পরিবর্তনের কথা শুনি মাঝে মাঝে। পরিবর্তনের পরিবর্তনের কথাও শুনি। আমাদের এ সম্পর্কে কিছু কিছু অস্পষ্ট ধারণা আছে। কিন্তু পরিবর্তন তো হয়েই চলেছে। The only thing that never changes is the propensity to change।
বিগত এক দশকে দেশে তথা আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তনগুলি হ’ল ১। বিজ্ঞানচেতনার পতন ও ধর্মবাদের উত্থান। ২। ন্যূনতম আয়ের বিধি কিন্তু কর্মসংস্থানের শূণ্যতা। ৩। রাজনীতির দুবৃত্তায়নের পরিবর্তে দুবৃত্তের রাজনীতিতে প্রবেশ। ৪। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অর্বাচীনদের নেতৃত্বে আসা এবং শিক্ষিতদের চাকরীর দাবীতে অনশন। ৫। রাজনৈতিক নেতাদের কৃচ্ছসাধনের গর্বের পরিবর্তে কোটিপতি ক্লাবে প্রতিষ্ঠা। ৬। বুদ্ধিজীবিদের নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দলদাসবৃত্তিতে আগ্রহ। ৭। দলমত নির্বিশেষে ব্যক্তিপূজার ঝোঁক। ৮। বিতর্কের পরিবর্তে গালিগালাজ ও ব্যঙ্গ। ৯। সামাজিক বিপ্লবের পরিবর্তে ব্যক্তিগত অধিকারের আন্দোলন। ১০। গণমাধ্যমের অপমৃত্যু ও কর্পোরেট মিডিয়ার শাসন আমল।
পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। আমরা স্রোতের তৃণ, তাই বহমান ধারা টের পাই না।
কলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে আমরা একটি বিরোধ দেখি। এই বিরোধ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অনেকে এই বিরোধকে একটি দন্দ্ব হিসেবে দেখেন আর একে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যে বিরোধ তার সঙ্গে তুলনীয় মনে করেন। এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ ভুল। ধর্ম মূলত একটি সামাজিক বিশ্বাস যাতে তথ্য প্রমানের প্রয়োজন নেই, বিজ্ঞানের ভিত্তি তথ্য প্রমানের উপর নির্ভরশীল। এই নিয়ে বিশ্বাসী আর মুক্তমনাদের একটি পুরোনো ঝগড়া আছে। কলার সঙ্গে বিজ্ঞানের এখন কোন সম্পর্কই নেই। মানুষ, যাদের মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী এবং কলাবিদ্ আছেন, মনে করে কলাচর্চা আর বিজ্ঞানচর্চা কেউ কারো কাজে আসে না। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) আর Artsএর মধ্যে একটি দুঃখজনক গন্ডি কেটে দেওয়া হয়েছে। এই বিভাজন সামাজিক compartmentalization তৈরী করে। একসময় শিল্পী ও কলাবিদরা বিজ্ঞানীদের ঝাড়ফুঁক করা ওঝার চেয়ে বেশী মর্যাদা দিতেন না, এখন বাপ মায়েরা ছেলে মেয়েদের STEM পড়াতে না পারলে দুঃখ পান।
কলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে এই বিভাজন সৃষ্টি করতে করতে আমরা ভুলে গেছি, দুটিই উদ্ভাবনমূলক জ্ঞান। আর এই উদ্ভাবনার মূলে আছে কল্পনা। যে কোন পেশাদার বিজ্ঞানীই জানেন যে আবিষ্কার আর সত্যসন্ধানের মূলে আছে গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা। এই অন্তর্দৃষ্টি আসলে মৌলিক কল্পনা। যা ভৌতিকভাবে দৃষ্টিগোচর নয় তাকে হৃদয়ংগম করার চাবিকাঠি হল কল্পনাশক্তি। মজার ব্যাপার হল, শিল্পকলায় এই কল্পনাশক্তিই হল চালিকাশক্তি। লিওনার্দো দ ভিঞ্চি এক প্রবাদপ্রতিম উদ্ভাবক ছিলেন। তিনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন না শিল্পী ছিলেন? নাকি দুইই ছিলেন?
গণিতের চেয়ে বেশি কাল্পনিক আর কিই বা হতে পারে? দুয়ে দুয়ে যে চার হবে সেটি একটি উৎকৃষ্ট কল্পনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। অথবা ধরুন দুটি সমান্তরাল রেখার ধারণা, যারা অসীম দূরত্বে গিয়ে মিলিত হবে। কিংবা এই প্রতিপাদ্য যে একের সঙ্গে আধ, তার সঙ্গে আধের আধ, তার সঙ্গে আধের আধের আধ এইভাবে অসংখ্যবার যোগ করে গেলে দুই পাওয়া যাবে। ভাবুন একবার! এক আর দুইএর মাঝখানে অসীম। অতি উৎকৃষ্ট কল্পনা কি না?
বস্তুতপক্ষে বিজ্ঞানীরা হরদম কলাশিল্পের কাছে হাত পাতছেন। কোয়ার্কগুলির নাম দেখুন, টপ বটম, স্ট্রেঞ্জ চার্ম আর আপ ডাউন। কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিক্সে তো রংয়ের ছড়াছড়ি, যেন দোল খেলছে সবাই। আসলে লড়াই নেই কোন। সমস্ত কৃতবিদ্য বিজ্ঞানীরা কলার কোন না কোন একটি শাখার গোপন বা প্রকাশ্য চর্চা করে গেছেন। শুধু শখে মনে হয় না। তাঁদের প্রয়োজন পড়েছিল।
কেমন প্রয়োজন? স্পেশাল রিলেটিভিটির তত্ত্ব আইনষ্টাইন যখন নির্মান করছিলেন তখন সময় কাল সন্ততি (space time continuum) কল্পনা করতে হয়েছিল কেননা ত্রিমাত্রিক ভৌতবিশ্বে মাথা কুটলেও চতুর্থমাত্রা সময়কে এঁকে দেখানো যাবে না। খাতার পাতায় ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিই যথেষ্ট জটিল, চতুর্থ মাত্রা তাহলে আঁকব কি করে। কল্পনায় আঁকব। ফর্মূলাবাদী মন দিয়ে বোঝা যাবেনা যে একটা বলকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে এক সেকেন্ডে আবার লুফে নিলে দুটি স্থানাঙ্কের মধ্যে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল স্পেস গলে যায়। খুব জোরালো কল্পনাশক্তি না থাকলে এও বোঝা মুশ্কিল যে যতবার আমরা রাতের আকাশে আলফা সেঞ্চুরির দিকে তাকাই আসলে আমরা টাইম ট্রাভেল করি। রোদের অমন যে বর্তমান আলো তাও আসলে আটমিনিট অতীতের ইতিহাস।
মানুষ যতই বিজ্ঞান আর কলাশিল্পের মধ্যে তফাত করুক, মূলে তফাত নেই কোন। কল্পনার একটি আধার হল স্মৃতি। এখন নিঃসন্দেহ হওয়া গেছে প্রতিটি দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিই আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর এক একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক। বিজ্ঞানীই বলুন আর শিল্পী সকলেই শেষপর্যন্ত সেই নেটওয়ার্কের সদস্য।
বেসিক সায়েন্সের পাঠ্যক্রমে অন্তত একটি কলার অধ্যয়ন জরুরী।
আমি কলকাতার পশ্চিমপ্রান্তে মহেশতলায় বাস করি। এই অঞ্চলটি তারাতলার মোড় থেকে জিনজিরাবাজার হয়ে বজবজ পর্যন্ত চলে যাওয়া বজবজ ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত, যদিও বজবজ-শিয়ালদহ ট্রেনলাইনও এই যোগাযোগের অন্যতম শরিক। মহেশতলা এখন একটি থানা, অতীতে টালিগঞ্জ থানা এই অঞ্চলের দেখভাল করত। অঞ্চলটি আয়তনে বিশাল, বস্তুতপক্ষে মহেশতলা পৌরসভা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরশাসিত অঞ্চল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার শতাব্দী প্রাচীন এই জনপদটি কলকাতা শহর বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলির ইতিহাসে কোন উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারে নি। মহেশতলারও পশ্চিমে বজবজ প্রায় দুশো বছরের পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু শহরতলী কিন্তু মহেশতলা যে কোথায় অর্ধেক কলকাতা তা জানে না। ভারতবিখ্যাত বাটানগর যে মহেশতলার অংশ সে কথাও অনেকে জানে বলে মনে হয় না।
এই অবহেলার পিছনে দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণটি হল মহেশতলা ঐতিহাসিক ভাবে সমাজের নিম্নবর্গের (অনুপ জাতি) বাসস্থান ছিল – কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলে শিক্ষার তেমন প্রসার হয় নি। বাওয়ালির মোড়লরা, চটা রায়পুরের রায়েরা, আকড়া কৃষ্ণনগরের মুখার্জিরা আর আদি মহেশতলার ব্যানার্জিরা এখানে জমিদারি করেছেন, স্কুল খুলেছেন, মন্দির স্থাপন করেছেন কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের কূপমন্ডুকতা তেমন পাল্টাতে পারেন নি। এই এলাকায় ওয়াচেন মোল্লা (যার নামে মোল্লার গেট) কিংবা সুবিদ আলির মত স্বনামধন্য, দাতা, বিদ্যোৎসাহী আর সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন, কিন্তু উদাসীন আলস্যে মহেশতলার মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে কিছু কম যান না। মহেশতলার মানুষ একসময় স্বচ্ছল ছিল কিন্তু কোনকালে উদ্যোগী বা উচ্চাকাঙ্খী ছিল না।
কোন সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এখন বহুতল আবাসন হচ্ছে – এতে এই অঞ্চলের জনভিত্তি পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু এখানকার সাবেক মানুষের বনিয়াদি উন্নয়ন কতটা হবে সন্দেহ।
দ্বিতীয় কারণটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার পালাবদলে পাল্টে পাল্টে গেছেন কিন্তু মহেশতলার জন্য কেউ বিশেষ কিছু করেন নি। কিছু নলকূপ, গ্রামের কিছু রাস্তার মেরামতি ইত্যাদিতেই এখানকার মানুষ খুশি, সুতরাং তাঁরাও দিনগত পাপক্ষয় করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে মহেশতলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা নেই, রাস্তাঘাট অতিসঙ্কীর্ণ, এলাকায় বড় কোন হাসপাতাল নেই এমনকি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বজবজ ট্রাঙ্ক রোড যা নাকি মহেশতলার ধমনী, দশকের পর দশক ধরে অনুন্নত আর বেআইনিভাবে দখল হয়ে পড়ে আছে। কোন সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এখন বহুতল আবাসন হচ্ছে – এতে এই অঞ্চলের জনভিত্তি পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু এখানকার সাবেক মানুষের বনিয়াদি উন্নয়ন কতটা হবে সন্দেহ।
অথচ মহেশতলার স্বল্পপরিচিত আকর্ষনীয় ইতিহাস আছে। এখানকার ভূমিপূত্ররা কলকাতার এলগিন রোডে বা বালিগঞ্জে বসতি স্থাপন করে মহেশতলাকে ভুলে যেতে পারেন কিন্তু মনে রাখতে হবে এখানকার ব্যানার্জিহাটের ব্রাহ্ম মুখুজ্যেবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ বহুবার অতিথি হয়েছেন। এখানকার শিব আর কালীমন্দিরগুলি শতাব্দী প্রাচীন। মনে রাখতে হবে মহেশতলার পাঁচ মসজিদ বৌদ্ধ, হিন্দু আর মুসলিম সংস্কৃতির বিরল মিশ্রন। মনে রাখতে হবে মহেশতলার ইতিহাস কলকাতা শহরের অনেক অঞ্চলের চেয়ে কিছু কম সমৃদ্ধ নয়।
চব্বিশ পরগনার একটি পরগনার আদি নাম ছিল মাগুরা। সেই মাগুরা পরগনায় মহেশতলা ছিল একটি গ্রাম। সেই গ্রামের পাশে চিংড়িপোতা গ্রাম থেকে কটক রোড (দেড়শো বছর আগে যে নামে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড পরিচিত ছিল) ধরে সারেঙ্গাবাদ যাওয়ার পথে পড়ত একশ একর বিস্তৃত গুমোরজলা। সেই জলাভূমির একাংশ বুজিয়ে হয়েছে বিশাল আবাসন। শীতকালে অনেক রাত করে গাড়ি চালিয়ে ইডেন সিটির কাছে এলে জলা থেকে কুয়াশা ভেসে এসে গাড়ির আলোর সামনে অশরীরি নৃত্য করে। সে কি আমাদের কিছু বলতে চায়?
ফেসবুকের দেওয়ালে কি লিখব-র চেয়ে কি লিখব না, সেই ধারণাটি বেশী মজবুত হওয়া উচিত। নীরবতারও স্বতন্ত্র অর্থ আর প্রয়োজনীয়তা আছে। অনেকে ভাবেন, দেয়াল আমার, আমার যা খুশী তাই লিখব, অনেকে এই ধারণাটি রক্ষাকবচের মত ব্যবহারও করেন, বিশেষত সমালোচিত হলে। কিন্তু ধারণাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়।
প্রথমত; বিদ্বেষমূলক, হিংস্র, আগ্রাসী বা অশ্লীল বক্তব্য (লেখা বা ছবি) এমনিতেই ফেসবুকের নিজস্ব নিয়মে অপসারণযোগ্য। আপাতদৃষ্টিতে তেমন বোঝা না গেলেও এইজাতীয় একটি censoring ফেসবুকে হয়েই থাকে। ফেসবুক একটি জনসংযোগ মাধ্যম, এখানে যে কোন postকেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে ধরে নেওয়া হয়, এমনকি নিজের দেওয়ালেও। কারুর আপত্তিজনক মনে হলে report করার ব্যবস্থাও আছে। এর সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানবিধির প্রকাশ্য আচরণ ও বত্তব্য প্রকাশের নিয়মনীতিগুলিও সরাসরি জড়িত। সুতরাং অনেকদুর উদারতা থাকলেও প্রকাশ্য জনসংযোগ মাধ্যমে কি লেখা হবে তার নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে।
এ তো গেল সরাসরি অসৎ উদ্দেশ্যে দেওয়া postএর কথা। কিন্তু এমন অনেক post আছে যেগুলিকে এই গোত্রে ফেলা না গেলেও, সামাজিকভাবে ক্ষতিকর বলে মনে হয়। এইখানে ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে পড়ে কারণ মুক্তসমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এর সঙ্গে জড়িত। তবে স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচার এক নয়, স্বাধীনতা নিতে গেলে দায়িত্বশীল হতে হয়। যুক্তিগ্রাহ্যতা, সহনশীলতা এবং স্বচ্ছতা সেই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমার প্রকাশিত মত বা বত্তব্য যদি অন্যের আবেগ বা ধারণাকে challenge করে তাহলে সেই বক্তব্য প্রকাশের সংগত ও সুচিন্তিত কারণ থাকতে হবে এবং অবশ্যই আমাকে বিরুদ্ধ মত শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার দেয়াল, আমি যা খুশি লিখব, ভালো না লাগলে অন্যত্র যাও গোছের যুক্তি আসলে কোন যুক্তি হতে পারে না।
প্রকাশ্যে শুধু মত নয়, ঠাট্টা, তথ্য বা অনুভূতি বিনিময়ও content হিসেবে শেষপর্যন্ত জনসম্পত্তি। কেবল মাত্র দুজনের বা কয়েকজনের ব্যক্তিগত চৌহদ্দি নয়। তার জন্যে private message আছে।ফেসবুকের প্রকাশিত post গুলির নিরিখে কাউকে বিচার করার সময় তাই সে কোন কোন বিষয়ে নীরব সেটাও দেখা জরুরী। আর তাহলেই কি লিখব আর কি লিখব না-র ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আমার বন্ধুরা আর সুমনা (সেও নিশ্চয়ই বন্ধু) সদগুরুর বক্তব্য খুব মন দিয়ে শোনে। তাদের কথায় আমি বুঝতে পারি ইশা ফাউন্ডেশনের কর্মকান্ড এবং সদগুরুর ব্যাখ্যাগুলিতে তারা মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত। যেহেতু বন্ধুদের দ্বারা আমিও প্রভাবিত হই, আমি সদগুরুর ভিডিওগুলি মন দিয়ে দেখতে শুরু করি।
মানুষ অনেক রকমের হয়। কেউ কেউ সহজেই মুগ্ধ হয়, অনুপ্রাণিত হয় – যেন তারা মুগ্ধ হবে বলে ঠিক করে রেখেছে। কেউ আবার সম্পূর্ণ বিপরীত, কোন কিছুই তাদের সহজে উদ্বেল করে না, সন্দেহ আর প্রশ্ন করা তাদের ধাত। আমি মুগ্ধ হই প্রকৃতির অপার বিস্ময়ে, সম্ভাবনায় আর জীবনের গভীর ব্যপকতায়, সৃষ্টির চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া বৈচিত্রে আর মহাজাগতিক প্রাকৃতিক নিয়ম ছন্দের অপূর্ব ছন্দবদ্ধতায়। গুরু মানে যদি এমন কেউ হয় যে আমার চোখ থেকে, চৈতণ্য থেকে অন্ধকার দুর করে দেবে, তাহলে এই প্রকৃতি বা জীবন আমার গুরু। গুরুবাবাজীতে আমার মোটে বিশ্বাস নেই, তাদের আমি সন্দেহের চোখে দেখি। আমি সহজেই কোন মানুষকে শ্রদ্ধার আসন দিতে পারি না, দীর্ঘদিন তার কাজকর্ম, বুদ্ধি ও চেতনা এবং উৎকর্ষের একটি সম্যক ধারণা হলে তবে আমি মানুষে মুগ্ধ হই। এইরকম একটা দ্বন্দ্ববাদী মন নিয়ে শুরু হয়েছিল সদগুরুকে আমার অনুধাবণ করার চেষ্টা।
সদগুরু আমার দেশের অতিপ্রাচীন অধ্যাত্মবাদকে একটি ধর্মবিহীন, নিরীশ্বরবাদী মোড়কে পেশ করছেন দেখে আনন্দিত ও কৌতুহলী হলাম। চেতনার বিকশিত স্তরে মানুষের জ্ঞান বা wisdom প্রসারিত হয়, তখন তার কথাগুলি মানুষের বোধ বিবেচনাকে আলোড়িত করে, এমন মানুষকে আমি বলি evolved being । প্রাথমিকভাবে সদগুরুকে আমার evolved being বলে মনে হয়েছে। আমি তার panel discussion গুলিও মন দিয়ে শুনেছি, এমনকি যেখানে Michio Kakur মত পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখকও উপস্থিত ছিলেন। কাউকেই সদগুরুর বক্তব্যকে খন্ডাতে দেখিনি। এসত্বেও সদগুরুকে আমার বিখ্যাত পাশ্চাত্য অতীন্দ্রীয়বাদী আধ্যাত্মিকদের মত লাগে নি, Allan Wattsএর মতও না। তাঁর আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোথাও একটা আমার দেশের সুপ্রাচীন এবং প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া জীবনদর্শনের ভিত্তি আছে বলে মনে হয়েছে, সেই ভিত্তিভূমিটি আমি সন্ধান করছি।
ড্যান ডেনেটের মত জড়বাদী দার্শনিকরা মানুষের চৈতণ্যকে মস্তিষ্কের বিপুল জটিলতাসঞ্জাত একপ্রকারের ইল্যুশন বা মায়াকল্পনা বলে দাবী করেন। তাঁদের মতে চৈতণ্য বা conciousness আসলে একপ্রকারের মায়া যা মস্তিষ্ক সামাজিক বিবর্তনের প্রয়োজনে তৈরী করেছে। এই মতটিও বিবেচনাধীন তবে আমার এরকমও মনে হয় জেনেটিক বিবর্তন বা সামাজিক বিবর্তন যদি এমন মায়ার জন্ম দিয়েও থাকে তবে তা এখন বাস্তবিকতার অংশ, ম্যাজিক বা ধাপ্পা নয়।