সুনীল সামন্তর নেশা বলতে ঐ একটাই। মালিশ। প্রতিদিন লোক ডাকিয়ে আচ্ছাসে দলাই মলাই না করালে তাঁর মেজাজ ভয়ানক খিঁচড়ে যায়। আর সে যেমন তেমন ম্যাসাজ নয়, রোজ সকালে ঝাড়া দুটি ঘন্টা দলাইমলাই না নিলে তাঁর গা গতর টাটিয়ে ওঠে, মাথা গুড়ের হাঁড়ির মত ভারি হয়ে যায়, ঘন ঘন হাই উঠতে থাকে, এমনকি চোখ নাক দিয়ে জলও পড়ে। সে সময় তাঁর সামনে কেউ পড়লে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কান্ড। গালমন্দ করে তিনি তার ভুত ভাগাবেন। মারধোর খাওয়াও বিচিত্র নয়। শোনা যায় একবার কি কারণে যেন টানা দু তিন দিন মালিশওলা আসে নি, সামন্ত মশাই এমনিতেই মাত মাত করছিলেন; সেই সময় তাঁর মুড না বুঝে বিহারী চাকর রামবিরিখ গড়গড়া সেজে দিতে গেছিল। সুনীল সামন্ত হাউ হাউ করে হাই তুলতে তুলতে চোখের জল ফেলছিলেন তখন। রামবিরিখ ভাবল এখন বাবুকে দুটো মিষ্টি কথা বলে দশটা টাকা বকশিস বাগানো যাবে। সে খুব ভক্তিভরে বাঁহাতে ডানহাতের কনুই ধরে গড়গড়ার নল মনিবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, রামজি কি মায়া, কহি ধূপ কহি সায়া। কাঁদে না বাবুজি কাঁদে না, লিন প্রেমসে তামাক খায়েন। ব্যস, আর যায় কোথায়? সামন্তমশাই লাফিয়ে উঠে, ‘কি বললি রে পাঁঠা’ বলে গড়গড়াটার নল তুলে রামবিরিখকে চাবকাতে লাগলেন আর জ্বলন্ত কলকে ছিটকে সোজা রামবিরিখের ফতুয়ার মধ্যে ঢুকে গেল। রামবিরিখ তখন ‘উরেঃ শ্বশুরা রে, জ্বলা দিয়া রে, মার দিয়া রে’ ইত্যাদি বলতে বলতে ছুটে হাওড়া স্টেশন চলে গেল। লোকে কথা বাড়িয়ে টাড়িয়ে একতাল করে, তারা বলল রামবিরিখ নাকি সেখান থেকে টিকিট কেটে সোজা ছাপরায় ওর বাড়ি চলে গেছিল। সত্যি মিথ্যে জানা নেই তবে সেই যে রামবিরিখ গেল, আর কোনোদিন ফিরে এল না।
অথচ এমনিতে সামন্ত মশাই কিন্তু ভারী ভালো লোক। কাঠের ব্যবসা করে পয়সা করেছেন অনেক, পাড়ার মধ্যিখানে তাঁর প্রাসাদের মত বাড়ি। দানধ্যান করেন নিয়মিত – এলাকার দু তিনটে ক্লাব তাঁকে সভাপতি করেছে। একসময় যখন বছর বছর বন্যা হত তখন তিনি এত কম্বল দান করেছিলেন যে লোকে তাঁর নাম দিয়েছিল কম্বল সামন্ত। হৃষ্টপুষ্ট লোকটি কোঁচানো ধূতি আর আদ্দির পাঞ্জাবী পরে হাতে ছড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে গাড়ি চেপে তাঁর কাঠচেরাইএর কারখানা দেখতে যান। পাড়ার লোক সামনে পড়লে একগাল হেসে হাত তুলে নমস্কার করেন। তখন দেখলে কে বলবে মালিশ না হলে তিনি অমন বেয়াড়া আচরণ করেন?
সুনীল সামন্তের স্ত্রী বহুদিন হল স্বর্গে গেছেন। মা মরা একটি মেয়ে ছিল, তারও বিয়ে দিয়েছেন, তা বছর দশেক তো হবেই। ফলে আপন বলতে দুনিয়ায় তাঁর তেমন কেউ নেই। থাকার মধ্যে আছে রাঁধুনী পাতিরাম আর দিলীপ নামে দুর সম্পর্কের এক ভাগনা। দিলীপ সামন্ত মশাইএর বাজারহাট করে, কাজের লোকদের মায়নাপত্র দেয় আর বিভিন্ন মালিশওলাদের ডেকে টেকে আনে। মানে সে হল সুনীল সামন্তর বাজার সরকার কাম প্রাইভেট সেক্রেটারি। মাস মায়না আর মামাবাবুর বাজার থেকে পয়সা টয়সা সরিয়ে দিলীপের ভালোই চলে যাচ্ছিল। কিন্তু ইদানিং সে একটা বিচ্ছিরি ঝামেলায় পড়েছে। পাড়ার সেলুনগুলোয় আগে যে সব নাপিতরা মালিশআলার কাজ করত, তারা হালে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। বেশিরভাগ সেলুনেই এখন চ্যাংড়া ছেলেপুলে চুল দাড়ি কাটে। তারা চেয়ারে বসা কাস্টমারদের বড়জোর একটু থাবড়ে টাবড়ে দিতে পারে, কিন্তু সামন্তমশাইকে ম্যানেজ করা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। অথচ রোজ সকালে মামাবাবুর ম্যাসাজ চাই-ই চাই আর মালিশওলা ধরে না আনলে তিনি ভয়ংকর লাফালাফি জুড়বেন। মরিয়া হয়ে দিলীপ নকল ফিজিওথেরাপিস্ট ধরে এনে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছিল। কিন্তু তাদেরও দুজনের অলরেডি চাকরি গেছে। এখন যে ফিজিও বহাল আছে তার নাম বাবুলাল। ছোটখাটো চেহারার রাম সেয়ানা এই লোকটার উপর দিলীপ খুব আশা করেছিল। বাবুলাল এককালে নাপিতই ছিল, কিন্তু তার মালিশের হাত ভালো বলে জাত ব্যবসা ছেড়ে কি একটা নাকি সার্টিফিকেট কোর্স করে কার্ড ছাপিয়ে ফিজিওথেরাপিস্ট হয়ে গেছে। তার হাত আর মুখ সমান চলে। প্রথম কদিন সে ভালোই চালাচ্ছিল কিন্তু গতকাল যা কান্ড হল তাতে তার চাকরি পাকা হবার আশার বারোটা বেজে গেছে। বাবুলাল ভেগে গেলে তল্লাটে আর মালিশওলা জুটবে না। দুচার দিন ম্যাসাজ বন্ধ থাকলে সামন্তমশাই কি করবেন কল্পনা করে দিলীপের কান্না পেতে লাগল।
ঠিকই চলছিল সব। বিকালবেলা বেশ ফুরফুরে বাতাস ছেড়েছিল। সুনীল সামন্ত তাঁর শেড লাগানো ছাদে উপুড় হয়ে শুয়ে বাবুলালের কাছে ম্যাসাজ নিচ্ছিলেন। দিলীপ সামন্তমশাইএর পায়ের কাছে বসে পরেরদিনের বাজারের লিস্টি অ্যাপ্রুভ করাচ্ছিল।
কাক্কালকে গোগ্গোটা কাৎলা মাম্মাছ আনবে তিত্তিনকিলোটাক। বলছিলেন সুনীল সামন্ত। তক্তপোষের কিনারে তাঁর থুতনি, শেবনেত্র হয়ে আছেন আর বাবুলাল তার পিঠে দুহাত জড়ো করে তকাতকাতকাতক শব্দে ভাইব্রেশান চাপাটি মারছে। এতে সামন্তমশাইএর সারা শরীরে কাঁপুনি হচ্ছে। তার মধ্যেই অর্ধনীমিলিত চোখে তিনি অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন।
লিলিখ্লে? বললেন তিনি।
– হ্যাঁ মামাবাবু। আর কি বলুন।
– পপ্পটোল নেবে। মাছের ঝোলে দেদ্দেবে। আর বব্বড়ি।
– ঠিক আছে। একটু মোচা নিই নাকি?
– নাও। তাহলে কিক্কিসমিস।
বাবুলাল এবার দুহাতে প্রবল চটাস চটাস আওয়াজ করে সামন্তমশাইএর শিরদাঁড়া বরাবর থাবড়া মালিশ শুরু করল। প্রায় আধঘন্টা ধরে কসরত চলছে তার, জামা ঘামে ভিজে গায়ে লেপ্টে গেছে বাবুলালের।
লাল লাল চোখ করে সামন্ত মশাই বললেন, সাবু খেয়েছ নাকি?
দিলীপ ফর্দতে সাবু লিখে মাথা চুলকে টুলকে বলল, সে কোন ছোটবেলায় খেয়েছি। কতটা নেব? পায়েস হবে তো?
সামন্তমশাই চিরতা খাওয়ার মত মুখ করে বললেন, তোমাকে না, বাবুলালকে বলছি।
বাবুলাল কনফিউসড হয়ে দুহাতের তালুর গোড়া দিয়ে তবলার ডাঁয়া ঠোকার মত করে সুনীল সামন্তর পিঠের দাপনা ঠুকতে ঠুকতে বলল, আস্তে আস্তে ইনটেনসিটি বাড়াতে হয় স্যার। এ হচ্ছে পেক্টোরালিস, খুব ডেলিকেট জায়গা বুঝলেন না!
দিলীপ কিছু বলবার আগেই সুনীল সামন্ত মাথাটা একটু তুলে বললেন, পেক্টোক্লিসের নিকুচি করেছে। গাঁটগুলো ছাড়াও দেখি। সব গিঁট পড়ে আছে। অমন ফুল তুললে কিছু হবে না। জোরসে!
বাবুলাল মুখের ঘাম গামছা দিয়ে মুছে ফের সামন্তমশাইএর পিঠে হামলে পড়ল। সুনীল সামন্তর কমসে কমসে শখানেক কেজি ওজন, বাবুলাল তুলনায় সিড়িঙ্গেমার্কা। সে খালি সামন্ত মশাইএর পিঠে চড়ে বসতে বাকি রেখেছে। এবার দুহাতের আঙুল দিয়ে আকুপাংচার মালিশ দিতে দিতে সে বলল, ম্যাসাজ মানেই জোরের ব্যাপার নয় স্যার। আমাদের শরীরে সাতশো সাতান্নটা প্রেশার পয়েন্ট আছে। সেগুলো সব জাগিয়ে তুলতে হবে।
সামন্তমশাই আচমকা খ্যাঁক খ্যাঁক গ্যাঁক গ্যাঁক করে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে তিনি বলতে লাগলেন, হেঃ হেঃ হেঃ কাঃতুঃকুঃতুঃ লাগছেঃ রেঃ! বাবুলাল এতে আরও ঘাবড়ে গিয়ে দুহাত মুঠো করে দমদমা মালিশ শুরু করে দিল। দিলীপ বহুদিন ধরে মালিশআলাদের স্টাডি করেছে, তার এবার সন্দেহ হতে লাগল, বাবুলালের ফিজিওথেরাপির বিদ্যে কম পড়ে যাচ্ছে। সুনীল সামন্ত বছরের পর বছর ম্যাসাজ নিতে নিতে শরীরের সব মাসলের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন, কোন মালিশওলাই এখন তাকে দুচারদিনের বেশি সন্তুষ্ট করতে পারে না। আর বাবুলালের সার্টিফিকেট কোর্সে এমন বেয়াড়া পেশেন্টের চিকিচ্ছেও শেখানো হয় বলে মনে হয় না। বাজারের লিস্টি হাতে নিয়ে দিলীপ প্রমাদ গুনছিল, এমন সময় ‘হোয়াও’ বলে আওয়াজ করে সুনীল সামন্ত এক ঝটকা মেরে উঠে বসলেন আর বাবুলাল ঘরের এককোনায় ছিটকে পড়ে চোখ গোল গোল করে বলল, যাঃ তারা!
এ জিনিস দিলীপ অতীতে বহুবার দেখেছে। চিত্রনাট্য একটু পাল্টে পাল্টে যায়, এন্ডিং একই থাকে। নিরাপত্তার খাতিরে দিলীপ ছাতের এই শেড থেকে ছাতা, টুল, ফুলের টব সব সরিয়ে ফেলেছে। শেষ গেছে জলের কুঁজো, যেটা সামন্তমশাই তুলেছিলেন আগের মালিশওলা জনার্দনের মাথায় ভাঙ্গবেন বলে। জনার্দন সিঁড়িঘরের মাথায় জলের ট্যাঙ্কির উপরে চড়ে আধঘন্টা বসেছিল। দিলীপ বুঝল পরিস্থিতি ঘোরালো হতে যাচ্ছে। হুড়মুড় করে ফর্দ ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে সে জনগনমন অধিনায়ক গাইতে লাগল।
সুনীল সামন্ত প্রচন্ড দেশপ্রেমিক লোক। তিনি হাফপ্যান্ট ভুঁড়ির উপর টেনে তুলতে তুলতে টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, পাঞ্জাবো সিন্ধু গুজরাটো মারাঠা। কাতুকুতু দিলি কেন রে উজবুক!
দিলীপ প্রাণপনে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে বাবুলালের দিকে তাকিয়ে চোখ মারতে লাগল। চোখ মারে আর সিঁড়ির দিকে দেখায়। সামন্তমশাই তখন বিড়বিড় করে বলছেন, সাত দিন ধরে মালিশ করছি বলে গায়ে হাত বোলাচ্ছিস হতভাগা, তবো শুভো নামে জাগে তবো শুভো – চটি জোড়া কোথায় গেল? এই বলে তিনি নিচু হয়ে চটি খুঁজতে লাগলেন। দিলীপ মরিয়া হয়ে বাবুলালের নড়া ধরে সিঁড়ির দরজার দিকে টানতে লাগল।
কথায় আছে অতি চালাকের গলায় দড়ি। এই পরিস্থিতিতে আগের সব মালিশওলা সটান চম্পট মেরেছে। কিন্তু বাবুলাল অতিচালাক তো বটেই, তার উপর ফিজিওথেরাপিস্ট হয়ে তার ডাক্তার ডাক্তার ভাব হয়েছে। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলতে লাগল, ম্যাসাজের মধ্যে এমন তড়াক করে লাফালেন স্যার, আপনার তো লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাবে। চলুন চলুন শুয়ে পড়ুন। এই বলে সে সুনীল সামন্তর ভুঁড়িতে হাত দিয়ে আলতো করে ঠেলা দিল।
আর যায় কোথায়! সামন্ত মশাই ‘তবে রে বাঁদর’ বলে ভারী সোলের চামড়ার চটি তুলে বাবুলালের মাথা লক্ষ্য করে মোক্ষম একটি চাঁটি হাঁকালেন। সে কোনক্রমে সেই আঘাত ঠেকিয়ে লাফ দিয়ে সিঁড়ি ঘরের দরজায় সামনে গিয়ে পড়ে বলল, করেন কি স্যার? আপনার কি মাথায় রক্ত চড়ে গেল নাকি? দিলীপ মূকাভিনয় করে বলতে লাগল, পালাও পালাও আর সুনীল সামন্ত দুচোখের জল মুছতে মুছতে ছাতে কাপড় শুকোনোর জন্য দড়ি খাটানো বাঁশ ধরে টানাটানি করতে করতে হিংস্র গলায় বলতে লাগলেন, রক্ত? মাথা? দাঁড়া তোর মাথা ফাটিয়ে রক্ত বার করছি। এরপরে কি আর রিস্ক নেওয়া যায়? বাবুলাল টপাৎ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে পালাল। দিলীপও সিঁড়িঘরের দরজা টেনে শিকল তুলে দুদ্দাড় করে সোজা নিচে নেমে এল।
নিচের প্যাসেজে পৌঁছে বাবুলাল হাঁপাচ্ছিল। দিলীপ এসে পৌঁছতে সে বলল, স্যারের কি মিরগীরোগ আছে নাকি? আগে বলবেন তো!
দিলীপের তখনও বুক ধড়ফড় করছে, সে দম নিতে নিতে বলল, মালিশ ঠিকমত না হলে মামাবাবু একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েন আর কি! ও কিছু না।
বাবুলাল চোখ কুঁচকে উপরে ছাতের আলসের দিকে তাকিয়েছিল। সে বলল, নিচে নেমে এসে তাড়া করবেন কি?
শিকল তুলে দিয়ে এসেছি। এখানে আমরা সেফ। দিলীপ শ্বাস ফেলে বলল।
যেই না এই কথা বলা অমনি ছাতের উপর থেকে একটা গর্জন শোনা গেল আর একটা প্রমান সাইজের বাঁশের ঘরাঞ্চি দুম করে নিচে এসে পড়ল।
বাবুলাল ঘাড় নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে, দিলীপ মরিয়ার মত বলল, বিকেলেই মেজাজ ঠিক হয়ে যাবেখন, তখন ক্ষমা চাইবেন। তুমি একটা দিন গ্যাপ দিয়ে আবার এসো ভাইটি, কেমন?
বাবুলাল দিলীপকে আগাপাস্তলা দেখতে দেখতে বলে গেল, লাইফ রিস্ক আছে। জীবনবিমা করে আসতে হবে।
বেজায় মনখারাপ করে দিলীপ ভাবছিল কি করা উচিত এখন। যথারীতি সুনীল সামন্ত বিকেলবেলাতেই গলে জল। তিনি কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, টেম্পার লুস করে ফেলেছিলাম ভাগনা। ভুল হয়ে গেছে। বাবুলাল কি আর আসবে না?
– কি করে আসবে মামাবাবু? আপনি অতবড় মইটা ফেললেন তিনতলা থেকে। বাবুলালের মাথায় পড়ল।
– সর্বনাশ! মাথা টাথা ফাটেনি তো?
– ফাটেনি, তবে মাথায় শাঁকালু হয়েছে।
– হায় হায়। এখন কি হবে?
– পাড়ার ছেলেরা সামলে দেবে মনে হয়। কিন্তু বাবুলালের আসার আর চান্স নেই।
– সে তো বটেই, সে তো বটেই। যার মাথায় মই পড়েছে সে আর কি করে আসবে? এই নাও ভাগনা পাঁচশো টাকা। বাবুলালকে দিও। আর নতুন মালিশওলা দেখ।
নিমপাতা খাওয়ার মত মুখ করে বসে দিলীপ ভাবতে লাগল এই খেলা চলছে এক বছর ধরে। লোকাল মালিশওলারা এখন দিলীপকে দুর থেকে দেখে গলি ধরে কেটে পড়ে। সামন্ত মশাইএর খ্যাতি পাড়া ছাড়িয়ে আশে পাশের পাড়াতেও ছড়িয়েছে। এখন কোথা থেকে সে নতুন লোক ধরে আনে?
গত্যন্তর না দেখে দিলীপ ফের বাবুলালকেই গিয়ে ধরল। তুমি না পারো অন্তত একটা লোক দাও ভাই। দুদিন মালিশ না হলে তো দক্ষযজ্ঞ বেধে যাবে। কাতর গলায় বলল সে।
বাবুলাল মোটেই উত্তেজিত না হয়ে বলল, না না আমার দ্বারা ঠিক হচ্ছিল না। স্যারের আর কি দোষ।
দিলীপ হাঁ হয়ে গেল। বাবুলাল যে এত উদার তা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। হাতে চাঁদ পাওয়ার মত সে বলতে লাগল, আসলে মানুষটা ভাল বুঝলে! একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
বাবুলাল উদাস ভাবে বলল, সে তো ঠিক কথা। তবে কিনা আমার ম্যাসাজ ওনাকে স্যুট করছে না।
– তাহলে উপায়?
– উপায় একটা আছে।
– কি?
– আমি অন্য লোকের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
– সারা জীবন তোমার কথা মনে রাখব ভাই। তোমার সিনিয়র?
– সিনিয়র? হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমার গুরুও বলতে পারেন।
– সে তো দারুন ব্যাপার। ফিজ কি নেবেন?
– ঐ আমাকে যা দিতেন তাই দেবেন।
– তাহলে উনিই রেগুলার আসবেন, তাই তো?
– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আগে দেখুন কেমন ম্যাসাজ করেন।
পরের দিন সকাল নটায় বাবুলালের গুরু এসে উপস্থিত হলেন। ছফুট লম্বা, মাথায় বাবরি চুল আর পালোয়ানের মত চেহারা গুরুদেবের। তিনি হাজির হয়ে হাসি হাসি মুখে দিলীপকে বললেন, পরনাম। আপনি সুনীলজি আছেন?
– নেহি। সুনীলজি আমার মামা আছেন। আপনি কৌন হ্যায়?
– আমি বাবুলালকা মাস্টারজি আছি। ঠক্কন ঝা। ঘর ছাপরা জিলা।
– আপনি কি ম্যাসাজ কে লিয়ে আয়া হ্যায়?
– জি হাঁ।
ছাতে গুটিগুটি পায়ে এসে সুনীল সামন্ত হাত কচলে বললেন, বাবুলালের সঙ্গে রাগারাগি হয়ে আমি খুবই অনুতপ্ত। তুমি, মানে আপনিই কি মালিশ করবেন?
ঠক্কন ঝা ঝপ করে সামন্ত মশাইকে প্রণাম করে বলল, হাঁ মহারাজ। আপনার কি তকলিফ হল বলেন।
– তকলিফ? ও মানে কি প্রব্লেম তাই তো? আমার খুব গা ম্যাজম্যাজ করে।
– বদন দুখে?
– খুব দুখে। দুঃখের চোটে টাটিয়ে থাকে।
– কবসে মালিশ লিচ্ছেন?
– অনেকদিন। বছর তিন চার ধরে।
– জি সমঝা। কুর্তা খুলেন।
সামন্ত মশাই সুবোধ বালকের মত জামাটামা খুলে হাফপ্যান্ট বাগিয়ে তক্তপোশে শুয়ে পড়লেন। ঠক্কন ঝাও ধুতি ফতুয়া খুলে দু তিন বার বৈঠকি মেরে নিল। জামা খুলতে দেখা গেল ঠক্কন আদতেই পালোয়ান, ইয়া ইয়া তার হাতের গুলি আর ল্যাঙট পরে তাকে আখড়ার কুস্তিগীরের মত লাগছে। ডন বৈঠক সেরে ঝোলা খুলে একটা মাটির ভাঁড় আর একটা তেলের শিশি বার করে সাবধানে এককোনে রেখে সে বলল, কত হোবে বলেন, পঞ্চাশ, ডেড়শো না তিনশো?
সামন্ত মশাই তক্তপোশে উপুড় হয়ে শুয়ে জুলজুল করে ঠক্কনের কারবার দেখছিলেন। তিনি বললেন, সেগুলো কি বাবা?
ঠক্কন হেসে বলল, তেলের নাপি আছে। পঞ্চাশ গ্রাম তেল মালিশ মানে লাইট আছে। ডেড়শো মানে মিডিয়াম আর তিনশো মানে হেভি।
সুনীল সামন্ত আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, তাহলে তিনশোই হোক।
জি হজুর। বলে ঠক্কন ঝা দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করে তেলের শিশি খুলে সামন্তমশাইএর পিঠে উপুড় করে দিল। তারপর দিলীপ দেখল তার ভেলকি।
প্রথমে নরম হাতে সামন্তমশাইকে তেল টেল মাখিয়ে ঠক্কন দুহাত দিয়ে ঘাড় মুচড়ে ধপাধপ করে থাবড়া মারতে লাগল তাঁর পিঠে। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন বোধহয়, ঠক্কন ‘জয় বজরংবলী’ বলে ডাক ছেড়ে হাঁটু দিয়ে সুনীল সামন্তর শিরদাঁড়া বরাবর স্যাররা মেরে ঘাড়ে উঠে পড়ল। সামন্তমশাই দুচোখ বিস্ফারিত করে বললেন, কোঁক।
ঠক্কন সামন্তমশাইএর দুকান ধরে মাথা একবার ডানদিকে আর একবার বাঁদিকে ঘোরাতে লাগল। সুনীল সামন্তর ঘাড়ের থেকে পড়পড় করে শব্দ হতে লাগল। তিনি এবার বললেন, গেছিরে! ঠক্কন ঝা বলল, জেয়াদা দুর যাই নাই বাবুজি। ইবার যাব। দিলীপ বলল, উনি কিছু বলছিলেন বোধ হয়।
ইখন মউন থাকতে হোবে। বলল ঠক্কন। বলেই সে সামন্তমশাইএর দুটো হাত পিছন দিকে টেনে গিঁট দিয়ে দিল। সামন্তমশাই ভাঁটার মত চোখ করে বললেন, মেরেছে রে! ঠক্কন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কনুই দিয়ে তাঁর পিঠে চাপ দিতে লাগল। সে একবার করে চাপ দেয় আর সামন্তমশাইএর মুখ দিয়ে ফুস করে আওয়াজ হয়। মিনিট দশেক এমন চলার পর সুনীল সামন্ত নেতিয়ে পড়লেন।
অবস্থা দেখে দিলীপ দুর থেকে গলা তুলে ডাকল, মামাবাবু? কেমন বোধ করছেন? কিন্তু সুনীল সামন্ত উঁ উঁ করে ক্ষীণ আওয়াজ দিয়ে ভেটকে পড়ে রইলেন। তখন দিলীপ উদ্বিগ্ন হয়ে ঠক্কন ঝাকে বলল, মামাবাবু সাড়া দিচ্ছেন না যে?
উত্তরে ঠক্কন ঝা সামন্তমশাইকে কোল বালিশের মত তুলে চিত করে ফেলে একটা পা কাঁধে নিয়ে ম্যাসাজ করতে করতে বলল, এখন আরাম করছেন, তাই চুপ আছেন। দিলীপ ফের বলল, কথা বলে না যে?
তখন ঠক্কন দুহাতে সামন্তমশাইএর পায়ের চেটো মুচড়ে দিতেই তিনি বড় বড় করে চোখ খুলে জড়ানো গলায় বললেন, বাবাগো!
দলাইমলাই করতে করতে ঠক্কন ঝা গুনগুন করে গান গাইতে লাগল, রাম ভাইলে যোগিয়া লাখন বৈরাগিয়া কি দুনো ভাইয়া হো গাইলে ফকির। ঘন্টাখানেক মালিশ করার পর সামন্তমলাইকে চকচকে কাৎলা মাছের মত দেখাতে লাগল।
ঠক্কন তার মাটির হাঁড়ি থেকে কালো মত কি একটা বার করে মলমের মত সামন্ত মশাইএর সারা গায়ে লেপতে লাগল। দিলীপ সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ওটা কি?
উ গঙ্গামাটি আছেন। বলল ঠক্কন।
পরিপাটি করে গঙ্গামাটি মাখানোর পর সামন্তমশাইকে একমেটে অসুরের মত দেখাচ্ছিল। ঠক্কন ভালো করে তার হস্তশিল্প পরখ করে টরে বলল, ব্যস,ইবার ইনাকে ধূপে বৈঠিয়ে রাখেন। শুখা হলে নাহিয়ে দিবেন। এই বলে ঠক্কন ছাতের কলে হাত ধুয়ে ধুতি ফতুয়া পরতে লাগল।
চারশো টাকা নিল ঠক্কন ঝা। দিলীপ তাকে জিজ্ঞেস করল, কাল কখন আসবেন?
ঠক্কন টাকা মাথায় ছুঁইয়ে বলল, বাবুলালকে বলে দিবেন, হামি চলিয়ে আসব।
কেন সে একথা বলেছিল বিকালবেলায় বোঝা গেল। একঘন্টা রোদে শুকোবার পর সামন্তমশাই হামাগুড়ি দিয়ে তক্তপোশে এসে বসে চিঁ চিঁ করে বললেন, জল খাব। পাতিরাম এসে জল দিলে সামন্তমশাই বললেন, খাইয়ে দে। তারপর ধরে ধারে তাঁকে চান করানো হল। ছাতের তক্তপোশে বসেই তিনি উঃ আঃ করতে করে আড়কাত হয়ে মাংসের ঝোল দিয়ে একথালা ভাত সাঁটালেন। দিলীপ এসে জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে মামাবাবু? সামন্তমশাইএর ঘাড় লক হয়ে গেছে, তিনি কেৎরে তাকিয়ে বললেন, শরীরে যে এত জায়গায় গাঁট আছে ভুলে গেছিলাম। সব টনটন করছে রে। এইবলে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
সন্ধেবেলা নাগাদ ছাত থেকে আর্তনাদ শোনা গেল। দিলীপ দুদ্দাড় করে ছাতে গিয়ে দেখে, সামন্তমশাই ঘুম ভেঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তাঁর দু হাত দুদিকে মেলা। পা ফাঁক করে তিনি ইঞ্চি ইঞ্চি করে হাঁটবার চেষ্টা করছেন। সন্ধের আবছা আলোয় সুনীল সামন্তকে প্রকান্ড কাগতাড়ুয়ার মত দেখাচ্ছে। দিলীপ কিছু বলার আগেই তিনি গাঁ গাঁ করতে করতে বললেন, মনে হচ্ছে আমাকে কেউ মাড় দিয়ে কেচে ইস্ত্রি করে দিয়েছে। আমাকে বাঁচাও ভাগনা।
দিলীপ নিচে নেমে এসে বাবুলালকে ফোন লাগাল।
– কাকে পাঠিয়েছিলে? মামাবাবুর দফারফা করে ছেড়েছে।
– কেন?
– হাত পা নাড়তে পারছে না। কাগতাড়ুয়ার মত লেংচে বেড়াচ্ছে।
ফোনের ওপার থেকে বাবুলাল খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। হাসি থামলে সে বলল, মালিশ ছাড়ানোর এক্সপার্ট পাঠিয়েছিলুম। ছমাস ধরে এলাকায় বড্ড অত্যাচার করছিলেন স্যার।
দিলীপ অবাক হয়ে বলল, অ্যাঁ? ঠক্কন ঝা তাহলে মালিশওলা নয়?
বাবুলাল বলল, পাতিপুকুর আখড়ার কুস্তি মাস্টার। চেনা লোকের রেফারেন্সে পাওয়া।
– চেনা লোক?
– আজ্ঞে।
– কে? আমি চিনি?
– বিলকুল চেনেন।
– আজব ব্যাপার! কে বল দেখি?
– রামবিরিখ ঝা। ঘর ছাপরা জিলা।
দুদিন ধরে মালিশওলার খোঁজ করছেন না দেখে দিলীপ আর থাকতে না পেরে নিজেই সামন্তমশাইকে শুধিয়ে বসল, মালিশের লোক কবে ডাকব মামাবাবু? সে কথা শুনে সুনীল সামন্ত গুনগুন করে ‘কুঞ্জবনে নাচে কুঞ্জবিহারী গাইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উদাস হয়ে বললেন, মালিশের অভ্যেস ভালো না, বুঝলে ভাগনা? আর ডেকো নি কাউকে। দুদিনের জীবন, ও ঠিক ম্যাসাজ ছাড়াই চলে যাবে।
[শেষ]