সংশয়বাদীর স্মৃতিচারণ

আমার ছেলেবেলায় বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা। বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে ধর্ম কথাটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। সব পদার্থেরই নাকি ধর্ম আছে। সেই ধর্ম দিয়ে তাদের চেনা যায়। ধর্ম দুরকম – ভৌত আর রাসায়নিক। সহজ ব্যাপার কিন্তু বেশ মনোগ্রাহী। প্রত্যেক পদার্থের নিজস্ব ধর্ম আছে। মৌলিক পদার্থগুলি বেশ মৌলবাদী, কিছুতেই তারা নিজেদের ধর্ম ছাড়ে না। তবে দুটো মৌলিক পদার্থ মিলে একটা যৌগিক পদার্থ তৈরী করতে পারে। তখন তার আলাদা ধর্ম। যেমন হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন হল গ্যাস, উড়ে উড়ে বেড়ায়, চোখে দেখা পর্যন্ত যায় না। কিন্তু দুটো মিলে হয় তরল জল, যা পান করে আমরা বাঁচি। ক্ষুদ্রবুদ্ধি দিয়ে এটা বুঝলুম, জলের ধর্ম আলাদা বটে, তবে হাইড্রোজেন আর অক্ষিজেন প্রাণ থাকতে ধর্ম ছাড়েনি। তখন মনে প্রশ্ন উঠল, ধর্ম কি এমন ব্যাপার যে ছাড়া যায় না?
আমার যে বন্ধুরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছিল তাদের থেকে জানলুম আমি যেটাকে ধর্ম বলে জেনেছি সেটাকেই ওরা জেনেছে property বলে। তার মানে ধর্ম হল সম্পত্তি। এইবার খানিকটা বোঝা গেল। সম্পত্তি কে ছাড়তে চায়?
প্রকৃতিতে টিঁকে থাকতে গেলে যা ধারণ করতে হয় সেটাই হল ধর্ম।
ছেলেবেলায় সংস্কৃত আমাদের স্কুলপাঠ্য ছিল। আমাদের সংস্কৃত স্যারকে আড়ালে বিধিলিং বলে আমরা হাসাহাসি করতুম বটে, কিন্তু এই মাষ্টারমশাইএর যেকোন বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ধারণ করার অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তাঁকে একদিন ক্লাসের বাইরে শুধিয়ে বসলুম, স্যার ধর্ম কথাটি কিভাবে এসেছে? বিধিলিং স্যারের চোখজোড়া দপ করে জ্বলে উঠল। তিনি বললেন, প্রকৃতিতে টিঁকে থাকতে গেলে যা ধারণ করতে হয় সেটাই হল ধর্ম।
এইবারে ব্যাপারটা বেশ বোঝা গেল। বেচারি হাইড্রোজেন, অক্সিজেনকে টিঁকে থাকার জন্য ধর্ম নিতে হয়েছে। সেই ধর্ম তারা ছাড়ে কি করে?
গোল বেধে গেল ক্লাস এইটে দেশের বাড়িতে সালামতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে। সালামতের মত গাছে চড়তে পারে না কেউ। তার উপরে ডুবকি মেরে দীধাপুকুরের তল থেকে পাথর তুলে আনে। তাকে ছেলেপুলেরা ওস্তাদ মানে। সালামত বাবাকে আব্বু বলে। সালামতের আব্বু খেজুর রস দিয়ে গুড় বানায়। তার সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে ঠাকুমা বলল, সালামতের সঙ্গে যে এত খেলছিস, জানিস ও মুসলমান?
মুসলমান? সেটা কি বস্তু?
মুসলমান হল আলাদা রকমের লোক। তার ধর্ম আলাদা। তার ধর্ম ইসলাম।
সালামতকে এই কথা গিয়ে বলতে সে আমের কুষি চুষতে চুষতে বলল, তুই পুতুলপুজো করিস তাই দোজখে যাবি। আমি মুসলমানের ছেলে, সোজা বেহেস্ত। এই বলে সে আকাশের দিকে আঙুল দেখাল। সালামতের কথা শুনে রাগ হয়ে গেল। আমি তাকে বললুম, আমিও বেহেস্তে যাব। সালামত দাঁত বের করে হেসে ভেংচি কাটল।
মনখারাপ হয়ে গেল। মানুষেরও তাহলে ধর্ম থাকে। তাকেও টিঁকে থাকার জন্য ধর্ম নিতে হয়? তখন ভেবেচিন্তে বার করলুম, পদার্থ বলেই এই ঝামেলা। বড় হয়ে আমি অপদার্থ হব।
সেই লক্ষ্যে আমি অনেক দুর অগ্রসর হয়েছি। তবু ধর্ম পিছু ছাড়ে না।

কৈশোর থেকে তারুণ্যের দিকে যাবার সময় ধর্ম সম্পর্কে কৌতূহল অনেকটা প্রশমিত হয়ে এল। মধ্যমেধার মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী, কালীঘাট ভবানীপুরে মানুষ। সেখানে আমার কৈশোরে একটি নিপাট হিন্দু বাঙ্গালী সাংস্কৃতিক আবহ ছিল। সেই আবহে ধর্মাচরণ উচ্চকিত ছিল না। সামনেই বিখ্যাত কালীঘাটের কালীবাড়ি, সেখানে অনেকেই পূজো দেয়, আবার অনেকেই একেবারেই দেয় না। দূর্গাপূজো, কালীপূজো আর সরস্বতীপূজো নিয়ম করে হয় কিন্তু দূর্গাপূজোয় গানবাজনা, জামাকাপড় আর ঘোরা বেড়ানোই মুখ্য। কালীপূজোয় বাজি আর সরস্বতী পূজোয় স্কুলের এক্জিবিশন। এইগুলি যে ধর্মাচরণ তা মনেই হয় না। টিঁকে থাকতে গিয়ে এগুলি ধারণ করতে হয়েছে একথা অসার মনে হয়। সমস্ত পৃথিবীই তো এমনই করে থাকে, না কি? ধর্মটর্ম আবার কি?
সরস্বতীপূজোয় খুব মন দিয়ে অঞ্জলি দিতে যাই। ঐ দিন রোগা প্যাটকা বাঙালী মেয়েগুলি চুলে শ্যাম্পু দিয়ে আর শাড়ী পরে কেমন যেন বড় হয়ে যায়। সদ্য গোঁফ গজানো কিশোর ছেলেরা তাদের দিকে ড্যাবডেবিয়ে দেখে। তাদের ঝোড়ো কাকের মত চেহারা, কন্ঠার হাড় উঁচু, হাফপ্যান্ট পরা সেইসব ছেলের দল হাত পা কোথায় লুকিয়ে রাখবে ভেবে লজ্জা পায়। অপরুপ সেই সরস্বতী কিশোরীরা তাদের দেখে অপাঙ্গে হাসে। আমি অল্পবয়সে অতিপক্ক। সেই ছেলেদের দলে ভিড়ে আমি হাতের মুঠোয় ফুল নিয়ে আড়চোখে তাদের দিকে দেখি আর বিড়বিড় করে বলি, জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।মাথায় কুচযুগ ঘুরতে থাকে। শরীরে আলোড়ন হয়। খুব অধার্মিক ব্যাপার কিন্তু অপ্রতিরোধ্য তার আকর্ষণ।
ধর্ম ছাড়াই বেশ চলছিল। কিন্তু পনের বছর বয়সে পৈতে হয়ে আবার প্রশ্নটা চাগাড় দিয়ে উঠল। পিতৃদেব বসিয়ে উপনয়নের তাৎপর্য বোঝালেন। উপনয়নে দুটো চোখের অতিরিক্ত আর একটা চোখ ফোটে নাকি। দ্বিতীয়বার জন্ম হয় ব্রাম্ভনের। ন্যাড়ামাথায় গেরুয়া কৌপীন পরে সে আগুনের সামনে ভিক্ষুকের বেশে দাঁড়ায়। ভবতু ভিক্ষাং দেহি বলে ঝোলা বাড়িয়ে দেয়। আমাকেও ঐসব করতে হল। কি ভিক্ষা চাইলাম কে জানে, লোকে আতপ চাল, কাঁচকলা, সব্জিপাতি দিল। আর দিল নগদ টাকা, ঘড়ি, আংটি ইত্যাদি। তিনটে পান পেতে দেওয়া হল, আমি একটা করে পানে পা ফেলে এগুতে লাগলুম। এক পা ফেলি আর বৃদ্ধা ঠাকুমা দিদিমারা গলায় আঁচল দিয়ে আমার পায়ে পড়ে প্রণাম করেন। আমি তো দারুণ মজা পেয়ে গেছি। তিন নম্বর পানে পা দিলেই আজন্ম ব্রম্ভচারী সন্ন্যাসী! তিন নম্বর পানে পা ফেলতে যাব মাতা ঠাকুরানী জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, যেওনা বাবা আমার, টুকটুকে বৌ এনে দেব। গৃহস্থ হও।
এইগুলি লোকাচার। মা মোটেও টুকটুকে বৌ এনে দেন নি আমাকে! কিন্তু কুটকুটে কম্বলে শুয়ে, মাটির হাঁড়িতে আতপচাল সেদ্ধ আর সব্জিপাতি খেয়ে তিনদিন দন্ডীঘরে কাটাতে হল। ঐ তিনদিন ত্রিসন্ধ্যা আহ্ণিক করলুম আর গায়ত্রী মন্ত্র আউড়ালাম। ঐ মন্ত্রের অর্থ হল সকলের আরাধ্য সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ঈশ্বরের কাছে আবেদন তিনি যেন আমাকে সঠিক মার্গদর্শন করান। তৃতীয় রাত্রি ভোর হয়ে আসছে, আমাকে বাবুঘাটের গঙ্গায় দন্ডী ভাসানোর জন্যে নিয়ে যাওয়া হল। ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে স্নান করানো হল না, গঙ্গাজল ছিটিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। ভোরের আকাশ পাতলা অন্ধকারে তখনও শুকতারা ফুটে আছে। আমি ভাবতে লাগলুম ধারণ না করে কি কিছুতেই টেঁকা যায় না?
বাড়ি ফিরে শুনি ঐদিন রাত্রেই বাঁকুড়ার চাকলতোড়ে আমার মাতামহ রামপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়েছে।
উপনয়নের পাক্কা একমাসের মাথায় এসপ্ল্যানেডের নিজামে গিয়ে যখন বিফ রোল খেলুম তখনও মাথায় ভালো করে চুল ওঠে নি। এই অসদাচরণ বাড়িতে গোপন রইল না, আমি গোপন করতে চাইও নি। পিতৃদেবের কঠোর ভ্র্ৎসনার মুখে পড়তে হল। তিনি আমাকে বললেন, নিজের ধর্মীয় সংস্কার ও বিশ্বাসকে এইভাবে বিসর্জন দিয়ে আমি চরম ভুল করেছি। আমাকে এরজন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। মা কান্নাকাটি করলেন। আমিও প্রবল ক্ষোভে উপবীত ত্যাগ করে বসলুম।
পরের বছর সরস্বতী পূজোয় অঞ্জলি দিতে যাব, বাবা বললেন আমার অঞ্জলি সরস্বতী ঠাকুর নেবেন না। আমার মনে ভক্তি নেই আর আমার আচরণ অত্যন্ত গর্হিত।
ধর্ম গেল আমার। সেই থেকে আজীবন অঞ্জলি দেওয়া বন্ধ হল। কুচযুগ ভাবতে ভাবতে অঞ্জলি দেওয়া ঠিকও হচ্ছিল না বোধহয়।

একটু গভীরতর বিজ্ঞানশিক্ষা হতে জানা গেল মৌলিক পদার্থ কিছুতেই ধর্ম ছাড়ে না একথা সত্য নয়। বেকেরেল, রাদারফোর্ড আর কুরী দম্পতি তেজস্ক্রিয়তার তত্ব আবিস্কার করে জেনেছেন অনুর অভ্যন্তরের নিউক্লিয়াসে নিউট্রন, প্রোটন পদার্থকে ভৌত ধর্ম দেয় আর নিউক্লিয়াসের চারপাশে প্রায় আলোর গতিতে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনগুলি দেয় রাসায়নিক ধর্ম। নিউক্লিয়াসের ভিতরে নিউট্রন, প্রোটনের দল বাহান্নটির বেশি হয়ে গেলেই পদার্থের ধর্ম নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তখন পদার্থের অনুগুলির তেজস্কিয় রশ্মি বিচ্ছুরণ করার প্রবনতা দেখা যায়। এই তেজস্ক্রিয় রশ্মি আসলে নিউট্রন, প্রোটন আর ইলেকট্রনের স্রোত। ইউরেনিয়াম নামে এক মৌল এই রশ্মি ছেড়ে ছেড়ে তার ধর্ম পাল্টে রেডিয়াম এমনকি সীসা হয়ে যেতে পারে। এই জেনে খানিকটা স্বস্তি হল। তাহলে সম্পূর্ণ অপদার্থ না হলেও চলবে।
উচ্চমাধ্যমিক দেব দেব করছি, পড়াশুনো ছাড়া আর সব চলছে। কতিপয় বন্ধু জুটেছে সব ধাতছাড়া। একদল ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানে বসে গাঁজা খায়। তাদের সঙ্গে গঞ্জিকাসেবন চলতে লাগল। গাঁজা খেলেই আমার পৈতের সময় গজানো কিন্তু বন্ধ থাকা তৃতীয় নয়নটি উন্মীলিত হতে থাকল। উচ্চচিন্তা, বিমূর্তভাবনা আর অতীন্দ্রীয়তা সাইকেডেলিক অনুপানে মস্তিষ্কের নিউরাল জালিকার অজানা পথগুলিকে আবিস্কারের ফল। সুতরাং আরেকদল বন্ধু যখন হঠযোগ আর তন্ত্রসাধনার অ্যাডভেঞ্চার করতে লাগল তাতেও আমার সমান উৎসাহ। মহাউৎসাহে ধ্যানচর্চা চলতে লাগল।
এইগুলি ধর্মাচরণ বলে মনে করতুম না। বরং মনে হত এগুলো ধর্মচেতনাকে চ্যালেঞ্জ। কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে, হাতে নাতে ধরতে হবে।
এইগুলি ধর্মাচরণ বলে মনে করতুম না। বরং মনে হত এগুলো ধর্মচেতনাকে চ্যালেঞ্জ। কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে, হাতে নাতে ধরতে হবে। আমার বন্ধু রাহুল তন্ত্রমন্ত্র রীতিমত পড়াশুনো করেছে। সে হল নাটের গুরু। আরেক বন্ধু অরুণ সে হল চ্যালা। মোমবাতি জ্বেলে নির্বিকল্প সমাধির চেষ্টা করতে লাগল সকলে। মনে কোন প্রশ্নের উদয় হলে যাই শান্তিস্যারের কাছে। তিনি ভাতের ফ্যান গালবার একটা মেশিন বানিয়েছেন, নাম ফ্যানগালিক মেশিন। আমাদের প্রশ্ন শুনে তিনি হাসেন আর বলেন, এইডা বোঝলা না? এ তো আমাগো ব্যাদে আসে!
অনেকদিন হয়ে গেল তবু মনে আছে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে ধ্যানচর্চা বন্ধ হয়ে গেল। শ্মশানে চিত্তরঞ্জনের সমাধি সৌধে বসে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করার চেষ্টা করতুম। কল্পনা করতুম দুটি ভ্রুর মাঝে শূন্যে একটা প্রদীপ জ্বলছে। আমি মনকে সম্পূর্ণ ভাবনাশূন্য করে খালি ঐ প্রদীপটাকে ভাবব। ভাবা সহজ কিন্তু অতি কঠিন কাজ। যত চেষ্টা করি ভাবনাগুলো দুরে সরে যায় আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে আসে। কিন্তু মজাও লাগে বেশ। কয়েক সপ্তাহ অভ্যাস করার পর মনে হল, দুচার মিনিট হলেও মাধাটা পুরো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা ঘুমের মত, কিন্তু আবার আলাদাও বটে। মনে হতে লাগল আমি নিজেই যেন আমার মাথার বাইরে গিয়ে আমাকে নজর করছি। বিচিত্র অনুভূতি! একদিন হল কি এক পুরিয়া গাঁজা টেনে ধ্যান করতে লাগলুম। আস্তে আস্তে মনটা ফাঁকা হয়ে গেল। চেতলা ব্রিজের ওপর গাড়ির প্যাঁ পোঁ ক্ষীণ হয়ে গেল। আমার কিন্তু পুরো সম্বিত আছে। শুধু শরীর হাল্কা হয়ে বোধশূন্য হব হব করছে। এই সময় আর্ক ল্যাম্পের মত একটা তীব্র আলো বন্ধ চোখের উপর পড়ল আর বুক ধড়ফড় করে উঠল। ভয়ে চোখ খুলে দেখি সর্বাঙ্গে ঘাম। টলতে টলতে ঘরে ফিরতে মা চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, কি হয়েছে তোর, কি করেছিস তুই?
আমার মা রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিতা। পরদিন আমাকে গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশনের এক মহারাজের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। এই তরুণ মহারাজ ট্রানসালডেন্টাল মেডিটেশানের শিক্ষক। আনুপূর্বিক সব শুনে তিনি আমাকে বললেন, খেলাচ্ছলে যা করছ বন্ধ কর। নইলে উন্মাদ হয়ে যাবে। সকলের জন্যে সব নয়।
ধ্যান বন্ধ হয়ে গেল। স্বপনদা আমার স্কুলের দুবছরের সিনিয়র, ডাক্তারি পড়ছে। সে সব শুনেটুনে বলল, প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল মনে হচ্ছে। তখন কিছুই বুঝিনি। মনে হত ধ্যান করলে মানুষের তো উপকারই হয়, আমার এমন হয়েছিল কেন? পরে জেনেছি যে ছিয়াত্তর সাল থেকে দুহাজার নয় সাল পর্যন্ত ধ্যানের উপর নিউরোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন কিছু কিছু বেয়াড়া লোকের ক্ষেত্রে ধ্যানের বিপরীত ফল হয়। একে বলে ডিপারসোনালাইজেশান সিনড্রোম। এ জিনিষ হলে অস্তিত্বের বোধ হারিয়ে মানুষ আচমকা মারাত্মক ঘাবড়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে, এপিলেপ্সি হওয়াও বিচিত্র নয়। যাইহোক সমাধি হল না আমার।
এর কিছুবছর পরে কলকাতার আর্চবিশপ হলেন আমার বাবার কলেজের বন্ধু রেভারেন্ড অজয় গড়াই। তাঁর আমাকে কি মনে ধরল কে জানে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সংলগ্ন বিশপের অফিসের লাইব্রেরির দরজা খুলে গেল আমার কাছে। সে এক বইএর সমুদ্র। সেখানে গ্রীক দর্শন থেকে হিন্দু অধ্যাত্মবাদ, বেদান্ত, আব্রাহামিক ধর্মের ইতিহাস, ইসলাম এবং ধর্মীয় নৈতিকতা সংক্রান্ত বইএর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে লাগলুম। তখন আমি প্রযুক্তির ছাত্রও বটে। একদিকে বিজ্ঞান আর অন্যদিকে ধর্ম এই দুইয়ের টানাটানির মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল উত্তর খোঁজা। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু না কি বস্তু মিললে বিশ্বাস? কোন পথে যাই? ধর্মের মানে কোন পথে খুঁজে পাওয়া যাবে?

মধ্য তিরিশ থেকে মধ্য চল্লিশ পর্যন্ত ধর্মের অর্থসন্ধান বন্ধ ছিল। এই সময় ঘোর গৃহস্থ জীবন চলেছে। স্ত্রী, পুত্র, বাসস্থান, রোজগার এইসব চিন্তা মাথা জুড়ে ছিল। বলা যেতে পারে গৃহস্থের যা ধর্ম, সেটাই পালন করেছি। তবে এই সময় বিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু অসামান্য বই পড়েছিলাম। এই বইগুলি প্রকৃতি সম্পর্কে আমাকে ক্রমাগত একটি পরিস্কার ধারণা দিচ্ছিল যা স্কুল বা কলেজপাঠ্য বিজ্ঞান দিতে পারেনি। এই বইগুলির মধ্যে পল ডেভিসের বইগুলি অন্যতম, এ ছাড়াও ছিল ফেইনম্যান লেকচার সিরিজ, মিশিও কাকু, ব্রায়ান গ্রীন, রজার পেনরোজ, স্টিফেন হকিং, লরেন্স ক্রস, নীল ডি গ্রাসের লেখা বই। বইগুলির বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি ছিল মারাত্মক। একদিকে কোয়ান্টাম বাস্তবতা থেকে আপেক্ষিকতা নির্ভর মহাজাগতিক বাস্তবতা – যাকে ফ্রন্টিয়ার সায়েন্স বলেন অনেকে। এই সুবিশাল ব্যাপ্তির খোঁজে বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য কিছু তত্বের উদ্ভাবন করেছেন, যেমন ক্যাওস থিওরী কিংবা হোলোগ্রাফিক পরাবাস্তবতা।
এই সুবিশাল ব্যাপ্তির খোঁজে বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য কিছু তত্বের উদ্ভাবন করেছেন, যেমন ক্যাওস থিওরী কিংবা হোলোগ্রাফিক পরাবাস্তবতা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এইসময় আমি কর্মসূত্রে কলকাতা হলদিয়া দৌড়াদৌড়ি করছি। রায়চকের বাসে বসে লিসা রান্ডালের লেখা ওয়ার্পড প্যাসেজেস বইটি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম। জেগে উঠে দেখি আমার আঙুলের বিয়ের আংটি চুরি হয়ে গেছে। আংটিটা একটু ঢিলে ছিল তবু আঙুল থেকে যে সেটা কি করে চুরি যেতে পারে তা মহাজাগতিক রহস্যের চেয়ে কম কিছু নয়।
যেটা ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম তা হল, ধর্ম যে প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজে বিজ্ঞানও সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। প্রশ্নগুলি মোটামুটি এই রকম:
এক। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড কিভাবে আর কখন তৈরী হল?
দুই। তৈরী হল কেন? এটি কি চৈতন্যময় না কি অচেতন? কেউ কি সচেতন ভাবে এর সৃষ্টি করেছে?
তিন। এই ব্রহ্মান্ডের নিয়ম গুলির সৃষ্টি কি ভাবে হল?
চার। কেউ সচেতন ভাবে করল? নাকি এমনিই তৈরী হয়ে গেল?
পাঁচ। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে মানুষ ঠিক কি ভাবে এল? কেন এল? মানুষের ভবিতব্য কি?
মজার ব্যাপার এই প্রশ্নগুলি বিপদজনকভাবে ঈশ্বরচেতনার আশেপাশে ঘুরছে। ধার্মিকরা যা বিশ্বাস করে মেনে নেন, বিজ্ঞান সেইগুলি অবিশ্বাসীর চোখে ছেনে ছেনে দেখছে। ধর্মের মানে কি ধর্ম বলে না। বিজ্ঞান সেই মানে খুঁজছে।
এও বোঝা গেল আমাদের জীবনে এই দোটানার অসীম প্রভাব। শিল্প, ভাষা, সাহিত্যও এর বাইরে নেই। যে ঘটনা কেন ঘটছে বোঝা যায় না তাকে আমরা বলি দৈবাৎ। মাথা কুটলেও একটি তেজস্ক্রিয় অনু ঠিক কখন একটি প্রোটন, নিউট্রন বা ইলেকট্রন ক্ষয় করবে তা আগাম বলা সম্ভব নয়। এটি পরীক্ষাপ্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা নয়, বৈজ্ঞানিক তত্বের সীমাবদ্ধতা নয় এটি অপরিমাপযোগ্য সম্ভাবনা যার কোন ভবিষ্যদবানী সম্ভব নয়। একে কোয়ান্টাম ইনডিটারমিন্যাসি বলে। এই অজ্ঞেয়তা সৃষ্টির মূলে উপ্ত। এরজন্যই শ্রডিংগার সাহেবের বিড়াল জীবিত না মৃত কেউ বলতে পারে না। এই কোয়ান্টাম ইনডিটারমিন্যাসি – এই কি দৈবাৎ?
এই সময়ে বার্ট্রান্ড রাসেলের দুটি বই যথাক্রমে হোয়াই আই অ্যাম নট এ খৃশ্চান আর সায়েন্স অ্যান্ড রিলিজিয়ান আমার ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্নগুলোকেই আমূল বদলে দিল।
বিজ্ঞান উপরের প্রশ্নগুলোর কি উত্তর খুঁজে পেয়েছে সে কথা পরে বলছি। রাসেলের লেখা পড়ে মনে হল উত্তরের চাইতে সঠিক প্রশ্ন বেশী জরুরী। টিঁকে থাকার জন্য ভুল বিশ্বাস ধারণ করার চেয়ে আজীবন সন্দিগ্ধ থেকে মরে যাওয়া শ্রেয়।

বার্ট্রান্ড রাসেলের বইগুলো পড়বার পর মনে হতে লাগল আমি কি হিন্দু? খুব সমস্যায় পড়তে হল। খৃষ্টধর্ম আর ইসলাম এই দুটিই আব্রাহামের থেকে উদ্ভূত। এই দুই ধর্মের দূতেরাও অনেকাংশে এক। ইসলামে যিশু বা ইশা একজন পয়গম্বর। হজরত মহম্মদ শেষ পয়গম্বর যাঁর মধ্যে আল্লাহ ধর্মের শেষ কথা বলেছেন। এইদুটিই গ্রন্থনির্ভর ধর্ম। দুটিরই কেন্দ্রীয় ভাষ্য অতিপবিত্র এবং অবশ্য পালনীয়। কিছুটা বিতর্ক থাকলেও একজন আদর্শ খৃশ্চান বা আদর্শ মুসলমানের কি কর্তব্য সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্ধারিত। দুটি ধর্মই একেশ্বরবাদী। কেউ যদি মনে করে আমি খৃশ্চান হব না বা মুসলীম হব না, তাহলে কি কি না করলে সে ঐ ধর্মভ্রষ্ট হবে সেটা স্থির করা সহজ।
গোল বেধে গেল হিন্দু ধর্ম নিয়ে। হিন্দু নামক কোন ধর্ম তিনশো বছর আগে ছিল না। এই হিন্দু নামক ধর্মটি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ পন্ডিতদের দ্বারা কল্পিত। ভারতীয় উপমহাদেশে খৃশ্চান, বৌদ্ধ আর মুসলীম ছাড়া যে বিপুল জনজাতি হাজার হাজার দেবদেবীর পূজো করে, বিভিন্ন রকম উপাসনা করে, বেদপাঠও করে আবার দুর্গা নামে পার্বত্য উপজাতীয় দেবীর আরাধনা করে এবং কমবেশী হাজার পাঁচেক বছর ধরে ভৌগলিক ভারতীয় উপমহাদেশে একটি নিরবিচ্ছিন্ন ধর্মসংস্কৃতি বজায় রেখেছে তাদের সকলকে একছাতার তলায় এনে হিন্দু বলে দেওয়া হল। বৌদ্ধরাও এর একটি ভগ্নাংশ।
মজার উপর মজা, কোন সংস্কৃত ভাষ্যে কোথাও হিন্দু শব্দটি নেই। এটি সংস্কৃত শব্দই নয়। পারসিক সিন্ধুর অপভ্রংশ হল হিন্দু। চুড়ান্ত মজা হল, হিন্দু শব্দটি ধর্মবাচক নয়, স্থানবাচক। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন আর ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট তর্কাতীত ভাবে মেনে নিয়েছেন হিন্দু বলতে সিন্ধুনদীর পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সমসাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। অর্থাৎ হিন্দু শব্দটি ‘ইউরোপীয়’ বা ‘আমেরিকান’ এই শব্দগুলির সঙ্গে তুলনীয়, খৃশ্চান বা মুসলীম শব্দগুলির সঙ্গে নয়। তর্কের খাতিরে ভারতীয় মুসলীমকে হিন্দুমুসলীম, খৃশ্চানকে হিন্দুখৃশ্চান কিংবা বৌদ্ধকে হিন্দুবৌদ্ধ বলা যেতে পারে। অথবা সংক্ষেপে এদের সকলকেই হিন্দুস্থানী বলা যায়।
আমার পিতৃদেবকে এই নবলব্ধ জ্ঞান বিতরন করাতে তিনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি নিজেও ধর্মবেত্তা। তবে তাঁর প্রবল ব্রাম্ভণ্য গর্ব আছে। তিনি আমাকে কুযুক্তির দোষে দায়ী করে বললেন, হিন্দু ধর্মের আসল নাম সনাতন ধর্ম।
সনাতন ধর্মের কেন্দ্রে আরাধনা ও উপাসনা নেই। যেটি আছে তা হল, ইটারন্যাল রাইটিয়াসনেস। এটি মূলত একটি নীতিপ্রকরণ।
সনাতন ধর্মটা কি বস্তু? অনেক প্রক্ষিপ্ত, আরোপিত এবং পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের কুহেলী ভেদ করে সনাতন ধর্মের যে ব্যাঞ্জনাটি বেরিয়ে এল সেটি চমকপ্রদ। সনাতন ধর্মের কেন্দ্রে আরাধনা ও উপাসনা নেই। যেটি আছে তা হল, ইটারন্যাল রাইটিয়াসনেস। এটি মূলত একটি নীতিপ্রকরণ। জীবনের কোন পরিস্থিতিতে কোন আচরণ সঠিক, তার গাইডলাইন হল সনাতন ধর্ম। অর্জুণকে যুদ্ধক্ষেত্রে কেন নিজের বৈমাত্রেয় ভাই আর খুল্লতাতকে রেয়াৎ করা চলবে না, সেটিই সনাতন ধর্ম।
বস্তুতপক্ষে কোন ধর্ম যদি সেকুলার হতে পারে, তথাকথিত হিন্দুধর্মের চেয়ে ভাল ক্যান্ডিডেট পাওয়া যাবে না। এর ছাতার তলায় চারটি বেদ, কতকগুলি উপনিষদ ও শাস্ত্র থাকলেও বাইবেল বা কোরানের মত কোন কেন্দ্রীয় ভাষ্য নেই। এই ধর্মে দশটি অবতার আছেন বটে তবে তাঁরা ঈশ্বরের কোন স্পষ্ট বানী নিয়ে এসেছেন বলে মনে হয় না। ভারতে গ্লানির আবির্ভাব হলে ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হবার প্রমিস আছে কিন্তু কল্কি অবতার তো সংহারক। তিনি ত্রাণ নয় একেবারে ধ্বংস করে দেবেন বলছেন। মুনি ঋষিরা যে কোন দেবতার আরাধনা করতে পারেন, তেত্রিশ কোটি দেবতা আছেন যে যা খুশি বেছে নিতে পারেন। আরাধনা না করতে চাইলে নাও করতে পারেন (জাবালি), ঈশ্বরকে ফুঁকে উড়িয়ে দিতে চাইলেও তেমন কোন অসুবিধে নেই (চার্বাক)। ধর্মাচরণের সঙ্গে যৌনতার নিবিড় সম্পর্ক। কিছু দেবতা তো প্রায় ক্যাসানোভা।
জীবনে প্রথম হিন্দুধর্মের প্রতি আকর্ষণ জাগল। এই ধর্মটি আমার পক্ষে কাট টু সাইজ। একে ছেড়ে দিতে মন চাইল না। তখনও যেটা বুঝিনি তা হল, মনু নামে এক মুনি যিনি কিনা সমস্ত মানবের আদি পিতা, সেই ভদ্রলোক এই সনাতন ধর্মের পিন্ডি চটকে ছেড়েছেন। হিন্দু ধর্ম নয়, তাকে ধরলেই বা কি আর ছাড়লেই বা কি। হিন্দুত্ব অতি মারাত্মক ব্যাপার। এটি পরিত্যাগ করার জন্য গোমাংস ভক্ষণ আর মূর্তিবিসর্জন অতি আবশ্যক।

ভারতবর্ষে থেকে হিন্দু না হয়ে পারা যাবে না। কিন্তু লাতিন আমেরিকাতে স্প্যানিশ হয়ে থাকা যায় অথবা কানাডার কিউবেকে ফ্রেঞ্চ।
এই সময় আমার এক ক্যাথলিক মহিলার সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। সম্পর্কের খাতিরে তাঁর দেশের নামটা গোপন রাখছি শুধু এটুকু জানলে চলবে দেশটি একদা খৃশ্চান, হিন্দু ও মুসলীমদের সমান সমান ভাগে ছিল। কিন্তু গত চারদশক ধরে সেই দেশের ইসলামীকরণ হচ্ছে, হতে হতে এখন হিন্দুরা প্রায় উধাও আর ক্যাথলিক খৃশ্চানরা একটি দ্বীপ ভূখন্ডে কোনঠাসা।
আমার বন্ধুটির পরিবার গোঁড়া ক্যাথলিক। মুসলমানদের তারা দুচোক্ষে দেখতে পারে না। বন্ধুটি যৌবনে এক মুসলীম যুবকের প্রেমে পড়েছিল কিন্তু বাড়ির আপত্তিতে এক চিনাম্যানকে বিবাহ করেছে। চিনারা অল্পসংখ্যক বৌদ্ধ ও মুসলীম বাদে ধর্মে উদাসীন। এটি কম্যুনিজমের প্রভাব নয়, চৈনিক সংস্কৃতির মূলে আছে কনফুসিয়ানিজম যা প্রচলিত অর্থে ধর্ম নয় – একপ্রকার চিন্তাধারা ও জীবনপ্রণালী। বন্ধুর স্বামী, স্ত্রীর অনুপ্রেরনায় অনায়াসে খৃশ্চান ধর্ম গ্রহণ করে, একটি খোলতাই খৃশ্চান নাম নেয় কিন্তু বিবাহের যা মূল আকর্ষণ তার নিবৃত্তি হতে দুই ক্যাথলিক সন্তানের পিতা চার্চ যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এই নিয়ে আমার বন্ধুর থেকে আক্ষেপ আর মনস্তাপ শুনতে থাকি। কিন্তু মুসলীম বিবাহে আপত্তি কি ছিল? তাহলে তো মুসলীম হতে হবে, আজীবন পর্ক খাওয়া যাবে না। আমার বন্ধুর সংস্কৃতিতে পর্ক অছ্যেদ্য অংশ। কেন ভালোবাসার জন্য শূকরমাংস ছাড়তে পারো না, এই প্রশ্নে সে উদ্দীপ্ত হয়ে বলতে থাকে ক্যাটেকিজমে রোমান ক্যাথলিকরা কত উদারতার সঙ্গে মুসলমানদেরও স্যালভেশন চেয়েছে। সে কেন তার খাদ্যাভ্যাস ছাড়তে যাবে?
সভ্যতার ইতিহাসে ইহুদিধর্ম, খৃষ্টধর্ম আর ইসলামের উৎপত্তি আর প্রসার যে কোন থ্রিলারকে হার মানাতে পারে। ঐতিহাসিক ভাবে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে যে স্থান লেভান্ত নামে পরিচিত সেখানে মেসোপটেমিয়া আর নীলনদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এখন থেকে প্রায় তিন হাজার আগে লোকগাথার মধ্যে মিশেছিল জেনেসিসের গল্প যার নায়ক আব্রাহাম। আব্রাহাম নোয়ার বংশধর আর তার বারো ছেলের থেকে তৈরী বারোটি যাযাবর গোষ্ঠী। দশটি ছেলে বিস্মৃতির গর্ভে হারিয়ে গেছে কিন্তু ইসমাইল আর ইশাককে ভোলা যাবে না। কারন গল্প অনুসারে ইসমাইলের বংশ থেকে এল আরব জাতি আর ইশাকের বংশ থেকে ইহুদি জাতি। ইশাকের বংশধরেরা তোরা বলে এক গ্রন্থ লিখে ফেলল যার ঈশ্বরের নাম ইয়োভা। ইয়োভা এক প্রতিহিংসা পিপাসু, নির্দয়, আর রক্ষরণশীল ঈশ্বর, তাকে না পূজলে সে কাঁচা চিবিয়ে খায়। ইয়োভার গল্প ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে। হাজার খানেক বছর ধরে ইহুদিরা তাকে মেনে চলল আর ইয়োভা আব্রাহামকে এক প্রতিশ্রুত ভূমির কথা বলেছিলেন ফিলিস্তিনের ইজরায়েলে সেই ভূমি খুঁজে পেল। সেখানে তারও বহু আগে থেকে ইসমাইলের বংশধরেরা থাকে, তাদের তো মাথায় হাত! সে যাইহোক সকলেই আব্রাহামের বংশধর, একটা কাজচালানো গোছের সমঝোতা হয়ে গেল।
এই সময় গ্যালিলির নাজারেথে এক দরিদ্র ছুতোরের ঘরে ইহুদি যিশু বা ইশার জন্ম। তিনি রোমান ব্যাভিচারী বহুঈশ্বরবাদী সমাজ আর ভয়ংকর ইয়োভার দেখানো পথ থেকে সরে এসে এক স্বর্গীয় রাজত্বের কথা বললেন। সেই রাজত্বের রাজা এক পরম করুণাময় ঈশ্বর, যাকে বিশ্বাস করে হৃদয়ে স্থান দিলে সব পাপের থেকে মুক্তি। ইহুদিরা অনেকেই একথা মানল না, তারা যিশুকে ষড়যন্ত্র করে ক্রুশে তুলে মারল। যিশু ঈশ্বরের সন্তান, তিনি পুনর্জীবিত হয়ে ফিরে এলেন। তাঁকে অনুসরন করে ইহুদি ধর্ম ভেঙ্গে খৃষ্টধর্ম তৈরী হল। আব্রাহামের পর যে কটি দেবদূত এসে এক এবং অভিন্ন ঈশ্বরের কথা বলেছিলেন, খৃষ্টানরা দাবী করল যিশুই তাদের শেষ দূত।
ছশোবছর গেল না মক্কায় জন্মালেন মহম্মদ। পারিবারিক পেশায় ব্যবসায়ী মহম্মদ হিরা গুহায় ঈশ্বরের বানী শুনতে শুনতে চল্লিশ বছর বয়সে ঘোষণা করলেন এক এবং অভিন্ন আল্লাহের কথা। সেই আল্লাহের বানী সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে যে গ্রন্থে লেখা হল তার নাম কোরান। সৃষ্টি হল ইসলাম ধর্মের। এই ধর্মে আব্রাহাম ও তার পরবর্তী সকল দূত খৃষ্টধর্মের অনুসারী, এমনকি ইশাও। শুধু ইশা শেষ দূত নন, মহম্মদ স্বয়ং শেষ দূত। কোরান হল শেষ কথা। ইসলাম ঘোষণা করল, এই দূতেরা পরম শ্রদ্ধেয় কিন্তু সকলেই রক্তমাংসের মানুষ। যিশুর ভক্তরা যে দাবী করেন যিশু ঈশ্বরের পুত্র একথা ভ্রান্ত। সমর্পিত হতে হবে পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরের কাছে। তাঁর দূতেরা পূজ্য হতে পারেন না। কোরাণ অভ্রান্ত এবং অপরিবর্তনীয়।
জীবনের প্রথম আটটি বছর মহম্মদ যুক্তি দিয়ে ইসলামের কথা সকলকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। তাঁর বিশেষ শিষ্য জুটল তো না ই, উল্টে তাঁকে ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলার চেষ্টা হল। ছশোবাইশ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ মক্কা ছেড়ে মদিনা শহরে এলেন। এখানে আমরা এক সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মহম্মদকে দেখি। মদিনায় মহম্মদ একটি ছোটখাট সেনাবাহিনী বানিয়ে ফেলে ঝড়ের গতিতে একের পর এক আরব গোষ্ঠীগুলিকে আক্রমণ করতে লাগলেন। তাঁর ধর্মপ্রচারের পদ্ধতি সহজ। হয় ইসলামের শরণ নাও নয়ত মুন্ডুটি বিসর্জন দাও। মাত্র দুশো বছরের মধ্যে ইসলাম ধর্মের মধ্যে সেনাবাহিনী, রাষ্ট্র ক্ষমতা, বানিজ্য ও অর্থনীতি মিলে এক অতিকায় অতিশক্তিশালী জাতির সৃষ্টি হল। তৈরী হল একটি কেন্দ্রীভূত মুসলিম পলিটি। এর কেন্দ্রে আরব আধিপত্য থাকলেও ইসলাম ক্রমশ ইউরোপ, আফ্রিকা হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করল।
এই যাত্রাপথে খৃষ্টানদের সঙ্গে মুসলীমদের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী বিবাদের ইতিহাস আছে। খৃষ্টান ধর্মকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছিল রোমান ক্যাথলিকরা। তারা ট্রিনিটি তত্বের উদগাতা, যাতে বলা হয়েছে ঈশ্বর, ঈশ্বরের পুত্র এবং হোলি স্পিরিট এই তিনটি এক ঈশ্বরের তিন চেহারা। ইসলাম এই গ্যাব্রিয়েলকে হোলি স্পিরিট মানে কিন্তু এই ট্রিনিটিকে অস্বীকার করে। তার মতে আল্লাহের কোন রুপ নেই। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। প্রটেস্টান্ট খৃষ্টানরাও ট্রিনিটি মানে না, যিশুই তাদের পরম আরাধ্য কিন্তু মুসলীমদের পৃথক আব্রাহামিক গোষ্ঠি বলেও তারা মানতে লারাজ। মহম্মদকে তারা মেকি ধর্মগুরু বলে মনে করে। এই দন্দ্ব আজও বর্তমান।
কিন্তু এই অতি শক্তিশালী ধর্মরাজনৈতিক ইসলামের পথে কাঁটা রয়ে গেল। প্রথমেই মনে রাখতে হবে ইসলাম আধুনিকতম ধর্ম হিসাবে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রাষ্ট্রক্ষমতার যোগফল। খলিফা শুধু ধর্মগুরু নন তিনি শাসনকর্তা। কিন্তু মহম্মদ পরলোকগত হতেই তাঁর উত্তরসুরী কে হবেন এই নিয়ে মতান্তর হতে লাগল। যদিও অধিকাংশ মুসলীম মনে করলেন তাঁদের মনোনীত যোগ্যতম ব্যক্তিই মহম্মদের উত্তরাধিকার পেতে পারেন, একটি ছোট অংশ এই নেতৃত্বের অধিকার মহম্মদের বংশের মধ্যেই রাখতে চাইলেন। এরা হলেন শিয়া। অগ্রগন্য নেতা আবু বকর প্রথম খলিফা মনোনীত হলেন বটে কিন্তু মহম্মদের খুড়তুতো ভাই এবং জামাতা আলিকে এই ছোট অংশটি খলিফা দেখতে চেয়েছিল। আবু বকরের পর দুজন খলিফার গুপ্তহত্যা হল আর আলি চতুর্থ খলিফা হলেন। মহম্মদের পরবর্তী ইসলামী নেতাদের মধ্যে চরম হানাহানি এবং যুদ্ধ শুরু হল খলিফার সিংহাসন দখলের জন্য সেই যুদ্ধে আলি মারা পড়লেন। শিয়া সুন্নি বিবাদ চরমে উঠল যখন আলির পুত্র হুসেন খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন। কারবালার প্রান্তরে এক মর্মান্তিক যুদ্ধে হুসেন সপরিবারে নিহত হলেন। সুন্নিরা হুসেনের মাথা কেটে এনে খলিফাকে উপহার দিল। সেই দিন থেকে ইসলামের এক হওয়া স্বপ্নই থেকে গেল।
মাহদি কি ইসলামের রিফর্মার রুপে আসবেন?
সিয়াদের নেতাকে বলে ইমাম। এই ইমাম এক অতীন্দ্রীয় ক্ষমতায় আল্লাহের অংশ হিসাবে প্রতিভাত। সুন্নি মুসলীমরা ইমামের আল্লাহের সঙ্গে এই একাত্মতাকে পাপ বলে মনে করে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে গেল যখন সিয়া মুসলীমরা তাদের অনুপস্থিত দ্বাদশ ইমামকে যিশুর মত মেসায়া মনে করে অপেক্ষা করতে লাগল। এই দ্বাদশ ইমাম বা মাহদি অবতীর্ণ হলে তবেই কোরাণের আসল অর্থ ও তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মহম্মদের সঠিক মূল্যায়ন হবে। এখন কি তবে তা হয় নি? মাহদি কি ইসলামের রিফর্মার রুপে আসবেন?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর মেলেনি। যেমন উত্তর মেলেনি মহম্মদের সমাধির পার্শ্ববর্তী সাহাবার মধ্যে প্রথম দুই খলিফা আবু বকর ও উমরের সমাধির পাশে শূন্য কবরটি কার। মুসলীমরা মনে করেন এখানে একদিন ইশা সমাহিত হবেন। ইসলাম কি তাহলে যিশুখৃষ্টের রেজারেকশান বিশ্বাস করে?
এইসব নিয়ে যখন মাথাপেচি করছি তখন কলকাতায় বক্তৃতা দিতে এলেন রজার পেনরোজ। ব্রিটিশ কাউন্সিলে তাঁকে একটি প্রশ্ন করার জন্যে অনেক হাত তুলে তুলে ব্যর্থ হয়ে যখন বসে পড়তে যাচ্ছি তিনি নিজেই আমাকে ডেকে আমার প্রশ্নটি জানতে চাইলেন। ঢোঁক গিলে তাঁকে শুধোলুম, সব প্রশ্নের উত্তর যুক্তি দিয়ে পাওয়া যায়? সব কিছু কি কমপিউটিবল হয়?
দিগ্বিজয়ী পন্ডিত ধূসর চোখ মেলে কি যেন ভাবলেন তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ওনলি রিজনেবল কোয়েশ্চেনস হ্যাভ রিজেনেবল আনসার। তারপর একটু ক্লান্তস্বরে বললেন, সারা জীবন গণিতের চর্চা করে তাঁর মনে হয়েছে গণিত কোন মৌলিক সত্য আবিস্কার করে না। সব কিছু কমপিউটিবল নয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে অজ্ঞেয়তার মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। যা জানা যায় না তার জন্য যুক্তিগ্রাহ্য কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। ঐ পর্যন্তই। রুজ বল প্রফেসর অফ ম্যাথামেটিক্সের মুখে এ কথা!!
এই স্বল্প বাক্যালাপ আমার উপর সূদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।

যা জানা যায় না তার জন্য যুক্তিগ্রাহ্য কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। ঈশ্বরকে জানা যায় না। তারজন্য মানুষ কতটা যুক্তিগ্রাহ্য কল্পনার আশ্রয় নিয়েছে?
রজার পেনরোজ কলকাতায় এসেছিলেন সম্ভবত দুহাজার এগারো সালে। এর বছর খানেক আগে থেকেই আমি ইউরোপিয়ান জার্নালিস্টিক অ্যাসোসিয়েশানে লেখালেখি শুরু করেছি। সেই আমার জীবনে প্রথম সিরিয়াস ব্লগিং। এখানে মূলত বিজ্ঞান নির্ভর রিপোর্ট লিখতে লিখতে কিছু গুনী মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জেসি মুর আর কাশীনাথ বাজপেয়ী তেমন দুটি বন্ধু। জেসি আমেরিকার ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানী আর কাশীনাথ দেরাদুনের পরিবেশবিদ। এদের উৎসাহে লিখতে লিখতে ইউরোপীয়ান জার্নালিস্টিক অ্যাসোসিয়েশানে আমার প্রবন্ধগুলি পুরস্কার জিতে বসল। তাঁরা আমাকে একটি মানপত্র আর উপহার পাঠালেন। দুহাজার বারোতে লিসবনে একটি সেমিনারে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রন এল যদিও ভিসা পেতে দেরী হওয়ায় সেটিতে যাওয়া হয়ে উঠল না।
এই লেখালেখির সূত্রে দুহাজার বারোতে আমার ওয়েবসাইটের প্রকাশ। এই সময়টি আমার জীবনের অতি আনন্দময় পর্যায় কারণ একে একে টেড এবং স্যাম হ্যারিসের প্রজেক্ট রিজনে আমার বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ ও বিতর্ক গুলি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। এখানে বন্ধুত্ব হল জিম মুনান, কলিন স্টিন আর সেলিম সোলেয়মানের সঙ্গে। সেলিম ঢাকার ছেলে তার সঙ্গে মোলাকাত, আড্ডা আর তর্ক করে কি পরিমান আনন্দ পেয়েছি যে কি বলব। বিজনেস ইনসাইডারে আমার একটি প্রবন্ধ বেরিয়ে গেল।
মানবজাতির বয়স কমবেশী দু লক্ষ বছর। তার এক লক্ষ পঁচানব্বই হাজার বছর মানুষের ধর্মের প্রয়োজন হয়নি।
এই ঘটনাগুলি যখন ঘটছে তখন আমি একে একে রিচার্ড ডকিন্স, স্যাম হ্যারিস, ড্যানিয়েল ডেনেট আর ক্রিস্টোফার হিচেন্সের বইগুলি ও বক্তৃতামালা গোগ্রাসে গিলে চলেছি। এরা সকলেই ঘোর নিরীশ্বরবাদী আর ডকিন্সকে মিলিট্যান্ট অ্যাথেইস্ট বলে লোকে চেনে। এরা ক্ষমাশীল অ্যাগনস্টিক নন, ধর্মকে আক্রমণ করে তার নৈতিক উচ্চাসন টলিয়ে দিতে চান।আমার লেখালেখিতে এদের প্রভাব পড়তে লাগল। ধর্মের মানে কি বোঝার জন্য একটু একটু করে তৈরী হতে লাগলুম।
মানবজাতির বয়স কমবেশী দু লক্ষ বছর। তার এক লক্ষ পঁচানব্বই হাজার বছর মানুষের ধর্মের প্রয়োজন হয়নি। মনুষ্যেতর প্রাণীদের এখনও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা গিনিয়ার শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে কিছু আচরণ লক্ষ করেছেন যাকে ধর্মাচরনের প্রাথমিক অবস্থা মনে হয়। এই শিম্পাঞ্জীরা এক ধরনের গাছকে উপাসনাস্থলের মত ব্যবহার করে। এই গাছগুলিকে জীববিজ্ঞানীরা টেম্পল ট্রি আখ্যা দিয়েছেন।
সমাজবদ্ধ জীবের জীবনযাত্রা যথেষ্ট উন্নত হলে ও সমাজ উপযুক্ত পরিমানে জটিল হয়ে উঠলে বিবর্তনের একটি বিশেষ স্তরে যুথবদ্ধ জীব প্রকৃতির মধ্যে উপাস্য খুঁজতে থাকে। এর ফলে প্রথমে আসে টোটেম, তারপর ওঝা এবং সবশেষে প্রাকৃতিক শক্তির আরাধনা। এটি চৈতন্যের চাহিদা। প্রকৃতির খেয়ালের কাছৃ জীব অসহায়, তাকে তুষ্ট রাখা একটি জৈবিক তাগিদ। এর পরবর্তী ধাপে উন্মেষ হয় অধ্যাত্মচেতনা। ড্যানিয়েল ডেনেট একে বলেছেন নেসেসারী ডেল্যুশান। যে প্রশ্নগুলো ক্রমাগত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় অথচ তার আশু মিমাংসার উপায় নেই সেগুলিকে অতিপ্রাকৃতের উপর আরোপ করা একটি নিখাদ সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট।
লক্ষ করা যেতে পারে পাঁচ হাজার বছর আগে যখন সুস্পস্টভাবে মানুষের মধ্যে অধ্যাত্মচেতনা এল তখন থেকে যতগুলি ধর্মের উদ্ভব সবকটির মধ্যে কতকগুলি বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে।
এক। সব ঈশ্বরই সর্বশক্তিমান এবং পুরুষ। শক্তির প্রয়োজন নিয়ন্ত্রনের জন্য এবং পুরুষই নিয়ন্ত্রক।
দুই। সব সৃষ্টিগাথাতেই ঈশ্বর মানুষকে তাঁর আদলে বানিয়েছেন। অর্থাৎ ইশ্বরকে বাঘ, সিংহ কিংবা পিঁপড়ের মত মনে হয় না। শিম্পাঞ্জীর ঈশ্বরকেও শিম্পাঞ্জীর মতই দেখতে হবে।
তিন। ঈশ্বরের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করলে শাস্তি, স্বীকার করলে পুরস্কার। ঈশ্বর বিরুদ্ধ মত পছন্দ করেন না।
চার। ঈশ্বরের নির্দেশ হল নৈতিকতার গাইড লাইন। এটি অলঙ্ঘ্য।
পাঁচ। মৃত্যুর পর জীবন আছে। সেখানে কৃতকর্ম অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা। মরে বাঁচার পথ বন্ধ।
ছয়। ঈশ্বরের আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী একটি সম্প্রদায় আছে। তিনি টম, ডিক আর হ্যারির সঙ্গে কথা বলেন না।
সাত। পূন্যের চেয়ে স্পষ্টতর পাপের ধারণা। স্বর্গ ও নরকের হায়ারার্কি।
সনাতন ধর্মের অবতারগুলি তো জীব বিবর্তনের সাক্ষী বলে মনে হয়। আদি অবতার হল মাছ কারণ তখন প্রকৃতি জলময়। তারপর কচ্ছপ অর্থাৎ উভচর। তারপর বরাহ যে কর্দমাক্ত ডাঙ্গায় উঠে পড়েছে। বলরামের হাতে হাল, কৃষির আবির্ভাব দ্যোতক, রামের হাতে ধনুক, যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হবার ইঙ্গিতবাহী।
আদি সনাতন ধর্মের ঈশ্বর বা তাঁর দূতের চেহারা স্পষ্ট না হলেও, খৃষ্টধর্মের ট্রিনিটি আর সনাতন ধর্মের ত্রিদেবের মধ্যে মিল আকস্মিক মনে হয় না। যিশু মেষপালক, মানুষ=মেষ, ঈশ্বর=মেষপালক। লেভান্তের মুখ্য জীবিকা মেষপালন। মহম্মদ বনিক গোষ্ঠীজাত, আল্লাহ একেবারে শতকরা ধরে জাকাতের বিধান দিয়েছেন। হিন্দুরা পবিত্রভূমি প্রদক্ষিণ করে, মুসলীমরাও করে। হজ্জ্বু মুসলমানের সাদা পোষাক, উত্তরীয় ও মুন্ডিতমস্তক দেখে ব্রাম্ভণ বলে মনে হয়। এই সাদৃশ্যগুলি দেখে মনে হতে লাগল, ঈশ্বরও নেসেসারী ডেল্যুশান।

ড্যানিয়েল ডেনেট নেসেসারী ডেল্যুশন বললে কি হবে, রিচার্ড ডকিন্স গড ডেল্যুশন বইটিতে ধর্মবিশ্বাসীদের সরাসরি আক্রমণ করে বসলেন। তাঁর যুক্তি হল ঈশ্বর আছেন বলে যিনি দাবী করছেন এবং অন্যকে ঈশ্বর বিশ্বাস করতে বলছেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করার দায় তাঁর। এবং সেই প্রমাণ যুক্তিগ্রাহ্য ও পরীক্ষাসাপেক্ষ হতে হবে। ধর্মবিশ্বাসীরা পাল্টা বললেন যে ঈশ্বর নেই এরও তো প্রমান কিছু নেই। কিন্তু সেই যুক্তি বার্ট্রান্ড রাসেলের টি পট তত্বের সামনে টেঁকে না। ব্যাপারটা এই রকম। ঈশ্বরের অনুপস্থিতি প্রমান করা সম্ভব নয় বলে যদি তাঁকে বিশ্বাস করতে হয় তাহলে রাসেল দাবী করলেন পৃথিবী আর চাঁদের মাঝে মহাশূন্যে একটি টি পট পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে এটিও মেনে নিতে হবে কেননা এমন টিপট যে নেই এটা কেউ প্রমান করতে পারছে না।
বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সবচেয়ে বড় তফাৎ হল, বিজ্ঞানের প্রতিটি দাবীর সঙ্গে সেটি ভ্রান্ত প্রমাণ করার আবেদন থাকে। বস্তুত পক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ব ভুল প্রমানিত হলে বিজ্ঞানীরা খুশী হন কারন তাতে সত্যর দিকে এক পা এগোন সম্ভব হয়। ধর্মবিশ্বাস স্থানু ও অপরিবর্তনীয়। ধর্মের দাবী অনড়, তাকে প্রশ্ন করা চলবে না সেটি ধর্মবিরুদ্ধ কাজ হবে। ধর্ম মানুষকে বিনা প্রশ্নে সমস্ত কিছুকে গ্রহণ করতে উৎসাহ দেয়।
স্যাম হ্যারিস অন্য একটি পথে ধর্মের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। খৃষ্টান যাজক দাবী করেন যিশুই একমাত্র পরিত্রাতা। তাঁকে বিশ্বাস করে অনুতপ্ত হলে স্বর্গের দ্বার খোলা। তাহলে তো ভারতীয় হিন্দু যারা হনুমান ভজে তাদের জন্যে স্বর্গের দরজা বন্ধ। নাকি তাদের জন্যে আলাদা স্বর্গ? নাকি তারা খৃষ্টান নরকে যাবে? মুসলীমদের নিয়েও তো একই সমস্যা! আমি হিন্দু যাজকদের স্যাম হ্যারিসের প্রশ্নটি করতে পারি। কোন মুসলীম বন্ধু মোল্লাদের একই প্রশ্ন করতে পারেন। স্যাম হ্যারিস জবাব পান নি, এইটুকু বলে রাখি।
খ্রিষ্টোফার হিচেন্স আরও অন্য একটি প্রশ্ন তোলেন। ঈশ্বর সম্পর্কে প্রশ্ন করা বা দুহাজার বছর আগে লেখা ধর্মগ্রন্থগুলির সামাজিক নৈতিকতার প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা যদি ধর্মবিশ্বাসীদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয় তাহলে ধর্মের কারণে গর্ভপাত করতে না পেরে মৃত্যু, কুরবানির জন্যে সর্বসমক্ষে প্রাণীহত্যা বা মৃত স্বামীর চিতায় বিধবা রুপ কানোয়ার পুড়ে মরলে যারা ধর্মবিশ্বাসী নন তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগছে বলে মানা হবে না কেন? ধার্মিককে এই সামাজিক উচ্চাসনটি কেন দেওয়া হবে? সে কিসে এই বাড়তি অধিকারটি পায়?
ইদানীং প্রতিটি ধর্মের মধ্যে এক চূড়ান্ত বিতর্ক চলছে। কেউ বলছেন ইসলামের অন্তর্নিহিত বানীগুলি হিংস্র, আধিপত্যকামী ও বর্বর। ইসলাম আদৌ শান্তির ধর্ম নয়। কেউ বলছেন খৃষ্টধর্মও কমবেশী এই দোষে দুষ্ট। এই দুটি ধর্মের লিখিত ধর্মগ্রন্থ আছে, তা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমান করার চেষ্টা চলছে অন্য ধর্মের চেয়ে আমারটি ভাল বা মন্দের ভাল। তথাকথিত হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত সহজ হচ্ছে না কিন্তু যুদ্ধবাজ কৃষ্ণ, ব্রম্ভার নিজ কন্যা সরস্বতীকে কামনা, মনু সংহিতার ব্যাখ্যায় সমাজে নারীর নিচু স্থান ইত্যাদি যথেষ্ট সমালোচনার মুখে।
যারা মুক্তমনা কিংবা নিরীশ্বরবাদী তাদের চাপাতির কোপে মারা পড়তে হচ্ছে। মহম্মদ সংক্রান্ত ব্যঙ্গচিত্র এঁকে চার্লি হেবদোর কার্টুনিষ্টরা মারা পড়লেন।
এই পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করি ধর্মের মানে কি? আমার মনে হয় দুটি ঈশ্বর আছেন। একজন মানুষের হৃদয়ে সংগোপনে বাস করেন। তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসীর ব্যক্তিগত মান, অভিমান, সংলাপ আর প্রার্থনা চলে। সেই ঈশ্বর আমার কাজে লাগুন বা না লাগুন নিরাপদ ঈশ্বর। আর একটি ঈশ্বর কেবল মন্দির, মসজিদ, গীর্জায় বাস করেন। তাঁর প্রবল প্রতাপ এবং তিনি কেবল গুরুবাবা, মোল্লা আর পাদ্রীর মারফত হুকুম জারি করেন। ধর্মের মানে কি এই প্রশ্নের উত্তর অনেকটাই নির্ভর করে কোন ঈশ্বরটি আমার বিবেচ্য।
বিজ্ঞান আমাকে কোন অনন্ত শান্তির প্রতিশ্রুতি দেয় না। সে ওঠে পড়ে আর এক পা এক পা করে এগোয়। কিন্তু যে গভীর প্রশ্নগুলি আমি আগে উল্লেখ করেছি সেগুলির অনেক চমকপ্রদ উত্তর সে দিয়েছে। এই উত্তরগুলিও চিরকালীন সত্য কিনা সে বলতে পারে না তবে তার যুক্তি, তথ্য, প্রমাণ সামনে সাজানো। পরীক্ষা করে নিলে তার আপত্তি নেই। ধর্মের মানে কি বুঝতে বিজ্ঞানের এই অবস্থানটিও বিবেচনা করা উচিত।
আমার সামনে দুটি পথ। চাইলে আমি গ্রহন করতে পারি মাত্র তিনহাজার বছর আগে ঈশ্বর অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে বললেন লেট দেয়ার বি লাইট আর সাতদিনে বিশ্ব ব্রম্ভান্ড সৃষ্টি করে ধূলো থেকে আদি পূর্বপুরুষ আর তার পাঁজর থেকে আদিতম মাকে সৃষ্টি করলেন। খালি বিশ্বাসে ভর করে একথা মানতে হবে। সমস্ত কার্বন ডেটিং করা লক্ষ বছরের পুরোনো ফসিল গুলো তাহলে ফেলে দিতে হবে। নতুবা আমাকে মানতে হবে সেই চমকপ্রদ তত্ব যাতে বলা হচ্ছে প্রায় চোদ্দ বিলিয়ন বছর আগে বিনাকারণে, কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই এবং কোন ঈশ্বর ব্যতিরেকে কেবলমাত্র কোয়ান্টাম খেয়ালে একটি ডাইমেনশনহীন বিন্দু থেকে এক বিকট বিষ্ফোরণে এই ব্রম্ভান্ড সৃষ্টি হয়েছিল। এর আগে কি ছিল? প্রশ্নটাই নাকচ কারণ ঐ বিষ্ফোরন যাকে বিগ ব্যাং বলে তাতে স্পেস আর টাইম এই দুটিই তৈরী হয়েছিল। বিগ ব্যাংএর আগে কাল অর্থাৎ সময়ই ছিল না তাই আগে পরে প্রশ্নের মানে হয় না। ওনলি রিজনেবল কোয়েশ্চেনস হ্যাভ রিজনেবল আনসার। এই বিশ্বব্রম্ভান্ড সম্পূর্ণ আকস্মিক।
আমি এই বিশ্বব্রম্ভান্ডের অজ্ঞেয়তা আর আকস্মিকতাকে প্রণাম করি। ঈশ্বরকে নয়।
আমাকে এও মানতে হবে মানুষ বিধাতার সৃষ্ট কোন বিশেষ প্রাণী নয়। বংশধারা ধরে দু লাখ বছর পিছিয়ে গেলে আমার পূর্বপুরুষ ছিল বাঁদর। আরও পিছিয়ে গেলে জলের মধ্যে কিলবিল করা এককোষী অ্যামিবা। অতিদীর্ঘ বিবর্তন যা কিনা সামান্যই কোষের মধ্যস্থিত ডি এন এ সংকেত লেখার সামান্য হেরফের কিন্তু কল্পনাতীত সংখ্যক বার হয়ে চলা বুদ্ধিহীন কারণহীন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রিপিটিশন আর সেই হেরফেরের ফলে হওয়া একটু অন্যরকম ভাই বোনেদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস – এই অত্যাশ্চর্য সরল প্রক্রিয়াই মানুষের জন্মদাতা, কোন ঈশ্বর নয়।
ঈশ্বরের চেয়ে এই গায়ে কাঁটা দেওয়া তত্ব আমাকে বেশী অনুপ্রানিত করে। চার্লস ডারউইন আঠেরোশো উনষাট সালে ওরিজিন অফ স্পিসিস লিখে বিবর্তনবাদের তত্ব দিলেন আর তার চৌত্রিশ বছর বাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন ‘এ কি লাবন্যে পূর্ণ প্রান প্রানেশ হে’। আমার মনে হয় বিবর্তনই সেই প্রানেশ।
যে ঈশ্বর মূক, অনড়, উদাসীন, যে ঈশ্বর আমার দৈনন্দিন মানবিক ওঠাপড়ায় আমার কাজে লাগেন না, যে ঈশ্বর জীবনের যে মৃত্যুর পর বেশী প্রাসঙ্গিক তাকে দিয়ে আমার কি দরকার?
ধর্ম মানে তাই আমার এই আজীবন অনুসন্ধান করে ফেরা, দূর নক্ষত্রের দিকে চেয়ে অনুভব করা যে আমার এই দেহ অনু পরমানুতে ঐ নক্ষত্র পোড়া ছাই দিয়ে তৈরী, আমার মন আর আবেগ একটি পাঁচ পাউন্ডের স্নেহজাতীয় পদার্থের তালে মিশে থাকা এই ইউনিভার্সের সমস্ত অনুর মোট যোগফলের চেয়েও বেশীসংখ্যক নিউরন জালিকার কারসাজি। ধর্মের মানে আমার কাছে এই। আর এর জন্য আমি এই বিশ্বব্রম্ভান্ডের অজ্ঞেয়তা আর আকস্মিকতাকে প্রণাম করি। ঈশ্বরকে নয়।
[সমাপ্ত]