১লা ধও অল-হিজ্জা। পূন্য হিজরার ১০৪১তম বৎসর।

কথিত আছে নদ নদী জলধারা বিধাতার কোনো মহাজাগতিক পাশাখেলার দান। এদের জন্মলগ্নেই সূচিত হয় অনন্ত অনিশ্চয়তা – বিপুল সময়কালের পটে এদের গতিপথ কখন কিভাবে পরিবর্তিত হয়, ক্ষুদ্র মানুষের কাছে সে রহস্য অজ্ঞেয়। অথচ মানব সভ্যতা নিতান্তই নদীনির্ভর, মেসোপটেমিয়া থেকে সিন্ধুসভ্যতা, নদীর গতিপথ মানুষের ভবিষ্যৎ নির্দ্ধারণ করে এসেছে চিরকাল। নদী যেমন যেমন আপন খেয়ালে গতিপরিবর্তন করেছে তেমনই জুয়ার দানের মত বৈভবপূর্ণ নগর ধূলিসাৎ হয়ে গেছে কিংবা নগন্য পল্লী সম্পদে ও ক্ষমতায় পরিনত হয়েছে অতিকায় জনপদে। ত্রিবেনীর কাছে ভাগিরথীর তিনটি জলধারায় বিভক্ত হয়ে যাওয়া বোধকরি তেমনই এক ঐশ্বরিক জুয়ার দান। নতুবা কে জানত প্রশস্তা সরস্বতী ও যমুনার পাশে এক নামহীন নগন্য জলধারা একদিন গঙ্গার প্রধান নদীখাতে পরিবর্তিত হয়ে যাবে? কে জানত ষোড়শ শতাব্দীর থেকে সরস্বতী ক্রমশ নাব্যতা হারিয়ে অকিঞ্চিৎকর হয়ে যাবে আর প্রাচীণ সপ্তগ্রাম বন্দর মৃত্যুমুখে পতিত হবে? পর্তুগীজরা স্বাভাবিক জলচর, তারা এই পরিব্তনের আভাস পেয়েই উগোলিমে বন্দর স্থাপন করে আর কালক্রমে তার প্রবেশপথের নদীপথটি হুগলী নামে পরিচিত হয়। যে সপ্তগ্রামকে তারা একদা ছোট বন্দর পোর্তো পিকেনো বলে ডাকত, উগোলিম সেই নামটুকু পর্যন্ত একদিন  কেড়ে নিল। হুগলী নদী যেন মুচকি হেসে এই জুয়াখেলার জয়ী নগর বন্দরটির গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিয়ে সগর্বে বঙ্গোপসাগরের দিকে বহে যেতে লাগল।

আজ হুগলী নদীর জল নিস্তরঙ্গ। সেই নিস্তরঙ্গ জলের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে সারেঙ্গীর মনকেমন করা মূর্চ্ছনা। তবায়েফদের পায়ের ঘুঙরুর শব্দও জলে ঢেউ তোলে না। গঙ্গার পূন্যলোভী স্নানার্থীরা সবিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে মাঝনদীতে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকা সারি গসারি রণপোত গুলিকে – বিশাল সম্ভারের যেন শুরু বা শেষ নেই। সেই দিগন্তবিস্তৃত জাহাজের সারির কেন্দ্রে আছে এক অতিউৎকৃষ্ট বজরা। এই বজরাটি সুচারু নৌস্থাপত্যের উদাহরণস্বরুপ – এর খোলের উপর একটি প্রশস্ত মঞ্চ, মঞ্চের উপর উজ্জ্বল হরিৎবর্ণ চাঁদোয়া আর বজরার গায়ে সোনালী রংয়ের কারুকার্য। বজরার মাথায় উড়ছে রুপালি চন্দ্রখচিত মিশকালো মসলিনের ত্রিকোনাকৃতি বিশাল ঘ্বজা। নদীর হাওয়ায় আন্দোলিত হয়ে সেই পতাকা সগর্বে জানান দিচ্ছে ভারতেশ্বর মুঘল সম্রাটের ক্ষমতার পরিধি। তবে স্নানার্থীরা জানে বাদশাহ আছেন দিল্লীতে; ঐ জাহাজে বসে তাঁর প্রতিনিধি বাংলার সুবাহদার কাশিম খান নৃত্যগীত উপভোগ করছেন। কাশিম খান চারুকলার উত্তম সমঝদার।

কাশিম খান জ্বিনি কে দেখে বিশ্বাস হয় না তিনি যোদ্ধা। কবি দার্শনিকের মত নরম চেহারার এই কাশিম শাহী রাজ্যপাল রুপে কি করে লৌহকঠিন মুষ্ঠিতে বাংলা বিহার উড়িষ্যার শাসনকার্য পরিচালনা করেন তা অনেকেই ভেবে পায় না। মুঘল সম্রাটের পিসী নুরজাহানের ভগ্নীপতি ও বর্তমান বাদশাহের বিশ্বাসভাজন হলে কি হয়, লোকে বলে অমুসলমানী আচার আচরণের জন্য তিনি নাকি তৃতীয় শাহজাদার চক্ষুশূল। বিশেষত আমির খুসরুর মত নাপাক মুরতাদের প্রতি কাশিমের অনুরাগ একটি বিতর্কের বস্তু। যদিও এই বিতর্ক চলে অতি গোপনে। কাব্যানুরাগী সুবাহদারের অসি মোটেও ধীরগতি নয়। পাটনায় প্রতি বছর ওমরাহদের তীরন্দাজির প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে দুশো পা দূরত্বে তীর দ্বারা আপেল ফোঁড়ায় কাশিমের দক্ষতা প্রায় প্রবাদ স্বরুপ। তথাপি সুবাহদার সাহেব আতর মেখে শেরশায়েরী আর নাচাগানায় মেতে থাকেন বলে আড়ালে আবডালে ফিসফাস চলতেই থাকে। চন্দ্রাতপের নিচে যখন নৃত্যগীত চলছে, তখন কাশিম খানের গোলন্দাজপ্রধান আগা আলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকে। সুবাহদারের জন্যে সে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে এসেছে।

শতাধিক জাহাজের এই নৌবাহিনী হুগলী নদীর বক্ষে যেখানে নোঙর ফেলেছে তার পশ্চিমতীরে অবস্থিত পর্তুগীজ পল্লী বন্দেল। কাশেম খানের স্বর্ণালী বজরার পাঁচশো গজ দূরত্বে চূনাপাথরের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে অপরুপ বারোক স্থাপত্যরীতির এক সুবিশাল গির্জা। দক্ষিণে যতদুর দৃষ্টি চলে শুধু ঘন সবুজ বৃক্ষের উদ্যান, সেই উদ্যানঅরণ্য চিনসুরা পর্যন্ত বিস্তৃত। চিনসুরায় আছে ওলন্দাজ উপনিবেশ। কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে এই ঘন সবুজ অরণ্যের অন্তঃস্থলে কোথাও আছে সুরক্ষিত পর্তুগীজ নগরবন্দর উগোলিম বা উগোলি, লোকমুখে যা হুগলী নামে পরিচিত। এই বন্দরের মুখ একদা সরস্বতী নদীর দিকে ছিল, কিন্তু নাব্যতা হ্রাসের কারণে ক্রমশই উগোলিম বন্দর হুগলী নদীর দিকে ধাবমান। পর্তুগীজরা এই জনপদের নাম দিয়েছে পোর্তো পিকেনো। আগা আলি যতক্ষণ ঘর্মাক্ত কলেবরে অপেক্ষা করে সেইসময় আমরা একটু ইতিহাস জেনে নিই।



প্রাচীন মগধের দক্ষিণে আর কলিঙ্গদেশের উত্তরপূর্বে যে সুবিশাল প্রদেশ রাঢ়, বাগরি, ভঙ্গ, বরেন্দ্র আর মিথিলা এই পাঁচ অঞ্চলের সমাহারে  উত্তরে কামরূপ  আর পূর্বে চট্টগ্রাম হয়ে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার রহস্যাবৃত ইতিহাস এখনো অনাবিষ্কৃত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় বক্তিয়ার খিলজি যখন এই রহস্যময় দেশ আক্রমণ করেন তখন সেনবংশের কর্তৃত্বের অবসান হয়েছিল বটে, কিন্তু চার হিন্দু নৃপতি যথাক্রমে কোচ, ত্রিপুরা, মল্লভূম আর ভুরশুতের সঙ্গে সুলতানকে এই অঞ্চল ভাগ করে নিতে হয়েছিল আর পূর্বে আরাকান রাজ্য দিল্লীর সুলতানের অধরাই রয়ে যায়। সেই সময়ে ভঙ্গদেশ ছিল তিনটি অংশে বিভক্ত: লখনাবতি, সুবর্ণগ্রাম আর সপ্তগ্রাম। চতুর্দশ শতাব্দীতে সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ প্রথম দুটিকে দিল্লীর সুলতানিয়াতে জিতে আনলেও সপ্তগ্রাম স্বাধীন রয়ে যায় আর কালক্রমে সমগ্র বঙ্গদেশের রাজধানীতে পরিনত হয়। সম্রাট আকবরের সময় থেকে মুঘলরা বাংলাকে করায়ত্ব করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল কিন্তু বাংলার বারো ভূঁইঞ্যা, হিন্দু রাজন্যবর্গ এমনকি মুসলিম নবাবরাও মুঘলদের কর দিয়ে স্বাধীন রাজত্ব করে চলেছিল। এই অবিশ্বাস্য বিত্তশালী দেশ যে কর মুঘল সম্রাটকে দিত তা সমস্ত মুঘল সাম্রাজ্যের মোট আয়ের অর্ধেক ছিল। এই সম্পদের খবর গোপন থাকেনি। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে ১৫১৭ খৃষ্টাব্দে দক্ষিণ ইয়ুরোপের একটি ক্ষুদ্র দেশ, পর্তুগাল থেকে বানিজ্যতরী বাঙ্গালার চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ব্যবসার পত্তন করেছিল। সেই সময় বাঙ্গালার স্বাধীন নৃপতি ছিলেন গৌড়েশ্বর হুসেন শাহ – চট্টগ্রাম থেকে মেঘনা নদীপথে গৌড় পৌঁছানো যেত। কিন্তু চট্টগ্রামের অধিকার নিয়ে গৌড়, ত্রিপুরা আর আরাকান রাজ্যের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকত। ১৫১৭ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত।

এই সময়ে রানী এলিজাবেথ ইংলন্ডের সিংহাসনে বসেন নি, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পত্তন হতে আরও ৮০ বৎসর বাকি আর কাবুলের পর্বত থেকে নেমে এসে বাবর দিল্লীতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাও করে ওঠেন নি।  প্রথম ইউরোপীয় বণিকরুপে পর্তুগীজরা ভারতে প্রবেশ করে উপকূল বরাবর বানিজ্যকেন্দ্র আর বন্দর স্থাপন করতে শুরু করে; পশ্চিমে গোয়া, দমন, দিউ থেকে শুরু করে কুন্নুর, কালিকট, কোচিন, নাগাপত্তম, মাইলাপুর, মুসলিপত্তম, হুগলী ও চট্টগ্রাম হয়ে পর্তুগীজ বানিজ্যপথ ব্রহ্মদেশ পেরিয়ে শ্যামদেশ হয়ে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এই দীর্ঘ বানিজ্যপথটির পূর্বপ্রান্তে বাঙ্গালাদেশে পর্তুগীজরা দুর্বলতম মুঘল আধিপত্যের সুযোগে আর আরাকানদের দাক্ষিণ্যে চট্টগ্রামে গড়ে তোলে পোর্তো গ্রান্ডি আর সপ্তগ্রামের মূল প্রবেশপথ সরস্বতী নদী ষোড়শ শতাব্দীতে নাব্যতা হারাতে শুরু করলে তার দুই ক্রোশ দক্ষিণপূর্বে উগোলিতে স্থাপন করে পোর্তো পিকেনো। দেড়শত বৎসরে পর্তুগীজ বানিজ্য ও নিয়ন্ত্রন বাঙ্গালায় গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে সাতগাঁ ও হুগলীতে ৭৭৭ বিঘা জমির সনদ লাভ করে পর্তুগীজরা হুগলী নদীর পূর্বে ও পশ্চিমে ষাট লীগ পর্যন্ত দূরবর্তী অঞ্চল নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। পর্তুগীজরা ইংরেজদের মত জাতিগত বিভেদ মানত না, বাঙালার শ্যামাঙ্গীদের প্রতি তাদের সবিশেষ আকর্ষণ ছিল। ফলে প্রভু যেসুর শরনাপন্ন হলেই তাদের বিবাহ করতে তারা উৎসাহী ছিল। এক শতাব্দীর মধ্যেই অর্ধপ্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালা ভাষায় কমপক্ষে হাজার খানেক পর্তুগীজ শব্দ আর বাঙালী রমনীর গর্ভে লুসোভারতীয় শঙ্কর জাতির জন্ম হয়ে গেল। কাশিম খান যখন রনতরী নিয়ে বন্দেলের নিকট উপস্থিত হচ্ছেন সেই সময়ে গাঙ্গেয়বঙ্গে পর্তুগীজ ভাষা প্রধান কাজের ভাষা। জোব চার্ণক নামে এক ইংরেজ বণিককেও হুগলীতে ব্যবসায় কার্য করার জন্যে পর্তুগীজ ভাষা শিখতে হয়েছিল।

বাঙ্গালার নদীউপকূল বরাবর পর্তুগীজদের এমন নিরঙ্কুশ প্রাধান্য ছিল যে তারা মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুষ্ঠানিক সৌজন্যকর পর্যন্ত দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল বরং উড়িষ্যার পিপলি থেকে বাঙ্গালার তমলুক, হুগলী,  সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামে তাদের কর না দিয়ে কেউ বানিজ্য করতে পারত না। আকবরের ফরমানে পর্তুগীজদের ধর্মপ্রচার ও অনুমতিসাপেক্ষে ধর্মান্তরিতকরনের অধিকার ছিল, কিন্ত ক্ষমতার গর্বে তারা বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ শুরু করেছিল। পর্তুগীজ রক্তে অভিযান আর আবিস্কারের ধারা সুপ্রথিত ছিল, ফলে তাদের একাংশ নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে জলদস্যুতা, দাসব্যবসা ও লুন্ঠনধর্ষনে বাঙ্গালার পল্লীগ্রামে ফিরিঙ্গি নামক ত্রাসে পরিনত হয়। অবশেষে মুঘল সম্রাট শাহজাহান এই আধিপত্য বিনষ্ট করার অভিপ্রায়ে পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে সমরাভিযান শুরু করলেন। ইতিহাসের মতানুযায়ী এই দমন অভিযান কেবল বাঙ্গালার পর্তুগীজদের উদ্দেশ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কেননা গোয়াস্থিত পর্তুগীজ ভাইসরয়ের কেশাগ্রও স্পর্শ করা হয় নি। তবে ইতিহাস মূলত বিজয়ীর ভাষ্য, নতুবা কিছু পর্তুগীজ বুকানিয়ারের অপরাধে বাঙ্গালার সমগ্র পর্তুগীজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা, মতান্তরে, সম্রাট শাহজাহানের ব্যক্তিগত কারণে হয়েছিল বলেও অনেকে মনে করে। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে আমাদের কাহিনীর পটভূমি এক অত্যাশ্চর্য স্থান কারণ, এই অঞ্চলে মাত্র বিশ ক্রোশ বৃত্তের মধ্যে তখন ইয়ুরোপ মহাদেশের সাতটি জাতি – যথাক্রমে পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশ, দিনেমার, ফরাসী, ফ্লেমিশ আর প্রুশিয়ান – অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিদ্বন্দিতা করছে আর সেই প্রতিদ্বন্দিতায় পর্তুগালের সৌভাগ্যসূর্য অস্তগামী।

পাটনা সাহিব থেকে নদীবক্ষে কাশিম খান বন্দেলের নিকটে এসে নোঙর ফেলে অপেক্ষারত, পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী বাহিনী আর হাতিতে টানা বৃহদাকার মুঘল কামানগুলি যতক্ষন না হুগলীনদীর পশ্চিমতীরে সন্নিহিত হয়। মনে হয় কাশিম খান মুঘল প্রথায় হুগলী অবরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন – অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নগর প্রাকার রুদ্ধ করে রাখবে আর নদীপথ পাহারা দেবে নৌকামান। কিন্তু এই অনুমানই সার, কেউই সঠিক জানে না কাশিমের মনে কি আছে। এমনকি আগা আলিও না।

পর্তুগীজরাও একই তিমিরে। মুঘল সেনাপতির এই কালক্ষেপ তাদের বুদ্ধির অগোচর। প্রথম দিকে হুগলী শহরের প্রতিরক্ষার জন্য হাজারখানেক আদিবাসী ও শঙ্কর উপজাতির পদাতিক সৈন্য ও শদুয়েক রননিপুন পর্তুগীজ ঘোড়সওয়ার ছাড়া বিশেষ কিছুই তাদের সম্বল ছিল না। কাশিম খানকে অপেক্ষা করতে দেখে পর্তুগীজ সেনাধ্যক্ষরা মরিয়ার মত চারিদিক থেকে হুগলীতে এসে যোগ দিতে লাগলেন। এক তরুণ ও দুঃসাহসী কাপ্তিনকে সুন্দরবন থেকে দাস সংগ্রহ করে আনার দায়িত্ব দিয়ে দক্ষিণে প্রেরণ করা হল। এই নবলব্ধ দাসগুলিকে যুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধরুপে ব্যবহার না করতে পারলে এই যুদ্ধে জয়ের আশা সুদুরপরাহত। পর্তুগীজ সৈন্যবাহিনী সংখ্যায় মুঘলদের তুলনায় নগন্যমাত্র।

সম্প্রতি পর্তুগীজদের শেষ শান্তিপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দূতের দল দিল্লীশ্বরের দরবার থেকে ফিরেছে খালি হাতে।  যে মুঘল সম্রাট একদা পর্তুগীজদের উদারহস্তে নিস্কর ভূখন্ড ব্যবসায়ের জন্য দান করেছিলেন, সেই সম্রাটই শান্তিদৌত্য অস্বীকার করেছেন। সম্রাটের তৃতীয় পুত্র দরবেশসদৃশ শাহজাদা আওরঙজেব সম্রাটের মন বিষিয়ে দিয়েছে কেননা মুঘল শাসন যাদের ধর্মান্তরিত করে উঠতে পারেনি পর্তুগীজরা তাদের দলে দলে খৃষ্ট ধর্মগ্রহনে বাধ্য করছে।



অবশেষে একজন খানসামা এসে আগা আলিকে জানাল কাশিম খান সাক্ষাতের সময় পেয়েছেন। আগা আলি সন্তর্পনে চাঁদোয়ার নিচে প্রবেশ করতে দেখা গেল সুবাহদার সাহেব একটি জাজিমের উপর উপবিষ্ট। চাঁদোয়ার ভিতর দিয়ে সবুজাভ আলো এসে পড়েছে বজরার পাটাতনের উপর, বাহিরের রৌদ্রাতপের পর নদীর বাতাসে এই স্থান অপেক্ষাকৃত শীতল। বাতাসে ভাসমান আতরের তীব্র সুরভি আগা আলিকে প্রায় আঘাত করল। নাসিকা কুঞ্চন করে সে মনে মনে ভাবল, এই আফগানগুলি একেবারেই জন্মদুষ্ট। কাশিম খান সহাস্যে করতালি দিয়ে বললেন, প্রিয় ভ্রাতা, তুমি কি জান যে এই সুগন্ধ তরবারির অগম্য হৃদয়কেও জয় করতে পারে?

আগা আলি নিরুত্তর হয়ে পদপ্রান্তে তাকিয়ে রইল। যে কথা সে বলতে এসেছে সেটি না বলা পর্যন্ত তার উদ্বেগের অবসান নেই।

কাশিম আগা আলির দিকে একগুচ্ছ আঙুর বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, স্বাদ পরীক্ষা করে দেখ আগা আলি, মুজফ্ফরপুরে এখন এই সুস্বাদু আঙুরের চাষ হয়। কি বার্তা এনেছ তুমি?

গতকাল দুটি নতুন জাহাজ সম্রাটের নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আগা আলি নিম্নস্বরে বলে।

আমি জানি।

আগা আলি আহতস্বরে অনুযোগ করল, ঐ জাহাজগুলিতে কারুর ওঠার অনুমতি নেই। আমারও না।

কাশিম খান মুখে আঙুর ফেলে ভাবলেশহীন মুখে  বললেন, আমি সেইরকম আদেশই দিয়েছি।

আগা আলি গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, লোকে বলছে ঐ জাহাজগুলিতে নাকি মুর আছে?

মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ, এমনকি পৃথিবীর অন্যপ্রান্তেও ধর্মান্তরিত দাস মুসলমানদের মুর বলে অভিহিত করা হয়। এরা চেহারা ও আদবকায়দায় মোটেই আরবিকসুলভ নয়। কোন কোন স্থানে এদের দেখে মুসলমান বলে বোঝাই দুস্কর হয়। উচ্চবংশীয় অভিজাত মুসলমান মুরদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখে।

কাশিম খান জ্বিনি আগা আলির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বন্দেলের গীর্জার দিকে দেখতে লাগলেন। নির্মেঘ গাঢ়নীল আকাশের পটভূমিতে গীর্জার সুউচ্চ চূড়ার শীর্ষে শুভ্র ক্রুশ রোদ্রের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। আগা আলি কাশিমের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেই দৃশ্য দেখতে যেতেই গীর্জার থেকে গম্ভীর ঘন্টাধ্বণি হল আর এক ঝাঁক কপোত গীর্জার চূড়া বেষ্টন করে উড়তে লাগল। কাশিম খান অন্যমনস্কভাবে বললেন, তোমার প্রশ্নটা ঠিক কি, আগা আলি?

আপনি ঐ মুরদের যুদ্ধে পাঠাবেন?

যদি পাঠাই?

মুঘল সমরনীতিতে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বিশ্বাসীকে আক্রমনে পাঠানো হয় নবাব সাহেব। অন্যরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, তবে সাহায্যকারীর ভূমিকায়। আগা আলির কন্ঠস্বরে স্পষ্ট নিন্দার সুর। সে দ্রুত যোগ করল, এতে সেনাবাহিনীর মনোবল ক্ষুন্ন হতে পারে।

কিন্তু মুরেরাও তো ইসলামের সন্তান। তাই না আগা আলি? কাশেম খান স্মিত হেসে বললেন।

আগা আলির মনে হল সে চিৎকার করে বলে, না। ওরা ইসলামের তরবারির সন্তান। ওরা বাস্তবিক মুসলমান নয়। এমনকি দিল্লীর মহান মুঘলবংশের সন্তানরাও আর সত্যকারের মুসলমান নয়। এই হিন্দুস্তান এক ডাকিনীবিদ্যার দেশ। এই দেশের জল আর বায়ুর মধ্যে দজ্জালের মন্ত্রপূত বিষ আছে, সেই বিষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুহম্মদের মরুসিংহদের কঠোর হৃদয় দ্রব করে দিয়েছে। এশিয়া মাইনরের ত্রাস মুঘলসন্তানেরা আজ নৃত্যগীত, সুরা আর কবিতায় ডুবে গেছে। তারা এই দেশের কাফের নারীর পাণিগ্রহন করে, তাদের গর্ভে জন্ম দেয় এমন শিশু যারা বড় হয়ে আরও অমুসলমানোচিত আচরন করে। এই মুঘলরা এমনকি পুতুল উপাসনাও শুরু করেছে। মসজিদ জীর্ণ হয়ে পড়ে আছে আর সম্রাট স্বয়ং মৃতা বেগমের স্মৃতিতে সৌধ রচনায় ব্যস্ত। এরা আর মুসলমান নয়। আর কাশিম খান তো অর্ধেক হিন্দু, কারণ সে আফগান। কিন্তু এই কথা বলা আগা আলির পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে মাথা নেড়ে দুর্বলভাবে বলল, খালি কালেমা পড়লেই মুসলমান  হয় না হুজুর। অর্ধেক বাংলা তা পড়ে।

কাশিম খান মেঝে থেকে একটি চর্মবন্ধ পুস্তক তুলে পাতা উল্টাতে লাগলেন। তারপর যখন তিনি সেই পুস্তক থেকে পড়তে শুরু করলেন, তাঁর মুখমন্ডল এক বালকের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি পড়লেন

কাফের-এ-ইশকাম মুসলমানি মারা দরকার নীস্ত
হার রাগ-এ মুন তার গাশ্তা হাজাত-এ-যুননার নীস্ত
আজ সর-এ বালিন-এ মুন বার খেজ অ্যায় নাদান তাবীব
দর্দ মন্দ-এ ইশক রা দারু বাজুয দীদার নীস্ত
খাল্ক মি গোয়াদ কি খুসরু বুত পরস্তি মি কুনাদ
আরে আরে মি কুনাম বা খাল্ক মারা কার নীস্ত

এই পর্যন্ত পড়ে কাশিমের খেয়াল হল আগা আলি পারসী ভাষা জানে না। তখন তিনি হিন্দুস্তানীতে বলতে লাগলেন,

বিশ্বাসহীন তবু ভালোবাসায় বিশ্বাসী, মুসলমানের জাত আমার দরকার নেই
দেহের সকল গ্রন্থি তারের মত সটান ব্রাহ্মণের গ্রন্থির আমার দরকার নেই
আমার শয্যাপার্শ্ব থেকে বিদায় হও ওহে চিকিৎসক
যার প্রেমের রোগ হয়েছে তার প্রিয় মুখদর্শন বিনা ঔষধ দরকার নেই
জগৎ সংসারের লোক বলে খুসরু মূরতি পূজে
তাই হোক তাই হোক, আমার সংসারের দরকার নেই, লোকের দরকার নেই।

আগা আলি সবিস্ময়ে কাশিম খানকে দেখতে লাগল, তার মুখে কথা জোগালো না। কবিতার বইটি বন্ধ করে কাশিম জাজিমে উপবেশণ করে আগা আলির মুখের দিকে চাইলেন। ধীরে ধীরে তাঁর মুখ থেকে বালকসুলভ হাসি মুছে গিয়ে তা প্রস্তরের মত বিবর্ণ হয়ে গেল। তারপর যখন তিনি ফের কথা বললেন তখন তার কন্ঠস্বর আততায়ীর মত শীতল শোনাল।

এ যুদ্ধ আমার নয় আগা আলি। পর্তুগীজদের আমি আমাদের নিজেদের চেয়ে বেশী দোষী মনে করি না। আমরা সকলেই জোর করে ধর্মান্তরিত করি। মুশ্কিল হল, এখন দেখা যাচ্ছে পর্তুগীজরা সেটা আমাদের চেয়ে ভালো করে। ধর্মের কথা বোলো না আমাকে। আমি সৈনিক, আমার কাজ যুদ্ধ জেতা। ঐটুকুই যথেষ্ট।

কাশিম খান হস্ত প্রসারিত করে দুরে অপেক্ষারত দুটি অপরিচ্ছন্ন কদাকার জাহাজের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ঐ দুটি জাহাজে বাঙালী মুরেরা আছে। প্রত্যেকে বাছাই করা এমনভাবে যে তারা স্বচক্ষে হয় স্ত্রী নতুবা মা-বোনকে পর্তুগীজদের দ্বারা ধর্ষিতা হতে দেখেছে। ওদের ধর্মে কিছু আসে যায় না। এটা ওদের যুদ্ধ।

আগা আলি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কাশিম খানকে দেখতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে সে অনুভব করল কেন বাংলার এই সুবাহদারকে শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিশারদ বলা হয়। অত্যাচারী পর্তুগীজদের শায়েস্তা করতে তিনি মুঘল সৈন্যবাহিনীকে আদৌ যুদ্ধে নামাবেন না। অন্তত সরাসরি যুদ্ধে তো নয়ই।

ঢোঁক গিলে আগা আলি বলল, তাহলে এই যুদ্ধে আপনার ভূমিকা কি নবাব?

কাশিম খানের মুখ পুনরায় হাসিতে ভরে গেল। তিনি বললেন, আমার ভূমিকা বিচারকের। আমি শুধু নদীপথ রুদ্ধ করে রাখব। যতক্ষণ না যুদ্ধ শেষ হয় কেউ যাতে লড়াইয়ের মাঠ ছেড়ে পালাতে না পারে।

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!