১
যারা বাংলাভাষাকে ভালোবাসেন আর এই ভাষাটির সঙ্গে নিজেকে আইডেনটিফাই করেন তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন এই ভাষাটি চিরকাল এইরকম ছিল না। ‘এইরকম’ কথাটি বিশেষ গোলমেলে কারণ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায় এবং আসামের কিছু অঞ্চলে মানুষ এইরকম বলতে তাঁদের স্থানীয় কথ্যরীতিটিকেই বোঝেন। স্থানভেদে লেখ্য বাংলারও কিছুটা রকমফের রয়েছে। স্বাধীনরাষ্ট্র বাংলাদেশের লেখ্য বাংলাতেও আমি স্বকীয়তা দেখতে পাই। এতৎসত্বেও কোথাও যেন বাঙ্গালীর ভাষায় একটি চোরা ঐকিকতার স্রোত রয়েছে যেটি দীর্ঘ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধার্মিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ধারায় পরিনত হয়েছে। এইরকম বলতে আমি তাকেই বোঝাচ্ছি। এ বিষয়ে অনেক গবেষণাপত্র ও প্রামান্য গ্রন্থাদি আছে। সেই গ্রন্থগুলি সুখপাঠ্য ও মনোগ্রাহী। কিন্তু আমি একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অবতারনা করব। সুধী সাবধান।
ভাষা বিবর্তনের ইতিহাস কে আলোচনার মধ্যে রাখার আগে বাঙ্গালীর, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীর একটি যুক্তিহীন ধারণাকে খন্ডাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ বাঙ্গালী আনন্দবাজার পত্রিকার লেখ্য বাংলাকে প্রামান্য মনে করেন। যাঁরা একটু সন্দিগ্ধ তাঁরা রাজশেখর বসুর চলন্তিকাকে অভিধান ধরেন, কেউ কেউ আরেকটু গভীরতর ভাবে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ বা ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহের বাঙ্গালা ব্যাকরণ ধরে বানান ও বাক্যরীতি মিলিয়ে নেন। কিন্তু ভাষা কেবল মাত্র ব্যাকরণে আবদ্ধ নয়, তার একটি প্রকাশরীতি আছে যা ভাষার মৌলিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় দেয়। এই মৌলিকতা এবং সংস্কৃতি ইতিহাস ও সমাজ নির্ভর; ফলে একটি বিশেষ ভৌগলিক স্থানের ভাষার উপর কোন বিশেষ অধিকার থাকা একটি অবাস্তব ধারণা।
বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে বিপুল সংখ্যক তৎসম শব্দের উপস্থিতির কারণে অনেকে সংস্কৃতকে বাংলাভাষার আদিরুপ বলে দাবী করেন। এও মনে করা হয় যে প্রাচীন ব্রাম্ভীলিপি থেকে পূর্বী ও পশ্চিমা লিপি (অবশ্যই ভারতীয় উপমহাদেশের) এবং বহির্ভারতীয় লিপির জন্ম হয়েছিল। পশ্চিমা লিপির অপভ্রংশ হিসাবে প্রথমে সিদ্ধমাতৃকা লিপি ও তার ধেকে নাগরী লিপির জন্ম হয়। এই নাগরীই বাংলার প্রত্নলিপি বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ হিন্দী ও বাংলা সহোদর ভাই আর সংস্কৃত তাদের জন্মদাত্রী। এই মতবাদটি জনপ্রিয় কিন্তু প্রশ্নাতীত নয়। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গবেষক ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মতবাদ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, দক্ষিণ পশ্চিম ভারতে পশ্চিমা ব্রাহ্মী অক্ষর থেকে যে লিপির জন্ম হয় তার নাম নাগরী লিপি। এই নাগরী লিপি কোন দিক থেকেই বাংলা অক্ষরের চেয়ে পুরাতন নয়। তবে উত্তরাপথের রাজবংশ পূর্ব ভারতে দীর্ঘকাল আধিপত্য করার ফলে এ দেশের পূর্বী লিপি (অর্থাৎ বাংলা) রাজকীয় প্রভাবে কিছু কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল এবং রাজভাষা ও রাজলিপি বাংলাদেশে পঞ্চম-সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেছিল। অবশ্য কোন দেশেই পরের লিপি দীর্ঘকাল দস্যুবৃত্তি করতে পারে না-পশ্চিমা নাগরী লিপিও পারেনি। খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমা লিপির স্থলে বাংলা অক্ষর আবার নিজস্ব স্থান করে নিল (ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত , পুনর্মুদ্রণ নতুন সংস্করণ, ২০০২, পৃ. ১২ দ্রষ্টব্য)।
সুতরাং বাংলা ভাষার কোন ভৌগলিক কেন্দ্রিকতাও নেই আর উত্তর পশ্চিম ভারতের আর্যভাষা সংস্কৃতকে এর উৎসমূল ভাবাও রীতিমত প্রশ্নযোগ্য, এমনকি তৎসম শব্দের আধিক্য সত্বেও। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবে একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সংস্কৃত ছিল বাংলার ভাবভাষা ( উদাহরণস্বরুপ লক্ষণসেনের তর্পণদিঘীর দানপত্র) তারপর ধীরে ধীরে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এই ভাষার ভাবপ্রকাশের মাধ্যম ক্রমশই অসংস্কৃত হয়ে পড়তে থাকে। বাংলায় মুসলীম শাসনের প্রভাবে ফারসী এই ভাবকেন্দ্রটি দখল করে নেয়। এরপর আশ্চর্যভাবে পর্তুগীজ ভাষাও বাংলা ভাষার প্রকাশরীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
পূর্ববঙ্গের লোক জলকে কেন পানি বলে এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রশ্ন উঠতে শুনি। বাংলাদেশের মানুষ একইভাবে ভেবে পায় না পশ্চিমবঙ্গের লোক পানিকে কেন জল বলে।
প্রথাগতভাবে যেকোন ভাষার বিবর্তিত রুপ বিচার করা হয় বিখ্যাত উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম থেকে। এই পদ্ধতিটি আমার যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক মনে হয় না। এই বিচারে দলিল দস্তাবেজ, চিঠি ও হিসাবপত্রে ব্যবহৃত সাধারন মানুষের ভাষার উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত বলে মনে হয়। আজ থেকে দুশোবছর পর কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে মনে করেন বাংলার মানুষ ‘দেখেছিলেম, করেছিলেম’ লিখত তাহলে প্রকান্ড ভুল হবে।
দেখা যাক দুশো বছর আগে সাধারণ মানুষের বাংলা কিরকম ছিল।
[সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি epub ফরম্যাটে পড়ার জন্যে এখানে ক্লিক করুন। epub আপনি মোবাইল ফোন, ট্যাব বা পার্সোনাল কম্পিউটারে সহজেই পড়তে পারবেন। মূল্য ২৫টাকা ]
epub কি ভাবে পড়বেন জানতে হলে দেখে নিন এখানে।

<<<<<< প্রবন্ধ সংকলনে ফিরুন