কলা ও বিজ্ঞান

কলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে আমরা একটি বিরোধ দেখি। এই বিরোধ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অনেকে এই বিরোধকে একটি দন্দ্ব হিসেবে দেখেন আর একে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যে বিরোধ তার সঙ্গে তুলনীয় মনে করেন। এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ ভুল। ধর্ম মূলত একটি সামাজিক বিশ্বাস যাতে তথ্য প্রমানের প্রয়োজন নেই, বিজ্ঞানের ভিত্তি তথ্য প্রমানের উপর নির্ভরশীল। এই নিয়ে বিশ্বাসী আর মুক্তমনাদের একটি পুরোনো ঝগড়া আছে। কলার সঙ্গে বিজ্ঞানের এখন কোন সম্পর্কই নেই। মানুষ, যাদের মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী এবং কলাবিদ্ আছেন, মনে করে কলাচর্চা আর বিজ্ঞানচর্চা কেউ কারো কাজে আসে না। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) আর Artsএর মধ্যে একটি দুঃখজনক গন্ডি কেটে দেওয়া হয়েছে। এই বিভাজন সামাজিক compartmentalization তৈরী করে। একসময় শিল্পী ও কলাবিদরা বিজ্ঞানীদের ঝাড়ফুঁক করা ওঝার চেয়ে বেশী মর্যাদা দিতেন না, এখন বাপ মায়েরা ছেলে মেয়েদের STEM পড়াতে না পারলে দুঃখ পান।

কলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে এই বিভাজন সৃষ্টি করতে করতে আমরা ভুলে গেছি, দুটিই উদ্ভাবনমূলক জ্ঞান। আর এই উদ্ভাবনার মূলে আছে কল্পনা। যে কোন পেশাদার বিজ্ঞানীই জানেন যে আবিষ্কার আর সত্যসন্ধানের মূলে আছে গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা। এই অন্তর্দৃষ্টি আসলে মৌলিক কল্পনা। যা ভৌতিকভাবে দৃষ্টিগোচর নয় তাকে হৃদয়ংগম করার চাবিকাঠি হল কল্পনাশক্তি। মজার ব্যাপার হল, শিল্পকলায় এই কল্পনাশক্তিই হল চালিকাশক্তি। লিওনার্দো দ ভিঞ্চি এক প্রবাদপ্রতিম উদ্ভাবক ছিলেন। তিনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন না শিল্পী ছিলেন? নাকি দুইই ছিলেন?

গণিতের চেয়ে বেশি কাল্পনিক আর কিই বা হতে পারে? দুয়ে দুয়ে যে চার হবে সেটি একটি উৎকৃষ্ট কল্পনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। অথবা ধরুন দুটি সমান্তরাল রেখার ধারণা, যারা অসীম দূরত্বে গিয়ে মিলিত হবে। কিংবা এই প্রতিপাদ্য যে একের সঙ্গে আধ, তার সঙ্গে আধের আধ, তার সঙ্গে আধের আধের আধ এইভাবে অসংখ্যবার যোগ করে গেলে দুই পাওয়া যাবে। ভাবুন একবার! এক আর দুইএর মাঝখানে অসীম। অতি উৎকৃষ্ট কল্পনা কি না?

বস্তুতপক্ষে বিজ্ঞানীরা হরদম কলাশিল্পের কাছে হাত পাতছেন। কোয়ার্কগুলির নাম দেখুন, টপ বটম, স্ট্রেঞ্জ চার্ম আর আপ ডাউন। কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিক্সে তো রংয়ের ছড়াছড়ি, যেন দোল খেলছে সবাই। আসলে লড়াই নেই কোন। সমস্ত কৃতবিদ্য বিজ্ঞানীরা কলার কোন না কোন একটি শাখার গোপন বা প্রকাশ্য চর্চা করে গেছেন। শুধু শখে মনে হয় না। তাঁদের প্রয়োজন পড়েছিল।

কেমন প্রয়োজন? স্পেশাল রিলেটিভিটির তত্ত্ব আইনষ্টাইন যখন নির্মান করছিলেন তখন সময় কাল সন্ততি (space time continuum) কল্পনা করতে হয়েছিল কেননা ত্রিমাত্রিক ভৌতবিশ্বে মাথা কুটলেও চতুর্থমাত্রা সময়কে এঁকে দেখানো যাবে না। খাতার পাতায় ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিই যথেষ্ট জটিল, চতুর্থ মাত্রা তাহলে আঁকব কি করে। কল্পনায় আঁকব। ফর্মূলাবাদী মন দিয়ে বোঝা যাবেনা যে একটা বলকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে এক সেকেন্ডে আবার লুফে নিলে দুটি স্থানাঙ্কের মধ্যে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল স্পেস গলে যায়। খুব জোরালো কল্পনাশক্তি না থাকলে এও বোঝা মুশ্কিল যে যতবার আমরা রাতের আকাশে আলফা সেঞ্চুরির দিকে তাকাই আসলে আমরা টাইম ট্রাভেল করি। রোদের অমন যে বর্তমান আলো তাও আসলে আটমিনিট অতীতের ইতিহাস।

মানুষ যতই বিজ্ঞান আর কলাশিল্পের মধ্যে তফাত করুক, মূলে তফাত নেই কোন। কল্পনার একটি আধার হল স্মৃতি। এখন নিঃসন্দেহ হওয়া গেছে প্রতিটি দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিই আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর এক একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক। বিজ্ঞানীই বলুন আর শিল্পী সকলেই শেষপর্যন্ত সেই নেটওয়ার্কের সদস্য।

বেসিক সায়েন্সের পাঠ্যক্রমে অন্তত একটি কলার অধ্যয়ন জরুরী।

Loading

সবাইকে বলুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!