হারানো নদী


পঞ্চান্ন বি হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীটের দুকামরার আবাসনের জানলা দিয়ে যে জলধারা দেখা যেত তাকে শৈশবে আদিগঙ্গা নামে জানতাম। সেই শীর্ণকায়া নদী বয়ে যেত আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের বিশাল উঁচু লাল রঙের পাঁচিলের পাশ দিয়ে, সেন্ট্রাল জেলের একটা অতিকায় অশ্বত্থ গাছ ঝুঁকে পড়ে সে নদীকে পাহারা দিত, পাশেই কুয়াশামাখা গাছগাছালির ফাঁকে দেখা যেত জেলগ্রাউন্ড, জেলগ্রাউন্ডের পিছনে চব্বিশ পরগনার জেলা শাসকের বাংলো (তখনো উত্তর দক্ষিণ ভাগ হয় নি বোধহয়)। জানলার লোহার শিকে গাল ঠেকিয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখতাম সেন্ট্রাল জেলের পিছনে আধেক দৃশ্যমান এক ঢালু চালের বিশাল ভবন, যার মাথায় উড়ছে তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। ঐ বয়সে মা ছিলেন আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মালিক (অজস্র প্রশ্ন ছিল, যা থামতে চাইত না, ফলে আমাকে থাবড়ে ঘুম পাড়াতে হত) – তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম ঐ বাড়ির নাম অ্যান্ডারসন হাউস। এখন জানি এ হল ভবানীভবন। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীট সেই নদীর পাশে পাশে চলেছে, যেন গল্প করতে করতে। রাস্তার সংলগ্ন পাড় বরাবর পর পর ইঁটের গোলা আর সুরকি কল আর সারি সারি ঘাট। বলরাম বসুর ঘাট, আমাদের জানলার ঠিক উল্টোদিকে মস্ত খিলানওলা টাকির জমিদারদের ঘাট, শীতলা মন্দিরের ঘাট, হিন্দু মিশনের ঘাট আর ট্রামরাস্তা পেরিয়েই কালীঘাট! এত ঘাটের সমারোহে একথা মানতে অস্বীকৃত ছিলাম যে এই আদিগঙ্গার আরেক নাম টালির নালা। নালা? ছিঃ, নালা আবার কি? এতো রীতিমত জোয়ার ভাঁটা খেলা নদী!

একথা ঠিক, ভাঁটার সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে হাফপ্যান্ট খুলে মাথায় নিয়ে হাঁটুজল, কোমরজল পেরিয়ে এই আদিগঙ্গার ওপারে জেলগ্রাউন্ডে খেলতে যাওয়া যেত। কিন্তু এও তো সত্যি ছিল যে জোয়ার এলে এই নদী হত টাপুটুপু, চোদ্দআনি পুল, মানে যাকে এখন লোকে ধনধাণ্যে সেতু বলে জানে, সেখান থেকে ডানপিটে ছেলের দল হাহা করে হাসতে হাসতে ঝাঁপ খেয়ে সাঁতার কেটে কালীঘাট পর্যন্ত চলে যেত। একথাও সত্যি ছিল যে এই আদিগঙ্গায় রোজ দুবার করে জোয়ার ভাঁটা হত, ষাঁড়াষাঁড়ির বান এলে জল উপছে রাসবিহারীর মোড় পর্যন্ত চলে যেত। কে একে নালা বলে? হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের দুকামরার ঘরে ঘুম ভেঙ্গে শুনতাম ধপ ধপ শব্দ, মানে আদিগঙ্গায় নৌকা লেগেছে, তারা বয়ে এনেছে বালি আর ইঁট। মজুররা লম্বা কাঠের পাটাতন ফেলে মাথায় করে ইঁট নিয়ে এসে নন্দীবাবুর গোলায় ফেলছে। একথা তো সত্যি যে আমি এই আদিগঙ্গায় পালতোলা নৌকা দেখেছি জানলায় বসে। একবার খুব হই হই হল যে বলরাম বসুর ঘাটে নাকি পাথর উঠেছে! ছুটে গিয়ে দেখেছিলাম অনেক লোকের ভিড় আর গম্ভীর চেহারার কিছু লোক আতশকাঁচ দিয়ে একটা মশলাবাঁটা শিলের মত পাথর দেখছে। ওতে নাকি খুব পুরোনো বাংলায় লেখা আছে এই ঘাটে সতীদাহ নিষিদ্ধ করা হল!

তাই আমি কোনদিন এই নদীকে টালিনালা বলে মানতে পারিনি। খালি আমি নয় কেউই মানত বলে মনে হয় না। এই আদিগঙ্গার ইষৎ কালো ইষৎ ঘোলা জল না হলে নাকি পূজোই হয় না। পরে জেনেছি, হেস্টিংসের কাছে দইঘাট, যার উল্টো দিকে হাওড়ার বেতোড়, সেখান থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত গঙ্গার জলে পূজোআচ্চা হয় না। আমার বাল্যকালের মাস্টারমশাই অজিতবাবুকে প্রশ্ন করায় তিনি অবঞ্জাসূচক নাক কুঁচকে বলেছিলেন, দুর পাগল ওটা কি গঙ্গা নাকি, ওতো আলিবর্দি খানের (একদা বাংলার নবাব, সিরাজদ্দৌলার মাতামহ) কাটা খাল। গঙ্গা তো হল আমাদের আদি গঙ্গা। এমন বিস্ময়কর কথা জীবনে শুনিনি। ছোটবেলায় বাটানগরের গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে বিস্তির্ণ জলরাশির দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, এ তাহলে গঙ্গা নয়, আমার বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া শীর্ণ নদী, লোকে যাকে টালিনালাও বলে, সে-ই আসলে গঙ্গা? শিবের ঝুঁটি থেকে নেমে এসে লোকের বাড়ির উঠোনের পাশ দিয়ে বইছে?

নদীকে নিয়ে এই এক মুশ্কিল। সে তার হাজার হাজার বছরব্যাপী প্রাগৈতিহাসিক জীবনে আপনমনে বয়, পথ বদলায়, পুষ্ট হয় নয়তো ক্ষীণ হতে হতে হারিয়েই যায়। মানুষ বড় আশায় তার তীরে ঘর বাঁধে, ভালোবাসে, তার অধিকার নিয়ে লড়াই ঝগড়া করে, তারপর একদিন দেখে আস্ত নদীটাই উধাও। নদীর জীবনে মানুষের জীবন চোখের পলকের মত। এই আছে এই নেই।

এইভাবে একদিন আদিগঙ্গাও হারিয়ে গেছে। একে খুঁজে পেতে পুনরুদ্ধার করার জন্য অনেক চেষ্টা চরিত্তির করা হচ্ছে বটে, কোটি কোটি টাকাও খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু যে হারিয়ে গেছে, তাকে পাওয়ার আশা দুরাশা। আমরা বরং তার স্মৃতিটুকু খুঁজে দেখি।

নদীর সঙ্গে আমার নাড়ীর যোগ আছে মনে হয়। জন্মেছি মেদিনীপুরের গড়বেতায়, কিন্তু ছমাস বয়সে সেই যে মা কোলে করে আমাকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটে এনে তুললেন, তারপর থেকে নদী আমার পিছু ছাড়ল না, আর আমিও তার আঁচলছাড়া হলাম না। শৈশব, কৈশোর তো আদিগঙ্গার পাড়েই কাটল, যৌবন বয়সে সেই নদীরই প্রেমে পড়লাম। আমার পেশাদার কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গেল হুগলী নদী, তার ঢেউ গুনে গুনে জীবন কেটে গেল। সত্যি কথা বলতে এই নদীই আমাকে খাইয়ে পরিয়ে রেখেছে। এক দুবার মারতেও যে চায় নি তা নয়, তবে শেষ পর্যন্ত ছেড়েও দিয়েছে। নদীর সঙ্গে কাজের সুবাদে তাকে বুঝেছি কিছুটা। সে বোঝা খানিকটা বিজ্ঞান নির্ভর অনুমান আর, এখন মাঝে মাঝে অনুভব করি, বাকিটুকু একরকমের প্রবৃত্তি – যা কোন জীবন্ত জিনিসের সঙ্গে কালাতিপাত করলে জন্মায়।

আদিগঙ্গার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলতে হচ্ছে কারণ নদীর জীবন বোঝাও একটু প্রয়োজন। একটা জিনিষ সবাই বোঝে যে নদীর উৎপত্তি হয় উঁচু জায়গায় আর নিষ্পত্তি হয় অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায়। এই উৎপত্তিস্থল যদি এমন হয় যে সেখান থেকে অনবরত জল আসছে তাহলে নদী হয় সদাপ্রবাহমান, আর যদি উৎপত্তিস্থল এমন হয় যে বৃষ্টির জলেই সে পুষ্ট, তাহলে নদী বর্ষাকালে দুকুল ছাপিয়ে বইতে থাকে আর বছরের অন্যসময় যায় শুকিয়ে। কিন্তু বড় বড় সব নদী, যেমন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং বা ভোলগা এরা শরীরে অসংখ্য উপনদী ধারণ করে; এদের নিজস্ব জলের যোগান তো আছেই, উপনদীগুলি উপত্যকা ঝাঁটিয়ে বৃষ্টির জল এনে এদের মধ্যে ফেলে। এ পর্যন্ত বেশ সহজবোধ্য ব্যাপার।

যেটা প্রহেলিকার মত তা হল নদীর আঁকাবাঁকা চলন আর পথ পরিবর্তন। যেহেতু শিকারী জোগাড়ে মানুষ দশ পনের হাজার বছর আগে নদীর তীরেই প্রথম আবাদ করে গেরস্থ হয়েছিল, সেই সময় থেকে সে নদীর প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছে। নদী তাকে অবিশ্বাস্য সমৃদ্ধিও দিয়েছে আবার ঘরদোর ভাসিয়ে ফৌত করেও ছেড়েছে। উত্তর না পেয়ে নদীকে মানুষ দার্শনিকের দৃষ্টিতে দেখেছে, কবিরা একে নারীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, নদীমাতৃক মানুষ নদীকে নিয়ে গান বেঁধেছে। না বোঝার থেকে সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস্য এক সংস্কৃতি, যা কেবল মানুষের দ্বারাই সম্ভব। বিজ্ঞানীরাও এনিয়ে মাথা ঘামান নি তা নয়, স্বয়ং আইনস্টাইন নদীর বক্রী গতিপথ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন আর তৈরী হয়েছে রিভার হাইড্রলিকস নামে এক গবেষণা। এসব বড় জটিল ব্যাপার। খুব সহজ করে বলা যায়, নদীর প্রবাহে সঞ্চিত থাকে শক্তি, প্রকৃতির নিয়মে যা সাগরে পড়ার আগে খরচ করে ফেলতে হবে। শর্টকার্ট ধরলে সেই শক্তি সম্পূর্ণ ব্যয় হবে না, তাই নদী এঁকে বেঁকে চলে চলার পথের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে নিতে চায়। অনেকটা মানুষের মত – জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে তার বড্ড বাড় বাড়ে, নইলে সঞ্চিত শক্তি ব্যায় হবে কি করে? এই এঁকে বেঁকে চলতে চলতে পথ পাল্টানো নদীর নিয়তি, এই নিয়তির নির্দেশে আজ যা বিপুল বেগবান বিস্তৃত জলধারা তা একদিন মজে গিয়ে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। আবার এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে এখন নদীর যে চেহারা দেখছি তা চিরকালই একই রকম ছিল। আদিগঙ্গার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই সত্যটি মাথায় রাখলে ভালো।

রমেশ চন্দ্র মজুমদারের বাংলার ইতিহাস থেকে জানা যায় ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে গঙ্গা, ভাগিরথী, হুগলীর চেহারাটি মোটেই এখনকার মত ছিল না। ত্রিবেনীতে ভাগিরথী তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল; একটি শাখার নাম ছিল সরস্বতী এটি দক্ষিণ পশ্চিম দিকে কিছুদুর বয়ে আবার দক্ষিণমুখী হয়েছিল, একটি শাখার নাম ছিল যমুনা যেটি দক্ষিণ পূর্ব দিকে ধাবিত হয়ে বর্তমান খুলনায় প্রবেশ করেছিল আর ভাগিরথীর মূল ধারাটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বয়ে এসেছিল গোবিন্দপুর পর্যন্ত, যে স্থানটি বর্তমানে দইঘাট বলে পরিচিত (আরো সহজ করে বললে হেস্টিংস) যার অপর পারে হাওড়ার বেতোড়। দইঘাটের কাছে ছোট লোহার ব্রিজটি এখন যেখানে আছে, যার উপরে দাঁড়ালে শীর্ণ আদি গঙ্গাকে হুগলী নদীর থেকে খুব কুন্ঠিতভাবে বিভক্ত হয়ে আসতে দেখা যায় আর দেখা যায় বিপুল চওড়া হুগলী নদী গার্ডেনরিচের দিকে পশ্চিমমুখো বেঁকেছে, সেখানে শচারেক বছর আগে কেউ দাঁড়ালে সম্পূর্ণ অন্য দৃশ্য দেখত। সে দেখত ভাগিরথীর মূল জলধারা ইষৎ পূর্বমুখী হয়ে বইছে আদিগঙ্গায় আর একটি তুলনায় অপ্রশস্ত শাখা চলে গেছে পশ্চিম মুখী। এই অপ্রশস্ত শাখাটি গেছে সাঁকরাইল পর্যন্ত যেখানে উত্তর থেকে নেমে আসছে সরস্বতীর মূল ধারা, বহরে যে প্রায় ভাগিরথীর মতই। উল্লেখনীয় ব্যাপার হল সাঁকরাইল থেকে ময়াপুর, রায়পুর, নৈনান, নুরপুর হয়ে যে নদীকে আমরা এখন হুগলী বলে চিনি তা আদতে সরস্বতীর নিম্নভাগ মাত্র। এই অংশকে পূর্বে কেউ গঙ্গা বলে মানেনি। বেতোড় থেকে সাঁকরাইল, এই সঙ্কীর্ণ নদীখাত যা ছিল ভাগিরথী আর সরস্বতীর মধ্যে একটি যোগাযোগ, লোকমুখে কথিত একেই বাংলার নবার আলিবর্দি খাঁ বাহাদুর সংস্কার করে চওড়া করেছিলেন। অনেকে মনে করেন এ কারণেই হুগলীর প্রধান প্রবাহ পশ্চিম দিকে ঘুরে গার্ডেনরিচ বজবজ হয়ে সাঁকরাইলের দিকে চলে যায় আর তারজন্যই আদিগঙ্গার শেষপর্যন্ত মৃত্যু হয়।

মানচিত্র ১

তবে এমন ধারণা কতদূর সত্য বলা কঠিন। মজার ব্যাপার হল নদী এমন ধোঁকা দিয়েই থাকে। ত্রিবেণীর থেকে নির্গত হয়ে সুপ্রশস্তা সরস্বতী ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত লালন করেছিল সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ ও বন্দর সপ্তগ্রামকে, কিন্তু ক্রমে সরস্বতীর উপরিভাগ (ত্রিবেণী থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত) শুকিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। পর্তুগীজরা হুগলীতে স্থাপন করল নয়াবন্দর পোর্তো পিকেনো। হুগলী নামটিই তর্কসাপেক্ষে পর্তুগীজ উগোলিম থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। এই হুগলী বন্দরও টিকল না কারণ হুগলী নদী ক্রমশই পূর্বদিকে সরে ক্ষীণ হয়ে গেল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজরা কলিকাতা, সুতানুটি আর গোবিন্দপুর গ্রাম সাবর্ণ জমিদারদের থেকে কিনে কলিকাতায় হুগলী নদীর তীরে বন্দর গড়তে লাগল।

মানচিত্র ২

এখানে বেশ চিত্তাকর্ষক একটি ইতিহাস আছে। এবং ইতিহাসটি প্রাক কলিকাতা বন্দরের।একসময় কলকাতায় সাহেবদের জাহাজ আদিগঙ্গা আর হুগলী সরস্বতী এই দুপথ ধরেই আসত। তবে বাংলার অন্তর্বানিজ্য চলত আদিগঙ্গা ধরেই। পঞ্চদশ, যোড়শ শতাব্দীর পালতোলা জাহাজ ছিল বড়সড় নৌকার মত, এদের জন্য আদিগঙ্গার প্রস্থ যথেষ্ট ছিল। হুগলী সরস্বতীর পথে কলিকাতা নামক অস্বাস্থ্যকর নগন্য গ্রামে বানিজ্য করতে আসার কোন প্রয়োজন স্থানীয় মানুষের ছিল না। মূল বানিজ্য সরস্বতী নদীপথে সপ্তগ্রামে চলে যেত। আদিগঙ্গা ছিল কিছুটা অন্তর্বানিজ্য আর কিছুটা তীর্থযাত্রার পথ। ইয়ুরোপীয় অভিযাত্রীরা বাংলার সুপ্রাচীন এই নদীযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল, যার ফলশ্রুতি প্রথমে হুগলী বন্দর (পর্তুগীজ ও ওলন্দাজ) ও পরে কলিকাতা বন্দর (ইংরেজ)। আদিগঙ্গার মূল মাহাত্ম্য ছিল ধর্মীয় তীর্থ, এ পথ গিয়ে শেষ হত গঙ্গাসাগরে। ইয়ুরোপীয় অভিযাত্রীদের আদিগঙ্গাকে রক্ষা করার কোন তাগিদ ছিল না। টলি সাহেব আদিগঙ্গাকে সংস্কার করেছিলেন টোল আদায়ের জন্য। পরের পর্যায়ে আমরা আদিগঙ্গার নিজস্ব ইতিহাসটি নেড়ে চেড়ে দেখব।

আদিগঙ্গার সঙ্গে মিশে আছে বহু জনশ্রুতি, আচার-বিশ্বাস আর মধ্যযুগের সাহিত্য। এর মধ্য থেকে ইতিহাসটি উদ্ধার করা কঠিন। মোটামুটি নিশ্চিতভাবে যেটা বলা যায়, তা হল এটি একটি সুপ্রাচীন নদী যা একসময়ে ভাগিরথীর অধিকাংশ জলধারা বহন করে বঙ্গোপসাগরে ফেলত। সে সময়ে সরস্বতী নদী ত্রিবেণীর থেকে বিভক্ত হয়ে ভাগিরথীর আরেক অংশ জল বয়ে নিয়ে আসত এবং সাঁকরাইলের দক্ষিণে আদিগঙ্গা আর সরস্বতী মোটামুটি সমান্তরালভাবে সাগর মোহনায় এসে উপস্থিত হত। এইসময় সাগর থেকে বাণিজ্যপোত দুটি পথে প্রবেশ করত, যাদের গন্তব্য সপ্তগ্রাম তারা সরস্বতী নদীপথে সরাসরি সেখানে পৌঁছাত। কিন্তু অন্তর্বাণিজ্য ও তীর্থ-পরিবহন চলত আদিগঙ্গা বরাবর। প্রাচীনকাল থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এই ছিল পরিস্থিতি।

আদিগঙ্গা যত না বাণিজ্য তারচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল ধর্মীয় কারণে। হিন্দু সনাতনধর্মীরা একেই পতিত পাবনী বলে জানত, তাদের বিশ্বাস ছিল গঙ্গাস্নানে সব পাপ ধুয়ে যায়, এমনকি মৃত্যুর পর দাহসৎকারও গঙ্গার তীরেই করা হত। পুরো আদিগঙ্গার তীরসংলগ্ন অঞ্চল যাকে strandline বলে স্নানের ঘাট আর মন্দিরে মন্দিরে পূর্ণ। এখনো খেয়াল করলে দেখা যায়, নেহাৎ হালের ইলেকট্রিক চুল্লি ব্যতীত, সাঁকরাইল নিম্নবর্তী হুগলীর তীরে তেমন পুরোনো শ্মশান বা মন্দির নেই। ধর্মীয় সংস্কার, স্থানীয় পরিবহন এবং অন্তর্বাণিজ্য এই তিনটি কারণে প্রাচীনকাল থেকেই আদিগঙ্গা এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে সপ্তগ্রাম বন্দরের নাব্যতা হ্রাস পেতে শুরু করল, পর্তুগীজরা তাদের পোর্তো পিকেনো হুগলীর দিকে সরিয়ে নিতে লাগল। হুগলীর নিচে চুঁচুড়ায় ওলন্দাজরা আর হুগলীতে পর্তুগীজরা তখন সরস্বতী নদীপথে যে জাহাজগুলি আনত সেগুলি নাব্যতার অভাবে সাঁকরাইলের কাছে এসে নোঙর ফেলে দাঁড়াত। সাঁকরাইল থেকে বেতোড় মোটে ছ মাইল, এই ছমাইল দুরে কলিকাতার কাছে বইছে প্রশস্ত আর গভীর হুগলীনদী, কিন্তু মধ্যবর্তী অগভীর ও অপ্রশস্ত জলপথটির জন্য জাহাজ থেকে পণ্য নামিয়ে ছোট নৌকায় তুলতে হচ্ছে। ক্রমে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে ব্রিটিশরা কলকাতায় বন্দর পত্তন করার পর এই সমস্যাটি একটি অর্থরাজনৈতিক চেহারা নিল। ইয়ুরোপীয় বাণিজ্যপোতগুলিকে এই সমস্যার থেকে উদ্ধার করার জন্য, এবং অবশ্যই নবাবী নৌবাণিজ্য আদায়ের জন্য অবশেষে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ওলন্দাজদের সহায়তায় বাংলার তৎকালীন নবাব আলিবর্দি খান খিদিরপুর থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত একটি খাল কাটলেন বলে কথিত আছে। এর অব্যবহিত পরেই ভাগিরথী-হুগলীর মূল জলধারা আদিগঙ্গাকে পরিত্যাগ করে সরস্বতীর দিকে ধাবিত হল। লোকমুখে গার্ডেনরিচ সাঁকরাইল অঞ্চলের মানুষ এখনো হুগলীর এই অংশকে কাটিগঙ্গা, কাটাগঙ্গা বা খাটাগঙ্গা বলে থাকে। এখনো ধর্মপ্রাণ হিন্দু গার্ডেনরিচ থেকে রুপনারায়নের মোহনা পর্যন্ত হুগলীনদীর জলকে গঙ্গার জলের মত পবিত্র মনে করে না। এমন একটি বিশ্বাস এখনো বর্তমান আছে যে আদিগঙ্গা ও সরস্বতী নদীর উপরিভাগ শুকিয়ে যাবার কারণ হল এই কাটিগঙ্গা।

এই বিশ্বাস জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু এর খুব একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তেমন কিছু নেই। প্রথমত, হুগলীর সঙ্গে সরস্বতীর এই কৃত্রিম যোগ সেই সময় খুব প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, আলিবর্দি উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প গড়তে পছন্দ করতেন, সেগুলি অনেকাংশেই তেমন দাঁড়াত না, যেমন মারাঠা খাল। এই কাটিগঙ্গার জন্যই ভাগিরথীর জলধারা চিরকালের মত আদিগঙ্গা ছেড়ে সাঁকরাইলের দিকে চলে গেল, আধুনিক নদী বিজ্ঞানের চোখে এ ঘটনা অতিসরলীকৃত মনে হয়। তৃতীয়ত, তথ্য প্রমানে আভাস মিলছে, ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে আদিগঙ্গা প্রাকৃতিক কারণে শুকিয়ে আসছিল। সুতরাং ভাগিরথীর প্রবাহ সাঁকরাইলের দিকে ঘুরে যাওয়া, আধুনিক বিচারে, প্রাকৃতিক।

এই প্রাকৃতিক অবশ্যম্ভাবিতাকে মেনে নিলে আদিগঙ্গার চিত্তাকর্ষক প্রাচীন ইতিহাস আমাদের কাছে সহনীয় হবে। আদিগঙ্গা একটি মিথ নয়, আধুনিক উপগ্রহচিত্রে হেস্টিংস থেকে প্রায় কাকদ্বীপ পর্যন্ত তার প্রাচীন নদীখাত, যাকে প্যালিওচ্যানেল বলা হয়, আবিস্কৃত হয়েছে। ১৫০ খৃষ্টাব্দে টলেমি, ১৫৫০ খৃষ্টাব্দে জাও দি বারোস, ১৫৬১ খৃষ্টাব্দে গাস্তাল, ১৬১৪ খৃষ্টাব্দে সিজার ফ্রেডেরিক, ১৬২০ খৃষ্টাব্দে মার্কাটার, ১৬৬০ খৃষ্টাব্দে ভ্যান ডি ব্রুক সহ বহু মানচিত্রকার তাদের আঁকা মানচিত্রে আদিগঙ্গার গতিপথ উল্লেখ করেছে। সবচেয়ে প্রামাণ্য ও বেজ্ঞানিক মানচিত্রটি ১৭৭৬ সালে এঁকেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইঞ্জিনীয়ার মেজর জেমস রেনেল। সব কটি মানচিত্র প্রামাণ্য না হলেও এগুলি একত্র করে দেখলে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে আদিগঙ্গার ক্রমক্ষীয়মান চিত্রটি উদ্ভাসিত হয়।

আদিগঙ্গার সামাজিক গুরুত্ব অনুধাবণ করা যায় মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে। বিপ্রদাস পিপলাইএর মনসাবিজয় বা মনসামঙ্গল, বৃন্দাবনদাসের চৈতণ্যভাগবত, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চন্ডীমঙ্গল আর কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল আদিগঙ্গার তীরবর্তী জনপদগুলির নাম উল্লেখ করেছে যার অনেকগুলি এখনো বর্তমান এবং উপগ্রহচিত্র স্হানগুলিকে প্যালিওচ্যানেলের উপরে নির্দিষ্ট করছে। এমনকি বহু অপ্রধান মধ্যযুগীয় সাহিত্য, যেমন অযোধ্যা রামের সত্যনারায়ণ কথা, হরিদেবের শীতলামঙ্গল কিংবা দ্বিজ নিত্যানন্দের কালু রায়ের গীতেও আদিগঙ্গার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রসিত রায়চৌধুরী তাঁর ‘আদিগঙ্গার তীরে – চব্বিশ পরগণার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন বেহুলা তার মৃত স্বামীকে নিয়ে ভেলায় চেপে যে গাঙুড়ের জলে ভেসেছিল, তা এই আদিগঙ্গা। এখনো বোড়ালের শ্মশানে লক্ষীন্দরের মন্দির এই জনশ্রুতির সাক্ষ্য বহন করছে। মনসা মঙ্গলের চাঁদ সদাগরের কাহিনী যদি কাল্পনিকও হয়, সেই কল্পনা জনমানসে একসময় সত্যি ছিল, নতুবা মানুষ মন্দির কেন গড়বে? তবে কেবল এইরকম একটি নয়, আদিগঙ্গার তীর বরাবর ইতিহাস আর জনশ্রুতির ছড়াছড়ি। চৈতণ্য ভাগবতে বলা হয়েছে মহাপ্রভু আদিগঙ্গায় নৌকাপথে অতিসার গ্রামে (অধুনা বারুইপুর) পৌঁছে ১৫১০ সালের ১৪ই ফাল্গুন সেখানে সাধু অনন্তরামের গৃহে রাত্রিযাপণ করেন। ঐ রাত্রিব্যাপী কীর্তণ হয়েছিল, বারুইপুরের মানুষ ৫০০ বছর ধরে ১৪ই ফাল্গুন সারারাত কীর্তন গেয়ে আসছে। এখানে হালে একটি মন্দিরও নাকি হয়েছে।

আদিগঙ্গার গতিপথ নির্দেশ করে বহু পরিচিত স্থান। উদাহরণস্বরুপ টালিগঞ্জের কাছে করুণাময়ী যেখানে আছে একটি বহুপ্রাচীন মন্দির। অথবা বোড়ালের ৭ম শতাব্দীর কষ্ঠিপাথরের নারায়ণ বিগ্রহ এবং ১২শ শতাব্দীর ত্রিপুরসুন্দরীর মূর্তি, কিংবা মহামায়াতলার ১৩শ শতাব্দীর কালীমন্দির। রাজপুরে আছে প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি মদন মল্লের পত্তন করা আনন্দময়ীর মন্দির, যেখানে বসে বিভূতিভূষণ চাঁদের পাহাড় লিখেছিলেন। হরিনাভিতে আছে নবীন ঘোষের দুর্গামন্দির, কোদালিয়ায় বাস করতেন সুভাষ চন্দ্র বসুর পূর্বপুরুষ, চাংড়িপোতায় (অধুনা সুভাষগ্রাম) সুভাষচন্দ্রের পূর্বপুরুষ পুরন্দর খান একসময় এক বিখ্যাত দিঘী খনন করিয়েছিলেন। আদিগঙ্গার তীরবরাবর ইতিহাস আর জনশ্রুতি হাত ধরাধরি করে আছে। আদিগঙ্গা রাজপুর, সোনারপুর, কোদালিয়ার মানুষের কাছে এতদূর পবিত্র ছিল যে তারা শুকিয়ে যাওয়া নদীখাতে দিঘী পুকুর কাটিয়ে সেই জলকে গঙ্গাজল মনে করে পূজো করত। ১৮৬০ সালে কবি দীণবন্ধু মিত্র তার সুরধুনী কবিতায় লিখেছিলেন:

“রাজপুর, কোদালিয়া, মালঞ্চগড়ে

গঙ্গার নয়ননীরে গঙ্গা ঘরে ঘরে।”

আমার শৈশবের আদিগঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে ডানদিকে তাকালে দুরে আবছা চোদ্দআনি পুল দেখা যেত। ঐ দিক থেকে জোয়ার আসত। বালক বয়সে হাঁটতে হাঁটতে চোদ্দআনি পুল পেরিয়ে দেখতে চলে গিয়েছিলাম জোয়ারের জল কোথা থেকে আসে। নাম না জানা রাস্তা আর বুক ছ্যাঁৎ করা অনেকগুলো মোড় পেরিয়ে, চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে, খিদিরপুর নামে এক জনবহুল অঞ্চল পেরিয়ে এসে পৌছেছিলাম দইঘাটের কাছে একটা লোহার ব্রিজে, বহু পুরোনো ব্রিজ নাম ঢোলঘাট ব্রিজ, যার উপর দিয়ে মেরিন হাউসের দিকে চলে যাওয়া যায়, সেই ব্রিজ থেকে স্পষ্ট দেখা যায় আদিগঙ্গা হুগলীনদী ছেড়ে শহরের ভিতরে ঢুকেছে। খুব অনাড়ম্বর সেই প্রবেশ। শৈশবের সেই অ্যাডভেঞ্চারে যা দেখেছিলাম তার সঙ্গে ভ্যান ডি ব্রুকের মানচিত্র মেলানো মুশকিল। সেখানে আদিগঙ্গার মুখ কমবেশি তিন কিলোমিটার চওড়া। সময় বড় প্রতারক!

জানার ইচ্ছে ছিল বাঁদিকে আদিগঙ্গা কোথায় গেছে। কালীঘাট পেরিয়ে? টালিগঞ্জ পেরিয়ে? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পেরিয়ে যাওয়ার পরিধি বাড়ছিল, তরুণ বয়সে কুদঘাট, তারপর যুবক বয়সে গড়িয়া পর্যন্ত আদিগঙ্গাকে ধাওয়া করেছিলাম। তখনো গড়িয়া কামালগাজির ঢালাই ব্রিজ হয় নি, সরু হলেও বেশ স্পষ্ট ছিল আদিগঙ্গা। তারপর কপালগুনে এমন জায়গায় কাজ জুটল যেখানে নদীর সঙ্গে নিত্য কোলাকুলি। ততদিনে জানা গেছে যে হেস্টিংস থেকে গড়িয়া পর্যন্ত ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হয়ে এলেও আদিগঙ্গাকে চেনা যায়। তারপরেই একটু বিপত্তি। সেই থেকে আদিগঙ্গার মোহনা খুঁজে বেড়াচ্ছি।

আদিগঙ্গা মজে আসছে দেখে ফোর্ট উইলিয়ামে কর্মরত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মেজর উইলিয়াম টলি ১৭৭৫ সালে সরকার বাহাদুরের সঙ্গে ড্রেজিং চুক্তি করলেন। ঠিক হল সরকার টলি সাহেবকে এক লক্ষ টাকা ধার দেবেন, বিনিময়ে তিনি স্বীয় খরচে আদিগঙ্গার সংস্কার করবেন। এই চুক্তি হল ১২ বছরের জন্য, ঠিক হল সংস্কার করা আদিগঙ্গায় যা পন্যপরিবহন হবে তার ওজন পিছু টলি সাহেব টোল আদায় করবেন। টলি সাহেব কাজ তো শুরু করলেন কিন্তু আদিগঙ্গা গেছে কোথায়? গড়িয়া পর্যন্ত সংস্কার করে সাহেব দেখলেন আদিগঙ্গা গেছে রাজপুর সোনারপুর হয়ে বারুইপুরের দিকে। টলি সাহেব সেদিকে না গিয়ে একটি খাল বরাবর পূবমুখো চলে আদিগঙ্গাকে শামুকপোতার কাছে বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। ১৭৭৭ সালে কাজ শেষ হলে হেস্টিংস থেকে শামুকপোতা পর্যন্ত মোট ২৭ কিলোমিটার সংস্কার করা এই নদীপথটিকে বলা হল টলির নালা। তখনকার মত কাজ মিটল। সুন্দরবনের ক্যানিং থেকে বিদ্যাধরী হয়ে নৌকাবোঝাই চাল, সব্জি, পাট ও অন্যান্য পণ্য টালি নালায় ঢুকে শহরে ব্যবসা করে হুগলীতে পড়ে খিদিরপুর বা আরও উত্তরে যেত আবার ফিরতি পথে ক্যানিং থেকে কালিন্দী নদী ধরে খুলনার বসন্তপুর হয়ে বরিশাল পর্যন্ত চলে যাওয়া যেত। সাহেবের ঘরে ঝনঝন করে পড়তে লাগল চুঙ্গির পয়সা। গোবিন্দপুর, ভবানীপুর, চেতলা আলিপুরের হিন্দু বাঙ্গালির আনন্দ দেখে কে! আদিগঙ্গা বরাবর ধনাঢ্য জমিদারেরা মনের আনন্দে ঘাট বানাতে লাগলেন। বলরাম বসুর ঘাট, মুখুজ্যের ঘাট, শীতলা ঘাট, হিন্দু মিশন ঘাট, কালীঘাট, ঘটকদের ঘাট, প্রসন্নময়ী ঘাট, রাসবাড়ির ঘাট, তর্পণ ঘাট, কুঁদঘাট, রথতলা ঘাট – বলে বলে নাম শেষ করা যাবে না। এইসময় আদিগঙ্গার পবিত্র জলে স্নান করার জন্য ঘাটগুলি ব্যবহার করা হত।

টলি সাহেবের মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী অ্যানা মারিয়া টলিকে টোল সংগ্রহের বরাত দেওয়া হয়েছিল। ইঞ্জিনীয়ারের বুদ্ধি আর উদ্যমে আদিগঙ্গার প্রথম ১৩ কিলোমিটার অর্থাৎ হেস্টিংস থেকে গড়িয়া পর্যন্ত অংশ প্রায় দুশোবছর কর্মচঞ্চল প্রাণ ফিরে পেয়েছিল, যতই তাকে টালিনালা বলে নাক কুঁচকোই না কেন। বস্তুত আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও কলকাতা শহরের ইমারতী মাল মশলা (ইঁট, বালি, চুন, সুরকী, বাঁশ আর খড়) পুরোটাই আদিগঙ্গা ধরে আসত। এরজন্য গড়িয়া পর্যন্ত আদিগঙ্গার পাশে গড়ে উঠেছিল অজস্র ইঁট বালি খড় আর বাঁশ গোলা। আমার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের দুকামরার ঘরের অদূরেই ছিল নন্দীবাবুর ইঁটগোলা, চিত্তদার সুরকী কল আর শৈলদাদের খড় গোলা। বাড়ির উল্টোদিকে ছিল টাকির জমিদারদের খিলানওলা সিঁড়িবাঁধানো ঘাট যেখানে লোকে স্নান করতে আসত আর পৈতের সময় পিতাঠাকুরের তত্বাবধানে আমার মাথা ন্যাড়া করেছিল নন্দনাপিত। তখন আমার কোন ধারণা ছিল না যে আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনের মধ্যে কিভাবে রয়ে গেছে এক দীর্ঘ ও ব্যাপ্ত ইতিহাসের স্পর্শ।

আমি সচেতনভাবে না চাইলেও এই গল্পের খানিকটা বেদনাদায়ক বইকি। ১৭৭৭ সালে খিদিরপুর থেকে গড়িয়া ছিল বাদাবন আর ইতস্ততবিক্ষিপ্ত কয়েকটি গ্রাম। ১৯৭৭ সালে এই অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগরী! এই দুশোবছর নগরায়ন আদিগঙ্গার কন্ঠরোধ করেছে রোজ একটু করে। কলকাতার ল্যান্ডইউজ ম্যাপগুলি দেখলে স্তম্ভিত হয়ে যাই নগরায়নের গতি দেখে আর এই নগরায়ন হয়েছে একেবারে আদিগঙ্গার গা ঘেঁষে। এখন গড়িয়ার কাছে আদিগঙ্গার বুকের উপর মেট্রোরেলের পিলার দেখে চমকে উঠে কি লাভ? বড় হলে সন্তান যেমন মাকে ছেড়ে যায়, তেমনি পিচের রাস্তা আর রেললাইনের হাত ধরে বাণিজ্য আদিগঙ্গার জলপথ ছেড়ে গেছে।

গড়িয়ার নিচে আদিগঙ্গার কি হল? এখন সাদার্ণ বাইপাস ধরে গাড়ি করে গেলে বারুইপুর আমতলা কানেক্টার পর্যন্ত আদিগঙ্গাকে খুঁজে পাওয়া যায়। বারুইপুরের দক্ষিণে সূর্যপুর পর্যন্ত আদিগঙ্গা মিলিয়ে যেতে যেতেও আছে। নাছোড় সংস্কারের বশে এখনো মানুষ শুকনো নদীখাতের ধারে দাহসংস্কার করে, পুকুর খুঁড়ে জল বার করে গঙ্গাজল বলে মাথায় ঠেকায়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ছত্রভোগের কাছে পাতালগঙ্গা বলে একটি জায়গা আছে, আদিগঙ্গার প্যালিওচ্যানেলের প্রায় উপরে, মানুষের বিশ্বাস আদিগঙ্গা এখানে পাতালে অর্থাৎ মাটির নিচে বইছে।

বিস্তর গবেষণা হয়েছে আদিগঙ্গার মোহনা বিষয়ে। কেউ কেউ মনসামঙ্গলের বর্ণিত স্থানগুলি ধরে ধরে আদিগঙ্গার প্রাচীন গতিপথ খুঁজেছেন, কেউ গত চার পাঁচশো বছরের মানচিত্র ধরে সেই একই চেষ্টা করেছেন, হালে উপগ্রহচিত্র থেকে দেখা গেছে ছত্রভোগের দক্ষিণে খারি পর্যন্ত বিস্তৃত এক প্রাচীন শুকিয়ে যাওয়া নদীখাত। এইসবগুলিকে মিলিয়ে দেখলে এইরকম একটা ছবি উঠে আসে।

আদিগঙ্গা গড়িয়ার দক্ষিণে নিশ্চিতভাবে সোনারপুর,রাজপুর, নরেন্দরপুর, মালঞ্চ,ডিহি মদনমল্ল, বারুইপুর হয়ে সূর্যপুর পর্যন্ত গিয়েছিল। এ ব্যাপারে সকলেই একমত। এরপরের গতিপথ সম্পর্কে অনেকগুলি মত আছে।

১। আদিগঙ্গা বারুইপুরের দক্ষিণ পশ্চিমে বসন্তপুরে (অধুনা খুলনার অন্তর্গত) বহুধা বিভক্ত হয়ে যায় যার মধ্যে প্রধানগুলি হচ্ছে কাকদ্বীপের কাছে বড়তলা, সুন্দরবণের সপ্তমুখী (বা শতমুখী) এবং ঠাকুরাইন। বড় নদী অববাহিকার কাছে এসে এমন বহুবিভক্ত হয়েই থাকে। এর মধ্যে বড়তলা মুড়িগঙ্গা অববাহিকা সবচেয়ে কাছে সুতরাং বড়তলা মুড়িগঙ্গাই আদিগঙ্গার মোহনা। এইমতটি সবচেয়ে পুরোনো (১৮৫৮ খৃঃ) এবং এর জনক শেরউইল সাহেব।

২ । ও ম্যালি সাহেব ১৯১৪ সালে এইরকম একটি তত্ব দিলেন যে আদিগঙ্গা কাকদ্বীপের কাছে সুন্দরবন থেকে বেরিয়ে এসে বড়তলায় পড়েছিল ঠিকই কিন্তু মুড়িগঙ্গার খাত পার করে এটি মনসাদ্বীপ ও ধবলাটের মাঝামাঝি কোন জায়গায় পশ্চিমমুখী হয়ে সাগরদ্বীপের ভিতর দিয়ে বয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিয়ে গঙ্গাসাগরেই বঙ্গোপসাগরে পড়েছিল। উল্লেখ্য আজ থেকে তিন চারশো বছর আগে কাকদ্বীপ, বড়তলা, মুড়িগঙ্গা বা সাগরদ্বীপের চেহারা মোটেই আজকের মত ছিল না। সুতরাং কে কাকে পার করেছে এখন বোঝা মুশ্কিল। কাকদ্বীপ কেন দ্বীপ এখন বোঝা দুষ্কর। তবে এই মতটি ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের খুব প্রিয়।

৩ । হার্স্ট সাহেব ১৯১৬ সালে বললেন যে সূর্যপুর থেকে আদিগঙ্গা পশ্চিমদিকে ঘুরে ডায়মন্ড হারবার খাঁড়িতে মিশে গিয়ে কপাটহাটের কাছে হুগলীতে এসে পড়েছিল। এই খাঁড়িটি এখনো বর্তমান, ডায়মন্ড হারবার ঢোকার আগে একটি সেতু পড়ে, যার তলা দিয়ে খাঁড়িটি বইছে। এইরকম মনে করার কারণ রায়মঙ্গলে আদিগঙ্গার তীরে মগরা নামক স্থানের উল্লেখ। তবে এই যুক্তি ধোঁপে টেকে না। রায়মঙ্গলে বলছে, ‘ দুরে থাকি মগরার জলের নিঃশ্বন/ যেন আষাঢ়িয়া মেঘের গর্জন’ অথবা ‘প্রলয়ের বৃষ্টি যেন উথলে মগরা’। এখানে মগরা মানে মোহনার বিপুল জলরাশি, চব্বিশ পরগনার মগরাহাট নয়।

৪। আরেকটি মত আছে যাতে মনে করা হয় আদিগঙ্গা কাকদ্বীপ বা ডায়মন্ড হারবারের কাছে নয়, কুলপীতে হুগলী নদীতে এসে পড়েছিল। এই মতটি তুলনায় আধুনিক, বাকিটা মোটামুটি ও ম্যালি সাহেবের মতানুসারী।

৫। শেষ মতটি হল আদিগঙ্গা ক্রমশই দক্ষিণদিক বয়ে গিয়ে গোবাদিয়া খাঁড়ি ধরে সপ্তমুখী অববাহিকায় মিশেছিল।

পন্ডিতরা এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছননি, তবে আধুনিক গবেষণায় আদিগঙ্গার গঙ্গাসাগরে গিয়ে পৌছনোর সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে। উপগ্রহ চিত্র, প্যালিওচ্যানেলের পর্যবেক্ষণ এবং নদীবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মে আদিগঙ্গার সপ্তমুখী কিংবা ঠাকুরাইনে পড়ার সম্ভাবনাই বেশী।

এখানে যে জায়গা গুলোর কথা বলা হল সেখানে আমার অর্ধেক জীবন কেটেছে। প্রায় জন্ম হয়েছিল হেস্টিংসের কাছে আদিগঙ্গার তীরে। সেই শিশু খেলতে খেলতে প্রৌঢ়ত্বে সাগরে এসে পৌছেছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে দুলতে দুলতে এই মোহনায় পৌঁছে মনে হয় ঠাকুরাইন থেকে সপ্তমুখী হয়ে সাগরদ্বীপ, পুরোটাই হয়ত গঙ্গাসাগর। হাজার হাজার বছরের চিত্রনাট্যে আমরা একটা পাতা, কিংবা একটা শব্দ অথবা শব্দও নয় একটা কমা বা সেমিকোলনের দিকে চেয়ে পুরো গল্পটা বুঝতে চাইছি। যারা নদীর সঙ্গে জীবন কাটিয়েছে তারা এর অসারতা বুঝতে পারবে। এরচেয়ে সেই কুয়াশামাখা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের আদিগঙ্গার ভোরে ফিরে যাওয়াই ভালো। সেখানে এখনো ছেলেরা বানের জলে সাঁতার কাটছে, নৌকাবোঝাই ইঁট আসছে নন্দীবাবুর গোলায় আর গঙ্গার ঘাটের বুড়ি আদিগঙ্গার জলে ডুব দিয়ে সূর্য প্রণাম করছে।

[শেষ]

তথ্যসূত্র

প্রসিত রায়চৌধুরী, আদিগঙ্গার তীরে – চব্বিশ পরগণার ইতিহাস

সুনন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, Location of Adi Ganga Palaeochannel, South 24 Parganas, West Bengal – A Review

অতনু মন্ডল, Decay of the Adi Ganga and its impact on the Surrounding

রমেশ চন্দ্র মজুমদার, History of Bengal, Vol I, Hindu Period

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!