
শেয়ালদা আসতে তখনও পাঁচটা স্টেশন দেরী, পকেটমার ধরা পড়ল কম্পার্টমেন্টে। প্রথমে হৈ হৈ, তারপর রে রে আর শেষে কামরার মধ্যে প্রায় খন্ডযুদ্ধ বেধে যাবার উপক্রম। একটা কালো, রোগা মত ছেলে, ইতিমধ্যে তার শার্ট ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই, ত্রস্ত বিস্ফারিত চোখে চারদিকে তাকিয়ে বলে চলেছে, বিশ্বাস করুন আমি চোর নই, আর উত্তেজিত ডেলি প্যাসেঞ্জারের দল তাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারতে চাইছে। শ্যামলেন্দু কামরার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চোখে মুখে একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে ভাবলেন, দিল সকালটা মাটি করে।
শ্যামলেন্দু সরকার গত দশবছর এই লাইনে ট্রেন ধরে কলকাতা আসছেন। কিন্তু তিনি যাকে বলে হংসমধ্যে বকযথা। তবে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থে। তাঁর একটি গভীর অন্তর্মুখী মন আছে। এই ভিড়ের মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র। কলকাতার অফিসমুখী ভিড়ঠাসা, হকার অধ্যুষিত, টোয়েন্টিনাইন খেলুড়ে যাত্রীদের মধ্যে তিনি দশবছর ধরে আত্মগোপন করে আছেন। এই ক্লিন্যতা তাঁকে স্পর্শ করে না।তার মন জুড়ে থাকে দর্শন, বিজ্ঞান, মনস্তত্ব আর পৃথিবীর যাবতীয় অজানা অল্পজানা বিষয়। বাইরে থেকে দেখে এসব বোঝা অসম্ভব, তবে খুঁটিয়ে দেখলে শ্যামলেন্দু সরকারের মুখে একধরনের উদাসীন আত্মমগ্নতার ছায়া দেখা যায়, যাকে প্রায়শই লোকে অহংকার বলে ভুল করে। এই পকেটমার ছেলেটিকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। এ এখনও শিক্ষানবীশ। গত দুদিন ধরে সে এই কামরায় নবলব্ধ জ্ঞানের হাতেকলমে পরীক্ষা করছিল, তা শ্যামলেন্দুর চোখ এড়ায় নি। একবার তার মনে হয়েছিল ছেলেটাকে ডেকে দুচার কথা বলেন। পকেটমারির মূল বিষয়টা হল মানুষকে অন্যমনস্ক করা। যেহেতু তিনি নিজে মনস্তত্ববিদ, যেহেতু তাঁর অন্যতম শখ হল ম্যাজিক, তিনি জানেন একে বলে মিসডিরেকশান। মানুষের মস্তিস্ক একসঙ্গে একাধিক জিনিষের উপর মনোযোগ রাখতে পারে না, ম্যাজিশিয়ানরা এই দুর্বলতার খবর রাখে, তারা মনোযোগ অন্যদিকে চালিত করে মানুষের সামনে থেকে জিনিষ ভ্যানিশ করে দেয়। পকেটমারির সঙ্গে এই ম্যাজিকের মিল আছে।শ্যামলেন্দু ভয় পেয়েছিলেন, আনাড়ি ছেলেটা ধরা পড়ে যাবে। আশঙ্কা সত্যে পরিনত হল।
মুখ ঘুরিয়ে শ্যামলেন্দু সরকার বাইরের ক্রমসঞ্চারমান পৃথিবী দেখতে লাগলেন। মারপিট, রক্তারক্তি, হিংস্রতা তাঁকে দীর্ণ করে। গণধোলাই মোটেও খুব দৃষ্টিসুখকর ব্যাপার নয়। পরের স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই টেনে হিঁচড়ে ছেলেটাকে প্ল্যাটফর্মে নামানো হল। হুড়মুড় করে কিছু লোক নামল স্টেশনে, যা নামল তার ডবল লোক উঠে পড়ে উর্দ্ধবাহু হয়ে হ্যান্ডেল ধরতে লাগল। কামরা থেকে উড়ে আসতে লাগল পকেটমার ছেলেটার উদ্দেশ্যে টুকরো টাকরা পরামর্শ।
ছাড়বেন না মশাই। আরপিএফের হাতে দিন।
দেখে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। কি মাল! ব্যাগটা প্রায় বের করে নিয়েছিল!
মারবেন না, মারবেন না। আইন নিজের হাতে নেবেন না। পুলিশে দিন।
দাদা, ব্যাগটা কার?
ট্রেন নড়ে উঠতেই একটি সুদর্শন যুবক কামরায় উঠে শ্যামলেন্দুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, পকেটমার?
বলছে তো। নিস্পৃহভাবে বললেন শ্যামলেন্দু সরকার। ছেলেটি নিজের বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে প্যান্টের পকেটে রেখে শ্যামলেন্দুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে চাইল। তারপর বলল, বলছে মানে? এমনিই সন্দেহের বশে ঠাঙাচ্ছে?
ট্রেনের গতি বাড়ছে। শ্যামলেন্দু বাইরের রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে বললেন, হতেই পারে। কে আর প্রমাণ খুঁজতে যাচ্ছে?
এ লাইনে খুব পকেটমারের উপদ্রব। সুদর্শন ছেলেটি প্যান্টের পকেট চেপে ধরে বলল।
তাই? আমি দশবছর এই ট্রেনে আসা যাওয়া করছি, কই আমার তো পকেটমার হয় নি? মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন শ্যামলেন্দু।
আপনি লাকি।
না। একটু সজাগ থাকলেই পকেটমারি এড়ানো যায়।
ছেলেটি হাসতে লাগল। আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন কি করে সজাগ থাকতে হয় এই ট্রেনের কামরায়।
শ্যামলেন্দু ছেলেটিকে দেখতে লাগলেন। চশমাপরা বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ। ফরমাল শার্ট প্যান্ট পরে আছে, কাঁধে লেদারের ব্যাগ। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি মনে হয় না। হয় প্রাইভেট ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ নতুবা আইটির লোক। সহজ সপ্রতিভ। শ্যামলেন্দুর ছেলেটিকে ভালো লেগে গেল।
কোন ব্যাংকে আছো তুমি? তুমি বলছি। সহজ গলায় বললেন শ্যামলেন্দু।
বন্ধন ব্যাংক। আপনি কি আমাদের কাস্টমার?
না।
তাহলে বুঝলেন কি করে? ছেলেটা অবাক গলায় বলল। শ্যামলেন্দু মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। একে কোল্ড রিডিং বলে। তিনি সম্পূর্ণ আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছেন। না লাগলে তিনি বলতেন, ও তোমাকে যেন কোথায় দেখেছি। জ্যোতিষীরা এ জিনিষ হামেশাই করে। খুব সাধারণ কথা এমন ভাবে বলে যেন মনে হয় অন্তর্যামী। আপনার ছোটবেলায় ক্রিটিক্যাল শরীর খারাপ হয়েছিল তো? শতকরা আশিভাগ ক্ষেত্রে মিলবেই। ছোটবেলায় কার না শরীর খারাপ হয়? আর সবাই মা বাবার থেকে শোনে সে হয়তো মরেই যেতে পারত। তিনি বললেন, সজাগ থাকলে বোঝা যায়। যেমন বোঝা যায় কে পকেটমার।
ছেলেটা অবাক হয়ে শ্যামলেন্দুকে দেখছিল। বাবা আপনি তো গুণী লোক কাকু। বলল সে। তারপর একটু ভেবে বলল, ঐ ছেলেটা সত্যি পকেটমার?
হ্যাঁ। তবে অ্যাপ্রেন্টিস।
কি করে বুঝলেন? সজাগ বলে?
ঠিক তাই। আমরা যথেষ্ট সজাগ থাকিনা বলে অনেক জিনিষ আমাদের চোখেই পড়ে না।
যেমন?
তোমার জুতোটা কতদিনের? ছেলেটার পায়ের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন শ্যামলেন্দু। ছেলেটার পায়ে লেদারের লেস লাগানো জুতো।
ছমাস পরছি। কেন?
নিজেই পর তো?
কে পরিয়ে দেবে? কিন্তু কেন বলুন তো কাকু?
অথচ তুমি জানোনা জুতোটাতে কটা লেসের ফুটো আছে। জান কি?
বিস্ময়ে ছেলেটার মুখ হাঁ হয়ে গেল।
শ্যামলেন্দু বলতে লাগলেন, আমাদের মস্তিস্ককে আমরা যতটা দক্ষ বলে ভাবি, সে মোটেই তা নয়। খুবই সফিস্টিকেটেড অরগ্যান, কিন্তু ওভাররেটেড। পাঁচ পাউন্ড ওজনের ফ্যাটের দলা, মোটের ওপর দশ ওয়াট পাওয়ারে চলে। অথচ দেখ তাকে সারা দুনিয়া সামলাতে হয়। অজস্র ইনফরমেশান, ইমোশান, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালানো আর একটি সেল্ফ বা আমি তৈরী করে মস্তিস্কের মালিককে ভুলিয়ে রাখা। এই পাওয়ারে অত কাজ! ফলে আমাদের মাথা স্রেফ আন্দাজের উপর কাজ চালিয়ে যায়, আমরা মনে করি, ওঃ কতই না ভেবেচিন্তে সব বুঝছি।
ছেলেটা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছিল সব। কথায় কথায় আরও গোটাদুয়েক স্টেশন বেরিয়ে গেল। শেয়ালদা এসে পড়বে এবার।
যারা এটা বোঝে তারা মস্তিস্কের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। জ্যোতিষীরা এইভাবে ভবিষ্যৎ বলে, সিয়ান্সরা প্রেতাত্মার সঙ্গে কথা বলে, ম্যাজিসিয়ান স্লাইট অফ হ্যান্ড করে ম্যাজিক দেখায়। সবই অ্যাটেনশান আর মিসডিরেকশানের খেলা। তুমি ডেরেন ব্রাউনের নাম শুনেছ?
ছেলেটা মাথা নেড়ে না বলল। শ্যামলেন্দু বলতে লাগলেন, বিখ্যাত ব্রিটিশ কনজ্যুরার। সাবলিমিনাল মেসেজ দিয়ে সে মানুষকে নিজের ঠিক করে রাখা কথা বলিয়ে নিতে পারে। মিসডিরেক্ট করে কাগজের টুকরোকে টাকা বলে চালিয়ে দোকান থেকে জিনিষ কিনে আনতে পারে। এগুলো সম্ভব হয় কারণ মানুষ সজাগ নয়। তার মন অরক্ষিত। পকেটমার ঠেঙিয়ে কি লাভ বলো যদি তোমার হুঁশই না থাকে?
ট্রেনটা শেয়ালদা স্টেশনে ঢুকতে লাগল। স্টেশনে সম্ভবত আরও কোন শহরতলীর ট্রেন এসেছে, চারদিকে থিকথিক করছে লোক। ছেলেটা অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে চেয়ে বলল, এভাবে সত্যিই কখনো ভাবিনি কাকু।
শ্যামলেন্দু সরকার হাসতে হাসতে বললেন, থ্যাংক ইয়ু। বেশ কেটে গেল তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে।
হুঁ। কাকু?
বলো।
আপনার বুকপকেটে একটা দুহাজার টাকার নোট না? পাতলা জামা বলে দেখা যাচ্ছে।
শ্যামলেন্দু জোরে হাসতে লাগলেন। বাঃ! তুমি সজাগ হওয়া প্র্যাকটিস করছ দেখছি।
ছেলেটা সলজ্জভাবে হেসে বলল, আরে না। পকেটমার মেরে দিতে পারে। সাবধান থাকবেন।
তাই? আমার বুকপকেট থেকে মেরে দেবে? শ্যামলেন্দু সরকার ভ্রু নাচিয়ে বললেন।
দিতে পারে কাকু। সাবধানের মার নেই।
কিন্তু কি করে?
ধরুন এইভাবে তুলে নিল। ছেলেটা হাসি মুখে শ্যামলেন্দুর শার্টের বুকপকেট থেকে ভাঁজকরা দুহাজার টাকার নোট দুআঙুলে তুলে নিয়ে হাসল।
শ্যামলেন্দু মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললেন। বেশ। তারপর?
তারপর ধরুন নেমেই গেল স্টেশনে। এইবলে ছেলেটা একেবারে গতি কমে আসা ট্রেন থেকে টুক করে নেমে গেল।
শ্যামলেন্দু সরকার এরপরও মিনিটখানেক হাসলেন। তারপর খেয়াল করলেন শেয়ালদা স্টেশনের জনস্রোতের মধ্যে ছেলেটি উধাও হয়ে গেছে। তিনি স্তম্ভিতভাবে জামার বুকপকেটে হাত বোলাতে লাগলেন।
ম্যাজিক।
মিসডিরেকশান।
<<<<<< অণুগল্প সিরিজে ফিরে যান