মোটেল ড্রিমল্যান্ড

১ 

রাস্তার ডানদিকে গাছের ফাঁক দিয়ে বাড়িগুলো উঁকি মারল, যেন খেলনাঘর সাজানো আছে। বাড়িগুলোর রঙ হাল্কা হলুদ, সবুজ রঙের ঢালু চাল, পরপর ব্যারাকের মত দাঁড়িয়ে আছে ঘুম ঘুম চোখে। সামনে একটা সাইনেজ, তাতে লেখা “মোটেল ড্রিমল্যান্ড”। এয়ারপোর্ট থেকে সেল্ফ ড্রিভেন গাড়ি নিয়ে পুরন্দর শর্মা প্রায় ঘন্টা তিনেক পথ পাড়ি দিয়ে পশ্চিমঘাট পাহাড়ের সানুদেশে এসে পড়েছে, এখান থেকে উটি আরো চারঘন্টা লাগবে। পথে সে গোটাদুয়েক ক্যানড বিয়ার খেয়েছে আর জিপিএস দেখে গাড়ি চালিয়েছে – মোটেল দেখে পুরন্দরের এক সঙ্গে খিদে আর ঘুম দুই-ই পেয়ে গেল। লম্বা ছুটি নিয়ে সে নিরুদ্দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছে, উটিতে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। এই পান্ডববর্জিত নাম না জানা জায়গায় সে যদি এক দিন থেকেই যায়, তাতে কারুর ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। পুরন্দর শর্মা গাড়ি ঘুরিয়ে মোটেল ড্রিমল্যান্ডের সামনে লালচে মোরামের পার্কি বে তে গাড়ি রেখে, নেমে আড়মোড়া ভাঙল। 

মোটেল ম্যানেজারের অফিস সামনেই। পিছনে মোটেলের সার সার কটেজের বারান্দা, অফিসের পাশে একটা চালার নিচে ছোট কফিশপে গোটা দুয়েক ভেন্ডিং মেশিন আর কোল্ড ড্রিঙ্কের ফ্রিজ। ধারেকাছে কেউ নেই, এমনকি একটা গাড়ি পর্যন্ত না। কফিশপ ফাঁকা। কটেজগুলোর উপর ঝুঁকে আছে বিশাল বিশাল গাছ, পুরো জায়গাটাই নির্জন আর ছায়াছায়া। একটা কটেজের বারান্দায় তোয়ালে মেলা না থাকলে পুরন্দর ধরে নিত জায়গাটা পরিত্যক্ত। ম্যানেজারের ঘরে দরজা ঠেলে ঢুকতেই, ডেস্কের পিছন থেকে এক বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে তাকে স্বাগত জানাল। যে ঘরটি পুরন্দরের জন্য নির্দিষ্ট হল, সেটা কটেজগুলোর সারির একেবারে এক কোনে। একটা টানা লম্বা বারান্দা চলে গেছে কটেজগুলোর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, সবকটি ঘরই স্বতন্ত্র, সামনে একটি বসবার ব্যবস্থা যেখান থেকে সামনের রাস্তা আর তার পার্ক করে রাখা গাড়ি দেখা যায়, ভিতরে একটা শোবার ঘর আর লাগোয়া টয়লেট। শোবার ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল, দুপুরের রোদে গাছের পাতা চকচক করছে। একটি কিশোর মত ছেলে পুরন্দরকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে গেল, খাবার ব্যবস্থা আছে ক্যান্টিনে তবে বাড়তি পয়সা দিলে ঘরেও খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়। পুরন্দর শর্মা খোলা জানলার সামনে সোফায় বসে সিগারেট ধরিয়ে ভাবল, গন্তব্য স্থানের চেয়ে তার এই স্টপওভারগুলোই বেশি ভালো লাগে। 

সময় গড়াতে গড়াতে এসে এখানে যেন থমকে গেছে। সোফায় আরাম করে বসে পুরন্দর ভাবতে লাগল তার ট্রাভেলোগ লেখার কাজ এখানে বসে খানিকটা এগিয়ে নিলে মন্দ হয় না। গত তিন চারদিন সে ডায়েরীতে নোট নেবার সময় পায়নি। সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার ড্রেসিং টেবলে রাখতে গিয়ে ব্যাগটা চোখে পড়ল। টেবলের কোনায় ওয়ার্ডরোবের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা। পুরন্দর শর্মা চোখ কুঁচকে ব্যাগটা দেখতে লাগল। ট্যানড লেদারের লেডিজ হ্যান্ডব্যাগ। এবং নতুন বলে মনে হয়। নিশ্চয় আগের বোর্ডার ফেলে গেছে। মোটেলের হাউসকিপিং স্টাফ কি ঘর পরিস্কার করে না? নাকি তাকে অন্যকারুর ঘর দিয়ে দিয়েছে? পুরন্দরের লাগেজ গাড়িতেই পড়ে আছে, সে ওয়ার্ডরোব, ড্রয়ার খুলে খুলে দেখতে লাগল আরও কোন জিনিষ এই ঘরে কেউ ফেলে গেছে কিনা। তেমন কোন কিছুই পাওয়া গেল না। পুরন্দর ব্যাগটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। মাঝারি মাপের ব্যাগ, গায়ে নামী ব্যান্ডের লোগো লাগানো আছে। ব্যাগটার একটাই সাইড পকেট। দামী মেটালিক চেন। কিন্তু কোথাও কোন লক আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই ধরনের ব্যাগে মহিলারা পার্স, ফোন, চাবি আর খুচরো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখে। কে এসেছিল এখানে? কোন ফ্যামিলি? নাকি সিঙ্গল কেউ? 

ইন্টারকম তুলে পুরন্দর ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন করল। ওপার থেকে বয়স্ক গলায় বৃদ্ধ বলল, বলুন স্যার। 

-একশ ষোলো থেকে বলছি। 

-বলুন। 

-আপনারা নতুন বোর্ডারকে দেওয়ার আগে ঘর পরিস্কার করেন না? 

-কেন স্যার? কোন প্রবলেম? আমি লোক পাঠাচ্ছি। 

-না। দরকার নেই। আমার আগের বোর্ডার কবে ঘর ছেড়েছেন, খাতা দেখে বলতে পারেন? 

বৃদ্ধ একমিনিট কি যেন ভাবল, তারপর বলল। একশ ষোলো নম্বর কটেজ তো আজই ওপেন হল। আপনি প্রথম বোর্ডার। তের থেকে ষোলো, নতুন তৈরী হয়েছে। এখনো কাউকে ঘরগুলো দেওয়াই হয়নি। আপনিই প্রথম। কি প্রবলেম হয়েছে স্যার? 

পুরন্দর শর্মা অবাক হয়ে গেল। তাহলে ব্যাগটা কার? সে ইন্টারকমে বলল, ইটস ওকে। আপনি এককাপ কফি পাঠিয়ে দিন। আইফোন বের করে ব্যাগটার দুটো ছবি তুলল পুরন্দর। একটা দুর থেকে আর একটা ক্লোজআপ। তারপর সে ব্যাগটাকে বিছানার মধ্যিখানে রেখে তাকিয়ে রইল। বিলকুল নতুন ঘরে ব্যাগটা এল কি করে? যার ব্যাগ সে কি এখনো টের পায়নি যে সে ব্যাগটা হারিয়েছে? সাধারণ হিসেবে তার উচিত এই বস্তুটিকে মোটেলের অফিসে জমা করে দেওয়া। কিন্তু পান্ডববর্জিত দেশে এই মাছি তাড়ানো মোটেল ব্যাগটা যে মেরে দেবে না তার কি গ্যারান্টি? তার কি ব্যাগটা খুলে দেখা উচিত? বিছানার মাঝখান থেকে বেওয়ারিশ ব্যাগটা যেন পুরন্দর শর্মার দিকে তাকিয়ে আবেদন করতে লাগল, আমার একটা হিল্লে করে দাও না! আমি হারিয়ে গেছি।

২ 

মন থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দেবার জন্য পুরন্দর বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করল। স্নান করতে করতে সে খানিকটা গানটানও করল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সে দেখল তার লাগেজ ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বেশ আরামদায়ক একটা কার্গো প্যান্ট আর ঢোলা টি শার্ট পরতেই পুরন্দরের ঘুমঘুম পেতে লাগল। রুমসার্ভিসকে ফোন করে তাকে ঘন্টাখানেক বাদে লাঞ্চ ঘরেই পাঠিয়ে দেবার পরামর্শ দিয়ে বিছানায় শুতে যেতেই ব্যাগটা আবার তার চোখে পড়ল। টানটান বিছানার মাঝখানে বসে ব্যাগটা যেন তার দিকে চেয়ে আছে। কোলের কাছে ব্যাগটাকে নিয়ে পুরন্দর ভাবতে লাগল, যদি ব্যাগের মধ্যে অনেক টাকা থাকে? কিংবা জরুরী কাগজপত্র? তার কি একবার দেখে নেওয়া উচিত নয়, ব্যাগের মধ্যে মালিকের নাম ধাম ফোন নাম্বার কিছু আছে কিনা? যদিও অজ্ঞাতপরিচয় কোন মহিলার ব্যাগ খুলে হাঁটকানো ঠিক সন্মানজনক ব্যাপার নয়। কিন্তু পরিস্থিতির বিচারে একাজ কি প্রয়োজন নয়? এসব ক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত কৌতুহলেরই জয় হয়। পুরন্দর ব্যাগের চেন খুলে বিছানার উপর উপুড় করতেই গুচ্ছের জিনিষপত্র, এমনকি চ্যুইংগামের বিলকুল খালি প্যাকেট পর্যন্ত, বিছানার উপর ছড়িয়ে পড়ল। একটা লম্বাটে থ্রিফোল্ড ওয়ালেট, কিছু খুচরো টাকা ও কয়েন, একটা কীরিং যাতে তিনটে চাবি, একটা ল্যামিনেট করা সাঁইবাবার ছবি, একটা লিপস্টিক, একটা কমপ্যাক্ট পাউডার, একগোছা সেফটিপিন, আর একটা আলট্রালাইট স্যানিটারি ন্যাপির প্যাকেট। জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে পুরন্দর শর্মার যুগপৎ খারাপ লাগতে লাগল আর উত্তেজনাও হতে লাগল। একটা হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে শুধু কিছু জিনিসই থাকে না, মানুষের ব্যাক্তিগত ও গোপন জগতও থাকে। এটি যার, তার সেই গোপনীয়তা ক্ষুন্ন করতে তার খারাপ লেগেছে। যদিও সেই খারাপ লাগার চেয়ে অনেক তীব্র তার কৌতুহল, যে কৌতুহলের সঙ্গে সে সচেতনভাবে এই ব্যাগের মালিককে খুঁজে বার করে তার হাতে এটি পৌঁছানোর সদুদ্দেশ্যকে মেলাতে চাইছে। কিন্তু সত্যিই তার উদ্দেশ্য কি, পুরন্দর শর্মা জানে না। 

ঘুম উড়ে গেল। পুরন্দর ব্যাগের লাইনিং উল্টে দেখল ভেতরে গোটা কয়েক কাগজ আছে। সাইডের চেনে পাওয়া গেল কিছু রশিদ আর সপ্তাহখানেক আগের একটা ফ্লাইটের অনলাইন টিকিটের প্রিন্ট কপি। মুম্বাই থেকে ব্যাঙ্গালোর জার্নি, প্যাসেঞ্জারের নাম শালিনী মাথুর। রশিদগুলো সবই পিওএস মেশিনের, লেখা ঝাপসা হয়ে পড়ার অযোগ্য হয়ে গেছে। ব্যাগের ভিতর থেকে ভাঁজকরা একটা মেনুকার্ড পাওয়া গেল, ব্যাঙ্গালোরের ঠিকানায় সম্ভবত হোমফুড ডেলিভারি। পুরন্দর খুচরো টাকাগুলো গুনে দেখল, মোট চারশো ষাট টাকা, আর কয়েনে আরও আঠেরো টাকা। টাকাগুলো একজায়গায় সাজিয়ে পুরন্দর শর্মা ছবি তুলে রাখল। তারপর ব্যাগের বাকি জিনিসগুলো পরপর সাজিয়ে সেগুলোর ছবিও তুলল আইফোনে। এরপর সে সব জিনিসগুলো ব্যাগের যথাস্থানে চালান করে, ওয়ালেটটা নিয়ে জানলার সামনে এসে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। শালিনী মাথুরের ওয়ালেটে ক্যাশে হাজার ছয়েক টাকা আছে। কিন্তু আজকের দিনে যেসব জিনিসকে যথাসর্বস্ব বলা হয় সেসবও এই ওয়ালেটে আছে। শালিনী যেখানেই থাকুক না কেন এখন, নির্ঘাৎ চোখে অন্ধকার দেখছে। ওয়ালেটের ভিতর তার দুটি ডেবিটকার্ড, একটি ক্রেডিটকার্ড, মুম্বাই থেকে ইস্যু করা ড্রাইভিং লাইসেন্স, আধার কার্ড আর একটি আইডি কার্ড আছে। এগুলো হারালে মানুষের পরিচয়টাই প্রায় হারিয়ে যায়। পুরন্দর আইডি কার্ডটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কার্ডের একদিকে হাসিমুখে একটি মেয়ের ছবি। সপ্রতিভ এবং আকর্ষনীয়। ছবি দেখে শালিনী মাথুরকে বছর তিরিশেকের বেশি মনে হয় না – অন্তত পুরন্দরের চোখে সে সুন্দরী। কার্ডটি একটি মুদ্রণ প্রকাশক সংস্থার, সেখানে শালিনী মাথুরকে লিটারারি এজেন্ট বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। কার্ডে একটি ইমেল অ্যাড্রেস আর ফোন নাম্বারও দেওয়া আছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পুরন্দর তার সেল ফোনে শালিনী মাথুরকে ফোন করতে লাগল। ব্যাগ যে নিরাপদে আছে সে খবর পেলে অন্তত মেয়েটা স্বস্তি পাবে। ফোনে বারবার যান্ত্রিক কন্ঠে বলা হতে লাগল, শালিনীর ফোন হয় সুইচ অফ আছে নতুবা নেটওয়ার্কের বাইরে। বিরক্তিভরে ফোন বন্ধ করে পুরন্দর শর্মা ট্যাবে শালিনীর উদ্দেশ্যে একটি ইমেল লিখল। 

প্রিয় শালিনী মাথুর আপনি যে বোতেগা ভেনেতা হ্যান্ডব্যাগটি গুন্ডুপেট হাইওয়ের ধারে মোটেল ড্রিমল্যান্ডে ফেলে গেছেন, সেটি আমার কাছে আছে। আমি এখানে কাল দুপুর বারোটা পর্যন্ত আছি। যদি ধারে কাছে আছেন তো আমার কাছ থেকে সরাসরি নিয়ে যেতে পারেন। যদি তা সম্ভব না হয় তো আমাকে জানাতে পারেন কোন ঠিকানায় পাঠাব। ব্যাগ খুলে দেখতে হয়েছে বলে দুঃখিত। পুরন্দর শর্মা। 

দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে খাবার দিয়ে যেতে, পুরন্দর শর্মা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ব্যাগের ঝামেলা মিটে যেতেই তার মাথায় ট্র্যাভেলোগ লেখার ভাবনাগুলো নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। ঘুমিয়ে পড়ে সে স্বপ্ন দেখল, একটা অচেনা পথের মাঝখানে তার গাড়ি খারাপ হয়েছে। পথটা কোথায় গেছে পুরন্দর জানে না, কিন্তু রাস্তার ধারে দূরত্বসূচক চিহ্নগুলোর জায়গায় সব শালিনী মাথুরের হাতব্যাগ রাখা, তার উপরে সংখ্যার বদলে রোমান হরফে ঘড়ির মত এক দুই তিন লেখা আছে।

৩ 

ঘুম ভেঙ্গে উঠে পুরন্দর শর্মা ট্রাভেলোগের জন্য ডায়েরী লিখল, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করল, তারপর কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে হাইওয়ের পাশে পাইন জঙ্গলে ঘন্টাখানেক পায়চারি করে এল। মোটেলের লাগোয়া কফিশপে এখন একটি মেয়ে বিক্রিবাটা করছে। কৃষ্ণকায় কিছু স্থানীয় লোক লুঙ্গি পরে ধোসা আর কফি খাচ্ছে। পুরন্দর একটা চেয়ারে বসে হাইওয়ে পার করে পাহাড়ের পিছনে ঢলে পড়া সূর্যাস্ত দেখতে লাগল। এই জায়গাটি অপূর্ব সুন্দর আর শান্ত। এ দেশের আর কোন জায়গা এরকম পরিচ্ছন্ন আর নিরালা কিনা সন্দেহ। একটিই মুশকিল, তেলেগু বা তামিল ভাষা পুরন্দর জানে না, তবে এখানে অধিকাংশ লোক কাজ চালানো গোছের ইংরেজি বলতে পারে এটাই সুবিধে। হাত তুলে মেয়েটিকে ডেকে একটা কফির অর্ডার দিয়ে পুরন্দর তাকে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি খালি বাইরের লোকেরাই আসে নাকি মোটেলের বোর্ডাররাও আসে? মেয়েটির কাছ থেকে জানা গেল, বোর্ডাররাও আসে। এখন কি অফ সিজন, বোর্ডার এত কম যে! না এখানে তেমন বোর্ডার হয় না, বড়জোর পাঁচ ছজন। তাহলে ঘর বাড়াচ্ছে যে? মালিকানা বদল হয়েছে। তারা আরও বড় করে ব্যবসা করবে। এখন এখানে কজন বোর্ডার আছে, আন্দাজ? জনা তিনেক হবে হয়তো! 

আইফোনে নতুন ইমেল নোটিফিকেশান দেখাচ্ছে দেখে পুরন্দর ইমেল পড়তে লাগল। শালিনী মাথুর ইমেলের উত্তর দিয়েছে। প্রিয় পুরন্দর শর্মা আপনার বক্তব্য কিছুই বুঝলাম না। কোন ব্যাগ আপনার কাছে আছে? মোটেল ড্রিমল্যান্ডে তো আমিও আছি। আমার ব্যাগ আমার কাছেই বহাল তবিয়তে আছে। আমার ইমেল পেলেন কোথায় আপনি? যদি স্প্যাম করছেন তো আপনাকে সতর্ক করে দিই, এরকম আনসলিসিটেড মেল করবেন না আর। শালিনী মাথুর পুরন্দর মেলটা বার দুই তিনেক পড়ে গুম মেরে বসে রইল। তারপর সিগারেট ধরিয়ে মেল ডিটেলস চেক করতে লাগল। তার মেল গেছে বাইশে ফেব্রুয়ারী, মানে আজ, দুটো তেত্রিশ মিনিট একান্ন সেকেন্ডে। আর শালিনী মাথুরের মেলটা সে পেয়েছে পাঁচটা আটত্রিশ মিনিট দুই সেকেন্ডে। কোথায় গোলমাল হচ্ছে পুরন্দর বুঝতে পারছে না। সে কি ভুল দেখল কিছু? শালিনী মাথুর এই মোটেলেই আছে বলছে, অথচ তার ব্যাগ পুরন্দরের ঘরে! আর শালিনী বলছে ব্যাগ তার কাছেই আছে। পুরন্দর শর্মা ঘনঘন সিগারেটে টান দিতে লাগল। তারপর সে ফোন বার করে শালিনী মাথুরকে ফের ফোন করল। 

-ইয়েস? ওপার থেকে ভরাট নারীকন্ঠে উত্তর এল। 

-শালিনী মাথুর? 

-হ্যাঁ। কে বলছেন? 

-পুরন্দর শর্মা। ফোনটা ছাড়বেন না প্লিজ। 

-পুরন্দর? আপনি ইমেল করেছিলেন না? 

-আপনার ব্যাগে একটা থ্রিফোল্ড পার্স, একটা চাবির রিংএ তিনটে চাবি, একটা মেবেলিনের লিপস্টিক আর একটা কমপ্যাক্ট ফেস পাউডার আছে কিনা বলুন। 

ফোনের ওদিকে প্রায় মিনিটখানেকের নীরবতা। তারপর শালিনী মাথুর বলল, কে আপনি? তার কন্ঠস্বর কেঁপে গেল।

-আপনি পনেরই ফেব্রুয়ারী নটা পঁয়ত্রিশের ফ্লাইটে মুম্বাই থেকে ব্যাঙ্গালোর ট্রাভেল করেছিলেন? 

– আপনি যদি প্র্যাংক কল করছেন তাহলে কিন্তু বিপদে পড়বেন। আর যদি তা না হয়, এসব ডিটেল আপনি কি করে জানলেন ভেবে অবাক হচ্ছি! 

পুরন্দর বিরক্ত গলায় বলল, আমি ভেবেছিলাম, আপনি ব্যাগ হারিয়েছেন। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। তবে এই মুহুর্তে মোটেল ড্রিমল্যান্ডের একশ ষোলো নম্বর ঘরে ঐ রকম একটা ব্যাগ পড়ে আছে, যার মধ্যে ঐ ওয়ালেট, টাকাকড়ি চাবি এসব আছে। কিকরে এটা সম্ভব বুঝতে পারছি না বলে আপনাকে ফোন ইমেল করা। শালিনী মাথুরের গলায় হাসির আভাস পাওয়া গেল। সে বলল, একশ ষোলো নম্বর ঘরে ব্যাগটা যে আছে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ঐ ঘরে আমিও আছি তো। আপনি নির্ঘাৎ হাউসকিপিংএর লোক। পুরন্দর শর্মার মনে হল তার পায়ের তলার মাটি দুলছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে লম্বা লম্বা পায়ে সে করিডর পেরিয়ে একশ ষোলো নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। পকেট থেকে চাবি বের করে এনে পুরন্দর ঘরের দরজায় নম্বরটা আরেকবার মিলিয়ে নিল। একশ ষোলো। পুরন্দরের বুকের ভিতর যেন ঢাক বাজছে। এই ঘরের ভিতর শালিনী মাথুর আছে? অথচ ঘর বাইরে থেকে চাবি দেওয়া। ঘরের মধ্যে তার জিনিসপত্র ছড়ানো। এই মোটেল তো আচ্ছা গোলমেলে! করিডোরে আলো কমে আসছে। বাইরে রাস্তার পাশে গাছগুলোর উপর সূর্যের শেষ আলো এসে পড়েছে। হাইওয়ে ধরে একটা গাড়ি হুশ করে চলে গেল। পুরন্দর হাতে ধরা ফোনে দেখল শালিনীকে করা কলটা কেটে গেছে। সে শ্বাস চেপে চাবি ঘুরিয়ে একশ ষোলো নম্বর ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। 

৪ 

ঘরে ঢুকে পুরন্দর শর্মা এদিক ওদিক দেখতে লাগল। ঘর যেমনকে তেমনই আছে। শালিনী মাথুরের ব্যাগ ড্রেসিং টেবলের উপরে সে রেখে গেছিল, সেখানেই আছে। বিছানার উপর ছড়িয়ে রাখা তার নিজস্ব টিশার্ট, বক্সার, ক্যামেরা, ডায়েরী সব যেমন থাকার তেমনি আছে। তার ট্রেকিং বুটজোড়াও ঘরের কোনে অবিচল পড়ে আছে। এবং অবশ্যই এ ঘরে শালিনী মাথুর নেই। উত্তেজনার প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেছে, পুরন্দর হাহা করে হাসতে লাগল। এমন ভাবনা যে তার মাথায় কয়েক মুহুর্তের জন্যে হলেও এসেছিল, এটা ভেবেই তার হাসি পাচ্ছে। হাসতে হাসতে পুরন্দর শর্মা ওয়ার্ডরোব খুলে একবার দেখে নিল, তারপর বাথরুমের দরজায় নাটকীয় ভঙ্গিতে টোকা দিয়ে বলল, মিস মাথুর আপনি কি বাথরুমে আছেন? থাকলে দয়া করে ভ্যানিশ হয়ে যান কারণ আমার একটু নেচার্স কল অ্যাটেন্ড করা দরকার। 

বাথরুমে ঢুকে পুরন্দর দেখে নিল, প্রত্যাশিত ভাবেই তার জিনিসপত্র যেখানে যা থাকার সব সেখানেই আছে। মাথা নাড়তে লাগল সে, কি পাগলামিতে পেয়েছে তাকে? কে ফোনে কি বলল, আর সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল? এখানে সন্ধে হয়ে গেলেই চারদিক ঠান্ডা হয়ে যায়। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে পুরন্দর শর্মা বাইরে গাছের মাথার উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে আসা সন্ধে দেখতে লাগল। দুরে একটা দুটো করে টিমটিমে আলো জ্বলে উঠছে। পাইন বনের ভিতর দিয়ে দীর্ঘশ্বাসের মত হাওয়া বইছে। এই হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে ভেবে সে আর মাথা খারাপ করবে না। শালিনী মাথুরকে ফোন করাও বৃথা। সম্ভবত মেয়েটা তাকে স্রেফ মিথ্যে কথা বলে বিচলিত করার চেষ্টা করছে। ব্যাগটা অবশ্যই তার, কিন্তু বাকিটা তার বানানো। পেশায় লিটারারী এজেন্ট, হয়তো এইসব উল্টোপাল্টা বলে গল্পের প্লট বানাতে চাইছে। পুরন্দর মনে মনে নিজেকে বলল ক্যাশটা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়ে ব্যাগটা সে ফেলে দেবে। শালিনী মাথুর তো বলছেই তার কোন ব্যাগ ট্যাগ হারায় নি। 

কিন্তু মনের কোনায় কোথাও একটা অবিশ্বাস আর সন্দেহ খচখচ করেই যাচ্ছে। আচ্ছা এমনটা কি হতে পারে কোন কারণে মিস মাথুর এই ব্যাগটাকে অস্বীকার করতে চাইছে? ব্যাগটার সঙ্গে কি কোনো অপরাধের সম্পর্ক আছে? দরজা লক করে পুরন্দর ব্যাগের মধ্যে থাকা জিনিসগুলো বারবার খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। কোথাও কোন অসংগতি চোখে পড়ছে না। শালিনীর প্রকাশনা সংস্থার নামটা নোট করে ট্যাব খুলে ইন্টারনেটে গবেষণা করে দেখল, সেখানে সংস্থার দিল্লী অফিসের ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বার ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। এ সময়ে সেখানে ফোন করলে কেউ ধরবে বলে মনে হয় না। পুরন্দর এক কাপ কফির অর্ডার দিতে যাবে এমন সময় শালিনী মাথুরের ফোন এল।

-কি হল? আপনি কথার মাঝখানে ফোন ছেড়ে দিলেন যে বড়? 

পুরন্দর সোফায় বসে ড্রেসিং টেবলে রাখা ব্যাগটার দিকে চেয়ে ছিল। সে বলল, আপনি এখন কোথায়? শালিনী মাথুর শান্তভাবে বলল, আপনাকে বলেছি তো! মোটেল ড্রিমল্যান্ডে। 

-না। আপনি এখন মোটেল ড্রিমল্যান্ডে কোথায়? 

– আমার ঘরে। 

– একশ ষোলো নম্বরে? 

– একশ ষোলো নম্বরে। 

পুরন্দর উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, মিস মাথুর, আমি জানিনা আপনি কেন এমন মিথ্যে বলছেন, তবে ঐ ঘরে এই মুহুর্তে আমি আছি। 

-মানে? 

– মানে আপনি যদি সত্যি কথা বলছেন, আর আপনি যদি বিদেহী আত্মা না হন, তাহলে এই মুহুর্তে এই ঘরে আমরা দুজনেই আছি। আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না, আপনি পাচ্ছেন? 

শালিনী মাথুর হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে সে বলল, না আমিও আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে দেখতে পেলে মন্দ হত না। 

-তাহলে কার ভুল হচ্ছে বলুন দেখি? 

-আপাতদৃষ্টিতে আপনার। তবে মিস্টার শর্মা, আপনার এই আষাঢ়ে গল্পটা খানিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে বলে, হয়ত আমারও ভুল হচ্ছে। 

-মিস মাথুর? 

-বলুন? 

-আপনার ব্যাগটা এখন কোথায়? 

-ওয়ার্ডরোবের ভিতরে। বাই দ ওয়ে, আপনি চোর ডাকাত নন তো? 

-ব্যাগটার মধ্যে একটা পুরোনো প্লেনের টিকিট আছে না? 

– ছিল। আমি কিছুক্ষণ আগে ছিঁড়ে লিটার বক্সে ফেলে দিয়েছি। 

পুরন্দর শালিনী মাথুরের ব্যাগ থেকে প্লেনের টিকিটটা বের করে আলোর সামনে ধরে দেখল। তারপর বলল, আমার হাতে আপনার ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া টিকিটটা একেবারে অক্ষত ধরা আছে। শালিনী মাথুর গলায় বিস্ময়সূচক শব্দ করে বলল, দেখান দেখি? 

পুরন্দর ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, একটা জলজ্যান্ত মানুষকে দেখাতে পারছি না, এটা কি ভাবে দেখাব? 

-দাঁড়ান ভিডিও কল করছি। এই বলে শালিনী মাথুর ফোন কেটে দিল। 

ভিডিও কল কিন্তু এল না। পুরন্দর শালিনীকে ফোন করতে গিয়ে হতবাক হয়ে দেখল তার ফোনের কল লগে শালিনীর ইনকামিং কল দেখাচ্ছেই না। সে যে বার দুয়েক ফোন করেছিল সেগুলোর লগ তার ফোনে আছে! অন্য কোন নাম্বার থেকে ফোন করেছিল কি? লগে তো তাও দেখাচ্ছে না! পুরন্দর শালিনী মাথুরের ফোন নাম্বার তার ফোনে সেভ করে রাখল। পুরো ব্যাপারটাই এমন অবাস্তব আর ঘোলাটে যে পুরন্দর শর্মা মনে মনে ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছিল। কেউ তার সঙ্গে একটা প্রকান্ড সাজানো খেলা খেলছে। শালিনী মাথুরের আই ডি কার্ড হাতে নিয়ে সে উজ্জ্বল এক হাসিমুখের তরুণীর দিকে তাকিয়ে বসে রইল। শালিনী মাথুরের চুল অদ্ভুত সুন্দর, তার হাসি দেখে মনে হয়, এ জগতে কোন খারাপ কিছু নেই। এই মেয়েটিকে সে একবার অন্তত চোখের দেখা দেখতে চায়। আধঘন্টা পরেও যখন কোন কল এল না, পুরন্দর নিজেই শালিনী মাথুরকে ভিডিও কল করল। এই জায়গার ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি কেমন সে জানে না, তার ধারণা খুব ভালো কিছু একটা নয়, কিছুক্ষণ বাদে ফোনে তার নিজের মুখ ভেসে উঠল আর শালিনী মাথুরের জায়গায় একটা সম্পূর্ণ কালো ফ্রেম দেখা গেল। পুরন্দর ঝুঁকে পড়ে হ্যালো হ্যালো বলতে লাগল, কিন্তু ওদিক থেকে কোন জবাব আসছে না। একটু বাদেই কল আপনা থেকেই কেটে গেল। সে বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দিতে যাচ্ছে, ফের ফোন বেজে উঠল। 

-হ্যালো? ভয়েস কল হচ্ছে কিন্তু ভিডিও কল হচ্ছে না। শালিনী বিড়ম্বিত গলায় বলল। 

-আপনি একশ ষোলো নম্বর ঘর থেকে বলছেন তো? সোফায় বসে বলছেন না বিছানায় শুয়ে বলছেন? 

– এ আবার কি কথা, মিস্টার শর্মা? আপনি সদ্যপরিচিত মহিলাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলেন? 

– সদ্যপরিচিত কিন্তু একই ঘরে বাস করা দুটি নারী পুরুষ! তাই না? 

– সেটা একটা হেঁয়ালি ঠিকই, তবে আপনি খুব রুড দেখা যাচ্ছে। 

পুরন্দর হাসতে লাগল। তার হাসির মধ্যে একজাতীয় বিমূঢ় তিক্ততা আছে। হাসতে হাসতে সে বলল, মাফ করবেন, এমন পরিস্থিতিতে জীবনে পড়িনি কিনা, তাই আমার কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগছে। বলছিলাম কি, আপনি দয়া করে একটু সোফায় গিয়ে বসবেন? 

– কেন? 

– আমি এখন বিছানায় একটু শোব। একজন অচেনা পুরুষের সঙ্গে এক ঘরে এক বিছানায় শোওয়া কি আপনার উচিত হবে? 

শালিনী মাথুর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর ভরাট গলায় হাসতে লাগল। শালিনীর কন্ঠস্বর একটু ভারীর দিকে, সামান্য ভাঙ্গা। কিন্তু তার হাসির শব্দ ভারি সুন্দর। ফোনের ওপার থেকে সেই হাসি পুরন্দরকে বিদ্ধ করতে লাগল। 

-মিস্টার শর্মা? 

-বলুন। 

-আপনার সঙ্গে সত্যিই একবার দেখা হওয়া উচিত। 

-করে ফেলুন। আমি তো আপনার ঘরেই বসে আছি। 

-না জোকস অ্যাপার্ট, অলসো দিস মিস্ট্রি অ্যাপার্ট,আমি কিন্তু সত্যিই আপনাকে দেখতে চাই। 

.-আপনি নেহাতই স্বল্পপরিচিত, তার উপর আমার সঙ্গে এক ঘরেই আছেন বলছেন, ভুতপ্রেতও হতে পারেন, তাই বলতে বাধছে। শালিনী আপনাকে আমারও দেখতে ইচ্ছে করছে। 

-ইস। আপনার একটা ছবিও যদি দেখতে পেতাম! আপনি আমার আইডি কার্ডের ঐ ছবিটা তাও দেখেছেন। 

-আপনি আমার ট্রাভেল ব্লগে গিয়ে দেখতে পারেন। ভান্দালুস্ত অ্যাট পুরন্দর ডট ইন খুঁজে দেখতে পারেন। 

ফোনটা কেটে গেল। পুরন্দর উঠে পায়চারী করতে করতে ভাবতে লাগল, এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা কি তার ব্লগে গল্পের মত করে লিখে রাখা যায়?

কিন্তু লিখব বললেই কি আর লেখা যায়? পুরন্দর শর্মাকে একটা ব্যাকুলতা ক্রমশ গ্রাস করতে লাগল। খানিকটা ট্যাব ঘেঁটে আর খানিকটা টিভি দেখেও মন থেকে শালিনী মাথুরকে সরাতে পারছে না দেখে, সে ফোন খুলে শালিনীর নাম খুঁজতে লাগল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, শালিনীকে করা কলগুলো লগে দেখা গেলেও শালিনীর নাম ফোনে সেভ হয়নি দেখা গেল। আজকের মত বিস্মিত হবার কোটা পুরন্দরের শেষ, ফলে সে আর অবাক হল না। তবে একটা ধারণা তার মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। শালিনী মাথুর মিথ্যে কথা বলছে না। এর একটা সম্ভাব্য ব্যখ্যা হতে পারে যে পুরন্দর সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। কিন্তু সিজোফ্রেনিয়া রুগী কি নিজে সচেতনভাবে বোঝে যে তার মানসিক বিকার হয়েছে? পুরন্দর শালিনীকে ফোন করতে একটা রিংএ তাকে পাওয়া গেল। পুরন্দর বলল, আপনি কি ফোন হাতে বসেছিলেন নাকি? 

-হ্যাঁতো। আমি তো আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। শালিনী বলল ওদিক থেকে। 

-শুনুন আমি সরি আপনাকে মিথ্যেবাদী বলেছি। 

– আপনি আরও আপত্তিকর কথাও বলেছেন। 

-সরি। 

-আপনি কি কাঁচুমাঁচু মুখ করছেন? 

-অনেস্টলি বলছি। আমার মনে হচ্ছে আপনি সত্যি কথাই বলছেন। 

-তাহলে আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি কোনভাবে আমার ব্যাগটা কোথাও হাঁটকেছেন, আর সেখান থেকে যা জেনেছেন তা ব্যবহার করে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন। তাই তো? 

-আপনি এটা বিশ্বাস করেন? 

– না করিনা। কিন্তু এছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হতে পারে? 

-আপনি আমাকে কেন ফোন করছিলেন? 

-আমি আপনার ব্লগ দেখলাম। ঐ ছবিটা কতদিনের পুরোনো? 

-মাসখানেকের। 

-ও। 

– কি ও? আমাকে সলমন খানের মত দেখতে কিনা বলুন। 

শালিনী সেই ভাঙ্গা ভারী গলায় হাসতে লাগল। তারপর বলল, আপনার থুতনির কাছে ঐ একগোছা রেখেছেন কেন? ওটা কাটুন। তাহলে থার্টি পার্সেন্ট কিং খানের মত লাগবে। 

এ কথা শুনে পুরন্দরও হাসতে লাগল। এখন তার হাসিতে আর তিক্ততা নেই। অবচেতন মনে সে ভেবে নিয়েছে যেন শালিনী মাথুর অন্য কোন শহরে বা অন্য কোন দেশে আছে। আর এই হ্যান্ডব্যাগটা তার কল্পনা মাত্র। সে হাসতে হাসতে বলল, আর আমার লেখাগুলো? 

-লেখাগুলো কি? 

-মানে আমার লেখার হাত কেমন? আপনি তো লিটারারি এজেন্ট। ছাপবেন? 

-মন্দ নয়। তবে ভার্চুয়াল মিডিয়ার লেখা আর প্রিন্ট মিডিয়ার লেখার জগৎ আলাদা। পাঠকও আলাদা। 

-মানে ভদ্রভাবে রিজেক্ট করছেন এই তো? 

শালিনী মাথুর চুপ করে রইল। তারপর অন্যমনস্ক গলায় বলল, আপনি ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ান? 

-হ্যাঁ। আপনি বেড়ান না? 

-না। আপনার বাড়ির লোক আপত্তি করে না? 

-তেমন আপত্তি করার মত কেউ নেই। আপনি কি কোন কাজে মোটেল ড্রিমল্যান্ডে এসেছেন? 

-না। আমি এখানে অজ্ঞাতবাসে এসেছি। 

-সেকি? কেন? 

-আমার পাবলিশিং হাউস পাগল করে দিচ্ছে। আমি দুজন পৃথিবীর সবচেয়ে কুঁড়ে আর ফাঁকিবাজ অথরকে হ্যান্ডল করছি। তারাও ম্যানাসক্রিপ্ট শেষ করবে না, আর পাবলিশিং হাউসও আমাকে ছাড়বে না। তাই আমি গাঢাকা দিয়ে আছি। 

-হাউ ইন্টারেস্টিং। তো আপনি এখানে, আই মিন মোটেল ড্রিমল্যান্ডের একশ ষোলো নম্বর ঘরে কদিন আছেন?

-এরা কোন বোর্ডারকে টানা তিনদিনের বেশি থাকতে দেয় না। দিলেও ঘর চেঞ্জ করে দেয়। অদ্ভুত নিয়ম! 

-ও। তারমানে চব্বিশে ফেব্রয়ারী চলে যাবেন? 

-পঁচিশে ফেব্রুয়ারী। আমি উটির ঠিক আগে একটা হোমস্টে তে থাকব। ওখানে আসুন না, দেখি আপনাকে দেখতে পাই কিনা? ঠিকানা দেব? শালিনী মাথুর ফের হাসতে লাগল। 

– মিস মাথুর? 

-মিস ফিস বাদ দিন দেখি। শালিনী বলুন। আমিও মিস্টার ফিস্টার বলব না। 

-শালিনী? 

-কি? 

-বাইশ তারিখ থেকে তিনদিন চব্বিশ তারিখ হয়। 

-হয় তো। 

-তাহলে আপনাকে একদিন বেশি থাকতে – শালিনী? 

-আবার কি হল? 

-আজ কত তারিখ? 

-তেইশে ফেব্রুয়ারী। কেন? 

-কি বার?

-বুধবার। পুরন্দর আপনি কি বলতে- 

পুরন্দর তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করতে লাগল, এখন কি আপনার ঘড়িতে সাতটা পনের বাজে? শালিনী অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। সাতটা চোদ্দ সাতান্ন সেকেন্ড। 

– আপনি তারিখটা একটু বলবেন? আপনার তারিখ? 

-আমার তারিখ মানে? তারিখের আবার আপনার আমার কি? 

-প্লিজ তারিখটা বলুন। 

-তেইশে ফেব্রুয়ারী দুহাজার আঠেরো। 

পুরন্দর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু মুছে গেছে। বাইরে আবছা অন্ধকারে গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে। ঠান্ডা হাওয়ায় পুরন্দর শর্মার গায়ে কাঁটা দিতে লাগল। টেলিফোনের ওদিক থেকে শালিনী মাথুর বলল, পুরন্দর? 

-আমাদের দেখা হওয়ার কোন চান্স নেই শালিনী। 

-কেন? ধরুন যদি আমরা অন্য কোন জায়গায় একটা ডেট ঠিক করে মিট করি? শালিনী মাথুরের গলায় কি কোন আকুলতা শোনা যাচ্ছে? নাকি পুরোটাই পুরন্দরের কল্পনা? সে খুব নিচু গলায় বলল, আমি যে বাইশে ফেব্রুয়ারী দুহাজার আঠেরোতে বসে আছি! আমার ঘরে তোমার গতকালের ব্যাগ পড়ে আছে শালিনী! 

-একটা তো রাত। কালকেই তো তোমার তেইশে ফেব্রুয়ারী হয়ে যাবে পুরন্দর। হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখবে খাটের ঐ কোনায় আমি ঘুমোচ্ছি? 

পুরন্দর হাসল। খুব ক্লিষ্ট সে হাসি। সে বলল, কালকে তো তোমার চব্বিশে ফেব্রুয়ারী। সেখানে আমি কোথায়?

 ########## 

রাস্তার ডানদিকে গাছের ফাঁক দিয়ে বাড়িগুলো উঁকি মারল, যেন খেলনাঘর সাজানো আছে। বাড়িগুলোর রঙ হাল্কা হলুদ, সবুজ রঙের ঢালু চাল, পরপর ব্যারাকের মত দাঁড়িয়ে আছে ঘুম ঘুম চোখে। সামনে একটা সাইনেজ, তাতে লেখা “মোটেল ড্রিমল্যান্ড”। এয়ারপোর্ট থেকে সেল্ফ ড্রিভেন গাড়ি নিয়ে শালিনী মাথুর প্রায় ঘন্টা তিনেক পথ পাড়ি দিয়ে পশ্চিমঘাট পাহাড়ের সানুদেশে এসে পড়েছে, এখান থেকে উটি আরো চারঘন্টা লাগবে। পথে সে গোটাদুয়েক ক্যানড বিয়ার খেয়েছে আর জিপিএস দেখে গাড়ি চালিয়েছে – মোটেল দেখে শালিনীর এক সঙ্গে খিদে আর ঘুম দুই-ই পেয়ে গেল। লম্বা ছুটি নিয়ে সে নিরুদ্দেশ ভ্রমণে বেরিয়েছে, উটিতে তার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। এই পান্ডববর্জিত নাম না জানা জায়গায় সে যদি দিন তিনেক থেকেই যায়, তাতে কারুর ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। শালিনী মাথুর গাড়ি ঘুরিয়ে মোটেল ড্রিমল্যান্ডের সামনে লালচে মোরামের পার্কি বে তে গাড়ি রেখে, নেমে আড়মোড়া ভাঙল।

[শেষ]

<<<<< ছোটগল্প সংকলনে ফিরুন

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!