চুক্তি

কাচের ব্যালাসট্রেডের ওপারে সরু একটা প্রজেকশান। সেখান থেকে মাটি পাঁচশো ফুট নীচে। সেই সরু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে তার মনে হল সে এক্ষুনি পাখি হয়ে উড়ে যেতে পারে। হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো, টাই উড়ে গলায় জড়িয়েছে। সারা জীবনের স্মৃতি তার মনের মধ্যে চমকে উঠছে আর শরীরে বাড়ছে মাটিমুখো টান। দুরে ঝলমল করছে শহর, গাড়ি ঘোড়া পিঁপড়ের মত গড়িয়ে যাচ্ছে এদিক ওদিক। হঠাৎ পৃথিবী যেন দুলে উঠল, মাটি আকাশে আর আকাশ মাটিতে। সারা শরীর ভারহীন। ফ্রি ফল।

হাউস কিপিংএর লোকেরা যখন ছুটে এসে পাঁচিলের ধার থেকে নীচে দেখল, ততক্ষণে লোক জড়ো হয়েছে বহু নীচে। সবাই বৃত্তাকারে ঘিরে আছে তাকে। দুর থেকে ক্ষীণ অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ আসতে লাগল। খুব ক্ষীণ শব্দ, যেন কেউ কল্পনা করছে।

#######

শিলাদিত্য সেন পেশায় কনট্র্যাক্ট কিলার। এই পেশার একটা চলতি নাম আছে – সুপারি কিলার।শিলাদিত্য এই নামটাকে ঘেন্না করে। এই দেশি প্রতিশব্দগুলো যেকোন কিছুর ক্লাশ একেবারে নষ্ট করে দেয়। সুপারি কিলার বললে একটা গোদা, গুন্ডাটাইপ চেহারা মনে আসে – যার না আছে পেশাদারী দক্ষতা না কোন সূক্ষ বিবেচনা বোধ। এদের কাজ প্রায়শই কদর্য, এবং ব্যর্থ। শিলাদিত্য নিজেকে একেবারে ভিন্ন উচ্চতায় দেখে। তার বছর পঁয়ত্রিশের মেদহীন পেটানো অ্যাথলিট সুলভ চেহারা, চারটে ভাষা সে মাতৃভাষার মত বলতে পারে, গাড়ি চালানো ছাড়াও ছোট সেসনা গোছের হাওয়াই জাহাজ ওড়ানো তার শখ। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী তো বটেই, এমনকি একটা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ম্যানেজমেন্ট ডিপ্লোমা আছে তার। খেলাধুলোয় ছেলেবেলা থেকেই শিলাদিত্য সেন চৌখস, মাউন্টেনিয়ারিংএ তার বিশেষ আগ্রহ আছে। শিলাদিত্যর সেনসিবিলিটি নামে একটা স্টার্টআপ আছে, যেটা মাঝারি গোছের প্রতিষ্ঠান এবং বিতর্কিত সেলেব্রিটিদের সিকিউরিটি সলিউশন দিয়ে থাকে। এটা তার লেজিটিমেট বিজনেস, রীতিমত ইনকাম ট্যাক্স দেওয়া প্রতিষ্ঠান, যার দৌলতে তার বাড়ি গাড়ি আছে। কিন্তু সেই যে আঠেরো বছর বয়সে সে বেড়াতে গিয়ে তার ট্যুরপার্টির একজনকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে মেরেছিল, তখন থেকেই শিলাদিত্য বুঝেছে যে মানুষকে মৃত্যু দেওয়াই তার ভবিতব্য। এ জিনিস তার সহজাতভাবে আসে। পঁচিশ বছর পার করতে না করতেই চুক্তিমাফিক খুন করা তার পেশা।

তবে শুধু পয়সা দিলেই শিলাদিত্য সেন খুন করে না। এই কাজকে সে শিল্পীর মত দেখে, অসম্ভব ঝুঁকিপূর্ণ না হলে সে কাজ নেয় না, আর কাজের পর সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে ছায়ার মত মিলিয়ে যাবার নিখুঁত পরিকল্পনা হল তার ট্রেডমার্ক। এই তীক্ষ্ণ পেশাদারীত্বের জন্য শিলাদিত্য অনেক পয়সা নেয় বটে, কিন্তু সে পয়সার প্রতি অনুরক্ত নয় মোটেই। দশবছরের কর্মজীবনে শিলাদিত্য গোটা তিরিশেক কনট্র্যাক্ট নিয়েছে, তার সাকসেস রেট একশ শতাংশ। একটা কাজেও কোন পুলিশি ঝামেলা হয় নি, একটি কাজে সে ডবল টাকা নিয়েছিল, যাতে নিহত ব্যক্তির খুনের দায় আরেকজনের ঘাড়ে পড়ে তার সাজা হয়েছিল। বেশ কিছুক্ষেত্রে তার হাতে হওয়া খুনগুলি দুর্ঘটনার অতিরিক্ত বলে কিছু মনে হয়নি। গত বছর টলিউডের এক নামকরা হিরোইন আত্মহত্যা করায় কাগজে খবর হয়েছিল। এটা শিলাদিত্যর কাছে একটা মাস্টারপিস কাজ। একজন সিজোফ্রেনিককে স্রেফ কথা বলে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে কাজ শেষ করা কনট্র্যাক্ট কিলিংএর ইতিহাসে বিরল।

পেশাদার হিসেবে শিলাদিত্য সেন কখনো কোন কাজ হাতে নিয়ে পিছিয়ে আসেনি। সে মনে করে যাকে খুন করার জন্য চুক্তিবদ্ধ, তার নিয়তি নির্দিষ্ট। এটা তার শ্লাঘার বিষয়। মানুষকে পরিস্কার ও নিশ্চিত মৃত্যু দেওয়ার চেয়ে মহৎ ও আনন্দময় কাজ আর কিছু হতে পারে বলে সে বিশ্বাস করে না।

এই মুহুর্তে শিলাদিত্য সেন স্কাই লাউঞ্জ নামে কলকাতার এক রুফটপ প্রমেনাডে বসে আছে।জায়গাটা চল্লিশ তলার উপর একটা অতিকায় ছাত, যার একদিকে একটা কাচের জানলা ঘেরা রেস্তোরাঁ, আরেকদিকে ইনফিনিটি পুল আর স্পা। শিলাদিত্য বসেছে ওপেন এয়ার লাউঞ্জে, এখানে লোকে সিগারেট খেতে আসে। কিন্তু শীতের সন্ধেয় জায়গাটা জনবিরল। দুরে অনেক নিচে ঝলমল করছে কলকাতা শহর, ছাতের স্বচ্ছ কাচের পাঁচিলের মধ্য দিয়ে শহরটাকে অচেনা লাগে। শিলাদিত্য মনে মনে তার নতুন মক্কেলের পছন্দের তারিফ করল।

মক্কেল কে সে জানে না। তাতে সে বিচলিত নয়, তার পেশায় এটাই দস্তুর। এখানে কনট্র্যাক্ট হয় মুখে মুখে, অধিকাংশ সময় মক্কেলের এজেন্টের সঙ্গে। পুরো পয়সা আগাম নিয়ে সে কাজ করে। কাজের জন্য নির্ধারিত সময় থাকে, অনেক সময় মৃত্যুর ধরণের ফরমাশও থাকে। দুর্ঘটনা, সাজানো খুন বা দেহসমেত লোপাট। কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক এবং অত্যন্ত চড়া। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিকার স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক ভাবে মারা গেলেও পয়সা ফেরত নেই। শিলাদিত্য সেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। এক মক্কেলের কাজ সে দুবার করে না। এই মক্কেল তার আনলিস্টেড ফোনে যোগাযোগ করেছিল। যদিও শিলাদিত্য কৌতুহলী নয়, তবু নিতান্তই নিয়ম মাফিক জেনেছে ফোনটি ল্যান্ডলাইন, কলকাতার একটি বিখ্যাত হোটেলের লবি থেকে করা। এ হোটেলে সে প্রায়শই ওঠে। ফোনে তাকে মেশিন ভয়েসে কনফারেন্সের জায়গা আর সময় বলা হয়েছে। শিলাদিত্য সেন কব্জি উলটে হাতের কার্তিয়ের ঘড়ি দেখল। সময় হয়ে গেছে।

লোকটা হেঁটে এসে পাশের টেবিলের চেয়ারে উল্টোদিকে মুখ করে বসল। পরনে হুডি আর জিন্স, লোকটা প্রায় তার সমান লম্বা। শিলাদিত্যর ফোন বেজে উঠতে সে ফোন ধরে সহজ গলায় বলল, বলুন?

আমরা যে যেখানে আছি সেখানে বসেই কথা বলব। হুডি ফোনের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল। শিলাদিত্য কোথায় যেন এই স্বর শুনেছে। সে পেশাদারী নিস্পৃহ গলায় বলল, কাজটা বলুন।

আমি এই টেবলের উপর একটা খাম রাখব। তাতে ভিকটিমের পরিচয় ও ডিটেলস বলা আছে। কাজটা কত সময়ের মধ্যে হতে হবে সেটাও বলা আছে।

বেশ। আপনি সার্টেন আমার আর কোন ইনফরমেশান লাগবে না? আমি কিন্তু মক্কেলের সঙ্গে একবারই মিট করি।

সার্টেন।

বেশ। আমার রেমুনারেশান? সেটা তো ভিকটিম দেখে ঠিক হবে।

ক্যাশ?

অফকোর্স। এবং এখনই।

আপনি হায়েস্ট কত নিয়েছেন এখন পর্যন্ত?

এক কোটি।

হুডি একটা মোটা বইএর মত প্যাকেট টেবলের উপরে রাখল। এখানে দুকোটি টাকা আছে, দুহাজারের আনসিরিয়াল নোটে।

ব্লাইন্ড অফার? শিলাদিত্য বলল। কথা বলতে বলতে সে অনুভব করছে তার শরীরে একটা উত্তেজনা তৈরী হচ্ছে। প্রত্যেকবার কনট্র্যাক্ট নেওয়ার সময়ে তার এটা হয়।

ব্লাইন্ড অফার। টেক অর লিভ।

বেশ। নিলাম।

ধন্যবাদ। আমি বেরিয়ে গেলে প্যাকেটটা নেবেন। হুডি উঠে হেঁটে গিয়ে ছাতের কাচের ব্যালাসট্রেড ঘেঁসে ঝুঁকে বাইরেটা দেখল। তারপর লঘুপায়ে লিফ্টরুম ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অন্ধকার নেমে এসেছে। শিলাদিত্য সেন প্যাকেটটার দিকে চেয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গিয়ে প্যাকেটটা তুলে ভাল করে দেখল। প্যাকেটের এক কোনায় পরিচিত সেনসিবিলিটির লোগো। নখ দিয়ে প্যাকেট কাটতে দেখা গেল ভিতরে দশটা কুড়িলক্ষ টাকার বান্ডিল। আর একটা কাগজে কিছু লেখা। কাগজ তুলে ধরতে নীচের পৃথিবীর প্রতিবিচ্ছুরিত আলোয় লেখাগুলি পড়া যায়।

নাম : লাগবে না। দেখলেই চিনবেন।
ঠিকানা: লাগবে না। আপনি জানেন।
সিন : দুর্ঘটনা বা সুইসাইড।
সময় : এক ঘন্টা।

উত্তেজনায় শিলাদিত্য সেনের আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল। ছোট একটা খাম প্যাকেটের এককোনে পড়ে আছে। শিলাদিত্য সেন বুঝতে পারল, একটু আগে জীবনের সবচেয়ে কঠিন অথচ সবচেয়ে সহজ কনট্র্যাক্ট করেছে সে। কাঁপা কাঁপা আঙুলে শিলাদিত্য ছোট খাম খুলে পাসপোর্ট সাইজের ফটোর দিকে তাকাল।

<<<<<< অণুগল্প সিরিজে ফিরে যান

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!