অফিস বেরোনোর আগে বেডসাইড টেবিল থেকে মানিপার্স তুলে জগৎকিশোর টাকাপয়সা চেক করতে লাগলেন। মাঝে মাঝেই তাঁর মনে হয় পার্সে টাকা কমে যাচ্ছে। আজও তাঁর মনে হল একটা পাঁচশোর নোট কম আছে। আশ্চর্য ব্যাপার। নিজের ঘরে নিজের টাকাকড়ি লুকিয়ে রাখতে হবে নাকি! কে সরায় টাকা? কাজের মাসি? নাকি সুলতা? অনিন্দ্য বড় হয়েছে, সিগারেট বিড়ি খেতে শিখেছে। তারও এমন হাতটান হওয়া বিচিত্র নয়। বিরক্তিতে জগৎকিশোরের মন ভরে গেল। কর্তব্য কর্মে তিনি কোন ত্রুটি করেন না। স্বচ্ছল সংসারে কারুর কোন অভাব রাখেন নি তিনি। মাসের শুরুতেই স্ত্রী পুত্রের হাতে নিয়ম করে হাতখরচের টাকা দিয়ে যাচ্ছেন উনি বছরের পর বছর। ড্রাইভার, কাজের মাসি যে যার পাওনা পেয়ে যায় মাসের এক তারিখে। তবু তাঁর পার্স হাঁটকাতে হবে? তিনি গলা তুলে ডাকলেন, সুলতা!
আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে এসে সুলতা বললেন, কি হল কি? চেঁচাচ্ছ কেন? সুলতার মুখে গলায় ঘাম, চেহারায় ব্যস্ততা।
তুমি কি আমার ব্যাগ থেকে টাকা নিয়েছ? তেতো গলায় বললেন জগৎকিশোর।
– সে কি কথা? আমি কেন নিতে যাব?
– তাহলে পার্সে টাকা কম কেন?
– সে আমি কি করে বলব? আলমারিতে ব্যাগ রাখো না কেন?
মুখঝামটা দিতে দিতে সুলতা চলে গেলেন। জগৎকিশোর ব্যাজার মুখে খাবার টেবিলে এসে বসলেন। এরা মা ছেলে এত উদাসীন যে বলার নয়। গত সপ্তাহে তাঁর একটা ঘরে পরার পাঞ্জাবী কোথায় গায়েব হয়ে গেল। দুচার দিন এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি হল, ইস্ত্রিওলাকে জিজ্ঞাসাবাদ হল, কিন্তু বস্তুটি আর উদ্ধার হল না। মাসখানেক আগে অনি ইয়ারফোন খুঁজে না পেয়ে গাঁক গাঁক করে চেঁচাচ্ছিল। বোসের ইয়ারফোন, এককাঁড়ি দাম নিয়েছিল, ফুটপাথের একশ টাকার মাল নয়। সেটাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। যাবে কি করে? এ বাড়ি থেকে জিনিস চুরি যাচ্ছে। এবং চুরি যাচ্ছে বাড়ির লোকের গা ছাড়া মনোভাবের জন্যে। একজন টিভি সিরিয়াল নিয়ে পড়ে আছে, আরেকজন ফেসবুক নিয়ে। হতাশা আর বিরক্তিতে জগৎকিশোর পাঁচশো টাকা কেজি পাবদা মাছটা আয়েশ করে খেতে পারলেন না।
কি হল? মাছ ফেলছ কেন? ভালো হয় নি? সুলতা এসে বললেন।
– এই নতুন কাজের মাসিটা কেমন?
– নতুন? চার মাস হয়ে গেছে।
– ঐ হল। মানুষটা কেমন?
– কেমন মানে? কাজের লোক যেমন হয়, তেমন।
– আঃ! কি বলছি বোঝো। হাতটান আছে কিনা লক্ষ্য করেছ?
– সে তো নজর রাখতেই হয়।
– আমি সিওর পাঞ্জাবীটা ও-ই নিয়েছে।
– ভ্যাট। এখানে গেটে সিকিউরিটি চেক করে।
– ধুস। পেটে গুঁজে নিয়ে চলে গেছে। মেয়েদের বডি সার্চ করবে কি করে?
সুলতা মাথা নাড়তে লাগলেন। না না। অমন সন্দেহ করতে নেই। ছি।
জুতো পরতে পরতে জগৎকিশোর মনে মনে গজ গজ করতে লাগলেন। সন্দেহ করতে নেই। অবতার সব। ঝেড়ে ফাঁক করে দিচ্ছে সেটা কোন দিকে গেল, আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে।
গাড়িতে বসতেই ড্রাইভার বাপি বলল, স্যর আজকে পিছনের চাকা দুটো পাল্টে নেবার কথা। আপনাকে অফিসে নামিয়েই আমাকে গ্যারেজে যেতে হবে।
জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে জগৎকিশোর বললেন, কত রে দুটো চাকা?
ব্রিজস্টোন নিলে সাড়ে ন হাজারের মত পড়বে। বাপি বলল।
জগৎকিশোর চিরতা খাওয়ার মতো মুখ করে বললেন, বাবা! এত? আর পুরোনো চাকাগুলো কি করবি?
বাপি ওস্তাদের মত বলল, ও আর কি হবে, ফেলে দিতে হবে। সামনের দুটোও তাই করতে হয়েছে।
ফেলে দেবে না কচু। ও দুটো তুমি মল্লিকবাজারে বেচবে। মিনিমাম পাঁচশো করে হাজার। মনে মনে বললেন জগৎকিশোর। একে তো পেট্রল ঝাড়া চলছে, তার উপর গাড়ির চাকা। সারা দুনিয়াটাই চোর। সবাই মিলে তাঁর থোবিল সাফ করছে। গাড়ির পিছনের সিটে প্যাঁচার মত মুখ করে বসে রইলেন জগৎকিশোর।
অফিসে কাজ করতে করতে মন টা অন্য দিকে চলে গেছিল। দিনের কাজ গুছিয়ে বেরোনোর জন্যে তৈরী হচ্ছেন, এমন সময় পিয়ন গোপাল এসে টেবিলের উল্টোদিক ঘন ঘন মুছতে লাগল।
এই! হঠাৎ ছটার সময় টেবিল মুছতে লেগেছো কেন? ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বললেন জগৎকিশোর।
– স্যার একটা কথা ছিল।
– কথা? কি কথা? বলে ফেল।
– স্যর আজ আপনার টেবিল গোছাতে গিয়ে দেরাজের ভিতরে অনেকগুলো ডায়েরী দেখলুম।
– তো?
– মানে বলছিলুম কি আমাকে একটা দেবেন? গতবছরের হলেও চলবে।
জগৎকিশোরের পিত্তি জ্বলে গেল। এই লোকগুলো সর্বদা ছোঁকছোঁক করছে। সবসময় বাগানোর তাল। ঐ ডায়েরীগুলো অনিন্দ্যর দরকারে লাগে। বিটেকের স্টুডেন্ট, নইলে রাফ ওয়ার্ক করার কাগজ কিনতে কিনতে তো তিনি ফতুর হবেন!
কর্পোরেট ডায়েরী পট করে যাকে তাকে দেওয়া যায় না, বুঝলে? গম্ভীর মুখ করে বললেন জগৎকিশোর।
গোপাল চুপসে গেল। সে ম্রিয়মান মুখে বলল, ও আচ্ছা।
বেরোনোর আগে একটা নতুন স্টেপলার আর এক বাক্স পিন ব্যাগে পুরলেন জগৎকিশোর। কাজের এত চাপ, দোকানে গিয়ে এ জিনিস কেনার সময় পাচ্ছেন না তিনি।