স্বপ্নের মানুষ

এক

প্রথমে খুব আস্তে ছিল শব্দটা। ঢুপ ঢুপ ঢুপ করে দুর থেকে ভেসে আসা মাদলের মত। নাকি টিম্পেনীর ড্রাম? ছোটবেলায় পড়া ফ্যান্টমের গল্প বা আফ্রিকান সাফারিতে দেখা গম্ভীর, বিষন্ন বনস্থলীর উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘের মত আওয়াজ? অক্রমশ সেই শব্দ জোরালো এবং স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উঁচু টিলার উপর থেকে ছুটে নেমে আসছে কেতকী। দৌড়ে যাচ্ছে মৃতকায়া নদীর ধারে শুয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটির দিকে। ধূসর উপত্যকার উপরে ঝুঁকে আছে নক্ষত্রহীন আকাশ আর তার উপরে থেকেও না থাকার মত একটুকরো চাঁদ। এই নক্ষত্রহীন আকাশ উপত্যকা, গাঢ় নয়, এক তরল অন্ধকারে ভেসে আছে। রাত্রির শীতল বাতাস সমস্ত প্রান্তর জুড়ে উড়িয়ে নিচ্ছে অসংখ্য শুকনো পাতা। কেতকীর শীত লাগছে আর ভয় করছে খুব। তার গলার মধ্যে ডেলা পাকিয়ে আছে ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না। টেডিবিয়ার বগলদাবা করে কেতকী ছুটে যাচ্ছে শায়িত অবয়বটির দিকে; তাকে তাড়া করে চলেছে ঐ ধ্বক ধ্বক শব্দের প্রবল আচ্ছন্নতা। সে কিছুতেই দেখবে না তবু তার মুখ ঘুরে যাচ্ছে শায়িত মানুষটির দিকে। সেই মৃতদেহ তাকে ‘বেবী বেবী’ বলে ডাকছে। কিছুতেই শুনবে না, তবু দুহাতে কান চাপা দিয়েও কেতকীকে তার মৃত পিতার কন্ঠস্বর শুনতেই হবে। আর সেই প্রবল ধ্বক ধ্বক শব্দ যা একটি সময় ফুরিয়ে আসা হৃৎপিন্ড থেকে উৎসারিত, ক্রমশ পরিনত হবে এক ক্রিসেন্ডোতে।

তারপর, কখন জানে না কেতকী, সেই মাথার মধ্যে ঘা মারতে থাকা শব্দ পাল্টে হয়ে যায় ঘোড়ার খুরের ধ্বণি। কেতকী কুঁকড়ে এতটুকু, তার দুগাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে, সে দেখে দুরের টিলা থেকে নেমে আসছে সাদা ঘোড়ার পিঠে এক ঘোড়সওয়ার। সেই ঘোড়সওয়ারের বুক অবধি বর্ম, তার কালো পোষাকে পিছলে যাচ্ছে মরা জোছনা, হাওয়ায় উড়ছে তার দীর্ঘ কেশ। টেন্টপেগিংএর মত সেই ঘোড়সওয়ার ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে তাকে। একজোড়া পাথরের মত দৃঢ় বাহুর ঘেরাটোপে শিউরে উঠছে কেতকীর শরীর। তারপর ম্যাজিকের মত ম্যান্ডোলিন বাজে আর সমস্ত চৈতন্য জুড়ে অনুভব হয় এক পরম নিরাপত্তা আর প্রশ্নহীন ভরসা। কেতকী চোখ খুলে দেখে ভোর হচ্ছে; নরম গোলাপী আলোয় ভরে উঠছে দিগন্ত। নতুন এক মানুষের বুকের খুব কাছে সে। মানুষটির গালে রুক্ষ দাড়ি, দৃঢ়নিবদ্ধ চোয়াল আর দৃষ্টি দুরে প্রসারিত। কেতকী খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে তার চিবুক, স্ফীত নাকের পাটা, বাতাসে উড়ন্ত চুল আর ডান ভ্রুর উপর কাটা দাগ।

দুরে কোথায় ঘন্টাধ্বণি হয়। তারপর ঘন্টা বাজতেই থাকে। বাজতে বাজতে কখন যেন সেটা কেতকীর অ্যান্টিক অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজ হয়ে যায়। কেতকী হাত বাড়িয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে।

জানলার পর্দার পিছনে সকালের রোদ। এসির মৃদু গুনগুন ছাপিয়ে বাইরে মানুষজনের কথাবার্তা, কাকের ডাক আর গাড়ির হর্ণের শব্দ শোনা যায়। আরেকটা দিন শুরু হল কেতকীর। ঘুম চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে সে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল।

বাথরুমের আয়নায় হঠাৎ চোখ পড়ে গেল। অনেকদিন পরে মুখ দেখলেন তিনি। ব্রাশটা হাত বাড়িয়ে বেসিনের তাকে রাখতে রাখতে কেতকী থমকে গেলেন। এই মুখটিই কি তাঁর? এই তাঁর নিজস্ব মুখ? ইনিই তাহলে মিস কেতকী রায়; স্বনামধন্য ফার্মাকোলজিস্ট ডক্টর সুদর্শন রায়ের কুখ্যাত কন্যা, রায় ফার্মাস্যুটিক্যালসের সোল প্রপ্রাইট্রেস! এই সেই বরতনু? কেতকী রায় আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। দুর থেকে দেখতে মন্দ লাগে না বটে, মধ্য চল্লিশে এসেও কেতকীর ঈর্ষনীয় একটি শরীর আছে, রীতিমত জিমন্যাসিয়াম লালিত। দেখতে তিনি কোন দিনই খারাপ নন, পনের ষোল বছর বয়স থেকে পুরুষের চোখে অজস্র নীরব সার্টিফিকেট পেয়ে আসছেন। বিদ্যেবুদ্ধিও নেহাৎ কম নয় – ফার্মাসির বিদেশী ডিগ্রী আছে এবং আছে বিজনেস ম্যানেজমেন্টের মাস্টার্স। দু একটি বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিনে কেতকীর সাক্ষাৎকারও বেরিয়েছে। ডক্টর রায়ের অর্ধএসমাপ্ত এইচ আই ভি ভ্যাকসিন তাঁর প্রচেষ্টাতেই সম্ভব হয়েছে। এই তাহলে সফল ও সুন্দরী এক নারী যিনি বহুজন কাম্যা? হাসতে হাসতেই কেতকী বুঝতে পারছিলেন দামী টুথপেষ্টে ব্রাশ করা সত্বেও তাঁর মুখটা তেতো হয়ে যাচ্ছে।

তেতো হয়ে যাচ্ছে কারণ কেতকীর চোখে ফাঁকিগুলো ধরা পড়ে যাচ্ছে। জোরালো আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তাঁর চোখের নীচের কালো দাগ। এটা তিনি একটু পরেই মেকআপে ঢেকে ফেলবেন। কিন্তু বেশ দেখা যাচ্ছে তাঁর চোখের তারায় একটা রেসিডুয়াল ক্লান্তির ছায়া। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মেকআপেও এ জিনিষ ঢাকা যাবে না। এই আদ্যন্ত পুরুষশাসিত সমাজে এবং ততোধিক পুরুষ শাসিত ব্যবসার জগতে আর তস্যাধিক পুরুষ শাসিত ওষুধ বেচার ব্যবসায় তিনি এক নারী। এবং তিনি একা এক নারী। তাঁর পিতা সুদর্শন রায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পরে টানা বারো বছর এই হীন, কুটিল কর্পোরেট জঙ্গলের স্বাদন্ত ও নখধারী প্রতিদ্বন্দীদের মধ্যে টিকে থাকা খুব সহজ কাজ ছিল না। কেতকী তা সম্ভব করেছেন এবং কর্পোরেট কম্যুনিটি তা প্রশংসার চোখে প্রত্যক্ষ করেছে। কিন্তু আঁচড় কামড়গুলো কেতকী লুকোবেন কি করে? এতদিনে তারা প্রকট হয়ে উঠেছে। রাতের কিমোনো খুলে বাথটাবের ইষদুষ্ণ জলে শরীর ছেড়ে দিয়ে কেতকী রায় টেলিফোন শাওয়ারে মুখ লুকাতে লাগলেন।

[সম্পূর্ণ গল্পটি epub ফরম্যাটে পড়ার জন্যে এখানে ক্লিক করুন। epub আপনি মোবাইল ফোন, ট্যাব বা পার্সোনাল কম্পিউটারে সহজেই পড়তে পারবেন। মূল্য ৭৫ টাকা ]

epub কি ভাবে পড়বেন জানতে হলে দেখে নিন এখানে

<<<<< বড়গল্প সংকলনে ফিরুন

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!