অমল ধবল পাল

রাশিয়া নামে একটি দেশ আছে। সেই দেশের সঙ্গে আমার দেশের একটি ইতিহাসও আছে। এখন এমন বয়েস হয়েছে যে রাজনীতি, রাষ্ট্র, বিদেশনীতি এইসব বড় বড় ব্যাপারে উলঝে যাই। আমেরিকা এখন ভারতের নতুন বন্ধু। কিন্তু একদিন রাশিয়া বড় ভাল বন্ধু ছিল মনে হয়। পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেমজালে।

একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় আমেরিকার সেভেনথ ফ্লিট ভারত মহাসাগরে এসে মাস্তানি করছিল। ভারত তখন একটি জিনোসাইডের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইউরোপ, আমেরিকা সকলে পাকিস্তানের পক্ষে। সেই দুর্দিনে রাশিয়া বিশ্বপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্বার্থরক্ষা করতে তিনবার ভেটো প্রয়োগ করেছিল। তখন দশ বছরের বালক হিসাবে আমার চোখে জল এসে গেছিল।

আসলে রাশিয়ার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। একেবারে ছোট থেকে পড়ার ঝোঁক ছিল। অবিশ্যি তখন টিভি ইন্টারনেটতো ছিলনা, বই আর রেডিও ছিল পৃথিবীর জানালা। ভোরবেলা স্কুল যাবার আগে দরজার সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজ তুলে দেখতুম ইন্দ্রজাল কমিকস এসেছে কিনা। অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিনা! তাদের সাথে খুলিগুহা, ওয়াম্বেসিদের গ্রামে ঘুরতাম। মনে মনে ঠিক ছিল বিয়ে হলে কিলাউইর সোনাবেলায় মধুচন্দ্রিমা করব। জানাডু দ্বিতীয় পছন্দ ছিল কারণ হোজোকে মোটে পছন্দ করতাম না। সেই ইন্দ্রজাল কমিকসে যখন ট্রেজার আইল্যান্ড এল আমার ঘরের খাট বিছানা আলনার পেছনে জলদস্যুরা লুকিয়ে থাকতে লাগল।

কিন্তু এইসব ছোটখাটো ব্যাপার। আটবছর বয়সে বাবা কিনে এনেছিলেন রুশদেশের রুপকথা। এ বইএর প্রকাশক ছিল প্রগতি প্রকাশক, মস্কো। বইএর চকচকে পাতা, আশ্চর্য সব ছবি আর সে কি সব গল্প। তখন আমি ইভান হয়ে গেলুম। সেই যে বোকা ইভান বড় বুদ্ধিমান, মনে আছে? সেই ইভান। গোলাপী ফুলো ফুলো গালওলা রাশিয়ার কোন গাঁয়ের মেয়ে ল্যুবা লুব্যুশকা হাত ধরে টেনে নিয়ে এক অত্যাশ্চর্য দেশের সীমাহীন স্তেপের উপর ছেড়ে দিয়েছিল আমাকে, স্পষ্ট মনে আছে। সেই ডাইনি বাবা ইয়াগা, আর সেই যে ইভান ঘোড়ার কান দিয়ে ঢুকে রাজপুত্তুর হয়ে বেরিয়ে আসত সেই দিনগুলি কি যে মনোরম ছিল।

আমি হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রীটের খালপাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলতুম: সিভকা বুর্কা, জাদুকা লেড়কা, সামনে এসে দাঁড়া। তখন সেই খালটা একটা ট্রেঞ্চ হয়ে যেত, জেলমাঠের গাছগুলোর উপর রুশী কুয়াশা ঘনিয়ে একাক্কার, আর সেন্ট্রাল জেলের পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে কসাক চাষিদের মত দেখতে লাগত।

কেন এমন হয়েছিল এখন বুঝি। রাশিয়ান সাহিত্য অনুবাদ করতেন সমর সেন, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, খালেদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ রায় আর হায়াৎ মামুদের মত দিকপালেরা। এই বিশাল, প্রাচীন এবং সংস্কৃতিঋদ্ধ দেশটির মানুষ, গান, গল্প আর নাটক বহুদিন ধরে এই ভূখন্ডের মানুষকে টানছে। আমরাও টেনেছি ওদের। মুকেশের গাওয়া আওয়ারা হুঁ গানটি রাশিয়াতে লোকগীতির মর্যাদা পায়।

কাতায়েভের অমল ধবল পাল পড়ে পেতিয়ার যে বন্ধু হয়ে যাব এতে আর আশ্চর্য কি?

নীচে রইল আমার সেই জলছবি।

Loading

লঙ্কা নয় মরিচের ঝাল

সত্যজিৎ রায়ের বায়োগ্রাফি পড়ে শেষ করে দিনদুয়েক বইমুখো হইনি। তারপর মনে পড়ল অনেকদিন ধরে শিবাসিস মুখোপাধ্যায়ের ‘কাহ্ন’ বইটি পড়ার ইচ্ছে ছিল। এটি শরদিন্দুর পরে সম্ভবত সার্থক একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ যার নায়ক চর্যাগীতির বিস্মৃতপ্রায় কবি কাহ্ন পা। কিন্তু বইটি খুঁজে পাওয়া গেল না। না ডিজিট্যাল না মুদ্রিত সংস্করণ। প্রকাশক ছিলেন বোধহয় সপ্তর্ষি, তাদের ঠিকানাও আমার জানা নেই। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেলাম রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’। আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত এই বইটি আমার পড়ার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের। রামকুমার শুরু করেছেন এইভাবে:
“পারলে গোধূলির এই রং গণ্ডূষে শুষে নিত ধনপতি। ওই কেশকালা ফিঙেটির মতো দোল খেত কর্ণের মাথায়। পশ্চিমের কমলা সূর্যের মতো দিনশেষে ডুবে যেত ভ্রমরার জলে। গিরি মাটিরঙে রাঙিয়ে দিত আকাশের কোল। কিন্তু তাকে যেতে হবে সিংহল দেশে, নোনা পথে—রাজার নির্দেশ।”

ভাষার সৌকর্যে এই বইটি অনন্য, বলা চলে ইয়ুরোপীয় প্রভাবে (বা ইংরেজির ধাঁচে) বাংলা গদ্য লেখার পূর্বে মঙ্গলকাব্যের সময় যদি বাংলা গদ্য থাকত, সেটি মোটামুটি এইরকম হতে পারত। এই গদ্য খুব interesting বটে, তবে উপন্যাস হিসেবে ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ যে খুব উৎরেছে তা বলতে পারছি না।

দুটি জিনিষ কৌতূহলোদ্দীপক।
এক, এখন অলস বদনামের ভাগী হলেও বাঙ্গালী চিরকাল এমন ছিল না বোধহয়। রামকুমারের কাহিনীর যদি ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে তাহলে দেখা যাচ্ছে বাঙ্গালী একসময় ব্যবসা বানিজ্যে পটু ছিল (চাঁদ সদাগর), উপরন্তু নৌবানিজ্যেও তার পারঙ্গমতা ছিল।
দুই, পাতা উল্টে পড়লুম: “কটু তৈলে ভাজা হয় বেথুয়া শাক। সুক্তা রন্ধন হয় বাগ্যন, কুমুড়া, কচা, কাঁচকলা, সজিনা, মোচার সঙ্গে মশল্লা মিশিয়ে। সন্তলন হিঙ্গু–জিরা–মেথির। রসবাস–হিঙ্গু–জিরা দিয়ে মুসুরি–মটর সূপ চাপে। ঘৃতে ভাজা হয় পাঁচ সহস্র পলাকড়ি। ঝোল হয় মানকচা, বড়ি, মরিচ ভূষিত কাতল মীনের। খর লবণে আম্র ও শকুল মীনের অম্বল বড়ো পছন্দ সদাগরের।”
বেথো শাকভাজা, সুক্তো, পটলভাজা, মানকচু বড়ি দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল, আমশোলের অম্বল, মানে খাওয়াদাওয়া মোটামুটি একইরকম ছিল। তবে লঙ্কা তখনো আসেনি, মরিচের ঝাল।

Loading

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!