বাপি দেয়াল লিখতো। অদ্ভূত নিয়ন্ত্রন ছিলো অক্ষরের উপর। মনে হ’ত ক্যালিগ্রাফি শিখেছে কোথাও। কিন্তু আমরা যারা ওর পাড়ার বন্ধু তারা জানতাম রঙ তুলি দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান লেখার ক্ষমতা বাপির ঈশ্বরদত্ত। হদ্দ গরিব ঘরের ছেলে ছিলো বাপি – ওর বাপ মরেছিল জুটমিলে আর মা বানাতো ঠোঙ্গা।
যেতে আসতে দেখতাম পাড়ার এ দেয়াল সে দেয়ালে বাপির হস্তাক্ষর। কাস্তে হাতুড়ি তারা কিংবা হাত, বাপির খাতির ছিলো সবার কাছে । আশির দশক সবে শুরু হয়েছে তখন – ঘাসফুল ফোটেনি বাংলায়।
“সিপিএম করিস না কংগ্রেস?” আমরা জিগ্যেস করতাম। বাপি লাজুক হাসতো। তারপর গলা নামিয়ে বলতো,” আমি বামপন্থী কংগ্রেস।” খুব হাসাহাসি হ’ত। গরিবের আবার পার্টি কি? যে পয়সা দেবে বাপি তার হয়ে দেয়াল লিখবে।
কেন জানিনা সবাই মেনেও নিয়েছিলো সেটা। সিপিএমের পার্টি অফিসে বসে চা বিস্কুট খেতো বাপি আর কংগ্রেসের কার্যালয়ে চপমুড়ি।
ক্রমশ হাতচিহ্নের রমরমা কমে গেল। সব দেয়াল লালে লাল। পয়সা কড়ি বেড়ে গেল বাপির। সিএসটিসিতে কন্ডাক্টরের চাকরি জুটে গেল। লোকে বলতে লাগলো, বাপি পুরো সিপিএম হয়ে গেছে।
একদিন শীতের সন্ধেয় শীতলাঘাটের রোয়াকে দেখি বাপি একা বসে আছে। লালচে হ্যালোজেনের আলোয় সবকিছু কেমন যেন বিষন্ন দেখায় – বাপির মুখও শুকনো।
“কিরে বাপি, মুখ শুকনো কেন? তোর তো এখন বাজার গরম!”
বাপি হাসে না। “ধুর । খালি এক লেখা। ভাল্লাগে না।”
কিন্তু পয়সা তো হচ্ছে। এখন লালের জামানা গুরু।
“এরা বোঝে না জানিস? এটাতো একটা আর্ট বল?” বাপি নিভন্ত গলায় বলে। বাপি তাহলে আর্টিস্ট? ভাবতে ভাবতে বছর ঘুরে যায়। আমরা যে যার রাস্তায় চলে যাই। জানা হয় না আমাদের বাপি আর্টিস্ট কিনা।
কাল ফেসবুকে সমরের অ্যাড রিকোয়েস্ট দেখে বাপিকে খুঁজে পেলাম। বাপির ভালো নাম যে সমর তাই মনে ছিলো না। প্রোফাইলে দেখি বাপি মুম্বাই গিয়ে উঠেছে। এও দেখা যায়, বাপি এখন ফিল্ম ক্যালিগ্রাফার।
“কিরে বাপি চিনতে পারিস? তুই তো এখন ফুল আর্টিস্ট রে!” মেসেজ করি ।
“হুঁ। তুই কেমন আছিস ?”
ভালোই আছিরে। তোর কি খবর? আর দেয়াল লিখিস না?
বাপির অক্ষরগুলো কেমন যেন কুঁকড়ে যায়।
“এই তো লিখছি। ফেসবুকের দেয়াল।”