মহেশতলা

আমি কলকাতার পশ্চিমপ্রান্তে মহেশতলায় বাস করি। এই অঞ্চলটি তারাতলার মোড় থেকে জিনজিরাবাজার হয়ে বজবজ পর্যন্ত চলে যাওয়া বজবজ ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত, যদিও বজবজ-শিয়ালদহ ট্রেনলাইনও এই যোগাযোগের অন্যতম শরিক। মহেশতলা এখন একটি থানা, অতীতে টালিগঞ্জ থানা এই অঞ্চলের দেখভাল করত। অঞ্চলটি আয়তনে বিশাল, বস্তুতপক্ষে মহেশতলা পৌরসভা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরশাসিত অঞ্চল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার শতাব্দী প্রাচীন এই জনপদটি কলকাতা শহর বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলির ইতিহাসে কোন উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারে নি। মহেশতলারও পশ্চিমে বজবজ প্রায় দুশো বছরের পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু শহরতলী কিন্তু মহেশতলা যে কোথায় অর্ধেক কলকাতা তা জানে না। ভারতবিখ্যাত বাটানগর যে মহেশতলার অংশ সে কথাও অনেকে জানে বলে মনে হয় না।

এই অবহেলার পিছনে দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণটি হল মহেশতলা ঐতিহাসিক ভাবে সমাজের নিম্নবর্গের (অনুপ জাতি) বাসস্থান ছিল – কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলে শিক্ষার তেমন প্রসার হয় নি। বাওয়ালির মোড়লরা, চটা রায়পুরের রায়েরা, আকড়া কৃষ্ণনগরের মুখার্জিরা আর আদি মহেশতলার ব্যানার্জিরা এখানে জমিদারি করেছেন, স্কুল খুলেছেন, মন্দির স্থাপন করেছেন কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের কূপমন্ডুকতা তেমন পাল্টাতে পারেন নি। এই এলাকায় ওয়াচেন মোল্লা (যার নামে মোল্লার গেট) কিংবা সুবিদ আলির মত স্বনামধন্য, দাতা, বিদ্যোৎসাহী আর সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন, কিন্তু উদাসীন আলস্যে মহেশতলার মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে কিছু কম যান না। মহেশতলার মানুষ একসময় স্বচ্ছল ছিল কিন্তু কোনকালে উদ্যোগী বা উচ্চাকাঙ্খী ছিল না।

কোন সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এখন বহুতল আবাসন হচ্ছে – এতে এই অঞ্চলের জনভিত্তি পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু এখানকার সাবেক মানুষের বনিয়াদি উন্নয়ন কতটা হবে সন্দেহ।

দ্বিতীয় কারণটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার পালাবদলে পাল্টে পাল্টে গেছেন কিন্তু মহেশতলার জন্য কেউ বিশেষ কিছু করেন নি। কিছু নলকূপ, গ্রামের কিছু রাস্তার মেরামতি ইত্যাদিতেই এখানকার মানুষ খুশি, সুতরাং তাঁরাও দিনগত পাপক্ষয় করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে মহেশতলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা নেই, রাস্তাঘাট অতিসঙ্কীর্ণ, এলাকায় বড় কোন হাসপাতাল নেই এমনকি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বজবজ ট্রাঙ্ক রোড যা নাকি মহেশতলার ধমনী, দশকের পর দশক ধরে অনুন্নত আর বেআইনিভাবে দখল হয়ে পড়ে আছে। কোন সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এখন বহুতল আবাসন হচ্ছে – এতে এই অঞ্চলের জনভিত্তি পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু এখানকার সাবেক মানুষের বনিয়াদি উন্নয়ন কতটা হবে সন্দেহ।

অথচ মহেশতলার স্বল্পপরিচিত আকর্ষনীয় ইতিহাস আছে। এখানকার ভূমিপূত্ররা কলকাতার এলগিন রোডে বা বালিগঞ্জে বসতি স্থাপন করে মহেশতলাকে ভুলে যেতে পারেন কিন্তু মনে রাখতে হবে এখানকার ব্যানার্জিহাটের ব্রাহ্ম মুখুজ্যেবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ বহুবার অতিথি হয়েছেন। এখানকার শিব আর কালীমন্দিরগুলি শতাব্দী প্রাচীন। মনে রাখতে হবে মহেশতলার পাঁচ মসজিদ বৌদ্ধ, হিন্দু আর মুসলিম সংস্কৃতির বিরল মিশ্রন। মনে রাখতে হবে মহেশতলার ইতিহাস কলকাতা শহরের অনেক অঞ্চলের চেয়ে কিছু কম সমৃদ্ধ নয়।

চব্বিশ পরগনার একটি পরগনার আদি নাম ছিল মাগুরা। সেই মাগুরা পরগনায় মহেশতলা ছিল একটি গ্রাম। সেই গ্রামের পাশে চিংড়িপোতা গ্রাম থেকে কটক রোড (দেড়শো বছর আগে যে নামে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড পরিচিত ছিল) ধরে সারেঙ্গাবাদ যাওয়ার পথে পড়ত একশ একর বিস্তৃত গুমোরজলা। সেই জলাভূমির একাংশ বুজিয়ে হয়েছে বিশাল আবাসন। শীতকালে অনেক রাত করে গাড়ি চালিয়ে ইডেন সিটির কাছে এলে জলা থেকে কুয়াশা ভেসে এসে গাড়ির আলোর সামনে অশরীরি নৃত্য করে। সে কি আমাদের কিছু বলতে চায়?

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!