আলোচনাচক্রে এই প্রশ্নটি বার বার ওঠে। কে বুদ্ধিজীবি?
আমাদের সমাজে, বিশেষত বাংলায়, এই শব্দবন্ধগুলি অতিপরিচিত। বিদ্বজ্জন, সুশীল সমাজ আর বুদ্ধিজীবি। বামশাসনের অবসানের পর, ‘বাম ও গণতান্ত্রিক কলাকুশলী’ ইত্যাদির স্থানে এখন বিদ্বজ্জন, সুশীলসমাজ আর বুদ্ধিজীবিরা এসে বসেছেন। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল পুরস্কার, সম্বর্ধনা দিয়ে এমন বিদ্বজ্জন, সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবি প্রতিপালন করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বুদ্ধি ও মেধার বিষয়ে একধরণের জাতীয় শ্লাঘাবোধ আছে, ফলে এই বিদ্বজ্জন, সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবিরা আপাত নিরপেক্ষতার আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য চালিয়ে দেওয়ার কাজে অত্যন্ত ব্যবহারযোগ্য। এই ব্যবহারযোগ্য রাজনৈতিক অস্ত্রের একেবারে কেন্দ্রস্থলে আছেন বুদ্ধিজীবিরা। বিদ্বজ্জন বা সুশীলসমাজও বুদ্ধিজীবিদেরই নামান্তর। তথাকথিত বাম ও অসাম্প্রদায়িকরা দক্ষিণপন্থীদের ব্যঙ্গ করে বলেন, তোমাদের তো কোন বুদ্ধিজীবি নেই হে!
তাই জানতে কৌতূহল হয়, কে বুদ্ধিজীবি? আমিতো সাদাচোখে দেখি বেশিরভাগই খ্যাতিজীবি, সম্বর্ধনাজীবি বা প্রশংসাজীবি। এর সঙ্গে বুদ্ধির কি সম্পর্ক? সম্ভবত বুদ্ধিজীবি কথাটি শ্রমজীবির বিপরীতার্থক অর্থে এসেছে। নতুবা জীবন ধারণের জন্য শ্রম আর বুদ্ধি দুই-ই লাগে তো! আর সঠিক অর্থে ধরলে বুদ্ধি যাদের জীবিকার মূল তাদেরকেই বুদ্ধিজীবি বলা উচিত, যেমন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ডাক্তার বা গোয়েন্দা। আমার তো একজন কবির তুলনায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে বেশি বুদ্ধিজীবি বলে মনে হয়!! তাহলে ঠিক ভুল ঠিক করে দেওয়া, সামাজিক নীতি নির্দ্ধারক বলে স্বঘোষিত, সম্বর্ধনা ও পুরস্কার পালিত কিছু ব্যক্তিকে বুদ্ধিজীবি বলে চালিয়ে দেওয়া হলে, অসংখ্য সাধারণ নাগরিক, যারা জীবনের প্রতি স্তরে বুদ্ধি বেচে খাচ্ছে, মানবে কেন?
কিশোর বয়স থেকে রক্তদান করা আমার একটি বিশেষ প্রিয় কাজ ছিল। বছরে অন্তত দুবার রক্ত দিতাম, স্কুল কলেজে আয়োজিত রক্তদান শিবিরে। দীর্ঘ কুড়ি পঁচিশ বছর এই দান দাতব্য চলেছে, তারপর বয়সের নিয়মে (কে আর বর্ডারলাইন ডায়াবেটিকের রক্ত সংগ্রহ করতে চায়?) রক্তদান বন্ধ হয়েছে। এখন আমি অল্পবয়সীদের রক্তদান করতে উৎসাহ দিই। আমাদের শৈশব যৌবনে রক্তদান শিবির হত, কিন্তু এখন সর্বত্র দেখি স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির হচ্ছে। এই স্বেচ্ছা কথাটি আমাকে ভাবায়। এক বন্ধুর কাছে এ ব্যাপারে আমার সংশয়ের কথা বলায়, সে হেসে বলল, মানে বুঝলে না? তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তো রক্ত নেবে না!
না তা নেবে না। কিন্তু এই ভাবনাটা একটু বেয়াড়া। পর পর প্রশ্ন সাজিয়ে রাখে। প্রথমত, আমরাও তো স্বেচ্ছাতেই রক্ত দিতুম, মানে আগ্রহ করে উৎসাহ ভরেই দিতাম। এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মানে কি? তবে কি স্বেচ্ছায় দিতাম না? স্বেচ্ছা, ব্যাপারটা ঠিক কি? সেটা কি Free Will? মানে আমার জেনে বুঝে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যাতে আমাকে কেউ বা কোন কিছু প্রভাবিত করে নি?
সত্যিই কি তাই? একটু তলিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝলুম যতটা ভেবেছিলুম ভাবনাটা তারচেয়ে অনেক বেশি বেয়াড়া। তখন বয়স কম ছিল, বুঝে হোক বা না বুঝে, একটা বিশেষ রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক আদর্শ ছিল যা ঠিক করে দিয়েছিল রক্তদান একটি মহান কাজ, সমস্ত সমমনস্ক বন্ধুরা রক্তদান করত, আমি তাদের থেকে আলাদা হতে চাইনি, conform করার তাগিদ ছিল। এমন কি, এখন ভাবলে হাসি পায়, রক্তদান করার মধ্যে একটা chivalry ছিল (তার dictionary মানে যত গোলমেলেই হোক) এমনকি মেয়েদের impress করার উদ্দেশ্যও যে ছিল না সে কথা হলফ করে বলা যায় না। অর্থাৎ সূক্ষ ভাবে হলেও প্রভাবিত হয়েছি, conditioned হয়েছি। যদি এমন ব্যবস্থা থাকত যে কেউ টেলিফোন বুথের মত কোন বুথে চুপচাপ যান্ত্রিকভাবে রক্ত দিয়ে আসতে পারত, কেউ টেরও পেত না, তাহলে কি অমন নিয়ম করে, উৎসাহ করে, বছরের পর বছর রক্ত দিতুম? বলা মুশ্কিল।
স্বেচ্ছা কথাটি গোলমেলে। এতে একটি স্ব আছে, যা আমাদের খুব ভুলিয়ে রাখে আর আমরা মনে করি আমাদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত, সমস্ত বাছাই আমাদের স্বেচ্ছাধীন, সেখানে কোন বহির্প্রভাব নেই।অথচ যারা বিপনন বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত, তা সে টুথপেস্ট বেচাই হোক বা দেশের প্রধানমন্ত্রী, তারা আমাদের বোকামি দেখে খুব একচোট হাসবে। রাষ্ট্র রেগে গিয়ে ফেসবুককে হুমকি দিয়ে বলবে, তুমি প্রভাবিত কোরো না ভায়া, আমি কি বানের জলে ভেসে এলাম নাকি?
স্বেচ্ছা মানে যদি Free Will হয় তাহলে বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটি মোটামুটি বাতিল করে দিয়েছেন। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে সমাজ বা রাষ্ট্র বা নৈতিকতার বোধ Free Willএর উপর গড়ে উঠেছে তা একটি শাস্তিমূলক (punitive), ধর্মবাদী (religiositious), আপাত ন্যায্যতাবাদী (just world viewing) এবং দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী (right wing authoritative) ব্যবস্থায় পরিনত হয়। আমেরিকানরা গড়পড়তা সবচেয়ে বেশি free willএ বিশ্বাসী আর বিশ্বের মোটে পাঁচ শতাংশ জনসংখ্যার এই দেশে পৃথিবীর যত কারাবন্দী মানুষ আছে তার পঁচিশ শতাংশের বাস। কড়া শাস্তি দিয়ে আমেরিকায় কতদূর অপরাধমূলক মানসিকতার সংশোধন হয়েছে খুব পরিস্কার নয়। সম্ভবত তেমন কাজের কাজ কিছু হয় নি। Free Will খৃষ্টধর্মের মূলভিত্তি – ভালো যা কিছু হচ্ছে সব ইশ্বরের অপার মহিমা, খারাপ কিছু হলে, ঈশ্বর তো তোমাকে স্বেচ্ছা দিয়েছেন বাপু, own up responsibility! মোটামুটি সব অ্যাব্রাহামিক ধর্মেরই বাড়বাড়ন্ত এই স্বেচ্ছাধীন নাগরিক রাষ্ট্রে – যতক্ষণ না ধর্মীয় মৌলবাদ এসে গলায় ছুরি ঠেকাচ্ছে।
এই স্ব টি কে? ৩৭ ট্রিলিয়ন ম্যামালিয়ান সেল, যা দিয়ে আমাদের শরীর তৈরী? ২৬ মিলিয়ন নিউরন যা দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক গঠিত? তারা কি আমার free will মানে নাকি? কার ইচ্ছেয় হৃৎপিন্ড ধুকপুক করে, পৌষ্টিকতন্ত্র খাবার হজম করে, সবলদেহ প্রজননক্ষম পুরুষ বা নারীর একে অন্যকে দেখে যৌনতা জাগে? প্রেমে কি স্বেচ্ছায় পড়ি নাকি ভাই? জেনেটিকসই বল বা এপিজেনেটিকস, কার ইচ্ছেয় ঘটে সবকিছু? শুধু রক্তদান স্বেচ্ছায় কি করে হবে? আমাদের পঁচানব্বই শতাংশ DNA ব্যাকটেরিয়ার দান। ব্যাকটেরিয়া আমাদের পরিপাক চালায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি কিছুক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, স্ব টি কে হে বাপু?
আমরা অদৃষ্টবাদী প্রাচ্যদেশীয় গন্ডমূর্খ। স্বেচ্ছাধীনতা আমরা পাশ্চাত্যের থেকে টুকলি করেছি। আমার ভাবনার সূত্র ধরে কেউ মনে করতেই পারেন, তাহলে আমাদের ‘সকলি তোমার ইচ্ছা’ গাইতে গাইতে নৈরাজ্যবাদের দিকে চলে যাওয়াই উচিত। আমি কিন্তু সে কথা বলছিনে। মানে নৈতিক দায়িত্বের ব্যাপারটা গোলমেলে হলেও ভুলবেন না সামাজিক দায়ভার কিন্তু আছে। স্বেচ্ছায় রক্ত না হয় না দিলাম, কিন্তু সত্য গোপন করে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া লালিত রক্ত অন্য কাউকে পাশাতে গেলে পুলিশে ধরবে। Responsible না হলেও আমরা accountable তো বটে!
অনেকের সঙ্গেই ইতিপূর্বে আলাপ হয়েছে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে লিখছি। ব্লগ লিখতাম ইউরোপীয়ান জার্নালিস্ট সোসাইটিতে, পরিবেশ সংক্রান্ত লেখালিখি। বিজনেস ইনসাইডেরে লেখা বেরিয়েছিল। বহু বন্ধু হয়েছে পৃথিবী জুড়ে। এখনো তাদের সাথে যোগাযোগ অটুট। তারপর একসময় মনে হল, নিজের ভাষায় লিখি। রম্যরচনা আর প্রবন্ধ লিখতাম সময় পেলেই। কিন্তু স্মৃতিচারণ আর গল্প কবিতায় জড়িয়ে গেছি শুধু বন্ধুদের দাবীতে। ফেসবুক থেকে শুরু করে আমার প্রথম বাংলা ব্লগ অল্প-স্বল্প-গল্পতে তার কিছু কিছু প্রকাশ পেয়েছিল। ততদিনে ধারাবাহিক লেখার কিস্তি সময়মতো না পেলে বহু রাগ অভিমানের ইতিহাস হয়ে গেছে।
হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছাপতে না দিলে বই হয়ে লেখাগুলো কোনদিন বেরোবে না, এমন সম্ভাবনার মধ্যে যে আগাম বিপদের আশঙ্কা আছে, তাকে এড়ানোর জন্যেই পবিত্র অনলাইন। এখানে নতুন পুরোনো যাবতীয় লেখা সংকলন করা হবে। আশা করি দুধের স্বাদ ঘোলে খানিকটা মিটবে। আরো কিছু পরিকল্পনা আছে, দেখা যাক কতদূর যাওয়া যায়।
লেখালিখির জায়গা বলে সচেতন ভাবে ব্লগ খুব মিনিম্যালিস্ট রাখার ইচ্ছে, অন্তত যতদিন না অলংকরণ করার মত কাউকে পাওয়া যাচ্ছে। পাঠক বন্ধুরা কেউ হদিস দিলে চমৎকার হয়। নতুবা পুরোটাই নিজে শিখে শিখে করা।
যারা পড়তে আসবেন, যদি ভাল লাগে , ফিরে জানাবেন। ভাল লাগবে, উৎসাহ পাবো এই আর কি!
আবার পথচলা শুরু। এবার আরো নিশ্চিত ভাবে, আরো ভালবেসে। যারা আমার লেখা পড়তে ভালবাসেন, যারা অপেক্ষা করে আছেন, তাঁরা তো বটেই, যারা নতুন এলেন তাঁদের জন্যেও রইল শুভেচ্ছা।