কেয়া চক্রবর্তীকে আমি সচক্ষে দেখিনি। তাঁর অভিনয় দেখিনি। জীবনের কোন পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কোন প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ যোগ ছিল না কোনদিন। যে বছর তাঁর মৃত্যু হয়, আমার বয়স ছিল ষোলো। আমার কৈশোরে ঐ বয়সে নাটক থিয়েটার দেখার চল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ছিল না, ফলে জীবিত কেয়ার সম্পর্কে আমার রোমন্থন করার মত সরাসরি কোন স্মৃতি নেই। এই পেজে অনেক প্রণম্য ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষ কেয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁদের জড়িয়ে থাকা স্মৃতি শেয়ার করছেন, সেগুলি পড়ছি এবং সমৃদ্ধ হচ্ছি। আর পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে আমি বা আমার মত যারা কেয়া চক্রবর্তীর সাক্ষাৎ সান্নিধ্য পায় নি, তারা কি এই স্মৃতিতর্পনে ব্রাত্য হয়ে থাকবে? কেয়া চক্রবর্তীর স্মৃতি কি ১৯৭৭ সালে মাঝগঙ্গায় থেমে গেছে? বিতর্ক আর প্রশ্ন থামেনি, কিন্তু কেয়া চক্রবর্তী কি সম্পূর্ণ অতীত হয়ে গেছেন?
আমার পিতৃদেব খুব কম মাইনে পাওয়া সরকারী কর্মচারী ছিলেন। আমার শৈশব কৈশোর তাই দৈনন্দিন লড়াইএ ব্যাপৃত থাকত। কিন্তু তিনি সাহিত্যের ছাত্রও ছিলেন বটে, ফলে লড়াই করা মানুষের যে শিল্পে অখন্ড অধিকার আছে – সেই বোধ ছোট বয়সে হয়েছিল। শৈশব কৈশোরে যা পেতাম তাই পড়তাম, অকালপক্ক বালকেরা যা করে আর কি, আর সেই সূত্রে সংবাদপত্রে নান্দীকারের ভালোমানুষ নাটকের কথা পড়ে জেনেছিলাম কেয়া চক্রবর্তী নামে এক অভিনেত্রী শান্তাপ্রসাদ আর শান্তি বলে দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। এগারো বারো বছরের কথা, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে পত্রপত্রিকায় ‘কেয়া চক্রবর্তী অভিনীত’ ট্যাগলাইনের বিজ্ঞাপন দেখেছি মনে আছে। সেই সময়ে এমনকি সুচিত্রা সেনের একার নামে সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখিনি। কেয়া চক্রবর্তীর সবচেয়ে কাছে এসেছিলাম, এখন মনে করে প্রসন্ন হাসি আসে, উত্তর কলকাতার রঙ্গনা থিয়েটার হলের প্রায়ান্ধকার লবিতে। না রক্তমাংসের কেয়া নন, তাঁর সাদাকালো ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম, যা হলের কাচের বাক্সে সাজানো থাকতো। সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন আমার বয়স বারো তেরো হবে বোধহয়, বাবার সঙ্গে তাঁর পুরোনো ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের আড্ডায় যাবার পথে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই ছবিগুলো হারিয়েই গেছিল, এখন ফেসবুক ফেরত নিয়ে আসছে।
সমস্ত জীবন জুড়ে কেয়া চক্রবর্তীর সন্ধান করেছি। তাঁকে যারা দেখেছেন, এমন কি তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন এমন অনেক মানুষকে আমি চিনি, তাঁদের মুখে কেয়ার কথা শুনেছি, অজস্র লেখা পড়েছি তাঁর সম্পর্কে, তাঁর কাজ সম্পর্কে, তাঁর তীব্র শানিত জীবন সম্পর্কে – এসব থেকে কেয়া চক্রবর্তীকে খানিকটা চেনা বোঝা গেছে। কিন্তু আবার বোঝাও যায় নি অনেক। মানে, কবি শঙ্খ ঘোষকে জিজ্ঞেস করে যদি জানা যেত কেন তিনি লিখেছিলেন ‘আগুন ঝাঁপ দিয়েছে জলে’ বা কবিতা সিংহের কবিতা গুলো কি কেয়ার এপিটাফ?
একটা সময় পর্যন্ত কেয়া চক্রবর্তী এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে বেঁচেছিলেন আমার কাছে। এখন এই অ্যানেকডোটাল লেখা লিখতে লিখতে বুঝতে পারছি, আমাদের মত অনেকের কাছে কেয়া এই প্রশ্নগুলোর মত বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কোনদিন অতীত হবেন না। তিনি কেবল অসামান্যা অভিনেত্রী নন, একরকমের জীবনবোধের আইকন, যাকে যাপন করতে না পেরে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুসরণ করি।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে দেখা কেয়া চক্রবর্তীর সাদা কালো ছবি, যাতে তাকে কলাবিনুনী করা আর ডুরে শাড়ি পরা দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট আছে। তথ্যের ভার তাকে এতটুকু ক্লান্ত করে নি।
[ ফেসবুকের Keya Chakraborty শীর্ষক পেজের অনুমতি সাপেক্ষে পুনঃ প্রকাশিত। ]