গ্রামপ্রধান একটি বেতসপীড়িকায় উপবেশন করেছেন। এখন বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূর্য অন্তরালবর্তী হলেও আর্দ্র উষ্ণতা শ্বাসরোধকারী। একজন গ্রামবাসী গ্রামপ্রধানের মাথার উপর তৃণছত্রিকা ধরে আছে আর আরেকজন শুস্ক খর্জুরপত্রের পাখা দুলিয়ে তাঁকে কিঞ্চিৎ স্বস্তিপ্রদানের চেষ্টা করছে। গ্রামপ্রধান একজন ব্রাহ্মণ; সুপুষ্ট উপবীত নগ্ন উর্ধাঙ্গে সগর্বে তাঁর বর্ণশ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিচ্ছে। দীর্ঘকাল শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে গ্রামপ্রধানের কলেবর অতিস্থূল, মেদবহূল পুরুষ স্তন আর উপর স্বেদধারা ঝরে পড়ছে। দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার পরিবর্তে গ্রামসভায় হাজির হতে হয়েছে বলে ব্রাহ্মণ দৃশ্যতই রুষ্ট। পাখাওয়ালার গতি সামান্য স্লথ হতেই তিনি তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করলেন।
গ্রামবাসীরা প্রধানের সামনে সন্মানজনক দূরত্বে মাটির উপর অর্ধবৃত্তাকার শ্রেণীতে বসে আছে।
সামনের দিকে প্রথানুযায়ী প্রবীণরা বসেছেন, অন্যান্যরা তাঁদের পিছনে একটু দুরে। আরও দুরে মহিলারা কাঁখে শিশু নিয়ে বৃক্ষের ছায়ায় বা কুটিরের দাওয়ায় অপেক্ষারত। কেউ জানেনা কার সর্বাগ্রে কথা বলা উচিত, ফলে সভায় এক আশ্চর্য নীরবতা বিরাজমান। সহসাচঞ্চল বাতাসে আন্দোলিত গাছের পাতারা মাঝে মাঝে যেন এই নীরবতাকে বিদ্রুপ করে। এই পৃথুলদেহী ব্রাহ্মণ গ্রামপ্রধান সন্নিকটস্থ শিবদেউলের পূজারীও বটেন, লোকে বিশ্বাস করে এই গ্রাম ও তার বাসিন্দাদের উপর তাঁর অতীন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ আছে।
অবশেষে প্রধান কথা কইলেন।
‘অজ্ঞাত কুলশীলা নারীকে গ্রামে আশ্রয় দিয়ে তোমরা নির্বোধের মত আচরণ করেছ।’ ব্রাহ্মণের তীক্ষ্ণ ও মিহি কন্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ে।
নীরব জড়তা কাটিয়ে উঠে গ্রামবাসীরা গুঞ্জন করতে লাগল। বৃদ্ধ গ্রামবৈদ্য উঠে দাঁড়িয়ে গ্রামপ্রধানকে করজোড়ে প্রণাম করে বললেন, ‘কন্যা সদ্যযুবতী প্রভু, আশ্রয় ও পরিচর্যা না দিলে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারত।’
-‘কেন?’
-‘অজ্ঞান অবস্থায় নদীতে ভেসে এসেছিল। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে আপনার পরামর্শ নিতে পারিনি।’
গ্রামপ্রধানকে আদৌ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল না। বিরক্তিতে তাঁর স্ফীত বর্তুলাকার মুখমন্ডল রক্তাভ হয়ে উঠল। তিক্তস্বরে তিনি বললেন, ‘ডাইনী আর অমঙ্গল ঠিক ঐভাবেই আসে – অসহায়ের ছদ্মবেশে। ঐ কন্যা নিশ্চয়ই রূপসী?’.
বৃদ্ধ গ্রামবৈদ্য মাটির দিকে চেয়ে নিরুত্তর রইলেন।
‘এই গ্রাম সদাচারীদের আশ্রয়স্থল। মহাদেবের আজ্ঞায় এই গ্রামকে অশুভ, অমঙ্গল আর অভিশাপের থেকে রক্ষা করাই আমার দায়িত্ব। কন্যাকে আমার সামনে নিয়ে এস।’ গ্রামপ্রধান কর্তৃত্বের সঙ্গে আদেশ দিলেন।
দুজন সবলদেহী ভক্ত দ্রুত পদক্ষেপে নিশিবালা যে শুভ্রকেশী বৃদ্ধার কুটিরে রাত্রিযাপন করেছিল তার সামনে উপস্থিত হল। কুটিরের জীর্ণ দরজার ওপারে সামান্যক্ষণ কথোপকথনের পর নিশিবালাকে গ্রামসভায় এনে হাজির করানো হল। তার পিছনে পিছনে এল সেই শুভ্রকেশী বৃদ্ধা। গ্রামপ্রধান নিশিবালাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
এক রাত্রির আহার ও শুশ্রূষার ফলে নিশিবালাকে প্রকৃতিস্থ লাগছে। তার পরনে গ্রামের কোন মহিলার দেওয়া হাতে বোনা নতুন তাঁতের শাড়ি, দীর্ঘ কেশ আঁচড়ে কেউ তাকে খোঁপা বেঁধে দিয়েছে। দিনের প্রখর আলোয় তাকে আশ্চর্য সুন্দর ও অসহায় লাগছে। গ্রামপ্রধান ও অন্যান্য পুরুষদের দৃষ্টির সামনে সে কুন্ঠিতভাবে মাথা নিচু করে রইল।
‘ভয় পাসনি ছুঁড়ি। সব সত্যি সত্যি বলে দে।’ শুভ্রকেশী বৃদ্ধা তার কানে ফিসফিস করে বলল। নিশিবালা তার দিকে ভয়বিস্ফারিত চোখে চেয়ে হাত চেপে ধরল।
‘তোমার নাম কি?’ প্রধান জিজ্ঞাসা করলেন।
-‘নিশিবালা।’
-‘গ্রাম?’
-‘নেতিধোবানি’, বলতে বলতে নিশিবালার গলা কেঁপে গেল।
গ্রামপ্রধান সামনে ঝুঁকে নিশিবালাকে দেখতে লাগলেন। তার পরনের শাড়ি সূক্ষ্ম, তাতে তার যৌবনবতী শরীরের ঔদ্ধত্য গোপন হয় না। নিশিবালার মনে হল তার উদরের প্রকোষ্ঠে এক আতঙ্কের পিন্ড ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘সে গ্রাম কোথায়?’ বলতে বলতে ব্রাহ্মণ বেতসপীড়িকা থেকে আরও ঝুঁকে পড়েন। নিশিবালা হাত তুলে দক্ষিন দিকে নির্দেশ করতে তিনি মাথা নাড়লেন। ভূগোল তাঁর বিষয় নয়, এই গ্রামই তাঁর পৃথিবী।
কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার পরিবারের কি হল? তুমি এখানে এলে কি ভাবে?’
নিশিবালা শুভ্রকেশীর দিকে তাকাতে সে বলল, ‘তারা বোম্বেটের হাতে মারা পড়েছে।’
‘চুপ কর বুড়ি মাগী। তোকে কথা কইতে কয়েছি?’ প্রধান ক্রুদ্ধস্বরে ধমক দিতে শুভ্রকেশী একপা পিছিয়ে গেল। তখন তিনি নিশিবালার দিকে ফিরে বললেন, ‘তোমার সিঁথিতে সিন্দুর নাই। তুমি কি অনূঢ়া?’
নিশিবালার প্রতিরোধ চূর্ণ হয়ে গেল। সে ব্রাহ্মণের পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী গড়গড় করে বলে দিল। তারপর সে বলল, ‘আমাকে আশ্রয় দাও। আমার কোথাও যাবার নেই গো।’
ব্রাহ্মণ এমন নাটকীয়ভাবে লাফ দিয়ে পশ্চাদপসর হলেন যে মনে হল তিনি সর্পদষ্ট হয়েছেন। তাঁর মুখ দিয়ে লালা উদগত হল, তিনি চিৎকার করে গ্রামবাসীদের বললেন, ‘দেখেছ? আমি বলেছিলাম কিনা? এতো জোড়া অভিশাপ! এই মাগী বিধবা অথচ সহমৃতা নয়। তার উপরে ফিরিঙ্গিদের অঙ্কশায়িনী হওয়ার কদাচারও আছে! দেখেছ কেমন অসহায়কে আশ্রয় দিয়েছ?’
গ্রামসভায় মহাবিশৃঙ্খলার উদ্রেক হল। বৃদ্ধ বৈদ্য কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কিছু গ্রামবাসী তাঁকে জোর করে বসিয়ে দিল। শুভ্রকেশী বৃদ্ধা অস্ফুটে বলতে লাগল, ‘তাতে ছুঁড়ির কি দোষ?’ একজন যুবক তাকে রুঢ়ভাবে ধাক্কা দিতে সে নিশিবালার উপরে গিয়ে পড়ল। ক্ষোভে ও ব্যথায় তারা দুজনেই আর্তনাদ করতে লাগল। তখন এক গ্রামবাসী সজোরে চিৎকার করে সকলকে থামিয়ে করজোড়ে গ্রামপ্রধানকে বলল, ‘এখন উপায় কি প্রভু?’
গ্রামপ্রধান উন্মত্তের মত মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘এক তো বিধবা নারী সহমরণে যায় নি তাকে গ্রামে আশ্রয় দিয়েছিস, তার অভিশাপ। তার উপরে বোম্বেটেরা একে ভোগ করেছে, সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে। পিছু পিছু ফিরিঙ্গি এল বলে। নির্বোধের দল, কি করেছিস বুঝেছিস?’
গ্রামবাসীরা মহা আতঙ্কে আর সংশয়ে নিজেদের মধ্যে অজানিত সম্ভাব্য সর্বনাশের আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু এর থেকে রক্ষা কিসে? তারা প্রধানের কাছে কাকুতি মিনতি করতে লাগল।
‘শোন!’ তীক্ষ্ম চিৎকার করে বললেন গ্রামপ্রধান। ‘মাগীকে চিতায় তুলতে হবে, বুঝলি? ওটাই বিধবার আশ্রয়। কিন্তু ঐ পাপিষ্ঠার শরীর ফিরিঙ্গিরা নষ্ট করেছে, সেই পাপ আগে শুদ্ধ করতে হবে, তারপর চিতা। ওকে শিবদেউলে নিয়ে গিয়ে ভাল করে বেঁধে রাখ। ঐখানে আমি ওর পাপ তাড়াবার জন্যে বিশেষ গোপন পূজা করব, তখন ওখানে কেউ যাবে না। পাপ বিদেয় হলে আমি ওকে তোমাদের হাতে তুলে দেব চিতায় দাহ করার জন্যে। বুঝেছ সবাই?’
গ্রামবাসীরা সহর্ষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। নিশিবালা ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল, হৈ হৈ করে গ্রামবাসীরা তাকে ধরে তুলে নিল, নিশিবালা বিস্ফারিত চোখে, ছটফট করে নিস্ফল প্রতিবাদ করতে লাগল। বৃদ্ধা শুভ্রকেশী মূর্চ্ছিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, গ্রামবাসীরা তাকে পদপিষ্ট করে নিশিবালাকে মাথায় নিয়ে নৃত্য করতে লাগল। গ্রামের শিশু ও মহিলারা উত্তেজিত ভাবে ঘটনাক্রম আলোচনা করতে করতে যে যার ঘরে ফিরতে লাগল।
কেউ নজর করল না, গ্রামের এককোনে নিস্পৃহভাবে বসে থাকা মাথায় ঝুঁটিবাঁধা পথিককে। ভিড় হাল্কা হতে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের পুঁটুলিটি খুলে একটি ধারালো হাঁসুয়া নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল। এখানে নিকটে কি কোন বাঁশঝাড় আছে? তার দুটি নিখুঁত পাকা বাঁশ প্রয়োজন।

ভগ্নপ্রায় প্রাচীন দেউলটি পথের পাশে বিশাল অশ্বত্থগাছের পিছনে লুকানো। পাথর ও চুনের এই মন্দিরটির গম্বুজটি ভেঙ্গে পড়েছে অনেকদিন। অশ্বত্থগাছের সর্পসদৃশ কান্ড দেউলের একাংশ বেষ্টন করে রেখেছে। দেউলের মঞ্চটি ঝরাপাতা আর ভেঙ্গে পড়া গাছের ডালে ঢাকা। অশ্বত্থের ছায়ায় এই ভগ্নমন্দির তার অন্ধকার গবাক্ষ নিয়ে পরিত্যক্ত পড়ে থাকে। বহুদিন আগে থেকেই এর অধিষ্ঠিত শিবলিঙ্গটি ভক্তজন মন্দির থেকে সরিয়ে এনে বৃক্ষের নিচে স্থাপন করেছে। পূজার্চনা ও গীতবাদ্য ইত্যাদি যা হবার ঐ বৃক্ষতলেই হয়, সচরাচর কেউ ভাঙ্গা দেউলের পথ মাড়ায় না। কথিত আছে এই মন্দির স্বয়ং প্রতাপাদিত্যের হাতে নির্মিত হয়েছিল।
এই মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি অতিকায় কাষ্ঠখন্ডের সঙ্গে নিশিবালাকে দুই হাত মাথার উপরে তুলে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাকে নিয়ে আসার পথে বহু পুরুষের সবল হাত মহানন্দে তার শরীর নিষ্পেশন করেছে, সেই আঘাতে নিশিবালা অর্ধচেতন, তার শরীরে কালশিটার দাগ। কেউ বোধকরি তার মুখে মুষ্ঠ্যাঘাত করেছিল, নিশিবালার অধর ফুলে রক্তাভ হয়ে আছে।
মন্দিরের অদূরে স্বল্পসময়ে কাঠকুঠা আর গাছের ডাল জুটিয়ে এনে একটি চিতাশয্যা তৈয়ার করা হয়েছে। কজন সবলদেহী গ্রামবাসী হাতে সড়কি বল্লম নিয়ে চিতাটি পাহারা দিচ্ছে। এই চিতাতেই নিশিবালাকে জীবন্ত দাহ করা হবে। কিন্তু দাহের পূর্বে ব্রাহ্মণ গ্রামপ্রধান ভাঙ্গা দেউলের গর্ভগৃহে ঝাড়ফুঁক করবেন, ততক্ষণ ঐস্থানে যাওয়া মানা। যথেষ্ঠ শঙ্খ ও ঢাকের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। চিতায় আগুন দেওয়ার পর এগুলির প্রয়োজন হয়। গ্রামবাসীরা গ্রামপ্রধানের ঝাড়ফুঁকের সমাপ্তির অপেক্ষা করতে লাগল।
এদিকে আকাশ ক্রমেই গভীর কৃষ্ণমেঘে আচ্ছন্ন হতে থাকে। দুরে কাছে ক্রমাগত বজ্রনির্ঘোষ হতে থাকে আর পাল্লা দিয়ে বাতাসের গতিবৃদ্ধি হয়। ঘনায়মান অন্ধকারে বৃক্ষের পাতাদের ঝরঝর শব্দ হতে থাকে। অর্ধজাগ্রত নিশিবালা দেখল গ্রামপ্রধান গর্ভকক্ষে প্রবেশ করলেন। তার হাতের আচ্ছাদিত প্রদীপটি মেঝেতে রেখে প্রধান কাষ্ঠখন্ড দিয়ে সেটিকে সুরক্ষিত করলেন।
প্রধান প্রথমেই নিশিবালার কাছে এসে তার হাতের বাঁধন পরীক্ষা করে দেখলেন। অতঃপর তিনি পরনের ধূতি খুলে ফেলে সম্পূর্ণ নগ্ন হলেন। প্রদীপের ক্ষীন আলোকে ব্রাহ্মণের স্থূলদেহ আরও কদাকার লাগে – তাঁর উদর গোলাকার, দুই জানু স্ফীত আর জানুসন্ধিতে ক্ষুদ্র শিশ্ন অর্ধ উত্তোলিত হয়ে আছে। ধূতির একপাশ দুহাতে ছিঁড়ে তিনি নিশিবালার মুখে গুঁজে দিয়ে বাঁধন দিলেন। কামতৃষ্ণায় তাঁর গোলাকার চক্ষুদুটি উজ্জ্বল, নিশিবালার বক্ষের আবরন সরিয়ে তিনি সুডৌল স্তনদ্বয়ের দিকে শিশু যেমন ভাবে খেলনা দেখে তেমনভাবে দেখতে লাগলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি বক্ষযুগল আকর্ষণ করতে লাগলেন। নিকটেই কোথাও বজ্রপাত হয়ে গর্ভগৃহ নীলাভ আলোয় আলোকিত হল। এরপরে যখন প্রধান নিশিবালার শাড়ি তুলে ধরে তার শরীরে প্রবেশ করতে উদ্যত তখন সে আড়চোখে দেখল গর্ভগৃহের প্রবেশপথে এক দীর্ঘ ছায়াশরীর এসে দাঁড়িয়েছে। হাওয়ায় সেই ছায়ামূর্তির দীর্ঘকেশ উড়ছে। অর্ধচৈতণ্যে অর্ধজাগরনে মূর্চ্ছিতপ্রায় নিশিবালার মনে হল তবে কি সাক্ষাৎ মহাদেব তার পরীক্ষা নিতে এসেছেন?
প্রদীপ উল্টে পড়ে গিয়েও জ্বলতে লাগল। সহসা নিশিবালার শরীরের উপর গ্রামপ্রধানের ভার অন্তর্হিত হল। তাঁর কন্ঠ বেষ্টন করে আবির্ভাব হল এক রজ্জুর এবং তাঁর চক্ষুদ্বয় ক্রমেই বিস্ফারিত হতে লাগল। প্রধান দুমড়ে মুচড়ে তার গলার ফাঁস আলগা করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন, ক্রমশ তাঁর জিহ্বা মুখগহ্বর থেকে নিষ্ক্রান্ত হল। ব্রাহ্মণের পশ্চাৎবর্তী ছায়ামূর্তির হাতের ফাঁস ক্রমশ তাঁর স্থূল গলদেশে কেটে বসতে লাগল। তিনি শূন্যে দুহাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে অকস্মাৎ স্থির হলেন,তারপর মাটিতে গড়িয়ে পড়ল তাঁর প্রাণশূন্য দেহ।
একাদশী সর্দার নিচু হয়ে ব্রাহ্মণের নাড়ি দেখে নিশ্চিত হয়ে সযত্নে মৃত প্রধানের গলা থেকে রজ্জুখন্ড উদ্ধার করে দক্ষহাতে সেটি পাকিয়ে নিয়ে কোমরবন্ধে রাখল। এই রজ্জুখন্ডকে বলে নাগপাশ, এটি সে তার দস্যুবংশের উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছে। এরপর সে নিশিবালার কাছে এসে তার মুখের ও হাতের বাঁধন খুলে তাকে মুক্ত করল। তার মুখ সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন আর তার গতিবিধির মধ্যে এমন নিশ্চয়তা আছে যা নিশিবালার বোধের অতীত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে তার এই অভিশপ্ত জীবনে প্রথম বার সে ভীত হল না। এমন কি তার অনাচ্ছাদিত বক্ষও আচ্ছাদিত করার কথা মনে পড়ল না।
-‘ও কি মরেছে?’ ভূপাপিত গ্রামপ্রধানের দিকে চেয়ে বলল নিশিবালা।
-বিলক্ষণ!’ মন্দিরের গর্ভকক্ষের ক্ষুদ্র প্রবেশদ্বার দিয়ে বাহিরের দিকে দেখতে দেখতে বলল একাদশী। বাহিরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। কমে আসা আলোকে আন্দোলিত বৃক্ষশাখায় তীরের মত আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির ধারা। প্রদীপের নিভন্ত আলোয় একাদশীর উর্দ্ধাঙ্গ উদ্ভাসিত – সেই আলোকে তার রজ্জুসম পেশী আর উড়ন্ত কেশ দেখে মনে হয় সাক্ষাৎ দক্ষিণরায়।
‘মরদ?’ নিশিবালার ডাকে একাদশী ফিরে তাকাল।
একটানে পরনের বস্ত্র খুলে ফেলে নিশিবালা বলল, ‘আমাকে নাও।’ একাদশী নিস্পলক তাকে দেখতে লাগল কিন্তু নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।
‘নাও। সব মরদেরই এই শরীর চাই। একে আমি আর বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না। তুমিই নাও আর আমাকে মুক্ত কর। বদলে আমি তোমার মত শক্তিশালী হতে চাই।’ নিশিবালা বলল। তার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বইছে।
একাদশী এগিয়ে এসে মেঝে থেকে শাড়ি তুলে নিয়ে নিশিবালার কোমরে জড়াল। তারপর দুই হাতে তার দুই জানু ফাঁক করে কাছা দিয়ে শাড়িখানি ধূতির মত মালকোঁচা করে পরাল যেমন সে নিজে পরে আছে। তার আঙুলের স্পর্শে নিশিবালার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। একাদশী যাদুকরের মত তার চারিদিকে ঘুরে তার চুল টানটান করে কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঝুঁটি বাঁধল। নিশিবালা একাদশীর পাথরের মত দৃঢ় আর শীতল বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নেবে না?’
-‘তুমি বুঝবে না এখন। চুপ করে দাঁড়াও।’ বিড়বিড় করে বলল একাদশী। নিশিবালার উন্মুক্ত পিঠে হাতের হাল্কা চাপড় মেরে সে সন্তর্পণে তার বুক মৃত প্রধানের ধুতি দিয়ে বাঁধতে লাগল। নিশিবালা বালিকার মত হাত তুলে দাঁড়াল আর একাদশী তার বক্ষবন্ধনীতে দৃঢ় করে গিঁট দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ‘সাবাস!’ এখন ঐ বক্ষবন্ধনী সত্বেও নিশিবালাকে প্রায় একাদশীর মতই দেখাচ্ছে।
নিশিবালা একাদশীকে আলিঙ্গন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমাকে বার বার বাঁচাচ্ছ কেন তুমি? কি উদ্দেশ্য তোমার?’ উদগত অশ্রু তার কন্ঠরোধ করে।
‘মরার চেয়ে বাঁচা ভাল। যেভাবেই হোক।’ একাদশী তাকে বলল।
বাহিরে বৃষ্টি গাছগুলিকে যেন চাবুক মারতে থাকে। বাঙ্গালার বৃষ্টি জলদস্যুর মত বন্য। মাটিকে সে শক্ত হাতে চেপে ধরে দস্যুর মত ভোগ করত থাকে। দুই পলাতক প্রাণী বৃষ্টির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার বেগ কমে এল। ক্রমশ কানে আসতে লাগল অদূরে কিছু মানুষের কন্ঠস্বর। সম্ভবত গ্রামবাসীরা অধৈর্য হয়ে মন্দিরের দিকে আসছে। এই বৃষ্টিতে চিতা কি করে জ্বালানো হবে? গ্রামপ্রধান এত সময়ই বা কেন নিচ্ছেন? হয়ত তারা এসব জানতে চায়।
একাদশী দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে নেয়। কিছু মূল্যবান মুহূর্ত সে এখানে নষ্ট করেছে। এখন এখান থেকে কারুর চোখে না পড়ে পালানো কঠিন। সে নিশিবালার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে শুষ্কস্বরে বলল, ‘আমাদের এবার এখান থেকে পালাতে হবে। আমি যা বলব, নির্দ্বিধায় করবে।’
নিশিবালা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, ‘মা মনসার কিরা। করব।’
একাদশী নিশিবালার হাত শক্ত করে ধরে বলতে লাগল, ‘ঐ দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে ঘুরে সোজা দৌড়াবে। কিছুতেই পিছনে দেখবে না। দুশ পা দুরে দেখতে পাবে এক বিশাল বাঁশঝাড়। সোজা গিয়ে সেখানে লুকাবে। আমি না ডাকা পর্যন্ত বেরোবে না।’ এই পর্যন্ত বলে সে নিশিবালার হাত ধরে গর্ভকক্ষের সঙ্কীর্ণ দরজায় এসে দাঁড়িয়ে একবার চকিতে চারিদিক দেখে নিয়ে বলল, ‘যাও!’
নিশিবালা দশ পা এগোতেই একাদশীও তাকে অনুসরন করা জন্য যেই দৌড়তে যাবে অমনি এক দশাসই চেহারার গ্রামবাসীর সঙ্গে তার ধাক্কা লাগল। লোকটির ডান হাতে সড়কি, বাম হাত দিয়ে সে মুখের বৃষ্টিজল মুছছে। চমকে উঠে সে বলল, ‘হেই! প্রধান যে আমাদের দেউলে আসতে না করেছিল? তারপর সে একাদশীকে চিনতে পারল। গতকাল রাতে সে অশ্বত্থ গাছের নিচে তার সঙ্গে কথা বলেছিল।
একাদশী তাকে কোনক্রমে ধাপ্পা মেরে পালাতে যাবে, লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দুরে পলায়নরত নিশিবালা। বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত মাটিতে নিশিবালা স্লথ গতিতে দৌড়াচ্ছে, ফলে বেশি দুর যেতে পারেনি। গ্রামবাসী উৎকন্ঠিত হয়ে সড়কি উঠিয়ে হাঁক দিতে যাবে, একাদশী কেউটে সাপের ক্ষিপ্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে একহাতে তার কন্ঠনালী চেপে ধরল আর অন্যহাতে তার সড়কি ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু এই গ্রামবাসী যথেষ্টই বলবান, সে সড়কি তো চেপে ধরে রইলই উল্টে একাদশীকে সজোরে ধাক্কা দিল। দুজনেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ে একে অন্যকে কাবু করার চেষ্টা করতে লাগল। চোখের কিনারা দিয়ে একাদশী দেখল নিশিবালা দাঁড়িয়ে পড়ে পিছু ফিরতে যাচ্ছে। চাপা গর্জন করে একাদশী বলল, ‘সামনে দৌড়াও।’
এইটুকু অসাবধানতার সুযোগে গ্রামবাসী একাধশীর উদরে হাঁটু দিয়ে আঘাত করল। সেই আঘাতের এমন জোর যে একাদশীর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কোনক্রমে শ্বাস উদ্ধার করে সে দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। এই লোকটির সঙ্গে গায়ের জোরে সে পেরে উঠবে না তা নিশ্চিত। দ্বিতীয়ত তার দুটি হাতই ব্যস্ত, কোমরবন্ধে থাকা নাগপাশের নাগাল সে পাচ্ছে না। অকস্মাৎ একাদশী মূর্ছা যাবার মত এলিয়ে পড়ল।
এই ভান বাঙ্গালার দস্যুদের হস্তযুদ্ধের এক মোক্ষম চাল। একাদশীকে এলিয়ে পড়তে দেখে গ্রামবাসী যেই হাত শিথিল করেছে, একাদশী সর্বশক্তি দিয়ে তার চোখে খোঁচা মারল। লোকটি ব্যথায় আর্তনাদ করে সড়কি ছেড়ে চোখে হাত দিতেই, একাদশী সড়কি তুলে হাতল দিয়ে তার ব্রহ্মতালুতে সজোরে ঘা দিল। আঘাতের অভিঘাতে একাদশীর কনুই পর্যন্ত ঝনঝনিয়ে উঠল বটে কিন্তু গ্রামবাসীটিও জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
লাফিয়ে উঠে হাঁফাতে হাঁফাতে একাদশী বাঁশঝাড়ের দিকে ছুটতে লাগল। এইসময় পিছনে কারুর শিশধ্বনি শোনা গেল এবং বিদ্যুতের মত উড়ে এসে একটি সড়কি একাদশীর কোমরের চামড়া চিরে দিয়ে সামনের এক গাছের কান্ডে গেঁথে গেল। একাদশী গতিও কমাল না পিছন ফিরে দেখলও না।
বাঁশঝাড়ে পৌঁছে দেখা গেল নিশিবালা ভিজতে ভিজতে সেখানে লুকিয়ে আছে। একাদশী তার হাত ধরে বাঁশঝাড়ে কিছু সন্ধান করতে লাগল।
রণপা হল একজোড়া কমবেশি দশহাত লম্বা বাঁশের খুঁটি। খুঁটিগুলির মাঝামাঝি চেরা বাঁশের পাদানি থাকে। বাঙ্গালার দস্যু ও লাঠিয়ালরা আশ্চর্য দক্ষতায় এই খুঁটিগুলিতে চড়ে অশ্বের সমধিক গতিতে মাঠঘাট বনবাদাড় ভেঙ্গে যাতায়াত করতে সমর্থ। কিছুক্ষণের মধ্যেই একাদশী বাঁশঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা একজোড়া রণপা উদ্ধার করে আনল। এই রণপাগুলি আজ দ্বিপ্রহরের হস্তশিল্প। মাটিতে জানু পেতে বসে সে নিশিবালাকে তার পিঠে সওয়ার হতে নির্দেশ দিল। প্রথমে আপত্তি করলেও নিশিবালা সেই নির্দেশ মেনে নিতেই একাদশী উঠে দাঁড়িয়ে এক শক্তিশালী লাফ দিয়ে রণপা চড়ে বসল। একক মানুষের পক্ষেই রণপা চড়া যথেষ্ট কঠিন, কাউকে পিঠে নিয়ে রণপা চড়া সুদীর্ঘ অভ্যাস ও শক্তির পরাকাষ্ঠা। ক্ষণিকের জন্য দুলে উঠে একাদশী ভারসাম্য বুঝে নিল। তারপর শুরু হল রণপা চেপে দৌড়।
নিশিবালা একাদশীর শরীরে ঘনসন্নিবদ্ধ হয়ে অনুভব করল একাদশীর ঘাড়ের ও পিঠের পেশীগুলির সামর্থ্য। দৌড়ের শ্রমে একাদশীর বক্ষ হাপরের মত ওঠে পড়ে আর নিশিবালার জানু ভিজে যায় একাদশীর ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে পড়া উষ্ণ রক্তে। একাদশীর পিঠের উপর থেকে নিশিবালা দেখতে পায় আলোআঁধারিতে দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে বৃষ্টিস্নাত ধান্যক্ষেত্র, মাঠ ঘাট আর তরুশ্রেণী। রণনায় ঝপ ঝপ করে শব্দ হয়। কিছুক্ষণ পর নিশিবালার মনে হয় এ এক সিক্ত জাগ্রতস্বপ্ন, ঐ ঝপঝপ শব্দের সঙ্গে তার হৃৎস্পন্দন এক হয়ে গেছে, এই স্বপ্নের দুটি মানুষের বাহিরে কোন স্বতন্ত্র পৃথিবী নেই। এই স্বপ্ন অনন্তকাল ধরে দুটি মানুষের অদৃষ্টের বিরুদ্ধে প্রাণরক্ষার সংগ্রাম।
ধীরে ধীরে নিশিবালার নিজেকে নিরাপদ মনে হতে লাগল। তার চোখে ঘনিয়ে এল নিদ্রা।