়িয়ে দিল। সই করতে করতে বললাম,”কালো কালো ছোপ কিসের?” অবনী হালদার নির্লিপ্ত গলায় বলল, “কয়লার দাগ। কয়লার ওয়াগনে বডি পড়েছিল।”

হেঁটে এসে অর্জুনের মন্ত্রনাকক্ষে বসতেই অর্জুন অবনী হালদারকে বলল, “উইটনেসকে আনুন। এই ঘরে কেউ থাকবে না, আমরা পাশের ঘরে বসব।” বোঝা গেল এইবার আমাকে মালতীর এজাহার নিতে হবে। অর্জুন হাল্কা হেসে আমাকে বলল, “আপনাকে শেখানোর কিছু নেই মুখার্জিদা, তবু বলছি। জেরা করার দরকার নেই, খালি শুনে যাবেন। স্পেসিফিক কিছু জানার হলে আপনাকে চিরকুটে লিখে পাঠাব।” পাশ থেকে অবনী একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা একটু পড়ে নেবেন। সুবিধে হবে।”

পাতলা একটা পুলিশ ফাইল। তাতে কিছু হাতে আর কিছু টাইপরাইটারে লেখা রিপোর্ট। পাতা উল্টিয়ে দেখা গেল মালতীর প্রথম জবানবন্দী, তাতে বিশেষ কিছুই নেই, খালি বলা আছে মালতী বাউড়ি, বয়স আনুমানিক চব্বিশ বছর, জামাকাপড় ছেঁড়া ও বিহ্বল অবস্থায় তাকে উনিশ ডাউন রানীগঞ্জ কোল ইয়ার্ড লাইনের কাছে পাওয়া যায়। মালতী কোন এক গনা নামক ব্যক্তিকে খুন হতে দেখেছে বলে দাবী করছিল। সে একেকবার একেকরকম কথা বলছে বলে তাকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন বলে মনে করা হচ্ছে।

আরেকটি রিপোর্টে, যেটি অবনী হালদারের সই করা, লেখা হয়েছে প্রাথমিকভাবে মালতীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা হয়েছিল বলে হয়। মালতী এইপ্রসঙ্গে ভুপিন্দর শর্মা অ্যালিয়াস ভূপিকে দায়ী করেছে। এই ধর্ষণের চেষ্টার সঙ্গে খুনের কোন যোগসূত্র আছে কিনা পরিস্কার নয়। নিহত ব্যক্তিও এই কাজ করে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে মালতী বাউড়ির স্টেটমেন্ট মিথ্যে এবং খুনে তার জড়িত থাকা অসম্ভব নয়। এই রিপোর্টের পাশে অর্জুনের লেখা নোটে বলা হয়েছে, মালতী স্বয়ং এই খুনের দায় নিতে চায় কিন্তু সেটা খুবই অসম্ভব এবং কোন সত্যগোপনের চেষ্টা হতেই পারে।

ফাইলের মধ্যে হলদে হয়ে যাওয়া পনের বছরের পুরোনো একটা রিপোর্ট পাওয়া গেল। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে চার নম্বর কয়লাখাদান বস্তিতে আগুন লাগার কথা। এই আগুন যে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হতে পারে সেকথা রিপোর্টে স্বীকার করা হয়েছে। কারণ ওপেনকাট খনিগুলি অনেকাংশেই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন, তারা খনিসম্প্রসারনের জন্য মাঝে মাঝে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ। এই রিপোর্টের নিচে আগুনে পুড়ে মৃত বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামের তালিকায় এগারো ও বারো নম্বর নামের তলায় লাল কালিতে আন্ডারলাইন করা। সরসতিয়া মাহাতো বয়স আট আর ভানুমতি দেবী বয়স চল্লিশ। পাশে ফুটনোটে লেখা, ইমিডিয়েট ফ্যামিলি অফ গনেশ মাহাতো।

চোখ বন্ধ করে ভাবতেই ছেঁড়া সৃত্রগুলো মিলে যেতে লাগল। পনের বছর আগে গনেশ মাহাতোর গনাপাগলা হয়ে যাবার টুকরো টুকরো কাহিনী। আগুন নেভার পর কিছুদিন লোকজন পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ছাই ঘেঁটে গেরস্থালীর জিনিষপত্র আর শবদেহ বার করেছিল। তখন তাদের ধরে ধরে গনেশ মাহাতো জিজ্ঞাসা করত তার মা আর বোনের কথা। তাকে যখন বোঝানো হল যে আগুনে পুড়ে তার মা আর বোন মরেছে তখন সে সেইকথা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করে। এর কিছুদিন পর থেকে গনেশের ভাবগতিক বদলে যেতে থাকে। কিছুদিন সে ভিক্ষে করেছিল, কিন্তু সবাইকে সে তার মা আর বোনের কথা শুধিয়ে উত্যক্ত করত বলে শেষে তাকে লোকে ভিক্ষেও দিত না। তারপর একদিন মাঝরাতে সে বিডিওবাংলোর আউটহাউসের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে মদন বাউড়ির বালিকা কন্যার হাত ধরে টানাটানি করছিল বলে লোকে তাকে বেধড়ক ঠ্যাঙায়। এর কিছুদিন পর থেকে গনেশ ওরফে গনাপাগলা জে কে নগর থেকে উধাও হয়ে যায়। নিশ্চয়ই নিয়তি তাকে এখানে টেনে এনেছিল। আজ তার বাতিল মৃতদেহ থানার মুর্দাঘরে বেওয়ারিশ পড়ে আছে। মনে হল অদৃষ্টের ফেরে আমি গনাপাগলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। নইলে তার মৃত্যুরহস্য এভাবে আমার কাছেই উদ্ঘাটিত হবে কেন?

ঘোর কালো চেহারার অতিকায়দর্শন এক মহিলা হাত ধরে মালতীকে ঘরে নিয়ে এল। মালতীকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। একদিনে একি চেহারা হয়েছে তার? চোখের কোনে কালি, মাথায় অবিন্যস্ত চুল আর গায়ে চাদর জড়ানো মালতীকে দেখে মনে হল কেউ যেন জাদুমন্ত্রে তার প্রানশক্তি শুষে নিয়েছে। ভেঙ্গে পড়া, ম্লান চেহারার এই মালতীকে প্রায় অচেনা লাগে আমার। নির্জীব ভঙ্গিতে সে ঘরের এককোনে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসল। আমি চেয়ার টেনে তার কাছে নিয়ে গিয়ে বসে বললাম, “ভয় পেয়ো না। সব কথা খুলে বল। বেঁচে যাবে।”

নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল মালতী। তারপর কান্নাবোঁজা গলায় বলল, “আমি বাঁচতে চাই না বাবু। আমাকে ফাঁসি দিন।”

অর্জুন যাই বলুক না কেন, এ মোটেই হিস্টিরিয়া নয়। এ হল অনুতাপ। আমি একটু সময় নিয়ে মালতীকে বললাম, “আমি ফাঁসি দেবার মালিক নই। কিন্তু তুমি ফাঁসি চাইছ কেন? গনাকে তো তুমি মারো নি।”

যন্ত্রনা আর শোকে মালতী বাউড়ির মুখ বেঁকেচুরে যেতে লাগল। কপালে করাঘাত করে সে বলল, “আলবাৎ মেরেছি। আমার গলতি মেরেছে ওকে। আমার নাসমঝি মেরেছে। বাবু আমাকে শাস্তি দিলান, নইলে মরেও আমার নিস্তার নেই।”

কিসের গলতি? কি নাসমঝি?

শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেছিল আমার।

জবানবন্দি

বাজারের মধ্যে গনা ধরেছিল মালতীকে। হঠাৎ পথ আটকে দাঁড়িয়ে জটা আর দাড়ির ফাঁকে মুচকি হাসছিল যেন খুব একটা মজার ব্যাপার হয়েছে কিছু। ভয়ে আর বিরক্তিতে মালতীর দম বন্ধ হয়ে আসে আর বাজারচলতি লোকজন রগড় দেখে। পাগল উত্যক্ত করছে জে কে নগরের নামকরা মাস্তানের প্রেমিকাকে এটা বেশ উপভোগ্য বস্তু। কোনক্রমে গনার খপ্পর থেকে পালিয়ে বুক ধুকপুক নিয়ে মালতী সটান চলে গেল ভূপিদের চকবাজারের ঠেকে। রাগে তার হাত পা কাঁপছে। এতদিন গলিঘুঁজিতে দুর থেকে দেখাদেখি চলছিল, এখন খোলা বাজারে তার হাত ধরতে আসছে মুশকো পাগলটা। মালতী জানে জে কে নগরের অনেক চ্যাংড়া তাকে কি চোখে দেখে। কিন্তু তাদের প্রানে ভূপির ভয় আছে – এই ভয় মালতীর রক্ষাকবচ। গনা উন্মাদ তার ভয়ডরও নেই। একলা পেয়ে গনা তাকে কি করতে পারে ভেবে মালতীর গা শিউরে ওঠে। এর একটা বিহিত করতে হবে তাকে।

চকবাজারে একটা কালিঝুলিতে বিবর্ণ চা সিঙ্গাড়ার দোকানে ভূপির ঠেক। এখানে তার চ্যালা চামুন্ডারা আড্ডা মারে। দোকানটা আসলে একটা মুখোশ মাত্র। চটের পর্দার পিছনে চলে সাট্টার আসর আর চোলাইমদের কারবার। এইগুলি ভূপি এন্ড কোম্পানীর সাইড বিজনেস। ভরদুপুরে মালতীকে দেখে ভূপির সাকরেদরা অবাক হয়ে গেল। মালতী দোকানের বাইরে থেকে তাদের একজনকে ডেকে বলল, “ভূপিভাই আছে?”

সাধারনত এই সময়ে ভূপির এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু আজ আচমকা চটের পর্দা ঠেলে ভূপি বেরিয়ে এল। তারসঙ্গে আরও জনাদুয়েক। “পার্সোনাল কথা আছে।” বলল মালতী। ভূপি হাতের ইশারায় লোকগুলোকে যেতে বলে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে মালতীকে দেখতে লাগল। আজ তার মুখে হিরোমার্কা হাসি নেই। মালতীর মুখে গনার বৃত্তান্ত শুনে সে চুপ করে রইল। মালতী এমনটা আশা করেনি। সে একটু দমে গিয়ে বলল, “দুচার থাপ্পড় দিলেই হবে। লোকে তোমার খিল্লি ওড়াচ্ছে, তাই বলছি।”

“আর ধর যদি নামিয়ে দিই?” আঙুলের ইশারায় গলা কেটে দেবার ভঙ্গি করে বলল ভূপি। তার বলার ভঙ্গির মধ্যে একধরনের শীতল নির্লিপ্ততা আছে। মালতী মাথা নেড়ে না বলল তাকে। ভূপিকে এই ব্যাপারটিতে ঢোকানো খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু গনাপাগলাকেও তার অসহ্য লাগছে।

ভূপি তারদিকে অপলক চেয়ে আছে দেখে মালতীর অস্বস্তি হতে লাগল। সে মাথা নিচু করে বলল, “কোন খুনখারাবীতে আমি নেই। তাহলে থাক, আমি বুঝে নেব।”

“কি করবি? পুলিশে খবর দিবি?”

“সে আমি বুঝব। যাই আমি।” মালতীর রাগ হয়ে গেল। ভূপির এমন নিরুত্তাপ আচরন মোটেই আশা করেনি সে। ভূপি মুখ বেঁকিয়ে হাসতে লাগল। তারপর ব্যাঙ্গ করে বলল, “কেন, তোর বিডিও সাহেব কে বল না!”

মালতী ঘুরে চলে আসতে যাবে ভূপি খপ করে তার হাত ধরল। সে হাত লোহার সাঁড়াশির মত শক্ত। মালতী বিকৃতমুখে বলে, “ছাড়ো। লাগছে!”

ভূপি দিনদুপুরে মালতীকে কাছে টেনে এনে তার কানে কানে বলল, “শাদি করব তোকে। পাগলে নজর দিচ্ছে।” মালতী হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে দেখে সে হিসহিস করে বলল, “সন্ধ্যে ছটায় কোল সাইডিংয়ে আয়। কথা আছে।” মালতীর শরীর গলে পড়তে লাগে। এই গা শিরশির করা বিপজ্জনক লোকটার সে দিওয়ানা। একে বিয়ে করে ঘর বসাবে সে।

একটু সেজেগুজে, চোখে কাজল পরে ছটার একটু আগেই কোলসাইডিংয়ে গিয়েছিল মালতী। তখনো আকাশে সূর্যের শেষ আলো লেগে আছে আর চারদিকে হলুদ কমলা আভা। সাইডিংয়র পাশের লম্বা ঘাসের জমির মধ্যে পড়ে থাকা পায়ে চলা পথ চলে গেছে জটার মন্দিরের দিকে। কোনকালে শিবের মন্দির ছিল ওখানে এখন ধ্বংসস্তূপ, পুরোনো দেউলে জড়াজড়ি করে আছে বট আর অশ্বত্থ গাছ। এমনিতেই এই জায়গাটা নির্জন আর ভূপির সঙ্গে এখানে দেখা করতে এলে সাইডিংয়ে অঘোষিত চারশোচুয়াল্লিশ ধারা লেগে যায়, দুদিকের পথ আটকে রাখে ভূপির চ্যালারা। জটার মন্দিরের ভাঙ্গা চাতালে গাছের নীচে সিমেন্ট বাঁধানো রোয়াকে ভূপি বসে বসে সিগারেট টানছিল। মালতী তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ভূপি সিগারেট ফেলে তার হাত ধরে টানল। আজ মালতীর থেকে বাধা নেই, তাদের বিয়ে হতে যাচ্ছে সামনেই, ভূপিকে সে আর ঠেকিয়ে রাখতে চায় না। আসন্ন অন্ধকারে নির্জন দেউলে দুটি শরীর ঘনসন্নিবদ্ধ হতে থাকে।

ব্যাপারটা যে আদর সোহাগের মত নেই সেটা বুঝতে মালতীর একটু দেরী হয়ে গেছিল। এমনিতেই ভূপির আদর একটু বুনো, মালতীর তা খুব যে খারাপ লাগে তেমন নয়। কিন্তু শাড়ির আঁচল গলায় পেঁচিয়ে ধরতে সে ভূপিকে ঠেলে বলল, “কি করছ, দম আটকে যাচ্ছে।”

ভূপি ততক্ষনে মালতীর দুইহাত পিছমোড়া করে ঠেসে ধরেছে। দাঁত দিয়ে তার কাঁচুলীর হাতা ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলে সে বলল, “দম নিয়ে নে ডাইন মাগী। পুলিশের কাছে চুকলি করা আজ খতম করে দেব।”

“কি বলছ কি যা তা! ছাড়ো বলছি!” মালতী ভূপির আলিঙ্গনের মধ্যে ছটফট করতে করতে বলল। উত্তরে ভূপি মালতীর শাড়ির আঁচল আরএক পাক জড়ায় তার গলায় আর হিসহিস করতে করতে বলে, “পুলিশের জাসুসি? আমার সঙ্গে? তোকে তো পরে মারব আগে তোকে ছিঁড়ে খাই কামিনি মেয়েছেলে।” সন্ধ্যের অন্ধকারে ঝটাপটি করতে থাকে দুজন। মালতীর চোখে অন্ধকার নামতে থাকে আর তার শরীরের গোপন গহ্বরে ভূপির হাত সাপের মত ছোবল মারতে থাকে। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়তে পড়তে মালতীর চৈতন্যের মধ্যে ঘুরপাক খায় একটিই প্রশ্ন, এমন তো হবার কথা ছিল না, ভূপিকে তো সে ভালোবেসেছিল?

আলোআঁধারিতে ভূপি যখন তার বুকের উপর চড়ে বসেছে তখন শেষবারের মত তার চোখে একবার তাকাতে গিয়ে মালতী দেখল, ভূপির মুখ হঠাৎ হাঁ হয়ে যাচ্ছে আর তার হাতের মুঠি হয়ে যাচ্ছে আলগা। তারপর যেন ম্যাজিকের মত ভূপির দেহ শূন্যে উঠে গেল। মালতীর বিস্ফারিত চোখের সামনে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠেছে গনাপাগলা। দুহাতে ভূপিকে তুলে সে ছুঁড়ে ফেলে। ভূপি আকস্মিক আঘাত সামলে উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ছুরি বার করে তেড়ে আসতেই গনা খপ করে ভূপির হাত ধরে ফেলে সজোরে মুচড়ে দিল। যন্ত্রনায় ভূপির মুখ বেঁকে গেল আর প্যাঁকাটিভাঙার মত শব্দ করে তার হাত ভেঙে ঝুলে পড়ল। খড়ের পুতুলের মত ভূপিকে একহাতে তুলে গনা ফের ছুঁড়ে ফেলে দিল দুরে। ট্রেনলাইনের ওপারে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল ভূপি। দুর থেকে মালগাড়ির হুইশল শোনা যায়, কয়লা রেক ঢুকছে কোল সাইডিংয়ে।

এই সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল মাত্র কয়েক মুহূর্তে, কিন্তু মালতীর মনে হয়েছিল সে যেন ফিলিমের স্লোমোশান দেখছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বুকের কাছে ছেঁড়া জামাকাপড় টেনে নিয়ে কোনঠাসা পশুর মত ঘসটে ঘসটে দেউলের দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল সে। গনা তার দিকে হেঁটে এল। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে তৈরী হচ্ছিল মালতী। প্রেমিকের হাতে রেপ হলেও যা পাগলের হাতে রেপ হলেও তাই। সে কেবলমাত্র একটি শরীর। আর দুটি পশু তাকে ছিঁড়ে খাবার জন্যে মারামারি করছে। হাতড়ে হাতড়ে একটা আধভাঙা ইঁট নিয়ে শেষ লড়াইয়ের জন্য তৈরী হয়ে সে চোখ খুলল।

দুহাত দুরে সিমেন্টের চাতালের উপর বাবু হয়ে বসে আছে গনা। অন্ধকারে তার দাড়ি গোঁফে ঢাকা মুখ খুব স্পষ্ট ঠাহর হয় না। সে দুলে দুলে গাইছে, রামজিকি মায়া কাঁহি ধুপ কাঁহি ছায়া। এই গান পনের ষোল বছর আগে সরসতিয়ার মা গাইত। বিদ্যুৎঝলকের মত ছোটবেলার কথা মনে পড়ল মালতীর। মনে পড়ল হাফপ্যান্ট পরা গনেশের কথা। এমনভাবে মনে পড়ল যেন পূর্বজন্মের কথা। গান থামিয়ে গনা বলল, “খারাপ লোককে পিটে দিয়েছি। মালতী আর ভয় নেই।”

আট ন বছর বয়সে একরাশ দুঃখের উপর পাথর চাপা পড়েছিল। সেই পাথর ভেঙে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত কান্না এল মালতীর। কান্নাভেজা গলায় সে বলল, “পালা। পালিয়ে যা গনেশ।”

গনেশ মাহাতো পাছা ঘসে ঘসে মালতীর পাশে এসে বসে বলল, “কেন? পালাব কেন? ঘর যাব।”

 মালতী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বেশ। যা ঘরে যা। এখানে থাকিস না।”

গনা দুহাত দিয়ে ইকড়ি মিকড়ি খেলতে খেলতে বলল, “ওখানে সরসতিয়া আছে? মা আছে?” মালতী দুহাতে গনেশের মুখ ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “আমার কথা শুন গনেশ। চলে যা।”

“তাহলে বলে দে কোন রাস্তা দিয়ে যাব। আমি রাস্তা ভুলে গেছি।”

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল লোকগুলো। মালতী চিৎকার করে বলল, “রামজির দোহাই ওকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও।” কান্নার চোটে হেঁচকি উঠতে লাগল তার। চারজন মিলে গনাকে চেপে ধরে ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে দিল লোকগুলো। গনার গলা দিয়ে ফরফর করে একটা শব্দ হতে লাগল। মাটিতে আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগল মালতী বাউড়ি। আর এইসব শব্দ ছাপিয়ে ঝড়াং ঝড়াং করে কোল সাইডিংয়ের লাইনে এসে পড়ল কয়লাভর্তি রেক। খুবই ধীরগতিতে যাচ্ছে সেই গাড়ি। প্ল্যান ছিল এই গাড়ি থেকে তামার তার নামানো হবে। তার বদলে সকলে ধরাধরি করে গনার বডি কয়লা ওয়াগনে তুলে দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মালতীর চোখের সামনে দিয়ে এক প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মত গড়াতে গড়তে যেতে লাগল কয়লার ওয়াগন।

[শেষ]

<<<<< বড়গল্প সংকলনে ফিরুন

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!