১৮ই জুন। প্রভু যেসুর ১৬৩২ বৎসর

নিঃসীম নীরব রাত্রি, আকাশ চন্দ্রমাহীন। অন্ধকার সুষুপ্তিময় চরাচরে, ততোধিক অন্ধকার ছায়াময় বৃক্ষরাজির উপর জাগ্রত শুধু পুঞ্জ পুঞ্জ নক্ষত্র। সুবিশাল জলরাশির প্রতি বৃক্ষের সারি যেন প্রার্থনার ভঙ্গিতে নিবব্ধ। এই অশরীরি জলভূমিতে হাওয়াও সন্তর্পনে বয়। নক্ষত্রের স্তিমিত আলোক নিকষ কালো জলের উপর এক অশরীরী আভার সৃষ্টি করেছে। অস্ফুট আলোক অন্ধকারের চেয়েও প্রহেলিকাময়, জলের মধ্যে কুয়াশা সাপের মত ফনা তুলে দুলছে। এই কুহেলিকার মধ্যে সবার অলক্ষ্যে তীরভূমির দিকে ভেসে আসছে এক জলযান। জলযান সম্পূর্ণ নিষ্প্রদীপ, কোথাও কোন শব্দমাত্র নেই। পঞ্চাশ জন মাল্লা কাশে পর্যন্ত না। এই জলযান আসলে একটি পর্তুগীজ কারাভেলা, এর শরীরে যুদ্ধ আর রক্তপাতের দীর্ঘ ইতিহাস। কাপ্তিন তাভারেসের আদেশে জাহাজের সকলে প্রায় শ্বাসরোধ করে নিশ্চুপ হয়ে আছে। কাপ্তিনের আদেশ অলঙ্ঘ্য। পর্তুগীজ কারাভেলার শিকারী বাঘের মত অতর্কিতে আক্রমণ করে। সামান্যতম শব্দে সতর্ক হয়ে শিকার ফস্কে গেলে মাল্লাদের আর রক্ষা নেই। পর্তুগীজ বিচার যেমন সহজ তেমনি নির্মম। নিমেষে মাল্লার গলা দুফাঁক করে বালির বস্তা বাঁধা দেহ জলে ছুঁড়ে ফেলা হবে। হুগলীর শীতল জলে এমন অনাড়ম্বর সলিল সমাধি কেউ চায় না।

যদিও দিয়োগো তাভারেস পর্তুগীজদের প্রতি এহেন ভয় মিশ্রিত সম্ভ্রম উপভোগই করে, কিন্তু আদতে সে অদ্যাবধি কোন গলা কাটেনি। এই সম্ভ্রম তার পূর্বপুরুষদের দ্বারা অর্জিত। দিয়োগোর যাবতীয় দক্ষতা অসি ও কারাভেলা চালনায় সীমিত। সন্মূখ সমরের অভিজ্ঞতা তার নেই। এই অভিযান তার এক চরম পরীক্ষা হতে চলেছে। জাহাজের পঞ্চাশটি মাল্লা সমুদ্রের বিদগ্ধ নাবিক হলে কি হয়, এরা মূলত দস্যু ও দুর্বৃত্ত। মালয়দেশীয় ও চৈনিক এই নাবিকদের সঙ্গে আছে বাঙ্গালার কিছু বাদামীবর্ণ ধূর্ত আদিবাসী। এই আদিবাসীরা ধীবর জাতি, এরা অত্যন্ত বাক্যবাগীশ, জুয়াপরায়ণ এবং মদ্যপ কিন্তু ধূর্ততার গুণে স্বভাবগতভাবে এরা উৎকৃষ্ট জলদস্যু। দিয়োগো সম্যক জানে নির্মম কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত এদের নৌসেনা হিসাবে ব্যবহার করার আর অন্য উপায় নেই। আজকের অভিযানে গোপনীয়তা সর্বাপেক্ষা জরুরী, তাই সে দাঁড় অথবা পাল দুইই ব্যবহার করতে অক্ষম; দাঁড়ে জলের শব্দ হয় আর পাল অন্ধকারে দৃশ্যমান হয়। হালের নিকট দাঁড়িয়ে কুহেলির মধ্য দিয়ে আসা নক্ষত্রের ক্ষীণ প্রভায় দিয়োগো জাহাজের মাস্তুলের অধিক দূরত্বে কিছু ঠাহর করতে পারে না। কারাভেলার বর্গপালগুলিও সে শেষ মুহূর্তে নামিয়ে ফেলার আদেশ দিয়েছে, সুতরাং বাতাসের সাহায্যও অমিল। হুগলী নদীর মোহনায় জোয়ারের সময় তীরমুখী স্রোত থাকে, আজ সেই প্রবাহে ভেসে চলাই তার একমাত্র বাজি।

উষ্ণ দীর্ঘশ্বাসের মত স্থলবায়ু দিয়োগো তাভারেসের মুখ স্পর্শ করে যায়। জাহাজের হালচক্রটি চেপে ধরে অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্রমশ তার কাছে দৃশ্যমান হয় অদূরে অস্পষ্ট দ্বীপরেখা আর নেতিধোবানি গ্রামের কুটিরগুলির ক্ষীনতম আলো। নেতিধোবানি এক অতিকায় প্রাচীন পল্লী, কথিত আছে এই গ্রামের এক রজকিনী একসময় নদীর জল ছিটিয়ে আর মন্ত্র পড়ে মৃত মানুষকে জীবন ফিরে দিত। জাহাজের সারেং একাদশীর এটি অত্যন্ত প্রিয় আখ্যান। নেতিধোবানি পল্লীর নাম দিয়োগো প্রথম শোনে তার পিতা পেদ্রো তাভারেসের কাছে। পেদ্রো বাঙ্গালার নদী আর জনপদ সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞানী ছিলেন, তিনি মোসলেম সম্রাট আকাবরের থেকে খেলাৎ লাভ করে উগোলিম আর সাতগাঁও নামক স্থানে পোর্তো পিকিনো স্থাপন করেছিলেন। দিয়োগোর মনে পড়ল পেদ্রোর মুখে সে শৈশবে শুনেছে এই নদীবেষ্টিত অরণ্যপ্রান্তরে একদা রাজত্ব করতেন মহান কায়স্থ নৃপতি প্রতাপাদিত্য। তিনি নাকি গভীর অরণ্যের ভিতর অনেক সুরম্য অট্টালিকা আর জনপদ স্থাপন করেছিলেন। নেতিধোবানী হয়ত তেমনই কোন জনপদের অবশেষ। ঈশ্বরের পুত্র ব্যতীত মৃত মানুষকে জীবনদান ডাকিনীবিদ্যা ছাড়া সম্ভবপর নয়। ক্রমশ দৃশ্যমান পল্লীটির দিকে তাকিয়ে দিয়োগো বুকে ক্রুশ আঁকল।

কারাভেলার তলদেশ জোয়ারের টানে তীরের নরম কর্দমাক্ত মাটি ছুঁতেই দুলে ওঠে। চাকা আঁকড়ে ধরে দিয়োগো স্বগতোক্তি করতে থাকে ওর্দো এরেমিতেরাম স্যাংতি আগুস্তিনির প্রার্থনা। নোঙর নিক্ষেপ করে এখানে জাহাজ বাঁধা যাবে না। সুতরাং এখন থেকে শুরু হবে তার নৌদক্ষতার পরীক্ষা। এই ছয়শত কুইন্তাল ওজনের জাহাজকে জোয়ারের ধাক্কার প্রতিকূলে তাকে স্থির রাখতে হবে যতক্ষণ না তার লোকজন কার্যসিদ্ধি করে। কারাভেলার সুকানী ডা কুনহার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র চারজন চীনা নাবিক দাঁতে দড়ি কামড়ে নিঃশব্দে বুকজলে নেমে পড়ল। এরা সাঁতার কেটে তীরের লবনাম্বু গাছের সঙ্গে আলগা ফাঁসে জাহাজের কাছি বেঁধে রাখবে, যাতে সময়ে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হওয়া যায়।


সময় হল মার্কুই? পিছন থেকে পর্তুগীজ ভাষায় ফিসফিস করে একাদশী জিঞ্জাসা করল। পরনের লেঙটটি ব্যতিরেকে একাদশী নগ্নদেহ, তার দীর্ঘকেশ মাথার পিছনে বস্ত্রখন্ড দ্বারা বাঁধা; গায়ে চর্বির প্রলেপ লাগানো বলে নক্ষত্রালোক তার শরীরে চকচক করছে। দিয়োগো এই সারেংটিকে সবিশেষ পছন্দ করে। তার শৈশবে পেদ্রো অর্ধমৃত বালক একাদশীকে কোথা হতে উঠিয়ে এনেছিলেন, প্রথানুসারে এ পর্তুগীজ দাস। কিন্তু কালের ফেরে সেই বালক পরিনত বয়সে আর ঠিক দাস নয়, বরং তাভারেসের পারিবারিক অনুচর ও বন্ধু। একাদশীর শরীর ঘোর বাদামীবর্ণ কিন্তু বেতসপত্রের মত নমনীয়; তাকে দেখে সর্বদা ধনুকের ছিলার মত টানটান মনে হয়। সে সর্দার গোষ্ঠীভুক্ত; এই সর্দার গোষ্ঠী বংশপরাম্পরায় সুন্দরবন অঞ্চলের লুটেল।

দিয়োগো দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। এইবার সময় হয়েছে। প্রয়োজনীয়  হলেও এই অভিযান তার কাছে অপ্রীতিকর। একজন নৌসেনাপতি হিসাবে দস্যুতস্করের মত রাত্রির অন্ধকারে সাধারণ পল্লী আক্রমণ আদৌ গৌরবের বস্তু নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইতিহাসের গতি এখন তার বিরুদ্ধে। বাঙ্গালার মহতী পর্তুগীজ উপনিবেশ উশৃঙ্খলতা, দস্যুতা, লবন পাচার আর তার স্বদেশীয়দের ধর্মান্ধতার ফলে আজ প্রায় বিনষ্ট। পর্তুগীজ জাতি পর্যটক ও অভিযাত্রী, সমুদ্রপারের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ও বানিজ্য পরিচালনার জন্য তাদের যথোপযুক্ত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা চারিত্রিক দৃঢ়তার বরাবরই অভাব ছিল। তারা এতকাল সকল বিধর্মী বা ধর্মহীন জাতিকে পর্তুগালের রাজা ও প্রভু যেসুর শত্রু মেনে এসেছে। পর্তুগীজরা স্বভাববনিক নয়, বরং রাজন্যবর্গীয় ধর্মযোদ্ধা। যন্ত্রনাময় ও পীড়নমূলক ধর্মান্তরিতকরণের ফলে এখন তারা ভারতের শাসকদের চক্ষুশূল হয়েছে। তদোপরি পর্তুগীজদের একটি অংশের অবিমিশ্রকারী জলদস্যুতা, লুন্ঠন-ধর্ষণ এবং দাসপ্রথার কারণে ও মানুষকে অপহরণ করে বিক্রয় করার ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকার ফলে বাঙ্গালার সাধারণ মানুষ তাদের সবিশেষ ঘৃণা করে। এই অভিশাপ পর্তুগীজরা স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের কাছে পদানত হওয়া ইস্তক বহন করছে। যুবক দিয়োগো জানে কালের চাকার গতিরোধ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বড়জোর তার স্বদেশীয় সৈন্যবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য যা প্রয়োজন তা করতে পারে। পর্তুগীজ উপনিবেশের বন্দরনগর উগোলিমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে মুঘল বাহিনী, সেই নগরের সুরক্ষার জন্য সৈন্য প্রয়োজন, আর সেই প্রয়োজন মেটাতে তাকে এখন পল্লী আক্রমণ করে দাস সংগ্রহ করতে হচ্ছে। অধুনা রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ বাঙ্গালা উপনিবেশের কথা বিস্মৃত, তিনি ইংরেজ ও ওলন্দাজদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় মগ্ন, তাঁর আগ্রহ বর্তমানে ব্রাসিলিয়ায় নূতন উপনিবেশ স্থাপনের দিকে।

একাদশীর সতর্ক তত্বাবধানে একের পর এক মাল্লারা কারাভেলার গা বেয়ে জলে নামতে থাকে। মাল্লাদের দাঁতে ধরা তরবারিগুলি ভুষোকালি মাখিয়ে কালো রং করা যাতে আলো প্রতিবিচ্ছুরিত না হয়। প্রত্যেক মাল্লার কাঁধে জাল গুটিয়ে কুন্ডলী করা। নিঃশব্দে জলে নেমে তারা সাঁতার কেটে তীরবর্তী বাঁধের পিছনে এক এক করে জড়ো হতে থাকে।



গ্রামবাসীরা প্রথমটায় অতর্কিত ঝটিকা আক্রমনে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। দিয়োগোর লোকজন সেই সুযোগে পঙ্গপালের মত তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই তারা বিহ্বলতা কাটিয়ে বাঁশের লাঠি আর ধান কাটার কাস্তে নিয়ে প্রতিরোধ করতে শুরু করল। একাদশী এমন মরিয়া আত্মরক্ষা আশা করেনি। এক দীর্ঘকায় গ্রামবাসী লাঠির আঘাতে দুজন মালয় নাবিককে ভূপাপিত করে উন্মত্ত ষাঁড়ের মত ঘূর্নায়মান লাঠিতে তরবারির আঘাত প্রতিহত করতে লাগল। বাংলার লাঠি সঠিক হাতে বড় ভয়ংকর অস্ত্র – মালয় মাল্লাদের খর্বকায় অসি তার সঙ্গে এঁটে ওঠে না। এইসময় চীনা মাল্লারা গ্রামবাসীদের একাগ্রতা নষ্ট করার অভিপ্রায়ে গ্রামের কুটিরগুলিতে অগ্নিসংযোগ করতে লাগল। অন্ধকার চিরে আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিক আলোকিত করে দিল। এই ধ্বংসলীলার মধ্যে একাদশী শৃগালের মত লঘু ক্ষিপ্রতায় ঘুরে ঘুরে রক্তপিপাসু মালয়দের নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করতে লাগল। তার কাছে অকারণ হত্যা অনাবশ্যক , মার্কুইয়ের আদেশ যথাসম্ভব অধিক সবলদেহী পুরুষ বন্দী সংগ্রহ করা। এরমধ্যেই একপলকে দেখা গেল দীর্ঘদেহী গ্রামবাসীটি অবশেষে লুটিয়ে পড়ছে, চীনা তরবারীর আঘাতে তার উদরদেশ ছিন্ন, রক্তের ফোয়ারার মধ্যে পতিত হচ্ছে তার শরীর। চারিদিকে পুরুষদের ক্রুদ্ধ হুংকার, নারীদের আর্তনাদ আর শিশুদের ক্রন্দনধ্বনি। বাতাস ক্রমশ রক্ত, ক্লেদ আর দগ্ধ কুটিরের কটু গন্ধে ভারী হতে থাকে। তারপর একসময় সহসাই সব প্রতিরোধ শেষ হয়ে গেল।

কারাভেলার প্রতিহারী চীনদেশীয় য়ু লি একখন্ড বস্ত্রে তরবারি মুছতে মুছতে একাদশীর কাছে এসে দুবার পাঁচ আঙুল দেখিয়ে তর্জনী দিয়ে গলার উপর আড়াআড়ি চিহ্ন দেখায়। এর অর্থ দশজন শত্রু নিহত। একাদশী তাকে অতিক্রম করে গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে সরেজমিনে পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। পথের দুইধারে পর পর কুটিরগুলি আগুনে পুড়ছে। জালে বেঁধে বন্দী পুরুষদের টেনে আনা হচ্ছে পথের মধ্যে। এখন একাদশীকে মাথা গুনতি করে দেখতে হবে কতজন বন্দী সংগ্রহ হয়েছে। বৃদ্ধ ও শিশুদের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে অরন্যে পলাতক হয়েছে। মাল্লারা এদের পশ্চাৎধাবন করে নি। কাল সকাল হওয়ার পূর্বেই পলাতকদের অনেকেই বাঘ ও কুমীরের খাদ্য হবে। হল্লা করতে করতে দুজন মালয় নাবিক এক যুবতীকে হিঁচড়ে টেনে আনতে লাগল। একজন তার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ঠেসে ধরল আর অন্যজন তাকে নগ্ন করে অশ্বারোহনের ভঙ্গিতে ধর্ষণ করতে লাগল। একাদশী তিক্তমুখে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে। পর্তুগীজ হানার এই হল রীতি। বিজিতকে লুন্ঠন ও ধর্ষণ জলদস্যুদের পুরস্কারস্বরুপ। একটি গর্জন গাছের কান্ডে হেলান দিয়ে একাদশী তার শ্বাস ও চিন্তা একত্র করার চেষ্টা করতে লাগল।


দিয়োগো না বলে দিলেও পর্তুগীজ হানার অলিখিত নিয়ম হল, সক্ষম পুরুষদের বন্দী করে শিশু ও বৃদ্ধদের মেরে ফেলা। একাদশী এই নিয়মটি উল্লঙ্ঘন করে ফেলেছে। যদিও শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে ফেলে যাওয়া হত্যারই নামান্তর। নারীদের নিয়ে আরেক সমস্যা, যদি না মালয় আর চৈনিক দস্যুরা তাদের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে। নেতিধোবানি গ্রামে নেমে আসা নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসে ধর্ষিতা নারীদের বুকফাটা হাহাকার আর জলদস্যুদের সম্মিলিত হাসির শব্দ। এদাদশী আকাশের দিকে চাইল।

বাঙ্গালার নদীমোহনার দেশে নক্ষত্রখচিত আকাশের এক অন্তর্ভেদী চেহারা আছে – সে শ্যামাঙ্গী আয়তলোচনা বঙ্গললনার মত রুপসী কিন্তু বাল্যবিধবার মত উদাসীন। বৃক্ষরাজির মাথার উপর নক্ষত্রমন্ডলীর মধ্যে একাকী বিষন্নতায় পৃথিবীর দিকে চেয়ে আছে স্বাতী তারা। সেই আলোকবিন্দু যেন অসীম লজ্জা ও দুঃখে এই ধ্বংসলীলা দেখছে। জ্বলন্ত পল্লীকুটিরের আগুনে আবছা দেখা যায় প্রাচীন অটবীগুলি নদীর বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। একাদশী মনে মনে তার ইষ্টদেবী সর্পমাতা মনসাকে স্মরণ করে। অদৃষ্টের প্রবল বাতাসে সে পালকের মত উড়ে চলেছে। এটিই তার নিয়তি। মা মনসা কি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?

য়ু লি এদাদশীর পিঠে টোকা দেয়। ফিরে তাকাতে সে তার ভাবলেশহীন নরুনচেরা চোখে তাকিয়ে নিজের বুকের উপর হাত রাখে। তারপর চারটি আঙুল দেখিয়ে তর্জনী দিয়ে গলা কাটার ইশারা করে। অর্থাৎ আজকের অভিযানে দিয়োগোর চারটি মাল্লা মারা পড়েছে। এতে কারুর তেমন কিছুই যায় আসে না, তবে একাদশীকে এই দেহগুলি নদীর জলে সমাহিত করতে হবে। তরবারিতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কর্কশ কন্ঠে একাদশী ডাক দিল, শুন হে সগলে!

একাদশী যশোহরের কথ্যভাষায় কথা বলে, এই ভাষা কারাভেলার মাল্লাদের বুকে কাঁপুনি ধরায়। ধীরে ধীরে হানাদারেরা এক জায়গায় জড়ো হতে লাগে। এমনিতেই তাদের পরিধেয় ছিন্ন ও নোংরা, এখন তাতে রক্তের দাগও লেগেছে। কয়েকটি মালয় নাবিকের নিম্নাঙ্গ নগ্ন, তাদের শিশ্নগুলি এখনও উত্থিত ও ধর্ষনসিক্ত। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে জালে আবদ্ধ পশুর মত কতিপয় হতভাগ্য মানুষ ত্রাসবিস্ফারিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মালাক্কার জারজ ছাওয়ালেরা! মাগীগুলিকে এইবার ছাড়। এক্ষনি! একাদশী ধমকের ভঙ্গিতে বলে। এই সম্ভাষণে এরা অভ্যস্ত। নাবিকগুলি অস্ফুটে প্রতিবাদ করতে থাকে। এখনও গুটিকয়েক গ্রাম্যবধুকে ধর্ষণ করা বাকি, কিন্তু অনিচ্ছা সত্বেও তারা ফিরে আসে। একাদশীর আদেশ অমান্য করার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু।

একাদশী চৈনিক নাবিকদের উদ্দেশ্যে বলল, ওহে চীনাবাঁদরের দল, দু কুড়ি দাস জোগাড় হয়েছে? উত্তরে য়ু লি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।

এদের নাউয়ে নিয়ে যাও। সাবধান, য়ু লি নজর রাখবে কিন্তু। একটিও যদি পালায় তাহলে মালয় মিনসেদের কান আর চীনাবাঁদরদের নাক কাটা যাবে। একাদশীর নির্দেশে ধীরে ধীরে সারিবদ্ধভাবে জালে বাঁধা দাস ও দিয়োগোর লোকজন নদীর জলে নেমে জাহাজে উঠতে শুরু করে। একাদশী শেষবারের মত অকুস্থলের দিকে ফিরে দেখতে যেতেই স্ত্রীলোকটিকে দেখতে পেল।



গ্রামের পথের প্রান্তে একটি স্থান অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। এক নারী সেখানে সিন্দুরমাখা গ্রাম্যদেবীর মত স্থানু হয়ে বসে আছে। চারিদিকে রক্তের দাগ আর মৃতদেহ, তার মধ্যে দীর্ঘাকৃতি গ্রামবাসীটির দেহ সে আঁকড়ে ধরে আছে। আশ্চর্যভাবে মালয় দস্যুরা একে রেহাই দিয়েছে, সম্ভবত তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে অভিশাপের ভয় ছিল। নতুবা এই নারী উদ্ভিন্নযৌবনা, বাতাসে তার আলুলায়িত কেশ উড়ে গলায় মুখে জড়িয়েছে আর ছিন্নমলিন শাড়ি অসংবৃত হয়ে উন্নত বক্ষদেশ দৃশ্যমান। রক্তমাখা হাতেমুখে সেই নারী অপলক চেয়ে আছে একাদশীর দিকে, তার চোখদুটি অঙ্গারের মত জ্বলছে।

এখন জৈষ্ঠ মাস, রাত্রির বাতাস শোনিতের মত উষ্ণ – নদীমোহনায় এখনও বৃষ্টি আসেনি। কিন্তু এইসময়ে বাঙ্গালার গ্রামে গ্রামে কালবৈশাখীর ঝড় হয়। দুরে কোথাও বজ্রনির্ঘোষ হয়ে বাতাসের ঘুর্ণি একরাশ ঝরাপাতা উড়িয়ে নিয়ে বধূটির চারিদিকে জাদুর মত ঘুরতে লাগল। সকলে অবাক হয়ে এই অপ্রাকৃত দৃশ্য দেখতে থাকে। একাদশী নারীটির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিস্পৃহভাবে বলল, মড়া ছেড়ে দাও। সৎকার করি।

বধূ অকস্মাৎ বিদ্যুৎগতিতে একাদশীকে আক্রমণ করে বসল। তার হাতে লুকানো ছিল একটি শানিত কাস্তে, সাপের উদ্যত ফনার মত সেটি ধেয়ে এল একাদশীর কন্ঠনালীর দিকে। কোনক্রমে শেষ মুহূর্তে একাদশী আঘাত এড়িয়ে মেয়েটির হাত চেপে ধরল বটে কিন্তু কাস্তের ফলা তার বাহু ছুঁয়ে গেল। একাদশীর মুঠির মধ্যে নারীটি ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত পাক খেতে লাগল আর তার কন্ঠ থেকে নিঃসৃত হতে থাকল বাঘিনীর মত গর্জন। দা কুনহা এগিয়ে এসে তার মাথা লক্ষ্য করে কাতান তুলতে একাদশী চিৎকার করে বলল, না!

দা কুনহা সেই নির্দেশে নিশ্চল হয়ে যেতেই বধূটি হতোদ্যম হয়ে একাদশীর পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। একাদশী তার হাত থেকে সতর্কভাবে কাস্তে কেড়ে নিয়ে দুরে নিক্ষেপ করল। নারী উচ্চস্বরে ক্রন্দন করে। দীর্ঘ, তীব্র ও বিলাপপূর্ণ সেই হাহাকার প্রাগৈতিহাসিক অভিশাপের মত নিভন্ত আগুনের আলোকে গ্রামের আকাশ বাতাস মথিত করে দিতে থাকে।

একাদশীর নির্দেশে দস্যুর দল আবার জাহাজের দিকে ফিরল, কিন্তু বধূটি একাদশীর পা আঁকড়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। তার মুখ ধূলিধূসর, অশ্রুর ধারা তার মধ্যে আঁকিবুকি কেটেছে। একাদশী ফের আকাশের দিকে তাকাল। সে এই অরন্যের শ্বাপদ; দু কুড়ি দশ বছর এই নিষ্ঠুর জলজঙ্গলের জীবন আর মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে সে হেঁটেছে কেবলমাত্র এক বন্য প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়। একাদশী জানে এই সদ্যবিধবা নারীর পক্ষে এখন মৃত্যুই শ্রেয়। কিন্তু মনের চলন বড় বিচিত্র। অনেক সময় মানুষের মন যা স্বাভাবিক তাকে অস্বীকার করে অসম্ভবের দিকে ধাবিত হয়। ক্রন্দনরতা যুবতীর মাথায় হাত রেখে সে বলল, কেন্দো না। ভগমান যা চায় তাই হবে। কেন্দো না মাইয়া।

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!