যাত্রীর নির্দেশে সারথি অশ্বচালিত শকটকে তীক্ষ্ণ ঘর্ষধ্বনি করে গতিরুদ্ধ করল। সবে মাত্র উষার উন্মেষ হচ্ছে, এখনো হুগলী শহর নদীর থেকে ভেসে আসা কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে নিদ্রামগ্ন। যাত্রী শকট থেকে অবতরণ করে তাঁর রাজপরিচ্ছদের গলাবন্ধ দৃঢ়নিবদ্ধ করলেন। উষার অব্যবহিত পূর্বে বৃষ্টি হয়েছিল, বাতাসে জলজ শীতল স্পর্শ অনুভব করা যায়। তিনি সিক্ত কর্দমাক্ত খননকারীদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তাঁর আদেশে হুগলী শহরের তিন দিকে সুবিশাল পরিখা খনন করা হচ্ছে। ভোরের আবছা আলোয় দেখা যায় বহু মানুষ সেই পরিখা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত।
একটু নিকটবর্তী হতে পরিখার ভিতর থেকে একজন টুপি তুলে তাঁকে সম্ভাষণ জানাল, ‘সুপ্রভাত কাপিতানো!’ কাপিতানো ঝুঁকে সম্ভাষণকারীকে দেখতে লাগলেন। কর্দমাক্ত মুখটি জনৈক পর্তুগিজের, তার চোখদুটি হাসিতে উজ্জ্বল। ‘ধন্যবাদ প্রাইভেটিয়ার, তোমাকেও সুপ্রভাত’ বললেন তিনি। একথা বলার সাথে সাথে আশেপাশের আরও কিছু শ্রমিক বলে উঠল, ‘সুপ্রভাত কাপিতানো, এইবার চা আর কুকির ব্যবস্থা হোক তাহলে।’ সকলে সশব্দে হাস্য করতে লাগল।
পর্তুগীজ হুগলীর সর্বাধিনায়ক কাপতিন মানোয়েল দি আজাভিদো অন্যমনস্ক ভাবে মৃদু হাসলেন। আসলে তাঁর মনোযোগ পরিখার দিকে। পরিখার সন্মুখভাগে অনুভূমির সঙ্গে পর পর ত্রিশ ডিগ্রি কোণে মজবুত বাঁশের খুঁটি পোঁতা, খুঁটিগুলির মুখ পূর্ণবয়স্ক মানুষের বক্ষের উচ্চতায় সুচালো করে কাটা। খুঁটিগুলি ঠেকা দিয়ে জোড়া, মধ্যে তীক্ষ্ণ কাঁটা তারের সারি। এগুলি যুদ্ধাশ্ব প্রতিরোধের পর্তুগীজ কৌশল। খুঁটির বেড়া আর পরিখার মধ্যবর্তী স্থানে মাটি ফেলে অনুচ্চ বাঁধের মত তৈরি করা হয়েছে, এর পিছনে মাস্কেট বাহিনী আড়াল নেবে। এই বেড়া আর পরিখা কমপক্ষে আট লীগ ব্যাপী একটি রেখার মত পর্তুগীজ ভবন, কাছারি আর চার্চগুলিকে বেষ্টন করে রেখেছে। কাপতিন মানোয়েল দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন – যদিও স্থানীয় মানুষের ধারণা বিপরীত, তিনি জানেন পর্তুগিজরা হুগলীতে কখনোই দুর্গ তৈরি করেনি। তারা কেবলমাত্র সৈন্যনিবাস বানিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, আজ একটি দুর্গের অভাব তাদের কাছে জীবন-মরণের পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। হুগলী শহরের একদিকে নদী, অন্য তিনদিক অরক্ষিত। সরস্বতী আর হুগলী নদীর মধ্যকার এই অপ্রশস্ত স্থান এবং হুগলী নদী আসলে পর্তুগীজ উগোলিম শব্দের স্থানীয় অপভ্রংশ, এই শব্দের অর্থই হল অপ্রশস্ত স্থান।
পরিখায় কর্মরত মানুষগুলির মধ্যে পর্তুগীজ ও দেশীয় দুই-ই বর্তমান। এই দেশীয় মানুষদের অধিকাংশই গত শতাব্দীর ধর্মান্তরিত ভারতীয় খৃষ্টান। এদের অনেকেই পর্তুগীজ নাম ধারণ করেছে এবং অনর্গল পর্তুগীজ ভাষায় কথোপকথন করতে সক্ষম। বিগত দুইশত বৎসর পর্তুগীজরা বাঙ্গালার দক্ষিণাংশে বসবাস করছে, ফলে কালিকট থেকে বোর্নিও পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখন্ডের মত দেশের এই অঞ্চলেও পর্তুগীজ ভাষা প্রধান কর্মভাষায় পরিনত হয়েছে। এমনকি ওলন্দাজ ও ইংরাজ বনিকরাও ব্যবসার তাগিদে হুগলী ও সন্নিহিত অঞ্চলে পর্তুগীজ ভাষাই ব্যবহার করে। কিন্তু অনুকরণপ্রিয় দেশীয়রা শুধু কাজের প্রয়োজনেই পর্তুগীজ বলে না, তারা নিরন্তর শত শত পর্তুগীজ শব্দ কথ্য বাঙ্গালার শব্দভান্ডারে গ্রহণ করে চলেছে। পর্তুগীজ বনিক প্রকাশ্যে উপপত্নী গ্রহণ করে না, বাঙ্গালী রমণীর গর্ভসঞ্চার করে ফেললে পিতৃত্ব স্বীকার করে তাকে খৃষ্টীয়মতে বিবাহ করাই দস্তুর। তবে তারজন্যে ঐ রমনীর ধর্ম পরিবর্তন আবশ্যক। বাঙ্গালায় আগত প্রথম ইয়ুরোপীয় জাতি হিসাবে পর্তুগীজরাই এদেশে উপনিবেশ স্থাপনের যোগ্য ছিল। দুর্ভাগ্যবশত স্পেন ও পর্তুগালের রাজশক্তি ব্যবসায়ের অতিরিক্ত রাজনৈতিক ক্ষমতাবিস্তারে আগ্রহী ছিল না। উপরন্তু ধর্ষণ, লুন্ঠন ও বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের আতিশয্যে পর্তুগীজরা নিজেরাই নিজেদের বিনাশ ত্বরান্বিত করছিল। প্রভাতের প্রসন্ন রৌদ্রে দীর্ঘ পরিখার মধ্যে শত শত কর্মচঞ্চল মানুষের শ্রেণীর দিকে চেয়ে মানোয়েল ফের দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল, পর্তুগালে স্পেনীয় আধিপত্য পর্তুগীজ জাতিচরিত্রকে দুটি ভিন্ন মেরুতে বিভক্ত করে দিয়েছে। গোয়া আর হুগলীতে পর্তুগীজরা সম্ভ্রান্তবংশীয় বনিক ও উদ্যোগপতি – তারা এই দেশের ভাষাসংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও প্রযুক্তিগত বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। অন্যদিকে সুন্দরবন, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামের পোর্তো গ্রান্ডিতে এই পর্তুগীজরাই আরাকানদের সঙ্গে মিলে শাসনহীন জলদস্যুরুপে মানুষের কাছে ত্রাস। পর্তুগীজদের এই অবিমিশ্রকারিতা এবং বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণের ফলে আত্মরক্ষার নৈতিকতাও শূন্যগর্ভ হয়ে পড়েছে।
ক্রমসঞ্চরমান হতাশা ও মানসিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করতে করতে মানোয়েল দি আজাভিদো সকাল সাত ঘটিকায় তাঁর সৈন্যনিবাসের মন্ত্রণাকক্ষে আসন্ন সভার কথা মনে করলেন। এই সভায় কোন দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া ঘোরতর অনুচিত হবে। অশ্বশকটে আরোহন করে মানোয়েল স্থানত্যাগ করলেন।
ব্যারাকে পৌঁছতেই ফের বৃষ্টি শুরু হল। শকট থেকে অবতরণ করতেই মানোয়েল দেখলেন পোর্তিকোর দ্বারে মায়া আর ডেভিড দাঁড়িয়ে আছে। তিনি নিচু হয়ে তাঁর বাদামীবর্ণ পুত্রের মস্তক চুম্বন করে স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। ক্যাথরিন মায়াবতী তাঁর দশ বৎসরের ধর্মপত্নী। মায়াবতী আদতে গোয়ার এক কোঙ্কনি নৃপতির কন্যা, কিন্তু শৈশব থেকেই সে বাঙ্গালায় বড় হয়েছে – এমনকি খৃষ্টান হওয়ার পরও কালিপূজা বন্ধ হয়নি তার। মৃদুভাষী, দয়াবতী ও নিষ্ঠাবতী এই নারীকে মানোয়েল প্রাণের অধিক ভালোবাসেন।
মায়া মানোয়েলের সভার কথা জানে। সে মানোয়েলের দিকে প্রীতিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি স্নান করে প্রাতরাশ করবে না আগে?
না সেনোরা, তোমার হাতের পুডিং খেয়ে আমার উদরস্ফীতি হচ্ছে। মানোয়েল স্মিত হেসে নিজের মধ্যভাগের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলেন। কিন্তু আমাদের ছোট সেনাধ্যক্ষের কি হল, চোখে জল কেন? ডেডিডের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
উত্তরে মায়া কটাক্ষপাত করে বলল, দিয়োগোর জন্যে মনখারাপ। সে সুন্দরবন থেকে ব্যাঘ্রশাবক এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে।
মানোয়েল দুহাতে ডেভিডকে শূন্যে তুলে নিয়ে তার চোখের দিকে চাইলেন। এ শিশু কতখানি পর্তুগীজ? এই আশ্চর্য দেশ তাঁর হৃদয়ের গভীর গোপনে প্রবেশ করেছে। তিনিও এখন জানেন না তিনি নিজে কতখানি পর্তুগীজ আর কতটা বাঙ্গালী। ডেডিডকে মাটিতে নামিয়ে তার কৃষ্ণকেশে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, মার্কুই যখন বলেছে তখন আর চিন্তা কি? আর সেনাধক্ষদের কখনো কাঁদতে নেই।
ডেভিডকে কোলে নিয়ে মায়া বলল, যুদ্ধ এড়ানোর আর কোন উপায় নেই তাহলে, কাপিতানো? মায়াবতীর চোখদুটি একই সঙ্গে প্রসন্ন ও বিষন্ন, মানোয়েল যতবার এই চোখদুটি দেখেন ততবার তাঁর হৃদয়ে আবেগের সঞ্চার হয়। শৈশব থেকে যুদ্ধ ও অস্ত্রচালনাই তাঁর শিক্ষা কিন্তু মায়াবতীর প্রতি প্রেম তাকে কবিয়াল হতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বাঙ্গালার পথে প্রান্তরে এই ফকির কবিয়ালদের গান গেয়ে বেড়াতে দেখেছেন। কোন মালিন্য দুঃখ এদের স্পর্শ করতে পারে না। গোপনে তিনি তাদের দুএকটি গীত আয়ত্ব করেছেন, কোন একদিন মায়াবতীকে সেই গানগুলি শুনিয়ে তিনি বাহবা পেতে চান। মায়াবতীর জন্য মানোয়েলের গৃহসুখের তীব্র আকাঙ্খা। সেনাধ্যক্ষের কঠিন আবরণে মানোয়েল এই দুর্বলতা গোপন রাখতে রাখতে বললেন, না। কোন উপায় নেই। মুঘলরা এমনকি শান্তিউৎকোচ প্রত্যাখ্যান করেছে। কথা বলতে বলতে মানোয়েল তাঁর ঘরে প্রবেশ করেছেন, সেখানে তিনি কর্দমাক্ত পাদুকাদুটি পরিহার করে একজোড়া নতুন পাদুকা গ্রহণ করলেন।
মায়াবতী কোন উত্তর করল না। মানোয়েল সভাগৃহে যাত্রার জন্যে উদ্যত হলে সে তাঁর কাঁধে হাত রাখল শুধু। মানোয়েল তার প্রতি দৃষ্টি পরিহার করে হাতের উপর হাত রেখে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে মায়া।
কিন্তু সব কিছু ঠিক হওয়া মানুষের হাতে থাকে না।

পর্তুগীজ যুদ্ধ মন্ত্রণাকক্ষের পরিবেশ আদৌ উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সভাগৃহে সেনাদের তুলনায় যাজক ধর্মগুরুদের সংখ্যাধিক্য। মানোয়েল লক্ষ্য করলেন উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে যুদ্ধ পরিকল্পনা করার মত কেবলমাত্র তিনজন নির্ভরযোগ্য সেনাপতি আছে। ম্যানরিক একজন অভিজ্ঞ সমর বিশারদ, এঁর নিয়ন্ত্রণে আছে একটি ক্ষুদ্র গোলন্দাজ বাহিনী। কিন্তু ম্যানরিক প্রায় বৃদ্ধ এবং ইদানীং শারীরিকভাবে খুব সক্ষমও নন। দ্বিতীয়জন হল বর্ণসংকর দা সিলভা। দা সিলভা অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্বে আছে। তরুণ দা সিলভা এক অসমসাহসিক অশ্বারোহী সৈনিক, কিন্তু তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কম। তৃতীয়জন সম্ভবত মানোয়েলের চেয়েও দক্ষ সেনাধিপতি আরেক মানোয়েল, মহান পর্তুগীজ নৃপতি পেদ্রো তাভারেসের জ্যেষ্ঠপুত্র মানোয়ল তাভারেস। দুর্ভাগ্যবশত এই মানোয়েল তার যৌবনের একটি ভুল সিদ্ধান্তের জন্য বাঙ্গালার সমগ্র পর্তুগীজ জাতির বিপদ ডেকে এনেছে এবং মানোয়েল দি আজাভিদোর নিকট কর্তৃত্ব খুইয়েছে। এক দশক আগে যখন বর্তমান মুঘল সম্রাট শাহজাহান শাহজাদা খুররম নামে পরিচিত ছিলেন তখন তিনি উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে পিতা জাহাঙ্গীর ও কুচক্রী খালা নুরজাহান দ্বারা সুবা বাঙ্গালায় নির্বাসিত হয়েছিলেন। এই সময় খুররম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও সমরাভিযান করলে মানোয়েল তাভারেস তাঁকে সাহায্য করতে প্রবৃত্ত হন। ঢাকার পর্তুগীজ গভর্নর মিগুয়েল রড্রিগেজ রাজনৈতিক কারণে মুঘলদের এই পারিবারিক বিবাদে জড়াতে অসন্মত ছিলেন। কয়েক শত অশ্বারোহী এবং ডজনখানেক যুদ্ধজাহাজ নিয়ে খুররমের বিদ্রোহী সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েও রড্রিগেজের আদেশে যুদ্ধের এক নির্নায়ক মুহূর্তে মানোয়েল তাভারেসকে সরে দাঁড়াতে হয়। মুঘল বাহিনীর হাতে খুররমের বিদ্রোহী সৈন্যদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবীই ছিল, কিন্তু খুররম এই বিশ্বাসঘাতকতা মনে রেখেছিল। এরপর থেকে পর্তুগীজরা আর কখনোই মানোয়েল তাভারেসকে কোন দৌত্যে ব্যবহার করতে পারে নি।
মানোয়েল দি আজাভিদো ধর্মযাজকদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। পাদ্রীদের দলের মধ্যে একজন বৃষস্কন্ধ লোক বসে আছে; লোকটির শুভ্র দাড়ি আর মাথাটি অতিকায় একটি গোলকের মত। পরনে ধার্মিকদের কালো আঙরাখা আর রজ্জুর কোমরবন্ধ থাকলেও লোকটির থেকে একপ্রকারের বেপরোয়া সাহস এবং শক্তির অদৃশ্য বিকিরণ অনুভব করা যায় যেন। আশেপাশের যাজকদের মধ্যে একে মার্জারকুলে সিংহসদৃশ মনে হয়। মানোয়েল জানেন এর নাম সান্তিয়াগো কাবরাল। কাবরাল বন্দেলের নোসা সেনরা দো রোসারিওর মুখ্যযাজক। জনশ্রুতি আছে ইনি একাই দশ হাজারের বেশি কৃতদাসকে খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিতকরণ করেছেন। এই ধর্মান্তরিতকরণের জন্যে কাবরাল মানুষের নখ উপড়ে নিতেও পিছপা নন।
মানোয়েল হাত তুলতেই সভাগৃহে নীরবতা নেমে এল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত মুখগুলির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ভদ্রমহোদয়গণ! আমি সুবক্তা নই। ফলে সোজা কথা সংক্ষেপে বলব। প্রথমেই বলি মুঘল শাসকরা আমাদের বলপূর্বক এক অন্যায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে বাধ্য করছে। আমরা শান্তিস্থাপনের জন্যে সর্বতো ভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাতে কোন ফল হয়নি।
ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন নীচু স্বরে বলল, মুঘলরা খামখেয়ালি, তাদের সাথে তর্ক করা অর্থহীন। মানোয়েল তাকে অগ্রাহ্য করে বলতে লাগলেন।
ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের ঘোষিত কারণ থাকে। আমরা খৃষ্টানরা একে কসাস বেলি বলি। আমাদের শান্তিদূতদের মুঘলরা সরকারীভাবে যে কারণগুলি বলছে সেগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাশিম খান সম্রাটকে যে বার্তা পাঠিয়েছে তারই নামান্তর। আপনাদের সেগুলো বলি।
মানোয়েল একটি পর্চা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন। সেখানে লেখা আছে, “বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের অনুমতি লইয়া পর্তুগিজগণ ব্যবসাবণিজ্যের পরিবর্তে হুগলীর সামরিকীকরণ করিয়াছে। বর্তমানে ইহারা এতই দুর্বিনীত ও দুষ্ট যে শাহি প্রজাকুলের উপর নৃশংস অত্যাচার করে। আদি সপ্তগ্রামের মুঘল বন্দর হইতে সমস্ত বাণিজ্য ইহারা বলপূর্বক হুগলীতে স্থানান্তরিত করিয়াছে এবং ধৃষ্টতাপূর্বক ইহাদের ফ্যাক্টরির সন্মুখ দিয়ে যাতায়াতকারী সকল নৌকা ও পোতগুলির থেকে ইহারা বেআইনিভাবে কর আদায় করিয়া থাকে। পর্তুগিজগণ নারী পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে অপহরণপূর্বক হিন্দুস্তানের অন্যত্র এবং বাহিরে কৃতদাসরূপে বিক্রয় করে, তাহাদের একাংশ মগদের সহিত মিলিত হইয়া গঙ্গার পূর্বতীর বরাবর মুঘল প্রজাদের গ্রামগুলিতে লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মত ঘৃণ্য অপরাধ সংগঠিত করে। এই দুরাচারের শাস্তিস্বরূপ পর্তুগিজগণকে হুগলী থেকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মহামতি মুঘল সম্রাটের আদেশক্রমে উহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হইল।”
চতুর্দিক হতে ক্রুদ্ধ প্রতিবাদের মধ্যে ফাদার কাবরাল উঠে দাঁড়িয়ে বজ্রকন্ঠে বললেন, কাশিম খান একজন ধর্মান্ধ মোসলেম, তার বিবরণী শুনে কি লাভ? আমরা শত শত ভাগ্যহীন বিধর্মীদের অন্তরে প্রভু যেসুর করুনালোক দান করে তাদের উদ্ধার করেছি। মুঘল সম্রাটের প্রদত্ত অধিকারবলে আমরা বাঙ্গালায় স্বাধীন বাণিজ্য ও ধর্মাচরণ করে থাকি। এর জন্য আমরা অবশ্যই কর আদায় করবার অধিকারী। কিন্তু কাপিতানো, আপনি কি এজাতীয় অন্যায় অভিযোগ সাধারণ অপরাধীদের মত মেনে নিচ্ছেন নাকি?
ফাদার কাবরালের মন্তব্যে সভায় এক অদৃশ্য উত্তেজনাতরঙ্গ সৃষ্টি হল। সকল যুদ্ধবিগ্রহের এক অন্যতম চালিকাশক্তি ধর্মবিরোধ। যদিও যুদ্ধের বাস্তবতার সঙ্গে ধর্মের তেমন সম্পর্ক থাকে না। মানোয়েল তাঁর চিন্তা ও বিবেচনাবোধকে একাগ্র রাখার চেষ্টা করতে লাগলেন। ফাদার কাবরালকে সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি সভার উদ্দেশ্যে বললেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে আমাদেরই একজন, যদিও সে বর্ণসংকর, আমাদের মহান নৃপতির বিরাগভাজন হওয়ার কারণে মুঘলদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সে নিশ্চয়ই কাশিম খানকে অর্ধসত্য বলে প্রভাবিত করেছে।
বিশ্বাসঘাতক মারতিম আফনসো নিপাত যাক, নিপাত যাক। চারিদিক থেকে অপেক্ষাকৃত তরুণ পর্তুগিজরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে লাগল।
মানোয়েল অপেক্ষা করতে লাগলেন কতক্ষণে সভা শান্ত হয়। ধীরে ধীরে উত্তেজনা প্রশমিত হলে তিনি পুনরায় বলতে শুরু করলেন, আমি স্বয়ং কাশিম খানকে পত্র লিখে জানিয়েছি যে হুগলীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং মারতিম আফনসো ও তার সহচরদের উর্বর কল্পনাপ্রসুত। প্রয়োজনে আমরা আন্তর্জাতিক বনিককুলের এবং মুর আদিবাসী, যারা এ অঞ্চলে বহুকাল ব্যবসা করছে, তাদের প্রামাণ্য তথ্য দিয়ে এর অসারতা প্রতিপন্ন করতে পারি। লুণ্ঠন অপহরণের জন্যে কিছু প্রাইভেটিয়ার পর্তুগীজ দায়ী হতে পারে, কিন্তু আমাদের কাছে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাদা পারভেজের লিখিত ফরমান আছে যেখানে বলা আছে কিছু ব্যাক্তি মানুষের অসদাচারণের জন্যে সামগ্রিকভাবে বন্দেল বা হুগলীকে দায়ী করা যাবে না।
এই কথা শুনে সভাকক্ষে প্রশংসাসূচক হর্ষধ্বনি হল এবং যাজকদেরও প্রসন্ন দেখাতে লাগল। কিন্তু মানোয়েল অন্তরের অন্তস্থলে এক বিষন্ন শূন্যতা অনুভব করছিলেন। তিনি বিলক্ষণ অবহিত আছেন যে কাশিম খান আর যাই হোক, ধর্মান্ধ নয়। বস্তুতপক্ষে তার অমুসলিমচিত আচরণের জন্যে সে নুরজাহান ও ঔরংগজেবের মত গোঁড়া মুসলিমদের চক্ষুশূল। একজন পেশাদার সমারবিশারদ রূপে মানোয়েল কাশিম খানের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন – ঘোষিত শত্রুর প্রতি তাঁর এই দুর্বোধ্য মনোভাব তিনি সযত্নে গোপন রাখেন। মানোয়েল এও জানেন যে, মুঘল সনদে কেবলমাত্র অনুমতিক্রমে ধর্মান্ততরিতকরণের উল্লেখ আছে, ফাদার কাবরালরা সর্বদা অনুমতির অপেক্ষা করেন না। তাছাড়া পর্তুগীজ জলদস্যুদের এখন যতই প্রাইভেটিয়ার ইত্যাদি বলে আলাদা করা হোক, বাঙ্গালার আদিবাসী, বিশেষত মুঘলদের এহেন পার্থক্য করার কোন দায় নেই, ফলে সমগ্র বাঙ্গালায় পর্তুগিজরা ফিরিঙ্গি নামে ঘৃণিত। এই অস্বস্তিকর সত্য বোঝার মত বয়েও মানোয়েলকে হুগলীরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এর জন্যে শুধু যুদ্ধ করলেই যথেষ্ট হবে না, তাঁকে রাজনীতির নেতাদের মত অর্ধসত্যের আশ্রয় নিতে হবে, এটাই মর্মপীড়ার কারণ।
যাই হোক, মুঘলদের দাবি আমরা, পর্তুগিজরা জাতি হিসেবে হুগলীর শাহি মহলে দুরাচার করেছি এবং এতদ্বারা মুঘল সম্রাটের বদান্যতার মর্যাদাহানি করেছি। সভাগৃহ কিঞ্চিত শান্ত হতে মানোয়েল বললেন, বন্ধুগণ, দুয়ারে যুদ্ধের ঘণ্টা বাজছে; আমাদের এখন পেড্রো তাভারেস দ্বারা বৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত হুগলী নগরীর প্রতিরক্ষা করতে হবে। ম্যানরিক, আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর কি পরিস্থিতি?
ম্যানরিক আসনে বসে থেকেই নিরাসক্তভাবে উত্তর দিল, পঞ্চাশটি একশ পাউন্ডের কামান আছে আমাদের। দশটি ব্যারাকের ছাতে বসানো হয়েছে নদীর দিকে মুখ করে। কুড়িটি নগর পরিখার পিছনে বসানো হয়েছে। বাকিগুলি শকটে জুড়ে বন্দেলের অগ্রবর্তী অঞ্চলে পাঠানো হচ্ছে। আমাদের হাতে এক সপ্তাহ চলবার মত গোলাবারুদ আছে।
মানোয়েল মনে মনে হিসেব করছিলেন। মুঘলদের তুলনায় পর্তুগীজ গোলন্দাজ বাহিনী শিশুর খেলনার মত। প্রত্যেক মুঘল সমরতরীতে এক ডজন পঞ্চাশ পাউন্ডের কামান থাকে। বন্দেলের কাছে মুঘলদের অন্তত একশ জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। গুপ্তচরেরা খবর এনেছে বিহার থেকে মুঘল গোলন্দাজ বাহিনী হুগলীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে; সেই বাহিনীতে হাতিতে টানা অতিকায় কিছু পাঁচশ পাউন্ডের কামানও আছে। মুঘলরা এই কামানগুলিকে জীবন্ত মনে করে নামকরণ করে। এগুলির নিশানা একেবারেই ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু এদের এক একটি গোলা একটি অট্টালিকাও ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। মানোয়েল দা সিলভার দিকে তাকালেন।
তোমার পরিস্থিতি কি দা সিলভা? বললেন তিনি।
– ‘হুগলী, বলাগড় আর বন্দেল মিলিয়ে আমাদের পাঁচশ অশ্বারোহী সৈনিক আছে, কাপিতানো। আর হাতে আরও দুশ সৈনিক আছে যদি অতিরিক্ত প্রয়োজন হয়।’
– ‘অশ্ব কতগুলি?’
– ‘পাঁচশ, কাপিতানো।’
– ‘এদের সম্পূর্ণ অস্ত্রসজ্জা দেওয়া হয়েছে?’
দা সিলভা নিম্ন স্বরে একজনের সহকারীর সঙ্গে আলোচনা করে জানাল, দুহাজার মাস্কেট আর যথেষ্ট সীসার গোলক আছে। বারুদও পর্যাপ্ত আছে। তরবারি এবং বল্লমেরও কোন অভাব নেই। কিন্তু যদি শুধু পর্তুগিজদের ধরি, দুশ জনের বেশি অভিজ্ঞ পদাতিক সৈনিক নেই। নিকট যুদ্ধে পদাতিক সৈনিক বেশি মারা যায়।
মানোয়েল চিন্তাক্লিষ্ট মুখে দা সিলভার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দুই মাস পূর্বে তিনি গোয়ার পর্তুগীজ ভাইসরয় ও চট্টগ্রামের আরাকানরাজের কাছে সৈন্য ও গোলাবারুদ চেয়ে দূত পাঠিয়েছেন। গোয়ার ভাইসরয় সরাসরি সহায়তা করতে পারেন হয়ত, কিন্তু আরাকানরাজ সম্ভবত কয়েকজন মগ দলপতির অতিরিক্ত কিছু পাঠাবেন বলে মনে হয় না। গোয়ার থেকে সাহায্য এসে পৌঁছাতে আরও এক মাস লাগবে। মানোয়েলকে অতি সতর্কতার সঙ্গে হুগলীর প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে এই এক মাসের মধ্যে তাঁর নিজস্ব বাহিনী বিনষ্ট না হয়। তিনি দিয়োগো তাভারেসের সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করে আনা দাসবাহিনীর উপরও নির্ভরশীল, কারণ যুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধে এদেরকেই পাঠাতে হবে।
মানোয়েলের চিন্তার জাল ছিন্ন করে ফাদার কাবরাল ফের হুংকার দিলেন। এইবার তাঁর স্বরে বিদ্রোহের সুর স্পষ্ট। তিনি আবেগরুদ্ধ কন্ঠে বলতে লাগলেন, কাপিতানো মনে রাখবেন যখন আস্থারক্ষার সংগ্রাম হয় তখন প্রত্যেক খৃষ্টান একেক জন সৈনিক। এই মুহূর্তে উগোলিমে ছয় হাজার খৃষ্টান আছে আর আমি নিশ্চিত যে এক হাজার জন হিন্দু মাঝি আমাদের পক্ষে থাকবে, কারণ তাদের সঙ্গে আমরা সদাচার করেছি।
মানোয়েল অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করছিলেন। তিনি ফাদার কাবরালের দিকে না তাকিয়ে বললেন, এই যুদ্ধ কোন ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে হতে যাচ্ছে। এমনকি মুঘল কসাস বেলিও সরাসরি কোন ধর্মীয় কারণের কথা বলছে না। উগোলিমের খৃষ্টানদের অর্ধেক বৃদ্ধ, মহিলা আর শিশু। ফাদার কি তাদেরকেও অস্ত্র ধরতে বলছেন?
ম্যানরিক শুষ্ক হেসে যোগ করল, খৃষ্টানদের মোটে চারশ জন পর্তুগীজ আর ইউরোপীয়। বাকিদের মধ্যে প্রভু যেসুর বাস সাময়িক।
ফাদার কাবরাল উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর দু হাত রাখলেন। তাঁর মুখ রক্তিমবর্ণ আর গোলকাকৃতি কেশহীন মাথায় স্বেদবিন্দুর সঞ্চার হল। গোল করে পাকানো একটি হাতে আঁকা মানচিত্র তিনি টেবিলের উপরে ছুঁড়ে ফেললেন। মানচিত্রটিতে হুগলী আর বন্দেলের অঞ্চল দেখানো আছে, আর সেই অঞ্চলের উপর আঁকা আছে অজস্র ক্রুশ চিহ্ন। ফাদার কাবরাল তাঁর স্ফীত অঙ্গুলি একটি ক্রুশ চিহ্নের উপর রেখে মানোয়েলকে বললেন, জমির দিকে দেখুন কাপিতানো। বন্দেল চার্চ বাদ দিয়ে হুগলীর আশেপাশে আশি টা ছোট বড় চার্চ আছে। তার মধ্যে অন্তত ষাটটায় ইঁট পাথরের মিনার আছে। সেগুলো কি আপনাকে কোন পরিকল্পনা দেয় না?
মানোয়েল হতবুদ্ধি হয়ে ফাদার কাবরালের দিকে চেয়ে রইলেন। এই যাজক কি যুদ্ধে যোগ দিতে চায়?
ফাদার কাবরাল শূন্যে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ম্যানরিকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আমাদের সেনাধিপতি মহাশয়ের মতে হুগলীর জনসংখ্যার অর্ধেকই নাকি যুদ্ধের জন্যে অকার্যকর! আমাকে সেই অকার্যকর অর্ধেকটাই দিন কাপিতানো। আমাকে দিন খৃষ্টান, আমাকে দিন দেশীয়, আমাকে দিন জেসুইট আর আগুস্তানিয়ান। চার্চ মহিলা আর শিশুদের জন্যে দরজা খুলে দেবে। হুগলীর প্রতিরোধে আমরা আপনাদের থেকে কিছু কম যাব না।
মহিলা ও শিশুরা ব্যারাক ছেড়ে কোথাও যাবে না। মানোয়েল পাথরের মত শীতল স্বরে বললেন। পঞ্চাশ জন সেরা পর্তুগীজ অশ্বারোহী আর দুই শত দাস সৈন্য তাদের প্রহরায় থাকবে।
ফাদার কাবরাল আর মানোয়েল দুজনে পরস্পরের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। সভাকক্ষে অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এল। তারপর এক সময়ে উত্তেজনা যখন বিস্ফোরক হয়ে উঠছে, মানোয়েল এক পা পিছিয়ে এসে বললেন, যদি হুগলীর অসামরিক পুরুষ যুদ্ধে যোগ দেয়, আমি আপত্তি করব না। কিন্তু মহিলা আর শিশুদের ব্যারাক ছেড়ে এক পাও নড়া চলবে না।
মানোয়েল দি আজাভিদো কাপুরুষ নন। তথাপি ভিতরে ভিতরে তিনি অসুস্থ বোধ করছিলেন। তাঁর কল্পনার চক্ষুতে ভেসে উঠছিল হুগলী শহর জুড়ে মৃতদেহের স্তুপ আর আগুনের এক ভয়ংকর ছবি। সেই ধ্বংসলীলার মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে এক শিশু, সে শিশুর মুখ অবিকল ডেভিডের মত। মানোয়েল-এর শরীর কেঁপে উঠল। তিনি এ দৃশ্য ঘটতে দিতে পারেন না।
মনের সমস্ত শক্তি একত্র করতে করতে মানোয়েল হতাশা আর বিষাদের প্রবাহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে দৃষ্টিপাত করলেন মানোয়েল তাভারেসের দিকে। সভাগৃহের এক কোণে মানোয়েল তাভারেস উদাসীন অন্যমনস্কতায় তার তরবারির হাতলটি নিয়ে খেলছে। এই যুবক অনেকটা তার ভ্রাতা দিয়োগোর মতই দীর্ঘাকৃতি ও সুপুরুষ – এর শরীরে রাজরক্ত বইছে। মানোয়েল তাভারেস হুগলী নগর ও নদীর সকল সামরিক ও অসামরিক নৌপরিচালনার প্রধান।
বন্ধু তাভারেস, আমার জন্যে কি আছে? সুসংবাদ না দুঃসংবাদ? আজাভিদো স্মিত হেসে বললেন।
দুইই। তাভারেস হাসতে হাসতে বলল। তার হাসিটি বড় মালিন্যহীন। প্রথমে দুঃসংবাদ দিই। আমাদের হাতে আছে ষাটটা ছোট যুদ্ধতরী, একশ আশিটা ডিঙ্গা আর কামান সহ মোটে দুটো কারাভেলা। সুতরাং আমাদের নৌবহর বলে কিছু নেই। প্রথাগত নৌযুদ্ধে মুঘলদের বিরুদ্ধে আমাদের জয়ের সম্ভাবনা শূন্য। এই পর্যন্ত বলে সে তার তরবারি তুলে ধরে মন দিয়ে ধার পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর ফের হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু সুসংবাদ হল, আমরা মুঘলদের তুলনায় ঢের বেশি দক্ষ, দ্রুত আর কৌশলী – মুঘলরা আদতে স্থলের জীব, আমরা জলের হাঙ্গর। সঠিক পরিকল্পনা করতে পারলে চোরাগোপ্তা আক্রমণে আর হাতাহাতি লড়াইয়ে আমরা মুঘল নৌবাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম।
তাভারেসের উৎসাহ মানোয়েলএর মনে উদ্দীপনার সঞ্চার করল। তাঁর মনে হল তাভারেসের উপর অনেকটাই ভরসা করা যেতে পারে। তিনি বললেন, অবস্থা বেগতিক হলে আমাদের হয়তো মহিলা ও শিশুদের নৌকাযোগে হুগলী ত্যাগ করে সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে ফেলতে হতে পারে। সে ব্যাপারে কি তোমার কোন পরিকল্পনা আছে?
অবশ্যই মার্কুই। মানোয়েল তাভারেস বলল। বস্তুতপক্ষে আমি হুগলী নদীতে ইতিমধ্যেই পন্টুন আর আগুন লাগানো নৌকার একটা জাল বিছিয়ে রেখেছি। প্রয়োজনে এই জাল ব্যাবহার করে মুঘল নৌবাহিনীকে বিভ্রান্ত করা যাবে। সেই সুযোগে আমরা পলায়ন করতে পারি। তবে এখানে একটা সমস্যা হতে পারে।
– কি সমস্যা?
– মারতিম আফনসোর কাছে এর খবর আছে কিনা আমি নিশ্চিত নই।
মানোয়েল প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবেন এমন সময় সভাকক্ষের কাঠের মেঝে কেঁপে উঠল। অব্যবহিত পরেই শোনা গেল দূরস্থিত কামান গর্জন। সভার সকলে উদ্বিগ্ন স্বরে কথা বলতে লাগল, কিছু লোক ব্যারাকের সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠে উঁকি দিয়ে দেখতেও লাগল।
হুগলীগড়ের পশ্চিম দিকে আদিগন্তবিস্তৃত ধান্যের ক্ষেত্র। আপাতসীমাহীন সেই হরিৎক্ষেত্র প্রভাতের আলোয় সমুদ্রের মত পড়ে আছে। দূরে, দিকচক্রবালের কাছে আবছা দেখা যায় তরুশ্রেনী আকাশের সঙ্গে মিশেছে। সেই তরুশ্রেনীর একাংশে এখন আগুন আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। কৃষ্ণ বর্ণের ধুম পাক খেয়ে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মানোয়েলএর চোখের সামনেই ফের দূরে আলোর ঝলকানি দেখা গেল, আর একটি ধোঁয়ার রেখা ধনুকের মত শূন্যে উঠে নেমে এল মাটিতে। রেখা ভূমি স্পর্শ করা মাত্রই ছিটকে উঠল অগ্নিবলয় আর কৃষ্ণ বর্ণের ধুম – ব্যারাকের ছাতও সামান্য কেঁপে উঠল।
এমন সময় দূর থেকে এক পর্তুগীজ অস্বারোহীকে ব্যারাকের মূল ফটকের দিকে ছুটে আসতে দেখা গেল। ব্যারাকে প্রবেশ করে সে টুপি তুলে সর্বাধিনায়ককে অভিবাদন করতে মানোয়েল উচ্চস্বরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মুঘলরা কি ইতিমধ্যেই আক্রমণ শুরু করেছে?
না কাপিতানো। কাশিম খানের পুত্র বাঁশবেড়িয়ায় কামান অভ্যাস করছে। বিশাল কামান কাপিতানো, হাতিতে টানছে।