বছর দুয়েক আগে যখন সবাই ফেলুদা আর ব্যোমকেশ নিয়ে পড়েছিল তখন তাকে বাঙ্গালীর রোম্যান্টিক আদেখলেপনা বলে মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল এ এক নস্টালজিক টেক্কা মারামারি।
গত দশ বছর ধরে পুরোনো খবরের কাগজে মলাট দেওয়া শতছিন্ন বইগুলি পরম মমতায় নাড়াচাড়া করতে দেখে বলেছিলুম, মা একে রিভিসিট বলে। সাহিত্যে, সিনেমায়, নাটকে এর প্রয়োজন আছে।
মা চুপ করে গিয়েছিলেন। কিন্তু টিমটিমে গ্যাস বাতি, কাঠের ট্রামগাড়ি আর বালিগঞ্জের শেয়ালের ডাক একটা প্রহেলিকার মত মায়ের স্মৃতিতে ব্যোমকেশকে জড়িয়ে আছে। আর পঞ্চান্ন বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের তিনতলার ছাদে এক বালকের চোখে বাদশাহি আংটির আলো ছলকে উঠেছে পঞ্চাশ বছর আগে। এরা কেউ রিভিসিটের টিকিট পাবেনা কোনোদিন। সত্যজিৎ বুঝেছিলেন। ঋতুপর্ণ কিছুটা। সন্দীপ, সুজয়, অঞ্জন, দিবাকরেরা বুঝবেন বলে মনে হয় না।
বাঙালী গোয়েন্দা, অর্থাৎ কিনা যে পরিধানে ধূতি ফতুয়া অথচ অপরাধ বিশ্লেষণে পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী, বাংলা সাহিত্যে এল হেমেন্দ্র কুমার রায়ের হাত ধরে আর তাদের নাম হল জয়ন্ত ও মানিকলাল। সঙ্গে এলেন অল্প কমিক খাদ্যরসিক দারোগা সুন্দরবাবু। জয়ন্ত মানিকের জনপ্রিয়তা প্রায় আইকনিক পর্যায়ে গিয়েছিল কারণ, এই দুই তরুণ সুদেহী, সাহসী আবার খানিকটা জাতীয়তাবাদীও বটে, অপরাধের বিরুদ্ধে এদের লড়াই বুদ্ধি ও শক্তির মিশেলে যার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান সচেতনতা। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের সামাজিক পটভূমিকায় বলে এদের অভিযানগুলি নারীবর্জিত ছিল। যাঁরা যখের ধন বা কাচের কফিন পড়েছেন তাঁরা বুঝবেন আমি কি বলতে চাইছি। হেমেন্দ্রকুমার রবীন্দ্রনাথের পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক পত্রিকা ভারতীতে তিনি নিয়মিত লিখতেন। একাধারে শিল্পী, সুরকার, গীতিকার এমনকি নৃত্যনির্দেশক এই বহুপ্রতিভাধর মানুষটি চল্লিশবছর বয়সে কিশোরপত্রিকা নাচঘরে লিখতে এসে আজীবন কিশোর রহস্যরোমাঞ্চকাহিনী লিখে অমর হয়ে গেলেন। রিভিসিট করলে এঁর জয়ন্ত মানিক এখনো বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
জনপ্রিয় হলেও হেমেন্দ্র কুমারের জয়ন্ত-মানিক সিরিজ মূলত কিশোরপাঠ্য ছিল। পাঁচকড়ি যেমন নীলবসনা সুন্দরী লিখতেন, তেমন প্রাপ্তমনস্ক অপরাধ কাহিনী বা অ্যাডাল্ট গোয়েন্দা হিরো, যাকে super sleuth বলা যেতে পারে, তার একটা অভাব থেকেই গিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে। ১৯৩৪ সালে পথের কাঁটা নামে রহস্যকাহিনীতে নিপাট বাঙালী ব্যোমকেশ বক্সী এসে সেই শূন্যতা পূরণ করল। পুনানিবাসী এক ফিল্ম স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে ব্যোমকেশ যা করল তাকে এক কথায় ভিনি ভিডি ভিসি বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হবে না। ইংরাজি সাহিত্যে শার্লক হোমস যেমন প্রবাদে পরিনত হয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে ব্যোমকেশও তাই। আমি এমন পাঠককে চিনি যিনি এখনও বিশ্বাস করেন কেয়াতলা রোডে ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর বাড়ি আছে, নিদেনপক্ষে পাড়ার মোড়ে অজিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেও যেতে পারে।
শরদিন্দু বম্বে টকিজের মাইনেকরা স্ক্রিপ্ট রাইটার ছিলেন। তাঁর কাহিনীনির্মান ও চরিত্রসৃষ্টির মধ্যে সিনেমাটিক উপাদান সবধরণের লেখার মধ্যে যথেষ্ট পরিমানে মেলে। সাহিত্যগুনে ও প্রাপ্তমনস্কতায় তাই ব্যোমকেশ বক্সী এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিল যে এর জুড়ি মেলা ভার। শার্লক আর ব্যোমকেশের মিল তাদের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও অবলোকনে, অপরাধীর মনস্তত্ব বিশ্লেষণে আর খামখেয়ালী সাহসে। কিন্তু ব্যোমকেশ শার্লকের মত নেশাগ্রস্ত প্রতিভা কিংবা রোম্যান্সহীন নয়, সে মধ্যবিত্ত গড়পড়তা বাঙালীর মত স্বাভাবিক জীব, অপরাধের কিনারা করতে গিয়ে প্রেমে পড়ে (অর্থমনর্থম), সে বিবাহিত ডিটেকটিভ হয়েও বন্ধু অজিতের সঙ্গে একগৃহে বাস করে, তার আবার একটি ছেলেও আছে। মজার ব্যাপার হল, কনান ডয়েল আর শরদিন্দু কেউই ভাবেন নি তাঁদের শার্লক আর ব্যোমকেশ জনপ্রিয়তায় অমর হতে চাইবে – কনান ডয়েল শার্লককে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলেন আর শরদিন্দু ছায়াছবির চিত্রনাট্য লেখার জন্যে ব্যোমকেশকে পনের বছরের রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কমবেশী তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছরের লেখক জীবনে তিনি মোটে ৩২টি ব্যোমকেশ কাহিনী লিখেছেন। ব্যোমকেশের অসামান্য পেশাদারী অপরাধ বিশ্লেষণ আর অপরাধীর চেয়ে বেশী অপরাধ ধরার প্রবনতা (কয়েকটি ক্ষেত্রে হাতে পেয়েও সে অপরাধীকে ধরে নি) গোয়েন্দা কাহিনীকে সাহিত্যের মূল স্রোতে আনতে সমর্থ হয়েছিল যার জন্য পরবর্তীকালে অনেক প্রতিথযশা সাহিত্যিক একটি আদর্শ গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করার চ্যালেঞ্জ এড়াতে পারেন নি।
চল্লিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত ব্যোমকেশ জীবন্ত কিংবদন্তী ছিল। শরদিন্দুর লেখায় তার একটা আবছা অবয়ব ফুটে ওঠে : লম্বা, পরিধানে পাজামা-পাঞ্জাবী/ধুতি-পাঞ্জাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি যুবক, চশমা পরিহিত কিনা বোঝা যায় না তবে ধূমপায়ী আর বেশ রসবোধ বিশিষ্ট বলে মনে হয়। কল্পনায় ব্যোমকেশ বেশ আকর্ষক (অবশ্যই সেক্স অ্যাপিল আছে) আর তার সম্পর্কগুলি (অজিত কিংবা সত্যবতী) অনেকটাই অর্ধকথিত বা unexplored। বিশেষ করে সত্যবতী অত্যন্ত interesting, তাকে Irene Adler ভাবলে ভুল হবে বরঞ্চ আবেভাবে সে কতকটা Mary Morstan আর কতকটা Harriet Vane। এমন মারাত্মক মশলা থাকা সত্বেও সত্যজিৎ রায় চিড়িয়াখানা নামে চলচ্চিত্রে ব্যোমকেশের প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি। অনেক চেষ্টা করে উত্তমকুমারও ব্যোমকেশ হয়ে উঠতে পারেন নি। আর এখন শুধু একটা চাদর বা বড়ফ্রেমের একজোড়া চশমা পরিয়ে কাউকে কি করে ব্যোমকেশ বানানো যায়? হয়ত এই ব্যর্থতার থেকেই ষাটের দশকের শেষদিকে সত্যজিতের কলমে প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের জন্ম হয়েছিল।
ব্যোমকেশ যুগেও কিন্তু স্বনামধন্য লেখকেরা গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। নীহাররঞ্জন গুপ্ত এনেছেন কিরীটি রায়, যাঁকে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল গোয়েন্দা বলা যায়। অনেকেরই হয়ত কিমোনো আর ঘাসের চটি পরা কিরীটির কথা মনে আছে। আর মনে আছে তাঁর ভয়ানক ধনী ও উচ্চকোটির মক্কেলদের। কিন্তু দিনের শেষে কিরীটি রায় হয়ে দাঁড়ান more show than substannce। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন পরাশর বর্মার কাহিনী। এই গোয়েন্দা আদতে একজন কবি, রহস্যভেদ করেন শীতল যুক্তির চেয়ে বেশী শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টিতে (এরকুল পোয়ারো স্মর্তব্য)। কিন্তু ঘনাদা ও অন্যান্য অমর কাহিনীর স্রষ্টা প্রেমেন্দ্র এতটাই বহুমুখী যে তাঁর অজস্র অমর কীর্তির ভিড়ে পরাশর বর্মা হারিয়ে গেছেন। এই সময়ে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজও লিখেছেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কাহিনী। কর্নেল বয়োঃবৃদ্ধ, পক্ষীবিশেষজ্ঞ আর প্রজাপতি সংগ্রাহক। ক্ষ্যাপাটে এই কর্নেল পাইপ ফুঁকে, ছড়া কেটে হাসতে হাসতে রহস্যভেদ করেন। চরিত্রগুনে ও লেখার মুন্সিয়ানায় পরাশর আর কর্নেল ব্যোমকেশকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ দিতে পারত হয়ত। কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীর প্রাণ হল অপরাধীর মনস্তত্ব, লোকে গোয়েন্দাতে বেশী মজে গেলে তার গতি রুদ্ধ হয়। ব্যোমকেশ এইখানে বাজি মেরে দিয়ে চলে গেল।

সত্যজিৎ এই ভুল করেন নি। তাঁর মন্দার বোস কিংবা মগললাল মেঘরাজ ফেলুর চাইতে কম জনপ্রিয় নয়। যেহেতু তিনি বিশ্বমানের চিত্রনির্দেশক ও ইলাস্ট্রেটর, প্রদোষ মিত্রের কাহিনীগুলির ডিটেল সাঙ্ঘাতিক মনোগ্রাহী। ব্যোমকেশ একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরত বটে, ফেলু অ্যাকশানে পিছপা নয় সে গুলির চাঁদমারি করে। সত্তরের দশকে বাঙালী অনেকবেশী আন্তর্জাতিক – ফলে প্রদোষ মিত্রর কান্ডকারখানা সারা পৃথিবী জুড়ে। ছফুট লম্বা, ডালমুট আর চার্মিনার ভক্ত, যোগব্যায়াম করা ফেলুদা রসবোধে ও বুদ্ধির ছটায় নব্যবাঙালী, কলকাতার ড্রইংরুম থেকে মিশর পর্যন্ত যে একইরকম স্বচ্ছন্দ। ফেলু সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র গোয়েন্দা চরিত্র যার নির্মান কাগজে কলমে আর ছায়াছবিতে একই সময়ে একই মানুষের হাতে হয়েছে। যদিও তোপসে তার কেমন ভাই আর তারচেয়ে কতটা ছোট সেটা ফেলুদার কাহিনীগুলিতে পরিস্কার নয়, অপরাধের গভীরতা ও প্রাপ্তমনস্কতায় এই কাহিনীগুলি ব্যোমকেশতুল্যও নয় তবুও ছবিতে, বর্ণনায় ও চলচ্চিত্রের উদ্ভাবনায় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সম্ভবত বাংলার দ্বিতীয় জনপ্রিয় গোয়েন্দা।

সমসাময়িক কালে সুনীল লিখেছেন কাকাবাবু আর গোগোল, সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখেছেন মিতিনমাসি (বিরল মহিলা রহস্যসন্ধানী) আর শীর্ষেন্দু লিখেছেন শবর যে কিনা একজন পুলিস অফিসার। এছাড়া সমরেশ মজুমদার লিখেছেন অর্জুন সিরিজ, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন পান্ডব গোয়েন্দা। লেখার গুনে এরা প্রত্যেকেই বিশিষ্ট চরিত্র, কাকাবাবু আর শবর ইতিমধ্যে চিত্রায়িতও বটে। দীর্ঘ দেড়শ বছর ধরে অপরাধ রহস্য আর তার উদ্ঘাটন বাংলা সাহিত্যের একটি চলমান ধারা। এটি একটি গবেষণার বস্তু হতে পারে যে অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় বাঙালীর মননে এই গোয়েন্দা কাহিনীর চাহিদা এবং জোগান এত বেশী কেন। তাহলে আমাদের ফের ফিরতে হবে নস্ট্যালজিক সেই রিভিসিটের কাছে। ফিরে দেখতে হবে বাঙালীর সমাজ দর্পন। যেখানে একজন স্বপনকুমার দীপক চ্যাটার্জীর পাল্প ফিকশন লিখে ইতিহাসে ঢুকে যেতে পারেন অথচ গভীরতম অপরাধ বিশ্লেষণের পরাকাষ্ঠা হয়েও নারায়ন সান্যালের কাঁটা সিরিজের পি কে বাসু তেমন জনপ্রিয়তা পান না। তাহলে কি অপরাধ রহস্যের চেয়ে রহস্যভেদীই বাঙালীর কাছে বেশী প্রিয়?
আসলে বাঙালী সম্পর্কবাদী। একটা শহর, একটা সময় আর একটা মানুষকে সে আশ্রয় করতে চায়। রহস্য, রোমাঞ্চ, কৌতুহল ও বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীবিন্যাসের মধ্যেও তার সম্পর্কগামিতা নিরন্তর ক্রিয়াশীল। কথিত আছে বাংলা সাহিত্যে কমবেশী ৯১টি গোয়েন্দা চরিত্র আছে। এদের মধ্যে দশটিকে যদি জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে অল টাইম ফেভারিট ধরি, আমাদের প্রত্যেকের মনে এদের এক একটা করে ব্যক্তিগত চেহারা আছে। এই গোয়েন্দাগুলিকে সর্বজনীন করে দিলেই আমার বা আমার মায়ের মত অনেকেই খুঁতখুঁত করতে থাকবেন।