রাশিয়া নামে একটি দেশ আছে। সেই দেশের সঙ্গে আমার দেশের একটি ইতিহাসও আছে। এখন এমন বয়েস হয়েছে যে রাজনীতি, রাষ্ট্র, বিদেশনীতি এইসব বড় বড় ব্যাপারে উলঝে যাই। আমেরিকা এখন ভারতের নতুন বন্ধু। কিন্তু একদিন রাশিয়া বড় ভাল বন্ধু ছিল মনে হয়। পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেমজালে।
একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় আমেরিকার সেভেনথ ফ্লিট ভারত মহাসাগরে এসে মাস্তানি করছিল। ভারত তখন একটি জিনোসাইডের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইউরোপ, আমেরিকা সকলে পাকিস্তানের পক্ষে। সেই দুর্দিনে রাশিয়া বিশ্বপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্বার্থরক্ষা করতে তিনবার ভেটো প্রয়োগ করেছিল। তখন দশ বছরের বালক হিসাবে আমার চোখে জল এসে গেছিল।
আসলে রাশিয়ার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। একেবারে ছোট থেকে পড়ার ঝোঁক ছিল। অবিশ্যি তখন টিভি ইন্টারনেটতো ছিলনা, বই আর রেডিও ছিল পৃথিবীর জানালা। ভোরবেলা স্কুল যাবার আগে দরজার সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজ তুলে দেখতুম ইন্দ্রজাল কমিকস এসেছে কিনা। অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিনা! তাদের সাথে খুলিগুহা, ওয়াম্বেসিদের গ্রামে ঘুরতাম। মনে মনে ঠিক ছিল বিয়ে হলে কিলাউইর সোনাবেলায় মধুচন্দ্রিমা করব। জানাডু দ্বিতীয় পছন্দ ছিল কারণ হোজোকে মোটে পছন্দ করতাম না। সেই ইন্দ্রজাল কমিকসে যখন ট্রেজার আইল্যান্ড এল আমার ঘরের খাট বিছানা আলনার পেছনে জলদস্যুরা লুকিয়ে থাকতে লাগল।
কিন্তু এইসব ছোটখাটো ব্যাপার। আটবছর বয়সে বাবা কিনে এনেছিলেন রুশদেশের রুপকথা। এ বইএর প্রকাশক ছিল প্রগতি প্রকাশক, মস্কো। বইএর চকচকে পাতা, আশ্চর্য সব ছবি আর সে কি সব গল্প। তখন আমি ইভান হয়ে গেলুম। সেই যে বোকা ইভান বড় বুদ্ধিমান, মনে আছে? সেই ইভান। গোলাপী ফুলো ফুলো গালওলা রাশিয়ার কোন গাঁয়ের মেয়ে ল্যুবা লুব্যুশকা হাত ধরে টেনে নিয়ে এক অত্যাশ্চর্য দেশের সীমাহীন স্তেপের উপর ছেড়ে দিয়েছিল আমাকে, স্পষ্ট মনে আছে। সেই ডাইনি বাবা ইয়াগা, আর সেই যে ইভান ঘোড়ার কান দিয়ে ঢুকে রাজপুত্তুর হয়ে বেরিয়ে আসত সেই দিনগুলি কি যে মনোরম ছিল।
আমি হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রীটের খালপাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলতুম: সিভকা বুর্কা, জাদুকা লেড়কা, সামনে এসে দাঁড়া। তখন সেই খালটা একটা ট্রেঞ্চ হয়ে যেত, জেলমাঠের গাছগুলোর উপর রুশী কুয়াশা ঘনিয়ে একাক্কার, আর সেন্ট্রাল জেলের পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে কসাক চাষিদের মত দেখতে লাগত।
কেন এমন হয়েছিল এখন বুঝি। রাশিয়ান সাহিত্য অনুবাদ করতেন সমর সেন, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, খালেদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ রায় আর হায়াৎ মামুদের মত দিকপালেরা। এই বিশাল, প্রাচীন এবং সংস্কৃতিঋদ্ধ দেশটির মানুষ, গান, গল্প আর নাটক বহুদিন ধরে এই ভূখন্ডের মানুষকে টানছে। আমরাও টেনেছি ওদের। মুকেশের গাওয়া আওয়ারা হুঁ গানটি রাশিয়াতে লোকগীতির মর্যাদা পায়।
কাতায়েভের অমল ধবল পাল পড়ে পেতিয়ার যে বন্ধু হয়ে যাব এতে আর আশ্চর্য কি?
কেয়া চক্রবর্তীকে আমি সচক্ষে দেখিনি। তাঁর অভিনয় দেখিনি। জীবনের কোন পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কোন প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ যোগ ছিল না কোনদিন। যে বছর তাঁর মৃত্যু হয়, আমার বয়স ছিল ষোলো। আমার কৈশোরে ঐ বয়সে নাটক থিয়েটার দেখার চল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ছিল না, ফলে জীবিত কেয়ার সম্পর্কে আমার রোমন্থন করার মত সরাসরি কোন স্মৃতি নেই। এই পেজে অনেক প্রণম্য ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষ কেয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁদের জড়িয়ে থাকা স্মৃতি শেয়ার করছেন, সেগুলি পড়ছি এবং সমৃদ্ধ হচ্ছি। আর পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে আমি বা আমার মত যারা কেয়া চক্রবর্তীর সাক্ষাৎ সান্নিধ্য পায় নি, তারা কি এই স্মৃতিতর্পনে ব্রাত্য হয়ে থাকবে? কেয়া চক্রবর্তীর স্মৃতি কি ১৯৭৭ সালে মাঝগঙ্গায় থেমে গেছে? বিতর্ক আর প্রশ্ন থামেনি, কিন্তু কেয়া চক্রবর্তী কি সম্পূর্ণ অতীত হয়ে গেছেন?
আমার পিতৃদেব খুব কম মাইনে পাওয়া সরকারী কর্মচারী ছিলেন। আমার শৈশব কৈশোর তাই দৈনন্দিন লড়াইএ ব্যাপৃত থাকত। কিন্তু তিনি সাহিত্যের ছাত্রও ছিলেন বটে, ফলে লড়াই করা মানুষের যে শিল্পে অখন্ড অধিকার আছে – সেই বোধ ছোট বয়সে হয়েছিল। শৈশব কৈশোরে যা পেতাম তাই পড়তাম, অকালপক্ক বালকেরা যা করে আর কি, আর সেই সূত্রে সংবাদপত্রে নান্দীকারের ভালোমানুষ নাটকের কথা পড়ে জেনেছিলাম কেয়া চক্রবর্তী নামে এক অভিনেত্রী শান্তাপ্রসাদ আর শান্তি বলে দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। এগারো বারো বছরের কথা, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে পত্রপত্রিকায় ‘কেয়া চক্রবর্তী অভিনীত’ ট্যাগলাইনের বিজ্ঞাপন দেখেছি মনে আছে। সেই সময়ে এমনকি সুচিত্রা সেনের একার নামে সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখিনি। কেয়া চক্রবর্তীর সবচেয়ে কাছে এসেছিলাম, এখন মনে করে প্রসন্ন হাসি আসে, উত্তর কলকাতার রঙ্গনা থিয়েটার হলের প্রায়ান্ধকার লবিতে। না রক্তমাংসের কেয়া নন, তাঁর সাদাকালো ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম, যা হলের কাচের বাক্সে সাজানো থাকতো। সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন আমার বয়স বারো তেরো হবে বোধহয়, বাবার সঙ্গে তাঁর পুরোনো ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের আড্ডায় যাবার পথে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই ছবিগুলো হারিয়েই গেছিল, এখন ফেসবুক ফেরত নিয়ে আসছে।
অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ফেসবুক পেজ। বাম দিকের ছবিতে ক্লিক করে পেজটি দেখুন।
সমস্ত জীবন জুড়ে কেয়া চক্রবর্তীর সন্ধান করেছি। তাঁকে যারা দেখেছেন, এমন কি তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন এমন অনেক মানুষকে আমি চিনি, তাঁদের মুখে কেয়ার কথা শুনেছি, অজস্র লেখা পড়েছি তাঁর সম্পর্কে, তাঁর কাজ সম্পর্কে, তাঁর তীব্র শানিত জীবন সম্পর্কে – এসব থেকে কেয়া চক্রবর্তীকে খানিকটা চেনা বোঝা গেছে। কিন্তু আবার বোঝাও যায় নি অনেক। মানে, কবি শঙ্খ ঘোষকে জিজ্ঞেস করে যদি জানা যেত কেন তিনি লিখেছিলেন ‘আগুন ঝাঁপ দিয়েছে জলে’ বা কবিতা সিংহের কবিতা গুলো কি কেয়ার এপিটাফ?
একটা সময় পর্যন্ত কেয়া চক্রবর্তী এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে বেঁচেছিলেন আমার কাছে। এখন এই অ্যানেকডোটাল লেখা লিখতে লিখতে বুঝতে পারছি, আমাদের মত অনেকের কাছে কেয়া এই প্রশ্নগুলোর মত বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কোনদিন অতীত হবেন না। তিনি কেবল অসামান্যা অভিনেত্রী নন, একরকমের জীবনবোধের আইকন, যাকে যাপন করতে না পেরে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুসরণ করি।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে দেখা কেয়া চক্রবর্তীর সাদা কালো ছবি, যাতে তাকে কলাবিনুনী করা আর ডুরে শাড়ি পরা দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট আছে। তথ্যের ভার তাকে এতটুকু ক্লান্ত করে নি।
হৃদয়ভাঙ্গা গান, যাকে আমরা heartbreak song বলে জানি, সঙ্গীতের একটি প্রাচীন ধারা। এটি ঠিক জঁর নয়, কোন বিশেষ গায়নরীতিতে এই ধারা আবদ্ধ নয়, বরং ধ্রুপদী থেকে লোকসঙ্গীত হয়ে জনপ্রিয় আধুনিক গানের মধ্যে এই ভাবধারাটি বহমান। প্রেম-ভালোবাসার উপাখ্যানগুলিতে বিরহ বা বিয়োগব্যাথার উল্লেখ মানুষকে নিশির ডাকের মত ডাকে, সেই unrequited love অনেক সময় মিলনের আনন্দের চেয়েও প্রিয়তর হয়ে ওঠে। আশ্চর্যের কথা এই গানগুলি শুনলে মনে হয় প্রেম পীরিতি যেন একটি উদাসীন প্রবাহ, যা নিরন্তর বয়ে চলেছে – কিছুটা নিষ্ঠুর আর উদাসীন – যার মধ্যে ভেসে ডুবে মানুষ আকুল হয়ে সেই গান গাইছে। এখানে প্রেমিকের চেয়ে প্রেম বড়। হয়তো ধারণাটি ভুল নয় : তোমরা যে বল দিবস রজনী, ভালোবাসা ভালোবাসা; সখী ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলি যাতনাময়? Careless love সেই রকম এক হৃদয়ভাঙ্গা গান। বহুপুরোনো প্রচলিত এই গানটির উৎস এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও blues সংস্করণরুপেই গানটির সর্বাধিক জনপ্রিয়তা, কিন্তু লোকগীতি থেকে শুরু করে jazz, country এমনকি পপসঙ্গীত হিসেবেও এই গানটি বার বার গাওয়া হয়েছে। যেহেতু স্রষ্টার দাবী নেই, ফলে অহরহ গানের কথা বদলেছে কিন্তু এর অপূর্ব মায়াবী সুর রয়ে গেছে অপরিবর্তিত আর ভালোবাসার বিচ্ছেদবেদনার মূল ভাবটিও রয়ে গেছে একই রকম। বেসি স্মিথ, মেরিলিন লি, পীট সিগার আর জর্জ লুইসের মত দিকপাল শিল্পীরা এই গানটি বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার গেয়েছেন। আর গেয়েছেন এডি আর্নল্ড, বিং ক্রশবি, রে চার্লস, বব ডিলান, জনি ক্যাশ এবং জোন বেজ। ইয়ু টিউবে careless love লিখে সন্ধান করলে এত সংস্করণ আসে যে শুনে শুনে শেষ হয় না। জনপ্রিয়তার নিরিখে ম্যাডেলিন পেরো এগিয়ে রইলেও তাঁর সংস্করণটির বাণী অনেকাংশেই শীলিত বা sophisticated: Love, oh love, oh careless love/ you fly through my head like wine/ You’ve wrecked the life of many a poor girl/ And you’ve spoiled the life of mine; গানটি যেন এক নারীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণার আলেখ্য। আমার বরং প্রচলিত বাণীটি, যেটি তুলনায় সরল আর মরমিয়া, সেটিই বেশি ভালো লাগে।
Love, oh love, oh careless love Can’t you see what your love’s done to me? It made me roam, to leave my happy home Oh love, oh love, oh careless love
Love, oh love, oh careless love This is all that I can take I’m just like a gypsy I’m roaming around and I just can’t chase the blues way
Well you tied me to your apron strings Yeah you tide me to your apron string You said that you loved me but it didn’t mean a thing Love, oh love, oh careless love
Love, oh love, oh careless love Can’t you see what your love has done to me? Well you said that you loved me but you know it didn’t mean a thing Oh come on love, oh love, oh careless love
অনেক নামীদামী শিল্পীই গেয়েছেন এই গান। কিন্তু আমার ভালো লাগে ঘরের ছেলে অর্ক মুখার্জির গাওয়া গানটি। ইয়ু টিউবেই আছে এর একটি সংস্করণ, যেখানে অর্ক একটা পার্কে বসে দুলে দুলে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে গানটি গাইছেন আর দীপ্তাংশু সংগত করছেন গীটারে। আমার ভালো লেগেছে কারণ অর্ক গায়নরীতিতে লোকসঙ্গীতের আদল নিয়েছেন – শীলিত মার্জনা পরিত্যাগ করে নিলাজ সহজিয়া ভাব পরিগ্রহ করেছেন। সেই আকুল সুরে কোন অচেনা দেশের অজানা নদী উপত্যকায় জিপসী মেয়ের চিকন কালো চোখে হারিয়ে যাবার গল্প আছে যেন। যদিও এসব ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার, তবুও একবার শুনে দেখলে ভালোই লাগবে মনে হয়।
এই গানের অনুবাদ করিনি। আমার মুর্শীদ শাহ আব্দুল করিম এমন একখানি গান লিখে রেখেছেন আমাদের জন্যে। সেখানে মিসিসিপি আর পদ্মা এক হয়ে বইছে। পারলে সে গানও শুনে নিন।
কেন পিড়িতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি কেমনে রাখিব তর মন আমার আপন ঘরে বাদী রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি পাড়া পড়শী বাদী আমার বাদী কালন নদী মরম-জ্বালা সইতে না’রি দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি কারে কি বলিব আমি নিজে অপরাধী কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বহাইলাম নদী রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি বাউল আব্দুল করিম বলে হল এ কী ব্যাধি তুমি বিনে এ ভুবনে কে আছে ঔষধি রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি কেন পিড়িতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি…
আমার বন্ধুরা আর সুমনা (সেও নিশ্চয়ই বন্ধু) সদগুরুর বক্তব্য খুব মন দিয়ে শোনে। তাদের কথায় আমি বুঝতে পারি ইশা ফাউন্ডেশনের কর্মকান্ড এবং সদগুরুর ব্যাখ্যাগুলিতে তারা মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত। যেহেতু বন্ধুদের দ্বারা আমিও প্রভাবিত হই, আমি সদগুরুর ভিডিওগুলি মন দিয়ে দেখতে শুরু করি।
মানুষ অনেক রকমের হয়। কেউ কেউ সহজেই মুগ্ধ হয়, অনুপ্রাণিত হয় – যেন তারা মুগ্ধ হবে বলে ঠিক করে রেখেছে। কেউ আবার সম্পূর্ণ বিপরীত, কোন কিছুই তাদের সহজে উদ্বেল করে না, সন্দেহ আর প্রশ্ন করা তাদের ধাত। আমি মুগ্ধ হই প্রকৃতির অপার বিস্ময়ে, সম্ভাবনায় আর জীবনের গভীর ব্যপকতায়, সৃষ্টির চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া বৈচিত্রে আর মহাজাগতিক প্রাকৃতিক নিয়ম ছন্দের অপূর্ব ছন্দবদ্ধতায়। গুরু মানে যদি এমন কেউ হয় যে আমার চোখ থেকে, চৈতণ্য থেকে অন্ধকার দুর করে দেবে, তাহলে এই প্রকৃতি বা জীবন আমার গুরু। গুরুবাবাজীতে আমার মোটে বিশ্বাস নেই, তাদের আমি সন্দেহের চোখে দেখি। আমি সহজেই কোন মানুষকে শ্রদ্ধার আসন দিতে পারি না, দীর্ঘদিন তার কাজকর্ম, বুদ্ধি ও চেতনা এবং উৎকর্ষের একটি সম্যক ধারণা হলে তবে আমি মানুষে মুগ্ধ হই। এইরকম একটা দ্বন্দ্ববাদী মন নিয়ে শুরু হয়েছিল সদগুরুকে আমার অনুধাবণ করার চেষ্টা।
সদগুরু আমার দেশের অতিপ্রাচীন অধ্যাত্মবাদকে একটি ধর্মবিহীন, নিরীশ্বরবাদী মোড়কে পেশ করছেন দেখে আনন্দিত ও কৌতুহলী হলাম। চেতনার বিকশিত স্তরে মানুষের জ্ঞান বা wisdom প্রসারিত হয়, তখন তার কথাগুলি মানুষের বোধ বিবেচনাকে আলোড়িত করে, এমন মানুষকে আমি বলি evolved being । প্রাথমিকভাবে সদগুরুকে আমার evolved being বলে মনে হয়েছে। আমি তার panel discussion গুলিও মন দিয়ে শুনেছি, এমনকি যেখানে Michio Kakur মত পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখকও উপস্থিত ছিলেন। কাউকেই সদগুরুর বক্তব্যকে খন্ডাতে দেখিনি। এসত্বেও সদগুরুকে আমার বিখ্যাত পাশ্চাত্য অতীন্দ্রীয়বাদী আধ্যাত্মিকদের মত লাগে নি, Allan Wattsএর মতও না। তাঁর আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোথাও একটা আমার দেশের সুপ্রাচীন এবং প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া জীবনদর্শনের ভিত্তি আছে বলে মনে হয়েছে, সেই ভিত্তিভূমিটি আমি সন্ধান করছি।
ড্যান ডেনেটের মত জড়বাদী দার্শনিকরা মানুষের চৈতণ্যকে মস্তিষ্কের বিপুল জটিলতাসঞ্জাত একপ্রকারের ইল্যুশন বা মায়াকল্পনা বলে দাবী করেন। তাঁদের মতে চৈতণ্য বা conciousness আসলে একপ্রকারের মায়া যা মস্তিষ্ক সামাজিক বিবর্তনের প্রয়োজনে তৈরী করেছে। এই মতটিও বিবেচনাধীন তবে আমার এরকমও মনে হয় জেনেটিক বিবর্তন বা সামাজিক বিবর্তন যদি এমন মায়ার জন্ম দিয়েও থাকে তবে তা এখন বাস্তবিকতার অংশ, ম্যাজিক বা ধাপ্পা নয়।
পঁচাশি থেকে নব্বই সালের মাঝামাঝি সময়ে অঞ্জন দত্তের বেনিয়াপুকুরের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। অঞ্জনের ওপেন থিয়েটার নামে একটা নাটকের দল ছিল, সেই দলে আমার পাড়ার বন্ধু নির্মল অভিনয় করত। সেই সূত্রে অঞ্জনদা, ছন্দাদি (অঞ্জনের স্ত্রী) আর নীল (অঞ্জন-ছন্দার একমাত্র পুত্র) এই পুরো পরিবারটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সেই যোগাযোগ আরও বাড়ে যখন অঞ্জনের নাটকগুলিতে আমার ছোটশ্যালিকা আর মেজশ্যালিকা (তখন অবশ্য তারা শ্যালিকা হয় নি, শুধুই টুম্পা আর পিকু) অভিনয় করতে শুরু করে। এখনও হয়ত অনেকের আলিজীন কিংবা কর্ডলাইন নাটকগুলির কথা মনে আছে। দুটিই ছিল মিউজিক্যাল এবং দুটিই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার তখন অভিনয়ে তেমন উৎসাহ ছিল না, কিন্তু অঞ্জনের বেনিয়াপুকুরের বাড়িতে জমাট আড্ডা, রিহারসাল আর গানের আসর বসত – সেই আকর্ষণ ছিল প্রবল। সেই আড্ডায় নতুন পুরোনো নাটক পড়া হত, আর দেশবিদেশের নাটকের আলোচনাও হত প্রচুর। আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতেন ব্রেখ্ট, তিনি অঞ্জনদার প্রিয় নাট্যকার ছিলেন। সেই রকম কোন একটা আড্ডায় ইষৎ মদ্যপ অবস্থায় প্রথম সুরবায়া জনি গানটি শুনেছিলাম। অবশ্য মূল গানটি নয়, অঞ্জন দত্তের করা বাংলা অনুবাদটি। সেইথেকে কমবেশি তিরিশ বছর এই গানটি আমার সঙ্গে রয়ে গেছে।
এই আশ্চর্য গানটি আসলে একটি মেয়ের ভাষ্য। একসময় নাবিকদের জলচর জীবন ছিল নারীসংসর্গবর্জিত; শহরগুলিই ছিল নারীসংসর্গের একমাত্র স্থান , সেখানে তারা প্রেমে পড়ত। সেই প্রেম কখনো সংসার বিবাহে পরিনত হত আবার কখনো বোকাসরল মেয়েগুলিকে মিথ্যে কথা বলে ঠকানোও হত। বহু গল্প উপন্যাস নাটক এই সম্পর্কগুলির টানাপোড়েনের উপর লেখা হয়েছে। গান খুব একটা হয় নি। সুরবায়া জনি গানটি তেমনি একটি মেয়ে ব্রেখ্টের নাটকে গাইছে। আমার কাছে এটা খুব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল।
১৯২৯ সালে এরিখ এঙ্গেলের নির্দ্দেশনায় বার্লিন শহরের শিফব্যুরদাম রঙ্গমঞ্চে হ্যাপিএন্ড নামে যে জার্মান-ইংলিশ মিউজিক্যাল বা সংগস্পিয়েল মঞ্চস্থ হয়, সেখানে এই গানটি জার্মান ভাষায় পরিবেশিত হয়েছিল। নাটকটির রচয়িতা ছিলেন যুগ্মভাবে এলিসাবেথ হাউপ্টমান আর বের্টোল্ড ব্রেখট, যদিও এই নাটকের একটি চরিত্র মঞ্চে কমিউনিস্ট প্যামফ্লেট পড়বে আর তা জার্মান সংবাদমাধ্যমে ঢি ঢি ফেলবে এই ভয়ে নাটকের টিকিটে রচয়িতার ছদ্মনাম ছাপানো হয়েছিল ডরোথি লেন। গানগুলির সুর করেছিলেন কার্ট ওয়েইল আর কথা লিখেছিলেন ব্রেখ্ট স্বয়ং। এ নাটক জার্মানিতে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়, আর দুটি বিশ্বযুদ্ধ পার করে ১৯৫৬ সালে মিউনিখে ফের শুরু হয়। মজার ব্যাপার স্যালভেশান আর্মি আর গ্যাংস্টারদের মধ্যে টানাপোড়েনের এই নাটক, যাতে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসভঙ্গের গল্প বলা হয়েছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল আমেরিকার ব্রডওয়েতে (১৯৭৭)। গল্পের পটভূমি অবশ্য পাল্টে শিকাগো শহর করা হয়েছিল। যাইহোক এই নাটকের তৃতীয় অঙ্কে লিলিয়ান নামের একটি মেয়ে বিল ক্র্যাকার নামে এক গুন্ডার প্রেমে পড়ে এই গান গাইছে। গানটি, যাকে বলে বিটার সুইট, লিলিয়ানের চোখ জ্বলছে ঘৃণায় অথচ সে চোখে জল কারণ তাকে ঠকিয়েছে জেনেও সে বিলকে ভালোই বাসে। ফ্যান্টম অপেরায় এমন উচ্চকিত মানবিক দ্বন্দ্বের গান শুনেছি, কিন্তু মঞ্চনাটকে?
ব্রডওয়েতে ম্যারিঅ্যান ফেথফুল এই গানের যে সংস্করণটি গাইতেন (কথার সামান্য অদল বদল পাওয়া যায় অন্যত্র) তা হল এই রকম:
I had just turned sixteen that season When you came up from Burma to stay And you told me I ought to travel with you You were sure it would be ok When I asked how you earned your living I can still hear what you said to me: You had some kind of job on the railway And had nothing to do with the sea
You said a lot, Johnny All one big lie, Johnny You cheated me blind, Johnny From the minute we met I hate you so, Johnny When you stand there grinning, Johnny Take that damn pipe out of your mouth, you rat
Surabaya Johnny No one’s meaner than you Surabaya Johnny My God – and I still love you so Surabaya Johnny Why am I feeling so blue? You have no heart, Johnny And I still love you so
At the start, every day was Sunday Till we went on our way one fine night And before two more weeks were over You thought nothing I did was right So we trekked up and down through the Punjab From the source of the river to the sea When I look at my face in the mirror There’s an old woman staring back at me
You didn’t want love, Johnny You wanted cash, Johnny But I sewed your lips, Johnny And that was that You wanted it all, Johnny I gave you more, Johnny Take that damn pipe out of your mouth, you rat
Surabaya Johnny No one’s meaner than you Surabaya Johnny My God – and I still love you so Surabaya Johnny Why am I feeling so blue? You have no heart, Johnny And I still love you so
I would never have thought of asking How you’d got that peculiar name But from one end of the coast to the other You were known everywhere we came And one day in a two-bit flophouse I’ll wake up to the roar of the sea And you’ll leave without one word of warning On a ship waiting down at the quay
You have no heart, Johnny! You’re just a louse, Johnny! How could you go, Johnny And leave me flat? You’re still my love, Johnny Like the day we met, Johnny Take that damn pipe out of your mouth, you rat
Surabaya Johnny No one’s meaner than you Surabaya Johnny My God – and I still love you so Surabaya Johnny Why am I feeling so blue? You have no heart, Johnny And I still love you so
Thank you! Thank you very much!
গানটি রহস্যময়। বিল ক্র্যাকার সুরবায়া জনি নয়, স্পষ্টতই লিলিয়ান বিলের সুমতির জন্য একটি প্রচলিত গান গাইছে। তাহলে সুরবায়া জনি কে? ব্রেখ্ট এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি, হয়ত সুরবায়া জনি বিশ্বাসভঙ্গের একটি মিথিক্যাল চরিত্র। কিন্তু তার এমন অদ্ভুত নাম কেন, সে তো গানেই জানতে চাওয়া হচ্ছে! গানে বর্মা, পাঞ্জাব আর সুরবায়া (ইন্দোনেশিয়ার একটি বন্দর শহর) ইত্যাদি স্থাননাম ব্যবহার করার কারণ কি? জনি এইসব স্থানে আরও নারীসংসর্গ করেছে? সে যে মিথ্যেবাদী তাতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ সে আসলে নাবিক আর ভালোমানুষের মেয়েটিকে সে ফুঁসলে নিয়ে গেছে রেলকোম্পানীতে কাজের ধাপ্পা দিয়ে! আক্রোশে ফেটেও পড়ছে মেয়েটি। তাকে ‘you rat’ বলে গালি দিচ্ছে (যদিও ১৯২৯ সালে ব্রেখ্ট জার্মান ভাষায় ‘du hund’ অর্থাৎ ‘তুই কুত্তা’ লিখেছিলেন আর ১৯৮৫তে অঞ্জনদা অনুবাদ করেছিলেন ‘শালা চোর!’)। তবুও মেয়েটি তাকে ভালোবাসে, কামনা করে এমন কি ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়? হায়, নারীর মন দুর্জ্ঞেয়!
যতবার এই গানটি শুনি ততবার বিপন্ন হই। এই গান সঙ্গীতের সৌকুমার্যকে চ্যালেঞ্জ করে অথচ হয়ে ওঠে এক মানবিক সুরবদ্ধ দলিল। প্রেম, যা পীড়নের পরেও টিকে থাকে, তার দিকে অবাক বিস্ময়ে দেখি। এই অদ্ভুত dark emotionএর প্রেরণা ব্রেখ্ট কোথা থেকে পেলেন খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ১৯২৫ সালে জার্মানিতেই লিয়ন ফুখ্তভাগনার ‘কালকুত্তা ফোর মাই’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন ‘ওয়ারেন হেস্টিংস, গভর্নর ফন ইন্ডিয়েন’ কাহিনীর নাট্যরুপ হিসেবে। ১৯১৪ সালে কলকাতার বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবনী আধারিত এই নাটকে ব্রেখ্ট সহসম্পাদনার কাজ করেছিলেন, সেই নাটকের প্রথম অভিনয়ে সুরবায়া জনির মত একটি গান ছিল বলে কথিত। লোকে বলে এই কাহিনী আবার রুডিয়ার্ড কিপলিংএর ‘মেরি, পিটি উওম্যান’ কাহিনীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। একথা যদি সত্য হয় কম্যুনিস্ট ব্রেখ্ট সাম্রাজ্যবাদী কিপলিংএর থেকে ডিক্যাড্যান্ট সাংস্কৃতিক রুপকল্প ধার করতে দ্বিধা করেন নি!
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে আমি সুরবায়া জনির পিছনে দৌড়ে মরছি। নাটক, সঙ্গীত থেকে সাহিত্য, রাজনীতি ঘুরে জার্মানি, আমেরিকা আর এশিয়া মহাদেশের সম্পর্ক আবিস্কার করতে করতে এখন শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার দ্বারস্থ হয়ে দেখি, হৃদয়াবেগের চেয়ে জটিল আর সুন্দর আর কিছু নেই।
এই গানটি অঞ্জনদা অনুবাদ করেছিলেন অস্পষ্ট মনে আছে এইরকম:
বহু বহুদিন আগের কথা তুমি বর্মাদেশে এসেছিলে তখন আমার বয়েস পনেরো কিংবা ষোল কত স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছিলে
সুরবায়া জনি তোমার মন বলে কিছু নেই মিছে বলেছিলে জনি ধাপ্পা দিয়েছিলে জনি ঠকিয়েছিলে জনি শালা চোর!
এই গান নতুন করে অনুবাদ করতে চাই। জানিনা পারব কিনা।
ইয়ু টিউবে ‘সুরবায়া জনি’র অনেকগুলি সংস্করণ আছে। আমার পছন্দের গুলোর লিংক দিলাম। প্রথমটা জার্মান ভাষায়, পরেরটা ইংরাজিতে।