
নকুড়েশ্বর প্রামানিক ঘুম থেকে উঠে আজ খুব হাল্কা বোধ করলেন। তাঁর কোমরে আর ডান হাঁটুতে কিছু পুরোনো পাকা ব্যথা আছে। ইদানীং ভুঁড়িটাও পেল্লায় হয়েছে। চলাফেরায় আগের সেই স্ফুর্তি অন্তর্হিত – নকুড়বাবুর শরীর এখন তাঁর নিজের কাছেই ভারী ঠেকে। কিন্তু আজ ঘুম ভেঙ্গে উঠে বিছানায় বসে তিনি লক্ষ্য করলেন সেই ভার ভার ভাবটা যেন আর নেই। বরং তিনি নিজেকে বেশ ফুরফুরে অনুভব করছেন। কালিদাস পাঠক গত সপ্তাহে তাঁকে ছোটকাছারীর স্বপ্নাদ্য মাদুলি পরিয়ে দুশো টাকা নিয়ে গেছে। মাদুলি পরেই নকুড় কালিদাসকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, দুশো টাকা নিলি। কাজ না হলে তোর শেতলা ঠাকুরের থান ভাঙচুর করে দেব। তবে কালিদাস অতি ঘোড়েল মাল। একটুও রাগ ফাগ না করে সে দেঁতো হাসি হেসে বলল, মাদুলি পরেই কেমন একটা জোশ এসেছে দেখুন, ভাঙচুর করে দেব বলছেন। তাহলে মাস খানেক মাদুলি পরে থাকলে কি হবে বুঝতে পারছেন? আরও একশো দিন কর্তা। নকুড় লাঠি তুলতেই সে ব্যাটা সটকে পড়ল। পালঙ্কে বসে পা দোলাতে দোলাতে নকুড়েশ্বর ভাবলেন, মাদুলির জোর আছে বটে।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। গোল বেধে গেল নকুড়বাবুর খাস চাকর শ্যামাচরণ ঘরের দরজায় উঁকি দিতেই। নকুড়েশ্বর তাকে দেখেই অভ্যাস মত চায়ের ফরমাশ করলেন কিন্তু শ্যামাচরণ যেন তাঁকে দেখতেই পায়নি এমন ভাব করে বকের মত গলা বাড়িয়ে ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। শ্যামাচরণের এহেন আচরণ দেখে নকুড়ের পিত্তি জ্বলে গেল। তিনি বাজখাঁই গলায় বললেন, ওরে পাঁঠা, তুই কি কানা আর কালা দুইই হলি?
শ্যামাচরণের অন্ধত্ব ও বধিরত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল যখন নকুড়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে তাঁর চোখের সামনেই টেবিলের উপরে রাখা বিড়ির বান্ডিল থেকে একটি বিড়ি বার করে, কানের কাছে নিয়ে দু আঙুলে ডলে আর বারকয়েক শুঁকে পকেটস্থ করল। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে নকুড় শ্যামাচরণের মাথায় একটি চাঁটি হাঁকালেন। কিন্তু হায়! পালক যেমন হাওয়ার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে যায়, তেমনি ভাবে নকুড়েশ্বরের হাত শ্যামাচরণের কাঁচাপাকা চুলওলা মাথার ভিতর দিয়ে ফুস করে বেরিয়ে গেল। এদিকে শ্যামাচরণ বেমালুম ‘ও কত্তা, আপুনি কোতা গেলেন গো? চা খাবেন নি?’ ইত্যাদি বলতে বলতে খাটের তলা, ঘর লাগোয়া বাথরুম এইসব খুঁজে দেখতে লাগল। নকুড়েশ্বর ছানাবড়ার মত চোখ করে শ্যামাচরণকে দেখতে দেখতে ভাবলেন, ভর সকালবেলা কি তিনি ভূত দেখছেন?
কিছুক্ষণ স্তম্ভবায়ু হয়ে বসে থাকার পর নকুড়বাবুর ঘোর সন্দেহ হল ভূতটুত নয়, তিনি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছেন। এক্ষুনি তাঁর ঘুম ভাঙবে আর এই সমস্ত অত্যাশ্চর্য ঘটনাবলীরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। সময় চলে যেতে লাগল কিন্তু দুঃখের কথা সেরকম কিছুই ঘটল না। শ্যামাচরণ তাঁকে খুঁজে না পেয়ে ‘ও কত্তামা, বাবু কোতা উধাও হলেন’ বলতে বলতে বেরিয়ে চলে গেল। এইসব দেখে নকুড়েশ্বরের খুব উত্তেজনা হতে লাগল। উত্তেজনার মাথায় সচরাচর তাঁর বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছে হয়। কিন্তু মুশ্কিলের ব্যাপার যতবারই তিনি বিড়ির বান্ডিলে হাত দেন, ততবারই হতচ্ছাড়া বান্ডিল হাত গলে বেরিয়ে যায়। নকুড় পালঙ্ক থেকে নেমে পায়ে চপ্পল গলাতে গিয়ে দেখলেন তাঁর পা চপ্পলের মধ্যে দিয়েও হাওয়ার মত বেরিয়ে যাচ্ছে।
যেকোন লোক এই পরিস্থিতিতে বেজায় ঘাবড়ে যাবে। কিন্তু বহু ঘাটের জল খেয়ে নকুড় আজ শ্রী নকুড়েশ্বর প্রামাণিক। কুলপী বাজারের ‘প্রামাণিক গহনা ভান্ডার’ তো আর এমনি এমনি গজিয়ে ওঠেনি। তিনি জীবন শুরু করেছিলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায় ছুরি কাঁচি সম্বল করে। মানুষের চুল কাটতে কাটতে বুঝেছিলেন চুল না কেটে পকেট কাটলে উন্নতি বেশি। তারপর চল্লিশ বছর ধরে তিল তিল করে নেত্রা থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা তিনি দখল করেছেন। প্রথমে ছিল গাছতলার সেলুন, সেখান থেকে মিষ্টান্ন ভান্ডার, তারপর লাইনের বাস, কোল্ড স্টোরেজ হয়ে গহনার দোকান। আজ কুলপীর একটা গাছের পাতাও তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে পড়ে না। এলাকার পঞ্চায়েত প্রধান, বিধায়ক সাংসদরা তাঁর আশীর্বাদ সঙ্গে না নিয়ে মাঠে নামে না। নকুড়েশ্বর বহু বিপদ পার করেছেন। তিনি ঠান্ডা হয়ে বসে পুরো ব্যাপারটা ভালো করে ভাবতে লাগলেন। শ্যামাচরণ কেন তাঁকে দেখতে পেল না? কেনইবা তাঁর কথা শ্যামাচরণের কানে ঢুকল না? কোন কিছু তিনি ছুঁতে পারছেন না কেন? তবে কি তিনি মরে ভূত হয়েছেন? এ কথা মনে হতেই নকুড়েশ্বরের গায়ে কাঁটা দিল। তারপর মনটা ফসফস করতে লাগল এই ভেবে যে গতকাল তিনি কচি এঁচোড় বাজার করে এনেছেন সেটি তাঁর ফ্যামিলি খাবে কিন্তু তিনি খেতে পারবেন না। ভূতে এঁচোড় কি করে খাবে?
কিন্তু খটকা একটা রয়েই গেল। মরে যদি তিনি ভূত হয়েছেন তাহলে বডিটাতো বিছানায় চোখ ফোক উল্টে পড়ে থাকবে। তা তো নেই। নকুড়েশ্বর ভাল করে নিজের হাত পা দেখতে লাগলে। নাঃ, সবই তো স্বাভাবিক লাগছে। মায় ডান হাতের বাজুতে কালিদাসের মাদুলিটি পর্যন্ত বহাল তবিয়তে। তিনি নিজেকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু শ্যামাচরণ তাঁকে দেখতে পাচ্ছে না। নকুড়েশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মুখ দেখতে গেলেন। আয়নায় সব দেখা গেল শুধু নকুড়েশ্বরের চেহারাটি ছাড়া। নকুড় বারকতক চোখ পিটপিট করলেন, মাথা এদিক ওদিক দোলালেন। ঘরের দরজা, দরজার বাইরে রোদ ঝলমল বারান্দা, বারান্দার বাইরে ল্যাম্পপোস্ট আর রাস্তার ওপারে নামখানার বাস ধরতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন সব স্পষ্ট দেখা গেল। কিন্তু নকুড়বাবু কিছুতেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলেন না। এমন আজব কান্ড দেখে নকুড়েশ্বরের মাথা গরম হয়ে গেল। রাগের চোটে তিনি আয়নায় টেনে এক লাথি মারলেন। তাঁর পা আয়নার মধ্য দিয়ে গলে গেল। লাথির যথেষ্ট জোর ছিল – নকুড় হুমড়ি খেয়ে আয়নার মধ্যে দিয়ে গলে দেওয়ালের উপর পড়লেন, দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে গলে ঘরের পাশের নারকেল গাছে আর নারকেল গাছের মধ্যে দিয়ে গলে বেলুনের মত টুপ করে এসে পড়লেন তাঁর বাড়ির সদর দরজার সামনে।
সেখানে তখন তাঁর ধর্মপত্নী কুন্তলীনি বেতের মোড়ায় বসে মাছের ওজন দেখছেন। ভোলা সর্দার ঝাঁকায় করে মাছ এনেছে। ঝাঁকার মধ্যে চালানী কাৎলা, ভোলা বঁটি পেতে মাছ চ্যালা করে দাঁড়িপাল্লায় চাপিয়েছে। নকুড় স্পষ্ট দেখলেন ভোলা দাঁড়িপাল্লার একদিকে সীসা ভরা একটা এক কিলোর বাটখারা চাপিয়েছে। এই বাটখারা গুলি তাঁর নিজস্ব হস্তশিল্প – এ জিনিস একদিন কুলপী বাজারে তিনিই আমদানি করেছিলেন – এতে প্রতি কিলোতে একশ গ্রাম মারা যায়। রাগে দুঃখে তিনি চিৎকার করে বললেন, ও কুন্ত, তোমার মাথায় কি গোবর পোরা? ভোলা শালা তোমাকে ঠকাচ্ছে আর তুমি বসে বসে ঠকছ? এমনিতেই কুন্তলীনি তাঁর কথা প্রায়শ অগ্রাহ্য করেন। আর আজ তো দিনটাই খারাপ। তিনি নকুড়েশ্বরকে দেখতেও পেলেন না, তাঁর কথাও শুনতে পেলেন না। তখন নকুড় মরিয়া হয়ে ভোলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দাঁড়িপাল্লা ধরে টান মারতে গেলেন। চুঁ করে একটা শব্দ হল আর নকুড়েশ্বর প্রামানিক ভোলা সর্দারের দেহে সেঁধিয়ে গেলেন।
ভোলার শরীরও ভারী। নকুড়শ্বর বুঝলেন ব্যাটা গুঁড়াখুর নেশা করে। গুঁড়াখুর গন্ধে তাঁর বমি বমি ভাব হল। কোনক্রমে বমির ভাব সামলে তিনি ফের কুন্তলীনিকে বললেন, বার বার বলেছি ভোলার থেকে মাছ কিনবে না, কিনবে না, ফের ওর থেকে মাছ কিনছ? ভোলার মুখ থেকে একথা শুনে কুন্তলীনি চোখ গোল গোল করে তাকে দেখতে লাগলেন। তারপর তিনি মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ভোরবেলাতেই নেশা ভাং করেছিস নাকি? মরণ!
নকুড়েশ্বর আকুল হয়ে কুন্তলীনিকে বলতে লাগলেন, ও কুন্ত, আমায় চিনতে পারছ না? আমি যে তোমার স্বামী গো! এই নাও এই মাছ তোমাকে ফ্রিতে দিলুম। পটল দিয়ে পাতলা ঝোল কর গে। যেই না এই কথা বলা অমনি নকুড়েশ্বর প্রামানিকের বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল। কুন্তলীনি উঠে দাঁড়িয়ে ফাটা বাঁশের মত গলায় বললেন, ও জিতু ও ধামু এখানে একবার আয় দেখি বাবা। ভোলা জেলে আমার শেলতাহানি করতেছে।
জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র পিঠোপিঠি দু ভাই। এরা নকুড়েশ্বরের জীবনের দুটি চরম ভুল। যদিও সম্পর্কে নকুড় এদের বাপ কিন্তু এই দুটিকে ত্যাজ্যপুত্র করার সাধ তাঁর বহুদিনের। এতদিনে করেই দিতেন, কুন্তলীনি পথের কাঁটা। জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র এসেই ভোলা সর্দারকে দুটি কোঁৎকা দিল। নকুড় দেখলেন, ধেনো খেয়ে খেয়ে আর গুঁড়াখুর নেশা করে ভোলার শরীরে আর মোটে কষ নেই। কোঁৎকাদুটি তার বিশেষ রকম লাগল। তিনি কাতরাতে কাতরাতে বললেন, ওরে হতভাগারা। বাপের গায়ে হাত তুলছিস? সে কথায় কাজ তো হলই না উল্টে জিতেন্দ্র দাঁড়িপাল্লা খুলে তাঁকে দু চার ঘা লাগাল আর ধর্মেন্দ্র একটি পাঁচশ গ্রামের বাটখারা দিয়ে ভোলার পায়ের বুড়ো আঙুলে ঠুকে দিল। ‘বাবারে’ বলে নকুড়েশ্বর ভোলার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে শূন্যে দুলতে লাগলেন। ভোলা হঠাৎ দেখে তার খদ্দেরের বাড়ির বেয়াড়া ছেলেরা তাকে বেনাহক পেটাচ্ছে। সে ঝাঁকা ফেলে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলতে লাগল, গরীবের উপর অত্যাচার? মানছি না মানব না।

ছেকু মিঞা সবে কুলপী বাসস্ট্যান্ডের লাগোয়া দিনুর চা দোকানে লেড়ো বিস্কুট সহযোগে একগেলাস লালচা খেয়ে খবরের কাগজ খুলে আয়েস করে শঙ্খবিড়ি ধরিয়েছে, ভোলা সর্দার হাঁউমাঁউ করতে করতে এসে তার পায়ে পড়ল। ভোলার গোটা গায়ে ধুলো, মুখেও অল্প ধেনোর গন্ধ, হইহই করে এসে ধাক্কা দিতে ছেকুর হাত থেকে সদ্য ধরানো বিড়িটা মাটিতে পড়ে গেল। ছোটলোকগুলোকে নিয়ে এই হয়েছে বিপদ। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত এরা বিভিন্ন ঝামেলা বাধিয়ে বেড়ায় আর অঞ্চলপ্রধান বলে ছেকুকে সেসব ঝামেলা মেটাতে হয়। নেহাত এরা সব ভোট নয়তো শেখ বংশের ছেলে হয়ে জন্মানো ছেকুর গা ছোঁয় কোন ইবলিশের বাচ্ছা! ভোলা হাউ হাউ করে কি সব বলে চলেছে, ছেকু তাকে ধমক দিয়ে বলল, হেই! কান্না থামিয়ে পস্ট করে কথা ক। চারশো সাত গাড়ির মত ধাক্কা মেরে বিড়িটা ফেলে দিলি যে বড়?
ছেকু মিঞার ভাল নাম শেখ সালাউদ্দিন। সে যখন ছোট ছিল তখন তার বিধবা মা পাড়া ময় ‘ও ছেকু ও ছেকু’ বলে ডেকে ডেকে তাকে খুঁজে বেড়াত। এখন মাঠে চাষবাস করলেও একসময় ছেকুরা ছিল খুব নামী বংশ – ছেকুর দাদু কুলপী থেকে প্রথম হজ্জ্বে গেছিল বলে তাদের খুব গুমর ছিল। পাড়ার লোকে তাকে টিটকিরি দিয়ে বলত, ছেলামু আলেইকুমু ছেখ ছালাউদ্দিন ছাহেব। সেই ছেখ থেকে সালাউদ্দিনের সঙ্গে ছেকু নামটি জুড়ে গেছে। ছাত্র জীবনেই সে বেশ একটু নেতা গোছের ছিল, মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ছেকু লোকাল কমিটির সেক্রেটারি হয়ে বসেছিল। ভোটে বিরোধীপক্ষ জিতে আসার পর তাল বুঝে সে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে রুলিং পার্টিতে যোগ দেয়। পার্টি অফিস চুনকাম করে লেনিন আর মার্ক্সের ছবি সরিয়ে সেখানে নেতাজি আর গান্ধীজির ছবি লাগালেও ছেকুর চ্যালারা এখনও বন্দেমাতরম বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে লালসেলাম বলে ফেলে। ভোলা সর্দার হল সেই জাতীয় চ্যালা। ছেকুর ধমক খেয়ে ভোলা কান্না থামাল বটে কিন্তু আর্তনাদ করে বলতে লাগল, সর্বহারার গায়ে হাত! ছেকুদা এর বিহিত করতে হবে।
কে সর্বহারা? তুই? কিলোপ্রতি দেড়শো গ্রাম মারিস আবার বড় বড় কথা! মুখ খিঁচিয়ে বলল ছেকু। কেসটা কি অল্পকথায় বল।
ধর্মেন্দ্র আর জিতেন্দ্রর হাতে মার খেয়ে ভোলার হাতে পায়ে কালসিটে পড়েছে। সেগুলি দেখিয়ে ভোলা সর্দার নকুড়েশ্বর প্রামাণিকের বাড়িতে তার হেনস্থার কথা ফলাও করে বলতে লাগল। মাছের ঝাঁকা আর দাঁড়িপাল্লা বাটখারা যদিও সে ফেলে পালিয়েছে তবুও অঞ্চলপ্রধানের কাছে সে অভিযোগ করল নকুড়েশ্বরের ছেলেরা সেগুলি কেড়ে নিয়েছে বলে। বিবরণ শুনে ছেকু গম্ভীর হয়ে গেল। নকুড়েশ্বর যে সে লোক নয়, তার সঙ্গে লাগা খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু পার্টি সদস্য এমন মার খেলে নেতা হিসেবে তার একটা বিহিতও করা দরকার, নইলে মান থাকে না। প্যাঁচে পড়ে ছেকু রাগত স্বরে বলল, খালি একপক্ষের কথা শুনে কিছু করা যাবে না। নকুড়দার সঙ্গে কথা বলতে হবে। আর কেউ সাক্ষী আছে?
ভোলা সর্দার বিরসবদনে ঘাড় নাড়ল। কেউ কি সাক্ষী নিয়ে মার খেতে যায় নাকি? আর তার অভিযোগের একটা বড় ফাঁক হচ্ছে শান্তি মত মাছ বিক্রি করতে করতে হঠাৎ সে কি করে মার খেতে লাগল সেটা তার নিজেরও মনে পড়ছে না। মাছ বিক্রির সময় তো ধারে কাছে নকুড়ের ছেলেরা ছিল না। ছেকু ভোলার দিকে চেয়ে মাথা নাড়তে লাগল। তার চোখে সন্দেহের ছায়া।
হঠাৎ তোকে মারবে কেন? তুই কি করেছিলি? সন্দেহপূর্ণ গলায় ছেকু জিজ্ঞেস করল।
ইতিমধ্যে চারিদিকে ছেলেপুলেরা জুটে গেছে। তারা এই কথোপকথনের মধ্যে ফুট কাটতে লাগল। ছেকু হাওয়া ভাল বুঝতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বুঝে গেল নকুড়েশ্বরের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটার নিস্পত্তি করা প্রয়োজন নয়তো গাঁগঞ্জে এইসব তিল থেকে তাল হয়। ব্যাপারটায় ফালতু পলিটিক্যাল কালার লেগে যেতে পারে। নকুড়েশ্বরের উপর অনেকের রাগ আছে বলে মনে হয়। কিন্তু মুশকিল হল নকুড়েশ্বরকে পার্টি অফিসে ডাকার সাহস নেই তার। তাহলে কি সে নিজেই টুক করে একবার চলে যাবে? কিছু টাকা দিলেই ভোলা খুশি হয়ে যাবে মনে হয়। এই সব সাত পাঁচ সে যখন ভাবছে তখন দেখা গেল শ্যামাচরণ উদভ্রান্তের মত দিনুর দোকানের সামনে দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। ছেকুর নির্দেশে সকলে হইহই করে গিয়ে শ্যামাকে ডেকে নিয়ে এল।
যাও গিয়ে নকুড়দাকে বল অঞ্চলপ্রধান দেখা করতে আসছে। মুরুব্বীর চালে বলল ছেকু। এই ঘোষণা শুনে শ্যামাচরণ খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কিন্তু বাবু তো হাইরে গেছে!
– হাইরে গেছে? মানে? কখন থেকে?
শ্যামাচরণ ডুকরে কেঁদে উঠে দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ল। একহাট লোকের মাঝে সে দুলে দুলে কাঁদতে লাগল। মুখে সে হাহাকার করতে লাগল তবে তার চোখ দিয়ে যে খুব জল পড়ছে তেমন নয়। সকলে তাকে হাওয়া করতে লাগল আর বলতে লাগল, আহা কাঁদে না কাঁদে না। কিছুক্ষণ পরে শ্যামাচরণ কান্নাটান্না সামলে বলল, আজ সকাল থেকে বাবু উধাও হয়েছেন। গিন্নিমা আর দাদাবাবুরা কি গরু খোঁজা খুঁজতেছে গো। কিন্তু বাবু কোত্থাও নাই।
ভোলা শুকনো গলায় বলল, নিরুদ্দেশ না হাতি! তাইলে কি আনন্দে গিন্নিমা সকাল সকাল দেড়কিলো কাটাপোনা কিনছিলেন? ছেকুদা এ মিথ্যে কথা বলছে! এই কথা শুনে শ্যামাচরণ লাফিয়ে উঠে তাকে মারতে যায় আর কি! ছেলেরা কোনক্রমে তাকে সামলালেও সে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, ব্যাটা ধেনোখোর! তুই গিন্নিমাকে ইস্তিরি বলে ডেকে সকাল সকাল দাদাবাবুদের হাতে অত মার খেলি তবু লজ্জা নাই? আমি কিনা মিথ্যুক?
ছেকু মিঞার মুখ হাঁ হয়ে চোয়াল ঝুলে পড়ল। রাত করে ধেনো খেলে ভোলা সকাল বেলা একটু ঘেঁটে থাকে ঠিকই কিন্তু তাই বলে নকুড়গিন্নির সঙ্গে ফস্টি নস্টি? ভোলাকে যে পিটিয়ে চালতা বানিয়ে দেয় নি এই যথেষ্ট। ছেকু হাত তুলে হেঁকে বলল, ইস্টপ। নকুড়দা যে নিরুদ্দেশ তা কি করে জানা গেল? আশপাশ থেকে ছেলেছোকরারা বলতে লাগল, আরে দুর! নিশ্চয়ই কাকদ্বীপ গেছে। শ্যামাচরণ খালি ঘাড় নাড়ে আর ইনিয়ে বিনিয়ে বলে, না। ভোলা গিন্নিমাকে বলল আমি তোমার সোয়ামী হই, তারপর দাদাবাবুরা ওকে ধরে ঠ্যাঙাল তারপর আমি গিন্নিমাকে বলনু যে মা, বাবু হাইরে গেছে। তখন গিন্নিমা আর দাদাবাবুরা উপরে উঠে খুঁজতে লাগল আর আমি ভোলার মাছের ঝাঁকা গুইছে রাখতে লাগনু –
ছেকু উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, অ্যাই চোপ। অত ডিটেল কে চাচ্ছে? চ আমি যাচ্ছি।
শ্যামাচরণ ফের ভেউ ভেউ করে কেঁদে বলল, আমি তো থানায় যাচ্ছি। গিন্নিমা বলল হাজরা বাবুর কাছে যেতে। আচ্ছা পুলিশকে কি বলব?
দিনুর দোকানে একটা ছোটখাটো ভিড় লেগে গেছে। এমন কিস্যা কুলপী বাজারে বিরল। একজন মানী লোক উধাও। মাছওলা তাঁর বৌএর সঙ্গে আসনাই করতে গিয়ে মানীলোকের ছেলেদের হাতে প্রহৃত। পুলিশ আসব আসব করছে। সকলে হামলে পড়ে শ্যামাচরণকে উপদেশ দিতে লাগল। আশে পাশের দোকান থেকে দোকানীরা গলা বাড়িয়ে মজা দেখতে লাগল। এমনকি ভ্যানোওলারা রগড় দেখতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে রাস্তা জ্যাম হয়ে নামখানার বাস তারস্বরে হর্ণ দিতে লাগল। নকুড়েশ্বর হাওয়াবেলুনের মত ভেসে ভেসে দিনুর দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ভিড় দেখে তিনি মাটিতে নেমে এলেন। পরিস্থিতি বুঝতে বুঝতে প্রথমে দিনুর দোকানের একগেলাস লালচা তুলে খেতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হলেন। হাওয়া শরীরের আঙুলে গেলাস উঠল না। তারপর লোকজনের কথাবার্তা শুনে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁকে যে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না সে খবর চাউর হয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে আলোচনা নকুড়েশ্বর মোটে পছন্দ করেন না। তিনি ছেকু মিঞাকে বললেন, আরে কিস্যু হয় নি। ভোলাকে আমি পাঁচশো টাকা দিয়ে দেব। কিন্তু কেউ তাঁকে দেখতে পেল না আর তাঁর কথায় কর্ণপাতও করল না। ছেকু তখন গম্ভীর গলায় শ্যামাচরণকে বলছে, আগে নকুড়দার বাড়ি গিয়ে কথা বলে দেখতে হবে। থানায় আমি নিজে যাব। নকুড়দা এইভাবে হারিয়ে গেলে কুলপীর অসন্মান।
পুলিশের কথা শুনে নকুড়েশ্বর খুবই বিচলিত হলেন। মুখ থাকলে তা নিশ্চয়ই শুকিয়ে যেত। তাঁর পালঙ্কের জাজিমের নিচে বাতিল পাঁচশো আর হাজার টাকায় লাখবিশেক টাকা রাখা আছে। এই টাকা তিনি আট দশটি ভুয়ো অ্যাকাউন্টে জমা দেব দেব করছিলেন। পুলিশ এসে ঘর তোলপাড় করলে তো মহাফ্যাসাদ। হাউমাউ করে ছেকুকে বারণ করতে গিয়ে তাঁর মনে পড়ল তাঁর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না। নকুড়বাবু মুষড়ে পড়তে যাচ্ছেন এমন সময় তাঁর মাথায় হঠাৎ বিদ্যুতের মত একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি হুশ করে ভেসে এসে পিছন থেকে ছেকু মিঞাকে আলিঙ্গন করলেন। ফের চুঁ করে শব্দ হল। ছেকু একটু কেঁপে উঠল বটে কিন্তু হট্টগোলের মধ্যে কেউ তা ঠাহর করতে পারল না।
ছেকুর বগলে দাদ আছে মনে হয়, নকুড়েশ্বর টের পেলেন তাঁর চুলকাতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে ছেকুও তাঁরই মত শঙ্খবিড়ি খায় এইটি বেশ স্বস্তির ব্যাপার। ছেকুর শরীরে গুছিয়ে বসতে বসতে তিনি বললেন, বন্ধুগণ! নকুড়দাকে নিয়ে চিন্তা করার কোন কারণ নেই। তিনি নিশ্চয়ই আশে পাশে কোথাও গেছেন। ভিড় হাল্কা করুন।
ছেলেছোকরারা ছেকুর কথা শুনে হতাশ হয়ে গুজগুজ করতে লাগল, এইসব নেতাদের মতিগতি বোঝা ভার। সকাল সকাল বেশ একটা ঝামেলা পাকছিল কিন্তু অঞ্চলপ্রধান সেটাও হতে দেবে না। ছেকু শ্যামাচরণকে ডেকে নিচুগলায় বলল, শ্যামা থানায় যাবার কোন দরকার নেই তোমার। ওসব আমি বুঝব। আগে গিয়ে নকুড়দার ঘরে তালা লাগাও। পুলিশ না আসা পর্যন্ত ঐ ঘরে কেউ যেন না ঢোকে। যাও, আমি বৌদির সঙ্গে গিয়ে কথা বলছি।
শ্যামাচরণ ছেকুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে এমন সময় ছেকু মিঞা গম্ভীর গলায় তাকে বলল, নকুড়দার বান্ডিল থেকে আর বিড়ি ঝেড়ে খেয়ো না। যাও যাও বাড়ি যাও।
শ্যামাচরণের হাঁ মুখ খপ করে বন্ধ হয়ে গেল।

শ্যামাচরণ বাড়ি ফিরে ফতুয়ার পকেট থেকে বিড়ি বার করে নকুড়ের টেবিলের উপরে পড়ে থাকা প্যাকেটের মধ্যে গুঁজে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। পুলিশকেস হলে সামান্য একটা বিড়ির জন্য ঝামেলায় পড়তে সে রাজি নয়। ছেকুমিঞা কি করে বিড়ির ব্যাপারটা জানল ভাবতে ভাবতে সে নকুড়ের ঘরে তালা দিয়ে নিচে নেমে এসে একেবারে কুন্তলিনীর মুখোমুখি পড়ে গেল। তিনি বললেন, হাজরাবাবুকে বলেছিস?
অঞ্চলপ্রধান মানা করেছে। তিনি এখানে আসতেছে। শ্যামাচরণ আমতা আমতা করে বলল। অমনি ধর্মেন্দ্র পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, নিকুচি করেছে অঞ্চলপ্রধানের। তোকে বারণ করল আর তুই ফিরে চলে এলি? শ্যামাচরণ বাবুর ছেলেদুটিকে ঘোর অপছন্দ করে, এরা যেমন ষন্ডা তেমন বজ্জাত। বাবুর অসাক্ষাতে ধর্মেন্দ্র আর জিতেন্দ্র তাকে দিয়ে বিভিন্ন ফাইফরমাশ খাটানোর চেষ্টা করে। এখন এই বিপদের সময়ে এরা কি যে করে বসবে ভগবান জানে। অত যদি থানায় খবর দেয়ার শখ তো তোরা যা না বাপু! সে মিনমিন করে বলল, তিনি নেতা লোক, না কইরে দিলে আমি কি করি?
কুন্তলিনী অত রাগ করলেন না। ঘরের চারদিক থেকে লোকজন এসে খবরাখবর দিচ্ছে, কেউই নকুড়েশ্বরকে আজ আর দেখেনি। ঠিকের লোক কামিনী এসে বলল, হ্যাঁ মা, বাবুর জামাকাপড় চটি জুতো সব পড়ে আছে, উনি এলোগায়ে লুঙ্গি পরে খালি পায়ে কি করে বেরোলেন গো?
তাও তো বটে! হ্যাঁরে কামিনী, কলঘরে ঢুকে বসে নেই তো? ভীষণ নোলা হয়েছে ক’দিন এটা সেটা খাচ্ছে, পেট ছাড়ল নাকি? চিন্তান্বিত মুখে বললেন কুন্তলীনি। সে কথা শুনে শ্যামাচরণ মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে লাগল, আমি কি আর কলঘর দেখি নাই মা? কত্তা গতবছর যে কমোট লাগালেন তার ঢাকনা তুলেও দেখিচি। এই বলে সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ফের বলল, এই রে জলের ট্যাঙ্কিটা তো দেখিনি!
কামিনী চোখ ঘুরিয়ে বলল, আহা কি বুদ্ধি! কত্তাবাবু অতবড় গতরটা নিয়ে ঐটুকু ট্যাঙ্কিতে ঢুকবেন নাকি?
জিতেন্দ্র উপর থেকে নেমে এসে বলল, বাবার ঘরের দরজায় কে তালা দিল?
কুন্তলীনি বললেন, শ্যামা তালা দিয়েছে। চাবি সাবধানে রাখবি কিন্তু। কারুর মাথার ঠিক নেই এখন।
ধর্মেন্দ্র পাশ থেকে বলল, শ্যামা চাবি হারিয়ে ফেলবি। আমাকে দে।
শ্যামাচরণ ফের মিনমিন করে বলল, চাবি রাখলে রাখ। কিন্তু অঞ্চলপ্রধান বাবুর ঘর তালাবন্ধ করে রাখতে বলেছে।
ধর্মেন্দ্র চোখ পাকিয়ে বলল, আমাদের পার্সোনাল ব্যাপারে অঞ্চলপ্রধান কথা বলার কে? ছেকুমিঞা মহা ঘোড়েল লোক। দে দে চাবি দে।
কুন্তলীনি মাঝে পড়ে বললেন, বাবা ধামু, চাবি শ্যামার কাছেই থাক। পুলিশ না আসা পর্যন্ত ঐ ঘরে কেউ না ঢোকাই ভাল।
জিতেন্দ্র প্রথমবার নকুড়েশ্বরের ঘরে ঢুকে বালিশ তুলে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে সিন্দুকের চাবি খুঁজেছে, কিন্তু তাড়াহুড়োর চোটে ঠিকমত দেখে উঠতে পারেনি। ঘর তালাবন্ধ থাকলে কি করে হবে? সে খুব বিচক্ষণের মত বলল, তালাবন্ধই থাকবে মা। কিন্তু এই বিপদের সময় চাবিটা আমার কাছেই সেফ থাকবে।
ধর্মেন্দ্র জিতেন্দ্রর তাল বুঝেছে, সে বাধ্য ছেলের মত বলল, না না শ্যামাদা আমাদের কত পুরোনো লোক, ঘরের লোক। চাবি তোমার কাছেই থাক শ্যামাদা। তুমি বরং আমাকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি-
চোপ! একটাও কথা বলবে না আর। কুন্তলীনি হেঁকে বললেন। যাও থানায় একটা ফোন কর। ধমক খেয়ে ধর্মেন্দ্র জিতেন্দ্র উঠোনে গিয়ে গজল্লা করতে লাগল।
বাবা রাত থাকতে ঘর ছেড়ে গেছে। বলল জিতেন্দ্র।
সদর দরজায় তালা মারা থাকে, চাবি থাকে মায়ের কাছে। বাবা কি ছাতের পাইপ বেয়ে গেল নাকি? ধর্মেন্দ্র বলল।
– আমি তোকে বলছিলুম কিনা যে বুড়োর তাল ভাল না?
– আমি ঠিক বুঝেছি। ঘরে বসে উইল লিখলে ধরে ফেলব তাই উধাও হয়েছে।
– হতে পারে। কিন্তু যা হোক একটা কিছু বানিয়ে বলেও যেতে পারত। এভাবে আচমকা গায়েব হয়ে যাবার মানে কি?
– তুই থানায় ফোন কর গে, নইলে মায়ের কাছে ঝাড় খাবি।
নকুড়েশ্বরের বাড়িতে সবাইকার মোবাইল ফোন থাকলেও একটা ল্যান্ডলাইন ফোন আছে কুন্তলীনির ঘরে। জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র গুটি গুটি পায়ে কুন্তলীনির ঘরে গিয়ে কুলপী থানায় ফোন লাগাল।
– নমস্কার। কুলপী থানা।
– দেখুন আমাদের বাবা – আমি প্রামানিক ভবন থেকে শ্রী নকুড়েশ্বর প্রামানিকের ছেলে জিতেন্দ্র প্রামানিক বলছি।
-বলুন।
– হাজরাবাবুর সঙ্গে কথা বলা যাবে?
– উনি এখন ব্যস্ত। যা বলার আমাকে বলুন।
– আমি বড়বাবুর সঙ্গে ছাড়া কথা বলব না। ওঁকে বলুন অন্য কাজ থামিয়ে এসে কথা বলতে।
– ঠিক আছে। পাঁচমিনিট বাদে ফোন করুন।
ধর্মেন্দ্র আর ডিতেন্দ্র রাগে গজগজ করতে লাগল। নকুড়েশ্বর একটা ফোন করলে হাজরা এসে বাড়ির সামনে লেফট রাইট করে, এখন সে নেই তাই শালার পায়াভারী হয়েছে।
হঠাৎ দোরগোড়ায় বন্দেমাতরম ধ্বনি শোনা গেল। জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র সদর দরজার কাছে আসতেই দেখা গেল, ছেকুমিঞা গলা বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছে আর পিছনে ভোলা সর্দার হাত মুঠো করে আকাশে তুলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিচ্ছে। জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্রকে দেখে ভোলা চট করে দুপা পিছিয়ে নারকেল গাছের পিছনে পজিশন নিল আর ‘গরীব ব্যবসায়ীকে প্রহার করা চলবে না’, ‘ঝাঁকা বাটখারা ফেরত দাও’ ইত্যাদি বলে স্লোগান দিতে লাগল। ছেকু খুব বিব্রতভাবে বলল, অ্যাই ভোলা, চুপ কর, চুপ কর।
কুন্তলীনি এগিয়ে এসে বললেন, ছেকু! এস বাবা এস। আমার যে কি সব্বোনাশ হল। ছেকু হেসে হাত তুলে কুন্তলীনিকে নমস্কার করে উঠোনে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ভোলা তুই এখানে দাঁড়া, কোথাও যাবিনি।
কুন্তলীনি বললেন, ও কামিনী ভোলা জেলের ঝাঁকা আর পাল্লাবাটখারা ফেরত দে।
ছেকু দেখল সে পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রন ফিরে পাচ্ছে, তাই সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ভোলা জিনিষ দেখে বুঝে নাও, আর সোজা পার্টি অফিসে চলে যাও।
ভোলা মোটেই খুশি নয়। তার সর্বাঙ্গে কালশিটে, কিন্তু ছেকু এমন ভাব করছে যেন ঝাঁকা পাল্লাটা সরকারী অনুদান। সে স্লোগান থামিয়ে দম নিয়ে বলল, আর আমাকে যে মারল? আড়াই কেজি মাছটা চ্যালা করিয়ে নিল না যে?
কুন্তলীনির রাগ পড়ে গেছে, তিনি বুঝেছেন ধেনোর ঘোরে ভোলা ভুল বকছিল। নরম স্বরে কুন্তলীনি বললেন, সে তুই অকথা কুকথা বলছিলি নেশার খোঁয়াড়িতে, দাদারা তাই একটু ম্যাসাজ করে দিয়েছে। ও কামিনী ওকে একশটা টাকা দে তো মা।
ফেকু খুব গম্ভীর গলায় বলল, শ্যামা বলছিল নকুড়দাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?
– আর বোলনি বাবা। জলজ্যান্ত লোকটা ঘর থেকে গায়েব! কুন্তলীনি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন।
– কোথাও বেরিয়েছেন কি?
– কি করে যাবে? পরনের ফতুয়া, চটি, হাতের লাঠি সব যে পড়ে আছে!
বিড়ির বান্ডিলটা পর্যন্ত পড়ে আছে। বাবা বিড়ি ছাড়া আধঘন্টা থাকতে পারে না। জিতেন্দ্র বলল।
ছেকু বলল, কাল নকুড়দাকে লাস্ট কে দেখেছে?
কুন্তলীনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, রাতে নিচের ঘরে বসে খেল, তাপ্পরে দোতলায় নিজের ঘরে শুতে চলে গেল। সেই শেষ দেখা। কতবার বলেছি ওগো আলেদা শুয়ো না শুয়ো না, তোমার নাকডাকা আমি সয়ে নেব। কারো কথা কি শোনে?
ভেঙ্গে পড়বেন নি বৌদি। নকুড়দা আমাদের কুলপীর গর্ব। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এই বলে ছেকু উঠতে যাচ্ছে, জিতেন্দ্র বলল, থানাতে ফোনও ধরছে না। বাবার ঘর তালাবন্ধ। আমরা ঠিক করে খুঁজতেও পারছিনে।
লোকটা হাইরে গেছে, এখন আর তালা দিয়ে কি লাভ? ছেকু বলল।
আপনেই তো বলেছেন তালা লাগাতে। ধর্মেন্দ্র বলল।
ছেকু অবাক হয়ে বলল, আমি বলেছি? সে কি কথা!
জিতেন্দ্র বলল, আপনে বলেন নি পুলিস না আসা পর্যন্ত বাবার ঘর তালাবন্ধ করে রাখতে? শ্যামা যে বলল?
ছেকু এবার রাগতস্বরে বলল, আমি কেন এসব বলতে যাব! ধেত্তেরিকা।
ধর্মেন্দ্র বলে উঠল, দেখেছ মা। শ্যামা গুল মেরেছে।
শ্যামাচরণ হাঁউমাউ করে বলতে লাগল, আমি কেন গুল মারব? আপনে যে বললেন শ্যামা, থানায় যাবার দরকার নাই, বাড়ি যা। বাড়ি গিয়ে বাবুর ঘরে তালা দে। পুলিসের আগে যেন কেউ ও ঘরে ঢুকতে না পারে।
ছেকু চোখ পিটপিট করে বলতে লাগল, আমি বলেছি? কই কখন বললাম?
সবাই কথা বলতে লাগল। ভোলা সর্দার ঝাঁকা মাথায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিল। সে ছেকুকে একথা বলতে শুনেছে। কিন্তু ছেকু এখন অস্বীকার করছে কেন? এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রাজনীতি আছে।
ছেকু মরিয়া হয়ে বলল, এসব বানিয়ে বানিয়ে বলা হচ্ছে। আর কি বলেছি আমি?
শ্যামাচরণ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, আলবাৎ বলেছেন। আপনে তাপ্পর বললেন, শ্যামা বাবুর থেকে বিড়ি- বলেই সে চুপ করে গেল।
ছেকুমিঞা ‘আমি এসবের মধ্যে নেই। এসব অপপ্রচার করলে আমি মানব না’ বলতে বলতে চলে গেল।
কুন্তলীনি, ধর্মেন্দ্র, জিতেন্দ্র, কামিনী আর শ্যামাচরণ সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল।
খানিকবাদে কুন্তলীনি মোবাইল ফোনে থানাকে বললেন, হাজরা বাবু কই। বলুন প্রামানিক ভবন থেকে কথা বলতে চাইছে।
– কি ভবন?
– বলুন নকুড় প্রামানিকের ফ্যামিলি কথা বলতে চাইছে।
– অ। বড়বাবু এখন বিজি। আমাকে বলুন।
– কিসের এত বিজি?
– থানায় সিনেমার শুটিং হচ্ছে। অনামিকা বাদশা এসেছে। এখন কথা বলা যাবে না।
কুন্তলীনি মোবাইল ফোন খাটে ছুঁড়ে ফেলে হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, তবে রে হাজরার বাচ্চা! অ জিতু অ ধামু চল দিকি থানায়, পুলিসের মুখে নুড়ো গুঁজে দিয়ে আসি।
জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র ঝামেলা পেলে আর কিছু চায় না। তারা তক্ষুনি দুটো বাইক বার করে আনল, কুন্তলীনি জিতেন্দ্রর বাইকে মাদুগ্গার মত চড়ে বসলেন, ফটফট করতে করতে তারা থানার রাস্তা ধরল।
শ্যামাচরণ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এবার হাজরা বাবুও নিরুদ্দেশ হবে।

কুলপী থানার সামনে তিনটে ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে একটা পুলিশের আর বাকিদুটো অগ্রদূত ফিল্মসের। থানার কম্পাউন্ডের ভিতর আরও কতকগুলো ঝাঁ চকচকে গাড়ি দাঁড় করানো আছে – এগুলো হিরো হিরোইন আর ডিরেক্টারের। এইসব দেখে একটা পাতলা কৌতূহলী ভিড় সবে জমাট বাঁধতে যাচ্ছে। থানার ভিতর যে সিনেমার শুটিং হতে পারে এখানকার লোক তা বুঝতে পারেনি। আর কুলপীর লোক কখনো সিনেমার শুটিং দেখেও নি। এখনও যে দেখতে পাচ্ছে তা নয়, কারণ থানার গেটের সামনে কনস্টেবল পোস্টিং হয়েছে – তারা কাউকে থানার ভিতরে ঢুকতেই দিচ্ছে না। বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আর গালগল্প করছে কিছু হাটুরে মার্কা লোক। কিভাবে যেন চাউর হয়ে গেছে বাংলা ফিলিমের পপুলার নায়ক নায়িকা বাদশা আর অনামিকা শুটিং করতে এসেছে। ভিড়ের মধ্যে লোকজন তাদের নিয়ে আলোচনা করছে। সেই ভিড়ের মাথার উপর দিয়ে ভেসে ভেসে নকুড়েশ্বর তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন। ছেকুমিঞাকে পরিত্যাগ করা ইস্তক তিনি থানা চত্বরেই ঘুরঘুর করছেন। তাঁর মন বলছে, পুলিসের কার্যকলাপের উপর নজর রাখার দরকার। তিনি যে ভ্যানিশ হয়েছেন সেটা একটা সমস্যা, কিন্তু তাঁর অবর্তমানে লোকজন যে ক্ষতি করার চেষ্টা করবে, সে সমস্যা আরও গভীর। এই যেমন তাঁর পালঙ্কের জাজিমের নিচে রাখা টাকা কি করে লুকোনো যায়, সে এক মস্ত ফ্যাচাং। তিনি তো কিছু ধরতে ছুঁতেও পারছেন না।
কুলপী থানার কাছেই ভবেন ঘোষের ঘোষ সুইটস। ভবেনের ছেলে বিশ্বরুপ বাংলা সিনেমার পোকা। সকাল থেকেই তার বড় ইচ্ছে শুটিং দেখে। থানার লোকজন তার কাস্টমার, ফলে একটু চেষ্টা করলে সে শুটিং দেখেও ফেলতে পারে। কিন্তু দোকানের কোনে ভবেন ঘোষ ক্যাশে বসে আছে। তার সামনে দোকান ছেড়ে বেরোনোও মুশকিল। বিশ্বরুপ এই সব সাতপাঁচ ভাবছে এমন সময় থানার থেকে লোক এসে বলল, বড়বাবু এক ক্রেট লিমকা পাঠাতে বলছে। কুইক।
এগারোটা বাজতে যায়। ঘোষ সুইটসের কাউন্টারে তিনজন কর্মচারীর একজন কামাই করেছে বলে খদ্দের সামলাতে হিমসিম অবস্থা। নামখানামুখি অনেক লোক গাড়ি থামিয়ে এইসময় তার দোকানে লুচি ডাল খায়। এই অবস্থায় এক ক্রেট লিমকা কি করে পাঠানো যায়? কর্মচারী দিয়ে জিনিষ থানায় পাঠিয়ে বিশ্বরুপ দুএকবার পয়সাও পায় নি। তবে কি এই ছুতোয় সে নিজেই চলে যাবে? একথা মাথায় আসতে তার চোখের সামনে অনামিকার লাস্ট সিনেমা ‘আমি যে তোমার’ ছবি ভেসে উঠল। সেই যে, যেখানে সে হোয়াইট গাউন পরে একটা ভাঙ্গা মন্দিরের মধ্যে হিরোর সঙ্গে লুকোচুরি করতে করতে গান গাইছে। বিশ্বরুপ কর্মচারীকে হেঁকে বলল, মাইতিদা, এক ক্রেট লিমকা আমাদের জিও গাড়িতে তোলো, আমি থানায় মালটা দিয়ে আসি।
থানার মুখে লোকে জটলা করছে বলে অনেকবার হর্ন দিতে হল। কনেস্টেবল গোপাল মাহাতো প্রায় বছর পাঁচেক থানায় পোস্টেড, বিশ্বরুপ তাকে ভালই চেনে। গোপাল গাড়িতে উঁকি দিয়ে কোল্ডড্রিংকের বোতল দেখে বলল, সোজা বড়বাবুর ঘরে চলে যান। ডিউটি অফিসারের ঘরে মেলা ফিলিমের লোক। গাড়ি রেখে ক্রেট নামাতে নামাতে বিশ্বরুপ দেখল, মেজবাবুর ঘরের মেঝেতে খেলনা রেল লাইনের মত লাইন পাতা, সেই রেললাইনের উপর একটা ট্রলিতে গাবদামার্কা একটা লোক ক্যামেরা ধরে বসে আছে। কিছু লোক সাদা রঙের বোর্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে এদিক ওদিক। মেজবাবুর টেবিলে পুলিসের পোষাক পরে বসে পা দোলাচ্ছে হিরো বাদশা সেন। আর একটা দাড়িওলা ঝুঁটিবাঁধা লোক হাতে কাগজ নিয়ে চোখে কাজলপরা, লকসকরে চুলবাঁধা, গাছকোমর করে শাড়িপরা হিরোইন অনামিকার সঙ্গে কথা বলছে। বড়বাবু শিবশঙ্কর হাজরা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, একটু আমার ঘরের টেবিলে ক্রেটটা রেখে দে বাবা। আর কত হয়েছে বল।
বিশ্বরুপ ক্রেট তুলে বড়বাবুর ঘরের দিকে যাবে, এমন সময় থানার গেটের কাছে হল্লা শুরু হল। দুজন কনস্টেবলের বগলের তলা দিয়ে থানার উঠোনে ঢুকে পড়ল জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র। আর কুন্তলীনি ফাটাকাঁসির মত গলায় বলতে লাগলেন, ঢোকা যাবে না মানে? সরকারি আপিস, জনসাধারণ ঢুকতে পারবে না?
মেজবাবু কার্তিক সাহা ছুটে গিয়ে বলতে লাগলেন, আস্তে চেঁচান পিলিজ। শুটিং হচ্ছে।
জিতেন্দ্র বলল, থানার ভিতর শুটিং? আপনাদের ফোর্স কি করছে? ধর্মেন্দ্র বলল, সাইলেন্সার লাগিয়েছে নাকি? কোন আওয়াজ নেই যে!
সাহাবাবু দুহাত পাখির ডানার মত ঝাপটাতে ঝাপটাতে বললেন, আরে সে শুটিং নয়। সিনেমার শুটিং!
কুন্তলীনি বৈজয়ন্ত ট্যাংকের মত সোজা ডিউটি অফিসারের ঘরের দিকে যেতে যেতে ঠোঁট উল্টে বললেন, সিনেমার নিকুচি করেছে। সকাল থেকে ঘরে সব্বোনাশ, লোক পাঠিয়ে ডাকছি, ফোন করছি, কোন বিকার নেই? উনি থাকলে এমন অগ্গেরাহ্যি করার সাহস হত? কোতায় শিবু হাজরা, কোতায়?
বিশ্বরুপ বড়বাবুর টেবিলে পরপর লিমকার বোতল সাজাচ্ছিল, কুন্তলীনি তা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, অ্যাঁ, দিনেদুপুরে থানার মধ্যে ড্রিংকের ব্যবস্থা? জিতু, ধামু বিধায়ককে ফোন লাগাও। আজ হাজরার একদিন কি আমার একদিন। কিন্তু এই কথা জিতেন্দ্র বা ধর্মেন্দ্র কেউই শুনতে পেল না, তারা তখন হিরোইনের দুপাশে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে সেলফি তুলছে। অনামিকা পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে আর ঝুঁটিওলা ডিরেক্টার কাগজপত্র টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলে বলছে, কি হচ্ছে কি এসব? জিতেন্দ্র ডিরেক্টারের গালে আঙুল দিয়ে টুসকি মেরে বলল, আমরা ফ্যান। অটোগ্রাফ প্লিজ। বাদশা সেন টেবিল থেকে উঠে পালাতে যাবে, ধর্মেন্দ্র তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, একটা সেলফি তুলব, একটু দাঁড়ান না। কুন্তলীনি ছেলেদের খুঁজতে খুঁজতে এঘর ওঘর উঁকি দিয়ে এই দৃশ্য দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গগনভেদী চিৎকার করে তিনি বললেন, অ্যাই, তোদের না বাপ নিরুদ্দেশ? তোরা ফটো তুলতে থানায় এয়েচিস ?
ধর্মেন্দ্র মাকে দেখেই সেলফি তোলা বন্ধ করে রেলে বসানো ট্রলির উপরে রাখা ক্যামেরার হ্যান্ডেল ধরে নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ট্রলিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলায় ট্রলি গড়াতে লাগল আর কেঁদো ক্যামেরাম্যান ট্রলির উপর থেকে আঁউআঁউ করতে লাগল। টেকনিশিয়ানরা এদিক ওদিক দৌড়তে লাগল আর ডিরেক্টার ‘সিকিউরিটি সিকিউরিটি’ বলে চেঁচাতে লাগল।
থানাতে ঢুকে সিনেমার শুটিং নিয়ে সবাইকে ব্যস্ত দেখে নকুড়েশ্বর খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু যেই না কুন্তলীনি জিতু আর ধামুকে নিয়ে থানায় ঢুকল, ফের তাঁর অশান্তি শুরু হল। আর কুন্তলীনি এখন যা শুরু করেছে মেনিমুখো হাজরা এ জিনিস সামলাতে পারবে বলে মনে হয় না।
এই হট্টগোলের মধ্যে শিবশঙ্কর হাজরা এসে কুন্তলীনিকে নমস্কার করে বললেন, ম্যাডাম আপনি এখানে কেন, আসুন আসুন আমার ঘরে আসুন। কি হয়েছে? এই বলে তিনি মেজবাবুকে চোখ মারতেই মেজবাবু দুজন সিভিক ভলান্টিয়ারকে ফিসফিস করে কিছু বললেন, তারাও তখন আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্রর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আস্তে আস্তে ঠেলতে লাগল। জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র যত তেরিয়া হয়ে তাদের দিকে তাকায়, সিভিক ভলান্টিয়াররাও তত একগাল হেসে আস্তে করে তাদের ঠেলে। ব্যাপারটা ঠিক কি হচ্ছে বোঝার আগেই তারা জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্রকে ঠেলে মালখানাবাবুর ঘরের দিকে এনে ফেলল।
এদিকে কুন্তলীনি ফোঁস করে উঠে বললেন, আপনার ঘরে যাব না। ওখানে মদের আসর বসেছে। আমি এমএলএকে বলে কি করি দেখুন।
হাজরা বললেন, মদ? সকালে থানায় মদ খাচ্ছে? কে? কার এত সাহস? তারপর তিনি মাথাটাথা চুলকে বললেন, ওহো আমার ঘরে তো লিমকা আনিয়েছি। থানায় এত গেস্ট এসেছে তো, তাই। অ্যাই ম্যাডামকে লিমকা দাও।
কুন্তলীনির রাগ একটু পড়েছে, তাও তিনি খুব বিরক্তির সঙ্গে বললেন, সকাল থেকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতেছি। প্রথমে লোক পাঠালুম, অঞ্চলপ্রধান তাকে ভড়কে দিল। ফোন করলুম, বলে আপনি ব্যস্ত! এসে দেখি সিনেমা হচ্ছে। ওনাকে বললে আপনার বদলি হয়ে যাবে, জানেন?
শিবশঙ্কর হাজরা হাতজোড় করে আকর্ণবিস্তৃত হেসে বললেন, এত রাগ করলে আমরা সরকারী গোলামরা যাই কোথায়? কি হয়েছে বলুন। এই বলে তিনি কুন্তলীনিকে নিজের ঘরে এনে বসালেন।
– আমার উনি সকাল থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। এখন কি করনীয়?
– নিরুদ্দেশ হয়েছেন মানে? কোথাও চলে গেছেন? ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল নাকি?
– ঝগড়া হতে যাবে কেন? আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিছুই হয়নি।
– তাও তো ঠিক। কিন্তু কি করে বুঝলেন যে নিরুদ্দেশ হয়েছেন? কিছু লিখে টিখে গেছেন নাকি?
– কিচ্ছুটি না। ফতুয়া, চটি, ঘড়ি, লাঠি সব ফেলে গেছে।
হাজরা একটা খাতা খুলে মিছিমিছি লেখার ভঙ্গি করতে লাগলেন। নকুড়েশ্বর প্রামানিক একটি বাস্তুঘুঘু। তিনি কি এমনিই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন নাকি? কেউ মেরে লোপাট করে দিতে পারে অবিশ্যি, তবে এ তল্লাটে তেমন পাকা ক্রিমিনাল নেই। ভাবতে ভাবতে তাঁর মাথায় একটা অদ্ভুত আইডিয়া এল। বাড়ির লোকেরাই এরমধ্যে জড়িত নয় তো? হাজরা তাঁর ড্রয়ারে রাখা টেপরেকর্ডারের সুইচ টিপে বললেন, ম্যাডাম এখন আমি আপনাকে কটা কথা জিজ্ঞেস করব একটু ভেবে উত্তর দেবেন কেমন?
– বেশ।
– লাস্ট কিছুদিন উনি কি কোন সন্দেহজনক আচরণ করছিলেন?
– না তো। খুব খাইখাই করছিল। সেটা কি সন্দেহজনক আচরণ?
– আজ্ঞে না। কোন অচেনা লোক ওঁর কাছে যাতায়াত করছিল কি?
– না। এখানকার সব লোক ওর চেনা। এই তো সেদিন কালিদাস পাঠক এসেছিল মাদুলি দিতে।
– কালিদাস পাঠক? কুলপী থানার আন্ডারে?
– সে কি করে জানব? মগরাহাটের কাছে শেতলা থানের জ্যোতিষী।
– বুঝেছি। আচ্ছা উনি কি উইল টুইল করেছেন, হালে? জানেন?
– না।
– ঠিক আছে। আমরা একবার যাব দেখতে। কোন চিন্তা করবেন না। আছেন এদিক ওদিক কোথাও।
কুন্তলীনি বললেন, এখুনি চলুন। ওনার ঘর তালাবন্ধ করা আছে।
-আরে যাব যাব। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? কোন দামী জিনিষপত্র আছে কি? টাকাকড়ি?
– না না। আমাদের সব ট্যাক্সো দেওয়া টাকা। উনি লুকিয়ে ঘরে রাখা অপছন্দ করেন। সব ব্যাংকে থাকে।
– হ্যাঁ। তাই ভাল। নোটবন্দির পর পাঁচশো হাজারের নোট জমা করে দিয়েছেন তো?
হাজরার ওস্তাদি দেখে নকুড়েশ্বরের গা জ্বলে গেল! আরে তোর সিভিক ভলান্টিয়াররাই কমিশন নিয়ে অন্য লোকের টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্যে লাইন দিচ্ছে, তার বেলা? হাত থাকলে তিনি হাজরার কানদুটো মুলে দিতেন।
কুন্তলীনি মাথা নেড়ে বললেন, তার সঙ্গে কর্তার নিরুদ্দেশ হবার কি সম্পক্ক? আপনে তদন্ত করবেন কিনা তাই বলুন।
এইসব গুরুতর কথাবার্তা যখন চলছে, বিশ্বরুপ ঘোষ মনমরা হয়ে মেজবাবুর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। তার কপালটাই খারাপ। হিরো হিরোইন হাজির, কুলপীতে এইরকম একটা ঐতিহাসিক সিনেমার শুটিং হচ্ছিল, আর নকুড়েশ্বর প্রামানিকের ফ্যামিলি এসে সব লন্ডভন্ড করে দিল। এতে তাদের নিশ্চিন্তপুরের কত বদনাম হল, এই ভেবে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। সিভিক ভলান্টিয়ার বাপী তার ইস্কুলের বন্ধু, সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেখে বিশ্বরুপ তাকে পাকড়াও করল।
হ্যাঁরে বাপী, নকুড়গিন্নি এসে ঝামেলা করছে কেন? বলল সে।
– বাবা। তুই শুনিস নি?
– কি হয়েছে?
– আরে ভয়ঙ্কর ব্যাপার। নকুড়বাবুকে লোপাট করে দিয়েছে এই সন্দেহের বশে জিতু আর ধামু ভোলা জেলেকে ধরে ঠেঙিয়েছে। ছেকুদা ব্যাপারটা মিটমাট করতে গিয়েছিল কিন্তু বলে সে-ই নাকি নকুড়বাবুকে দোতলার ঘরে তালাচাবি দিয়ে আটকে রেখেছে। ছেকুদা রেগে কাঁই। উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে ব্যাপারটা রিপোর্ট করছে।
– একটু আস্তে আস্তে বল না ভাই। নকুড়বাবু মানে প্রামানিক গহনা ভান্ডার?
– হ্যাঁ।
– সে লোপাট? গুমখুন?
– অত জানিনা।
– এর মধ্যে ভোলা কি করে এল?
– সে কি করে বলব?
বিশ্বরুপ রেগে গিয়ে বলল, তাহলে জানিসটা কি?
বাপী খুব রোয়াবের সঙ্গে বলল, লোকজন বিভিন্ন রকম বলছে, শুনে যাচ্ছি। আমার তো সকাল থেকে শুটিং ডিউটি।
– শুটিংএর তো বারোটা বাজিয়ে দিল জিতু আর ধামু।
– না না। ফের হবে। জিতু ধামুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে লকআপ করা হচ্ছে।
– বুঝিয়ে সুঝিয়ে? মানে?
– মেজবাবু ওদের বুঝিয়েছে, থানায় তো কোন পেরাইভেসি নেই, অনামিকা লকআপের ভিতর ওদের সঙ্গে সেলফি তুলবে। যেই ভেতরে ঢোকা, ঝপাং! এই বলে বাপী দাঁত বার করে হাসল।
বিশ্বরুপ ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ অঞ্চলের লোকেরা কোন ভাল জিনিসের মর্ম বোঝে না। থানার ভেতরে যা ছত্রভঙ্গ অবস্থা তাতে শুটিং আর হবে কিনা সন্দেহ। এরা কলকাতা ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবে, এখানে আর কেউ কোনদিন শুটিং করতে আসবে না। সে গুটিগুটি পায়ে বড়বাবুর কাছে পয়সা চাইতে এসে দেখে নকুড়গিন্নী টেবিলের উল্টোদিকে চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে আর বড়বাবু হেসে হেসে তাকে বলছেন, শুটিংএর ঝামেলাটা মিটে গেলেই যাব বলছি তো ম্যাডাম। নবান্ন থেকে চিঠি করিয়ে নিয়ে এসেছে, বুঝলেন না? তাছাড়া আমাকে একটা ছোট পার্টও করতে বলছে। হে হে।
কুন্তলীনি নিমপাতা খাওয়ার মত মুখ করে বললেন, আমি বসে আছি। আপনাকে নিয়ে তবে যাব।
বিশ্বরুপ মাথা চুলকে বলল, কেরেট টা নিয়ে যাই স্যার?
– ক্রেট? ও ক্রেট। হ্যাঁ হ্যাঁ নিয়ে যা। পয়সা কত হল বল, মেজবাবুকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। হ্যাঁরে শুটিং চলছে ওদিকে?
– না স্যার বন্ধ।
– সেকি? এখনও বন্ধ?
কুন্তলীনি খেঁকিয়ে উঠে বললেন, আপনি না গেলে শুটিংও বন্ধ। এই বলে তিনি জোরে হাঁক দিয়ে ডাকলেন, অ জিতু অ ধামু এদিকে আয়।
জিতু আর ধামু দুর থেকে সমস্বরে বলল, আমরা লকআপে ওয়েট করছি মা।
অ্যাঁ? লকআপে কেন? কে ওদের লকআপে ঢুকিয়েছে? বলে কুন্তলীনি লাফিয়ে উঠলেন। এত বড় সাহস? আমার জিতু ধামুকে লকআপে ঢুকিয়েছেন?
নকুড়েশ্বর বড়বাবুর ঘরের ঘুলঘুলির কাছে ভেসে ভেসে সব দেখছিলেন। জিতু ধামুকে লকআপ করা হয়েছে শুনে তিনি এত খুশি হলেন যে কি বলব। কিন্তু কুন্তলীনির উগ্রমূর্তি দেখে শিবু হাজরা টেবিলের তলায় ঢুকে যাচ্ছে দেখে তাঁর মাথা গরম হয়ে গেল। কুন্তকে এমন ভয় পেলে সে তো মারাত্মক কান্ড করবে। তিনি উপর থেকে ডাইভ দিয়ে হাজরার মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
পরিস্কার বোঝা গেল শিবশঙ্কর হাজরার নাড়ির গতি বেশ দ্রুত। নকুড়েশ্বর দেখলেন তার গলাও শুকিয়ে আছে, হাত পাও অল্প অল্প কাঁপছে। তিনি কালবিলম্ব না করে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর দুহাত রেখে চোখ মুখ ভয়ঙ্কর রকমের পাকিয়ে বললেন, চোওওওপ!!
সেই হুঙ্কার শুনে কুন্তলীনির মুখ হাঁ হয়ে গেল। তিনি চোখ গোল গোল করে হাজরাকে দেখতে লাগলেন। বিশ্বরুপ ফাঁকা ক্রেটটা হাতে তুলেছিল, সেটা তার হাত থেকে ঠাস করে পড়ে গেল।
হাজরা গাঁক গাঁক করে কুন্তলীনিকে বললেন, আর একটা কথা বললে, আপনাকেও চালান করে দেব। অ্যাই মেজবাবু খাতাটা আনুন দেখি, শালাদের পেটি কেস দিয়ে কাস্ডটিতে নিই!
বিশ্বরুপ এত অবাক হল যে ক্রেট না কুড়িয়ে হাজরাকে দেখতে লাগল। পাঁচবছরে কেউ কখনো বড়বাবুকে রাগতে দেখেনি। চেঁচিয়ে কথা বলা তো দুরস্থান। তিনি কিনা নকুড়গিন্নীকে ধমকাচ্ছেন?
বড়বাবুর চিৎকারে মেজবাবু, এসআই আর গোটাকতক সিভিক ভলান্টিয়ার দৌড়ে এল। বড়বাবু তখন ভাঁটার মত চোখ করে কুন্তলীনিকে বলছেন, ইঃ! সব ব্যাংকে জমা দিই! আপনার ঠাকুরঘরে লালবাবার কৌটোর মধ্যে রোল করে কি রাখা থাকে সে কি আমি জানিনা? সব সিজ করে নেব!
কুন্তলীনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, মাদুলি? ঐ মাদুলি কোথায় পেলেন?
নকুড়েশ্বর তাকিয়ে দেখলেন হাজরার সাদা ইউনিফর্মের হাতার তলা দিয়ে তাঁর মাদুলিটা উঁকি মারছে। তিনি তাড়াতাড়ি সেটা হাতার ভিতর গুঁজে দিতে দিতে বললেন, তাতে আপনার কি? সোজা বাড়ি যান। আমাকে আমার কাজ করতে দিন।
কুন্তলীনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, আপনাকেও কালিদাস মাদুলি দিয়েছে?
বিশ্বরুপ বড়বাবুর নলেজ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। নকুড়গিন্নী কোথায় হাতসাফাইএর টাকা রাখে তা পর্যন্ত ওনার জানা। এই না হলে বড়বাবু!
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত কুন্তলীনি সুড়সুড় করে ঘর ধরলেন। সিভিক ভলান্টিয়াররা ব্যারিকেড করে জিতু আর ধামুকে লকআপ থেকে বের করে বাইকে চড়িয়ে দিয়ে এল। জিতেন্দ্র বলল, কি হল মা? আমরা চলে যাচ্ছি কেন?
ধর্মেন্দ্র বলল, সেলফি তুলবে বলল যে? আবার আসব?
কুন্তলীনি কপাল চাপড়ে বললেন, ঘরে চল বাবা। আমাদের পিছনে শনি লেগেছে। দেশের আজ বড় দুর্দিন।

ভোলা সর্দার জিতু-ধামুর হাতে মার খেয়ে যত বিচলিত হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘাবড়ে গেল ছেকুমিঞার ভাবগতিক দেখে। নিজের বলা কথা সে বেমালুম অস্বীকার করছে, তাও এর কোন কারণ থাকতে পারে – রাজনীতির লোক কথায় কথায় কথা পাল্টেই থাকে। কিন্তু ছেকু একসময় লালপার্টি করত, তাবিজ, কবচে তার যে মোটে বিশ্বাস নেই এ কথা পুরো তল্লাট জানে। জীবনে তাকে কেউ পীরের দরগা বা মাজারে যেতে দেখেনি – মসজিদেও যায় নামমাত্র, লোকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে। দল পালটে তার আর অত কড়াকড়ি নেই বটে, কিন্তু ছেকুমিঞা মাদুলি পরা শুরু করেছে দেখে ভোলা অবাক। তারচেয়েও বেশি অবাক ছেকু সেটা লুকোচ্ছে বলে।
পার্টি অফিসে বসে ভোলা আর থাকতে না পেরে ছেকুমিঞাকে চেপে ধরল।
– ছেকুদা?
– আবার কি?
– তুমি কবে থেকে মাদুলি পরা শুরু করেছ?
ছেকুমিঞা হাঁ হয়ে গেল। পুরো একটি মিনিট সে ভোলার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোর এখনো ধেনোর নেশা নামেনি?
ভোলা মাথা নেড়ে বলল, আমি পস্টো দেখেচি, তোমার হাতে মাদুলি! কিন্তু তুমি সেটা খুলে ফেললে কেন ভাবছি।
ছেকুমিঞার ধুরন্ধর বুদ্ধি। সে মানুষের সত্যি মিথ্যে ধরতে পারে। তার মনে হল, ভোলা সত্যি কথাই বলছে। কিন্তু ভোলার এমন ভ্রম হল কেন? সে পরখ করার জন্যে জিজ্ঞেস করল, কোন হাতে দেখেছিস?
– ডান হাতে।
– কখন দেখলি?
– ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। সকালের দিকে বোধহয়।
এলাকায় এম পি আসছে বলে অনেকগুলো ফ্লেক্স লাগানো হবে। মনিরুল আর বাদল বাটামের ফ্রেমে ফ্লেক্সগুলো পেরেক দিয়ে সাঁটছিল। তারা নিজেদের মধ্যে খিঁকখিঁক করে হেসে বলল, চোলাই খেয়ে খেয়ে ভোলার ব্রেনসেলগুলো পচে গেছে। শালার মাথার ঠিক নেই। ভোলা এই কথা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, চোলাই কি আমি তোদের বাপের পয়সায় খাই? তোদের মাথার ঠিক নেই শালা।
ছেকুমিঞা আপনমনে নিজের ডানহাতের বাহুতে হাত বোলাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হল, বাহুর উপরের দিকে চামড়ার উপরে একটা টোলখাওয়া দাগ। জামার হাতা গুটিয়ে সে বাহু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। অস্পষ্ট হলেও হাতে একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। কোন শক্ত জিনিস হাতে টাইট করে বাঁধা থাকলে এমন দাগ হয়। ছেকু ভোলা সর্দারকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সে কি সত্যি হাতে কিছু পরেছিল? সেটা গেল কোথায়? তার মনেই বা পড়ছে না কেন?
আজ সকাল থেকে আজব কান্ড কারখানা হয়ে চলেছে। নকুড়বাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোলা সর্দার নকুড়গিন্নীকে আনাব সানাব বলেছে বলে অভিযোগ, ভোলা এমন করতে পারে বিশ্বাস হয় না। প্রামানিক বাড়ির চাকর বলছে ছেকু নাকি নকুড়ের ঘরে তালা লাগাতে বলেছে। এসবের মানে কি?
ছেকু হাত তুলে বলল, ইস্টপ। কেউ কারো পিছনে লাগবে না। আমি ফাজলেমো পছন্দ করি না। ভোলা?
– আমি সত্যি মাদুলি দেখেছি ছেকুদা।
– ভালো করে ভেবে বল, কখন দেখেছিস। আর কখন থেকে আর দেখছিসনে সেটাও পারলে বল।
– এক ঝলক মোটে দেখেছি তো, তাই ঠাহর করতে পারছি নে। ঐ যে গো তুমি যখন শ্যামাকে বলছিলে যে তোকে থানায় যেতে হবেনি আমি নিজে যাব। তখন মনে হয়।
ছেকু খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, শ্যামাটা কি পগেয়া! বলে কিনা আমি বলেছি নকুড় বাবুর ঘরে তালা দিতে!
বাদল পেরেক ঠোকা থামিয়ে বলল, বলেছ তো!
ছেকু হাসি থামিয়ে বাদলকে দেখতে লাগল। বাদল, মনিরুল, ভোলা সকলেই একদৃষ্টে তাকে দেখছে। সে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, বলেছি?
মনিরুল বলল, পস্টো শুনেছি। তুমি ব্যাপারটা টেকাপ করলে বলে আমরা সবাই হতাশ হয়েছিলুম। আমরা চাচ্ছিলুম কিচাইন হোক।
কাজ কর। বলে ছেকুমিঞা ছিটেবেড়ার পার্টি অফিসের বাইরে এসে শঙ্খবিড়ি ধরাল। তার কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে নাকি? কিচ্ছু মনে পড়ছে না কেন? বাইরে দিনের আলোয় সে জামার হাতা গুটিয়ে হাতের দাগটা ভাল করে দেখতে লাগল। চাপের দাগ ক ঘন্টা থাকে? এখানে মাদুলি এক্সপার্ট কে আছে? মগরাহাটের কালিদাস পাঠক?
ছেকুমিঞার পকেটে ফোন বাজতে লাগল। ঘোষ সুইটস থেকে ফোন করেছে।
– ছেকুদা এমপি ভিসিটের অর্ডারটা।
– হ্যাঁ, কি হয়েছে?
– লুচি, ডাল আর গজা। ঐদিন গজা হবে না। লাড্ডু দিয়ে দি?
– কে বলছ? বিশ্বরুপ?
– হ্যাঁ।
– লাড্ডু কি ভাল হবে? ক বাক্স বলা ছিল যেন?
– একশ বাক্স। লাড্ডু তো ভালই হবে। দিয়ে দি।
– দাও।
– ছেকুদা বলছিলাম কি কিছু পয়সা অ্যাডভান্স দাও না। আগেরটারও পাঁচশ বাকি আছে।
– ঠিক আছে। আমি গিয়ে পয়সা দিচ্ছি।
পঞ্চায়েতের ট্রেজারার আজ কিছু পয়সা দিয়েছে। ছেকুমিঞা সাইকেলে চড়ে ঘোষ সুইটসের দিকে চলল। সে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। হাত দিয়ে সে বাহুর দাগটা বার বার ছুঁয়ে দেখতে লাগল।
ঘোষ সুইটসে দারুণ জিলিপি বানায়। ছেকুমিঞা জিলিপি কিনে মুখে দিয়ে বলল, তোমার টোটাল কত হয়েছে বল দেখি?
বিশ্বরুপ ক্যালকুলেটারে যোগটোগ করে বলল, একহাজার আটশো। আর আগের পাঁচশো।
ছেকুমিঞা হাত ধুয়ে পকেট থেকে তিনটে পাঁচশোর নোট বের করে বিশ্বরুপকে দিয়ে বলল, বাকিটা ফাংশানের পরে। বিশ্বরুপ টাকা ক্যাশে রাখতে রাখতে বলল, ধারের হিসেব মনে থাকে না। তবে সবাই পুরোনো খদ্দের। থানাতেও টাকা বাকি। বড়বাবু যা রেগে আছে, ভয়ে চাইতে পারছি না।
ছেকু বলল, বড়বাবু মানে আমাদের শিবু হাজরা?
– হ্যাঁ
– শিবু হাজরা রাগতে পারলে কুলপীর আইনশৃঙ্খলার আজ এই অবস্থা হয়? খালি রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় আর কালচারাল করে বেড়ায়।
বিশ্বরুপ আজ হাজরাবাবুর যে অগ্নিমূর্তি দেখেছে তা এখনো তার চোখের সামনে ভাসছে। সে মাথা নেড়ে বলল, না ছেকুদা আজ নকুড়গিন্নীকে যা ঝেড়েছে না, কি বলব!
ছেকু অবাক হয়ে বলল, বড়বাবু নকুড়বৌদিকে ঝেড়েছে? দুর দুর। গালগল্প।
– সত্যি। নিজের চোখে দেখেছি।
– বল কি হে? কি হল ব্যাপারটা?
– নকুড়বাবু তো সকাল থেকে গায়েব। বৌদি বোধহয় বারবার ফোন করে কাউকে না পেয়ে ছেলেদের নিয়ে থানায় হাজির। এদিকে থানাতে সিনেমার শুটিং হচ্ছে, তাতে বড়বাবু অ্যাকটিং করবেন। বৌদি বড়বাবুকে বাড়ি নিয়ে যাবেন, বড়বাবুও যাবেন না। এদিকে জিতু ধামু থানা লন্ডভন্ড করছে বলে লকআপ করে দিয়েছে। তখন নকুড়বৌদি তো বড়বাবুকে মারতে যায় আরকি! এইসময় বড়বাবু যে চন্ডমূর্তি ধরল যে পুরো থানা হাঁ।
– তারপর? নকুড়বৌদি কি করলেন?
– জাস্ট পালালো ছেকুদা। অবিশ্বাস্য!
– ডায়রী নিল না?
– নিয়েছে বোধহয়, ঠিক জানি না।
– অবাক কান্ড। শিবু হাজরার এ চেহারা তো জানা ছিল না। তুকতাক করছে না কি?
– তুকতাক? সে জানিনা। তবে মাদুলি পরে তো, তার গুন কি না কে জানে!
ছেকু দোকান থেকে বেরোতে যাচ্ছিল, থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আবার মাদুলি? সে বিশ্বরুপকে বলল, ডানহাতে মাদুলি পরেছিল?
– হ্যাঁ। তুমি জানো?
না। তবে অনেকেই ডানহাতে মাদুলি পরে কিনা, তাই বলছি। বলল ছেকু। সে সাইকেল ঠেলে রাস্তায় নামল। কি একটা যেন আশ্চর্য কান্ড ঘটছে কুলপীতে। কি সে কান্ড ছেকু এখনো জানে না, তবে তার মন বলতে লাগল সেই কান্ডের মধ্যে সে আছে। ভোলা আছে, নকুড়গিন্নী আছে, মনে হয় শিবু হাজরাও আছে। হঠাৎ মুখ তুলে সে দেখে কুলপী থানার গেটের কাছে এসে পড়েছে।

মগরাহাটের শেতলা মন্দির কতকালের কেউ জানে না। মন্দিরের গায়ে পলেস্তারার পরত চাপতে চাপতে দেয়ালগুলো ইয়া মোটা হয়েছে। এত মোটা পলেস্তারা মাঝে মাঝেই খুলে পড়ে যায়, আর তখন ভেতরে যে পাতলা পাতলা যে ইঁট দেখা যায় তেমন ইঁট এখন আর তৈরী হয় না। লোকে বলে এখান দিয়ে এককালে আদিগঙ্গা বইত, চাঁদ সদাগর এখানে এসে পূজো দিয়েছিল। যেসব লোকে এইসব গল্প করে তারাও আর তেমন বেঁচে নেই। এখন শেতলা মন্দিরের একদিকে মোবাইল ফোনের দোকান আর আরেক দিকে একটা ভাঙ্গাচোরা বাড়ি। সেই বাড়িতে বংশানুক্রমিক ভাবে পাঠকদের বাস। তারা নাকি দুশো বছর আগে উড়িষ্যা থেকে এসে মন্দিরের সেবাইত হয়েছিল। কালিদাস পাঠক হল শেতলা মন্দিরের বর্তমান সেবাইত।
শেতলা মন্দিরের পূজো করে তো আর পেট চলে না, তাই পাঠকরা বরাবরই সাইড বিজনেস হিসেবে কবিরাজি চিকিৎসা, ঝাড়ফুঁক আর তাবিজ কবচের কারবার করে। এ ব্যাপারে কালিদাসের বেশ নামডাক আছে এ অঞ্চলে। তবে কালিদাস আসলে সেলসম্যান, তার গুরু হল বোমকালী কাপালিক। সে সুন্দরবনের দিকে কোথায় যেন থাকে, সপ্তাহে একবার এসে সে কালিদাসের বাড়িতে চেম্বার করে। সেই চেম্বারে লোকে বশীকরণ, বানফোঁড়া, কুলোচালা ইত্যাদির জন্যে হাজির হয়। বিভিন্ন সমস্যায় তাবিজ মাদুলি দেয় বোমকালী। কালিদাসের কাজ হল সেগুলো সাপ্লাই দেওয়া। সন্ধের দিকে জটামাথায় রক্তাম্বর পরা বোমকালী ভ্যানোয় চড়ে শেতলা মন্দিরে এসে পৌঁছল। কালিদাস তাকে খাতির করে বৈঠকখানা ঘরে বসিয়ে চা জলের ব্যবস্থা করতে লাগল। আজ চেম্বার নেই, মাসের এই একটা দিন ভিভিআইপি যজমানেরা লুকিয়ে বোমকালীর সঙ্গে কনসাল্ট করতে আসে। এদের সমস্যা খুবই গোপন ও গুরুতর। আজ যেমন আসছে বারুইপুরের এক মস্ত প্রোমোটার সদানন্দ জোয়ারদার।
সদানন্দ প্রায় মাস চারেক ধরে কালিদাসের কাছে যাতায়াত করছে। এক বিশাল এজমালি সম্পত্তি কিনে সে ফ্ল্যাটবাড়ি বানাতে চায়। চল্লিশজন শরিকের জনা পঁয়ত্রিশকে ম্যানেজ করে এখন সদানন্দ এমন পাঁচজনের পাল্লায় পড়েছে যারা কিছুতেই সই দেবে না। তাদের বশীকরণ করার জন্যে সে কালিদাসের কাছে এসেছিল। বোমকালী গণনা করে বলেছে এই পাঁচটি অকালযোনি, এদের বশীকরণ করা সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? সদানন্দ কেঁদে বোমকালীর পায়ে পড়েছিল।
উপায় আছে। তবে তা বড় কঠিন। এর জন্য ভূতচতুর্দশীতে বোমকালীকে স্মশানে মড়াপোড়া কাঠের উপর বসে জপ করতে হবে তারপর তন্ত্রমতে পূজো করে সাতরতি তামার সঙ্গে শকুনভস্ম, শেয়ালের হাড়ের গুড়ো আর পোয়াতি মেয়েছেলের বুড়ো আঙুলের নখের কুচি মিলিয়ে বানাতে হবে দেহান্তরী মাদুলী। সেই মাদুলি সাতদিন পরে থাকলে সদানন্দ যেকোন মানুষের উপর ভর করতে পারবে। তখন এই টেঁঠিয়া শরিকদের দিয়ে সম্পত্তি ট্রানেসফারের সই করিয়ে নেওয়া কি এমন ব্যাপার? শুনে সদানন্দর মুখ শুকিয়ে গেলেও সে রাজি হয়ে গেল। আজ সেই দেহান্তরী মাদুলি ডেলিভারি হবে।
চা-ফা খেয়ে বোমকালী জটা আর দাড়িতে ধুলো মেখে বাঘছালের আসনে বসে সামনে একটা ছোটমত ধুনি জ্বালল। তারপর সে বলল, কালিদাস, ঘরের বাতি নিভিয়ে দাও। এদিকে অন্ধকার নামতেই সদানন্দ জোয়ারদার ইনোভা গাড়ি চেপে এসে হাজির। কালিদাস প্রথমেই তাকে শেতলা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে একশ টাকার পূজো দেওয়ালো। তারপর তাকে নিয়ে সে বৈঠকখানার পিছনে বোমকালীর ঘরে হাজির হল।
বোমকালী ধুনিতে ধুলোপড়া দিতেই কটুগন্ধের ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেল আর সে বিকট গলায় বলতে লাগল, হ্রিং, ক্লিং, ট্রিং, ফ্রিং, হাম, নাম, ধাম, ভাম, ধুপ, রুপ, টুপ, চুপ ওঁ ফট। কালিদাস সদানন্দর কানে কানে বলল, বসে পড়ুন বসে পড়ুন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সদানন্দ হাতজোড় করে বোমকালীর উল্টোদিকে মেঝেতে থেবড়ে বসল। আধো আলো অন্ধকারে বোমকালীর মুখ ভালো করে দেখা যায় না, শুধু ধুনির আলোয় তার চোখ দুটো জ্বলছে। দুহাত মাথার উপর তুলে সে বাজখাঁই গলায় বলল, জয় মা শেতলা, বিশালাক্ষী, মনোবাঞ্ছা পূরণ কর মা। যজমান মূল্য এনেছ? সদানন্দ বিড়বিড় করছে দেখে কালিদাস তার কানে কানে বলল, বলুন হ্যাঁ বাবা মূল্য এনেছি।
– হ্যাঁ বাবা মূল্য এনেছি।
– কি মূল্য?
কালিদাস ফের বলল, বলুন পাঁচসহস্র টাকা।
সদানন্দ শুকনো গলায় বলল, সাড়ে চার হাজারের কথা হয়েছিল যে! কালিদাস চাপা গলায় বলল, আঃ এখানে অত হিসেব করতে নেই। দ্রব্যগুণ নষ্ট হবে। বলুন পাঁচসহস্র টাকা।
– পাঁচসহস্র টাকা।
– শেতলায় মতি?
কালিদাস বলল, বলুন মায়ের চরণে গতি।
– মায়ের চরণে গতি।
– কালিদাস কুলুঙ্গী থেকে বাক্সো নিয়ে এস।
কালিদাস দুহাতে করে কাঠের বাক্সো নিয়ে এসে বোমকালীর হাতে দিল। বোমকালী বাক্সো খুলতে দেখা গেল ভিতরে একটি চৌকো মাদুলি। সদানন্দ উঁকি মেরে মাদুলি দেখছে এমন সময় বোমকালী চিৎকার করে বলল, একি? কালিদাসের মুখ শুকিয়ে গেল, সে ঠোঁট চেটে বলল, কি হয়েছে বাবা?
বোমকালী আরও জোরে চেঁচিয়ে বলল, দেহান্তরী মাদুলি কই, এতো বাতের মাদুলি!
কালিদাস ফ্যালফ্যাল করে মাদুলির দিকে চেয়ে রইল। সব্বোনাশ করেছে। সে নকুড়েশ্বরকে পাঁচহাজারের দেহান্তরী মাদুলি দিয়ে দুশো টাকা নিয়ে এসেছে। হায় হায়! এখন কি হবে?
সদানন্দ তড়াক করে ব্যাগ চেপে ধরে উঠে পড়ে বলল, যাঃ শালা আরেকটু হলেই বাতের মাদুলি নিয়ে চলে যেতাম। এবার বলুন কবে কারেক্ট মাদুলি পাব। বোমকালী বাঘছালে বসে বলতে লাগল, আমি কি জানি? আমি তো মাদুলি বানিয়ে দিয়েছি। কালিদাসকে জিজ্ঞেস কর।
– কি পাঠক মশাই, আমার মাদুলি কবে পাব?
– দেখছি দেখছি। ডেলিভারিতে গোলমাল হতেই পারে। আমি তো পেমেন্ট নিই নি এখনো। নেক্সট উইকে আসুন।
– অত সময় দেওয়া যাবে না, দুএকদিনে সেটেল করুন। আচ্ছা ঝামেলায় পড়লুম রে ভাই! আমার মাল কাকে চালান করলেন? সদানন্দ উদ্বিগ্নমুখে বলল।
কালিদাস পাঠকের মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা, বড় কাস্টমার হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। সে মরিয়ার মত বলে দিল, ওসব জেনে আপনার কি? আমি ঠিক বার করে দেব। চার পাঁচটা দিন দিন।
সদানন্দ চলে যেতে বোমকালী কালিদাসকে বলল, কি গ্যাঁড়াকল করেছ কোন আইডিয়া আছে? গাধা কোথাকার!
কালিদাস শুকনো মুখে বসে রইল। সদানন্দ মাথা মুখ মুছতে মুছতে বলল, দুটো মাদুলি একই দিনে দিয়ে গেছিলুম। বার বার বলেছি একটা একটা করে কেস কর। বাতের মাদুলিটা কার?
কালিদাস হাতটাত কচলে বলল, ওটা নকুড়বাবুর। আমি ও মাদুলি ফেরত নিয়ে আসব কালকে।
বোমকালী খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল। কালিদাস বলল, হাসছেন কেন?
– কার থেকে ফেরত নেবে?
– কেন নকুড়েশ্বর প্রামানিকের থেকে?
– কিস্যু খবর টবর রাখো না।
– কিসের খবর?
– নকুড়বাবু নিরুদ্দেশ। আজ সকাল থেকে।
কালিদাস পাঠকের মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল,গলা শুকিয়ে গেল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল। সে হাঁ করে বোমকালীর দিকে চেয়ে রইল।

মেজবাবু কুন্তলীনি আর জিতু ধামুকে বাইকে তুলে দিয়ে এসে ফের শুটিং শুরু করালেন। ঝামেলার আগে অল্প কিছুটা তোলা হয়েছিল, আবার অনামিকাকে বুঝিয়ে শুঝিয়ে রাজি করানো হল, মেকাপের লোকজন এসে তার মুখে পাউডার ঘষতে লাগল, কুলার মেশিনের হাওয়ায় হিরোইনকে ঠান্ডাও করা হল। বাদশা এসে থানার ওসির শট দিল যাতে দেখানো হল গ্রামের মেয়ে অনামিকাকে সে জেরা করছে। এইসব দৃশ্যগুলি ডিরেক্টারের খুব মনপসন্দ হল না কিন্তু সে কোনরকমে লোকেশন শুটিং করে পালাতে পারলে বাঁচে। হিরো হিরোইনের শট হয়ে যেতেই একজন গুঁফো অ্যাসিস্ট্যান্ট হেঁকে উঠল, এবার পুলিশ কমিশনারের টেক।
পুলিশ কমিশনারের ভূমিকায় শিব শঙ্কর হাজরা। পনেরো সেকেন্ডের অ্যাপিয়ারেন্স, খাতিরের পার্ট। পুলিশ কমিশনার আর ওসির কথোপকথন। ঝুঁটিওলা ডিরেক্টার সাহাবাবুকে বললেন, পনেরো মিনিটের কফি ব্রেক নিচ্ছি। মিস্টার হাজরাকে রেডি হতে বলুন। কস্টিউম আর মেকাপের লোক পাঠাচ্ছি।
বড়বাবু যা চটে আছে, কি করবে কে জানে। ভাবতে ভাবতে মেজবাবু শিবু হাজরার ঘরে এসে দেখে তিনি ফ্যাকাশে মুখে চেয়ারে বসে নখ খাচ্ছেন। ঘরের কোনায় সিভিক ভলান্টিয়ার বাপী অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে। মেজবাবুকে দেখে হাজরা বললেন, সাহা নকুড় ম্যাডাম কই?
– তিনি তো বাড়ি ফিরে গেলেন।
– জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র?
– তারাও চলে গেছে স্যার।
শিবু হাজরা মেজবাবুকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, আমি কি অজ্ঞান হয়ে গেসলাম নাকি?
মেজবাবু ফিসফিস করে বললেন, না তো স্যার।
– বাপী বলছে আমি নাকি নকুড় ম্যাডামকে যাচ্ছেতাই করে বকেছি?
– ওরে বাপরে! যা দিয়েছেন না স্যার, লম্ফঝম্ফ এক্কেরে বন্ধ। সুড়সুড় করে পালাল।
হাজরা এই কথা শুনে চেয়ারের উপর ভেটকে পড়ে বললেন, অ্যাই মেরেছে! পাগল হলুম নাকি রে?
– কেন স্যার? বেশ করেছেন। সব সময় আমাদের চমকে বেড়ায়। এভাবে প্রশাসন কাজ করতে পারে?
– সাহা?
– স্যার?
– কিছু মনে পড়ছে না কেন বল দেখি? রেগে বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছিল নাকি?
– তাই হবে। আপনার তো রাগ করার অভ্যেস নেই স্যার। অনেকদিন বাদে হল কিনা।
– আমি ঠিক ডিপ্লোম্যাটিক্যালি সামলে নিচ্ছিলাম। কি যে হল!
– ছাড়ুন তো স্যার। আপনার শুটিং হবে বলল। মেকাপ আর পোষাকের লোক আসছে। রেডি হোন।
শিবশঙ্কর হাজরা রুমাল বার করে মুখ মুঝতে লাগলেন। তিনি ইতস্তত করে বললেন, শুটিংএর মুড নেই আর! এই জঘন্য জায়গায় পোস্টিং হয়ে আমার সব ফাইনার ব্যাপারগুলো নষ্ট হয়ে গেল!
বাপী বলল, করে দিন স্যার। আমাদের সবাইকে কমপ্লিমেন্টারি দেবে বলেছে।
শিবু হাজরা উদাস হয়ে বললেন, করে দিন বললেই হল? আর্টিস্টিক একটা ইয়ে আছে, সেটা বুঝতে হবে না?
মেকাপের বাক্সো নিয়ে একটা লোক ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, তাকে ড্রিবল করে ছেকুমিঞা ঢুকে পড়ে বলল, ওয়েট করুন, ওয়েট করুন। মেকাপের লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল।
সাহা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, বড়বাবুর শুটিং আছে স্যার। উনি মেকাপ আর্টিস্ট। ছেকু তাকে বিলকুল পাত্তা না দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বড়বাবুর উল্টোদিকে বসে বলল, শুটিং ফুটিং পরে হবেখন। বাপী দরজাটা ভেজিয়ে বাইরে দাঁড়া।
শিবু হাজরা চেয়ার ছেড়ে খানিকটা উঠে বললেন, নমস্কার সালাউদ্দিন সাহেব। একটা ফোন করে দিতেন, আমি চলে যেতাম।
– না। আমার থানায় আসার দরকার ছিল। আপনি নকুড়দার কেসটা শুনেছেন তো?
– হ্যাঁ। ওনার মিসেস এসেছিলেন। আমি দেখে নিচ্ছি।
ছেকু হাজরার হাতে মাদুলি দেখার চেষ্টা করছিল। জামার হাতা বড়, কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে খুব সিরিয়াসভাবে বলল, ডায়েরী নিয়েছেন?
– না। আমি নিজে একবার যাব। তারপর এফ আই আর।
ছেকুমিঞা টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে নিচুগলায় বলল, নকুড়বৌদির সঙ্গে কিসের ঝামেলা হল?
– আরে না না। ঝামেলা হবে কেন?
– আপনি তো ঠান্ডা মাথার লোক। অত চটে গেলেন কেন?
শিবু হাজরা একেবারে চুপসে গেলেন। তিনি মিনমিন করে বললেন, কি যে হল! মনে হয় খুব স্ট্রেস যাচ্ছে!
– কালচারাল লোক আপনি। আপনার কিসের স্ট্রেস?
– আমি মাইরি জানি না। এই বলে হাজরা রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে লাগলেন।
– স্ট্রেস বলে জ্যোতিষী ধরেছেন?
– মানে?
– মানে মাদুলি ফাদুলি পরছেন, তাই বলছি।
– মাদুলি? কিসের মাদুলি?
– ফালতু লুকোচ্ছেন কেন? ঐসব জিনিষের কি অ্যাকশান হয় জানেন না? আজকে রাগ করছেন, কাল হয়ত গুলি চালিয়ে দেবেন। কে দিল মাদুলি?
শিবু হাজরার মুখ হাঁ হয়ে চোয়াল ঝুলে পড়ল। তিনি বিস্ফারিত চোখে বললেন, আপনি কি বলছেন সালাউদ্দিন সাহেব, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– আপনার ডান হাতের বাজুতে একটা মাদুলি নেই?
হাজরা জামার হাতা তুলে নিজের বাহু দেখতে লাগলেন। কিস্যু নেই। তিনি ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, কোথায় মাদুলি?
ছেকু শান্তভাবে বলল, এখন নেই। কিন্তু ছিল।
– মানে?
– ভাল করে হাতটা চেক করে দেখুন দিকি, কিছু নজরে পড়ে কিনা?
শিবু হাজরা ‘কি নজরে পড়বে’ বলে বাহুতে হাত বুলিয়ে চুপ মেরে গেলেন। ছেকু বলল, কিছু নজরে পড়ছে?
– স্ট্রেঞ্জ! হাতে কিছু একটা ছিল মনে হচ্ছে।
ছেকু ঝুঁকে পড়ে শিবশঙ্কর হাজরার সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
মিনিট পাঁচেক বাদে বড়বাবুর ঘর থেকে বেল বাজতে মেজবাবু গিয়ে হাজির হলেন।
– সাহা। শুটিং ক্যানসেল। ওদের এসকর্ট করে করঞ্জলি পার করে দিয়ে এস।
– সেকি স্যার, আপনার-
– ডিরেক্টারকে বলে দাও, আমি পরে যোগাযোগ করব। ড্রাইভার জিতেন মন্ডলকে সুমো গাড়ি রেডি করতে বল, আমি রাউন্ডে বেরোব।
সাহা জানে কখন বড়বাবু কখন আর্টিস্ট আর কখন পুলিস। সে মুহুর্তে অ্যাটেনশান হয়ে গেল। মোবাইল ফোন বার করে জিতেন কে ফোন করতে গিয়ে একটু থমকে সে বলল, আমি যাব স্যার? সঙ্গে?
– না। তুমি এস আইকে নিয়ে প্লেন ড্রেসে মগরাহাটের শেতলা থানে যাবে।
– কালিদাস পাঠক?
– কিচ্ছু করবে না। মোড়ের মাথায় জগদম্বা মিষ্টান্ন ভান্ডারের দোতলাতে বসে নজর রাখবে।
ছেকুমিঞা আর শিবশঙ্কর হাজরা লালরঙের সুমোগাড়িতে উঠে বসল। দুজনেরই জামার হাতা বগল অবধি গুটোনো। হাজরা জিতেন মন্ডলকে বললেন, জামার হাতা গোটা। জিতেন চোখ গোল গোল করে বড়বাবুকে দেখতে লাগল। হাজরা নিজের জামার হাতার দিকে দেখিয়ে বললেন, দেখছিস কি? এইরকম করে জামার হাতা গোটা। জিতেন জামার হাতা গুটিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, কোথায় যাব স্যার?
– প্রামানিক ভবন চ। তাহলে সালাউদ্দিন সাহেব?
– আপনার হাতে দেখলে আমি খুলে নেব। আর-
– আপনার হাতে দেখলে আমি খুলে নেব।
জিতেন মন্ডল এইসব কথাবার্তা শুনে আরেকটু হলে ছাগল চাপা দিয়ে ফেলেছিল আর কি!

নকুড়েশ্বর প্রামানিকের হাওয়া শরীরের সুবিধে অসুবিধে দুই আছে। সুবিধে হল এ শরীর নামেই শরীর, এর না আছে ভার না আছে ধার। হাঁটাচলার কোন প্রশ্ন নেই, উড়ে ভেসে দিব্বি ঘোরাঘুরি। তারপর কেউ দেখতে পায় না, ফলে মনের সুখে আড়ি পাতা যায়। লোকের গোপনীয় ব্যাপার স্যাপার জানতে কার না আর ভালো লাগে? কিন্তু অসুবিধেগুলো মারাত্মক। এমনিতেই মানুষ সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই আগে দেখতে পায়, নকুড় এই ক ঘন্টায় একেবারে জেরবার হয়ে গেলেন।
এক নম্বর অসুবিধে হল কিছু ধরাছোঁয়ার জো নেই। তিনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন স্পষ্ট কিন্তু সেটা যেন সিনেমার ছবি। সে দেখায় তিনি থেকেও নেই। তাঁর কথা কেউ শুনতে পাচ্ছে না, তাঁকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এদিকে বিড়ির নেশা উঠছে চরম। নেশা অথচ বিড়ি টানার উপায় নেই। ধরতেই পারছেন না যে। খালি নেশা নয়, শরীরের ভার গেলে কি হয়, দুশ্চিন্তা তো পিছু ছাড়ছে না। বাতিল নোটগুলোর কোন ব্যবস্থা হল না, গয়নার দোকানের ক্যাশে কেউ নেই, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে চাট্টি ভাত না খেলে কি করে চলে? এইরকম হাওয়া শরীরের থেকে তাঁর নিজস্ব ভুঁড়িবহুল, গাঁটেব্যথা, হাঁসফাঁস করা রক্তমাংসের শরীর হাজারগুণে ভাল। সেখানে কিভাবে ফেরা যায় ভেবে ভেবে নকুড়ের অদৃশ্য মাথা ধরে যাবার উপক্রম হল।
সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল, চারদিকে ঢিঢি পড়ে গেছে। তিনি যে ভ্যানিশ সে খবর ঘন্টাকয়েকের মধ্যে লোকে জেনে গেছে। কুলপীর লোক যেমন বাচাল তেমন কানপাতলা, এর মুখে ওর মুখে নকুড়ের নিরুদ্দেশ কাহিনী দাবানলের মত ছড়াচ্ছে। তিনি অলরেডি বাজারহাটে তিন চার রকমের সংস্করণ শুনেছেন। তার উপরে কুন্তলীনি তার দুই কুলাঙ্গার পুত্রকে নিয়ে থানায় যা করে এসেছে তাতে পুলিসও হাত ধুয়ে তার পিছনে পড়বে। নকুড়েশ্বরের মনে কুডাক ডাকতে লাগল। এমন অবস্থা না হয় শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাকাপাকি ভাবে অদৃশ্যই থেকে যেতে হয়। এটা ঘটনা যে তিনি মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে তার ইচ্ছের দখল নিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু এভাবে একের পর এক এমার্জেন্সি তিনি কতক্ষণ সামলাবেন? একসঙ্গে কটা লোকের মধ্যে ঢুকবেন তিনি? নকুড়েশ্বর প্রামানিক তাঁর দোতলার ঘরের সামনের বারান্দার উপর ভেসে ভেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।
এমন সময় দেখা গেল ধর্মেন্দ্র আর জিতেন্দ্র এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। তাদের ভাবভঙ্গি খুবই সন্দেহজনক। একসময়ে তারা দুজন তাঁর ঘরের তালাবন্ধ দরজার সামনে এসে দাড়াল। ধর্মেন্দ্র জিতেন্দ্রকে বলল, তুই ঠিক জানিস এটাই ডুপ্লিকেট চাবি?
আমি তালাটা চিনি। এস্টোর ঘরে ডুপ্লিকেট চাবির গাদা থেকে ঠিক খুঁজে বার করেছি। এই বলে জিতেন্দ্র পকেট থেকে একটা চাবি বার করে তালা খুলতে লাগল।
আর ঘন্টাখানেক আগে হলেও নকুড় স্যুট করে জিতেন্দ্রর মধ্যে ঢুকে যেতেন। কিন্তু এখন তাঁর অভিজ্ঞতা বেড়েছে। তিনি ভুস করে ভেসে ঘরের মধ্যে ঢুকে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
জিতু ধামু ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক হাঁটকাতে লাগল। এই ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা পালঙ্ক, একটা ড্রেসিং টেবিল, কাচলাগানো কাঠের আলমারি, একটা আলনা আর একটা পুরোনো লোহার সিন্দুক। এই পুরোনো লোহার সিন্দুকটা নকুড়েশ্বর পোর্ট ট্রাস্টের একটা অফিসঘরের নিলাম থেকে কিনেছিলেন। এতে দুটো চাবি লাগে খুলতে। জিতেন্দ্র আগে এই ঘর একবার হাঁটকেছে, তাই সে সোজা কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে ভাঁজকরা জামাকাপড় চাদর মাদর তুলে তুলে সিন্দুকের চাবি খুঁজতে লাগল।
ধর্মেন্দ্র বলল, টাকা আছে ভিতরে?
– অল্প কিছু ছিল।
– ছিল মানে? কোথায় গেল?
– চুপ কর না!
– ও হরি। তুই ঝেড়েছিস।
– তোকে হাফ দেব। চেঁচাস না।
– কত ছিল?
– হাজার ছয়েক মনে হয়। গুনবার সময় পাইনি।
– দে আমার ভাগটা দে!
জিতেন্দ্র খুব বিরক্তিভরে বলল, আমি খুব জরুরী জিনিস খুঁজছি। এখন টাকা টাকা করিসনি।
– কি জিনিস?
– ঐ সিন্দুকের চাবি। সব টাকাকড়ি ওতেই তালাচাবি দিয়ে রাখে।
– বুড়ো বহুত বজ্জাত তো! সর সর আমিও দেখি।
রাগে নকুড়েশ্বরের গা পিত্তি জ্বলে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, যদি বা কিছু সম্পত্তি দিতুম, তোদের আর কাঁচকলা দেব। বাপকে বলে বুড়ো বজ্জাত?
সিন্দুকের চাবি না পেলেও জিতু ধামু নকুড়েশ্বরের আলমারী থেকে এক এক করে বন্ধকী দলিল, পুরোনো রশিদপত্র, ট্যাক্সো ফাঁকি দেবার জন্যে দুনম্বরী হিসাবের খাতা বার করে দেখতে লাগল। এসব জিনিসের মর্ম তারা বোঝে না, তারা ক্যাশ টাকা খুঁজছে। নকুড়েশ্বর ভাবতে লাগলেন জিতু ধামু কি তাঁর পালঙ্কের গদি তোষক তুলে চাবি খুঁজবে? ঐ বিশ লক্ষ টাকা পাঁচশো আর হাজারের নোটে আছে বলে এমনিতে তামাদি, কিন্তু তাঁর অন্তত দশটা বেনামী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, সেখানে ঐ টাকা তিনি জমা দেবার ব্যবস্থা করছিলেন। জিতু ধামুর হাতে ঐ টাকা বেকার কাগজের চেয়ে বেশি কিছু না। এদের দেখে এখন তাঁর মনে হতে লাগল ঐ বাতিল টাকা এদের হাতে পড়লেও তাঁর কিছু যায় আসে না। ও টাকা তিনি ছমাসে কামিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু এই ধর্মের ষাঁড় দুটোকে আচ্ছাসে টাইট না দিলে তাঁর অদৃশ্য হয়েও শান্তি নেই।
এই সময় জানলা দিয়ে দেখা গেল কুলপী থানার লাল সুমো এসে প্রামানিক ভবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে এল ছেকুমিঞা আর শিবু হাজরা। জিতু আর ধামু মুখ চাওয়াচাউই করতে লাগল। থানা থেকে লোক এসেছে মানে তো এবার নকুড়েশ্বরের ঘর সার্চ হবে। ধর্মেন্দ্র বলল, পালাই চ!
– সাত তাড়া কাঁড়ি করে ছড়ালি যে? এগুলো ঢোকা এখন। জিতেন্দ্র বলল।
– অমনি আমার দোষ না? তুই তো সিন্দুকের চাবি খুঁজতে গেলি।
দুজনে উবু হয়ে বসে হুড়মুড় করে দলিলপত্তর কাচলাগানো আলমারিতে গুঁজতে লাগল। কিন্তু তারা যত তাড়াহুড়ো করে ততই কাগজ লাট হয়ে এদিক ওদিক ছিটিয়ে পড়তে থাকে। এদিকে সিঁড়ির নীচ থেকে শ্যামাচরণ চেঁচিয়ে বলল, অ কত্তামা, পুলিস এইছে, দাদাবাবুরা কোথায় গ! কুন্তলীনি তাড়াতাড়ি করে তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, আপনার এতক্ষণে সময় হল?
শিবু হাজরার পা অলরেডি সামান্য কাঁপছে, তবু তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, আপনাদের বাড়ি ঘুরে দেখব।
কুন্তলীনি বললেন, সে দেখুন না। জিতু ধামুকে সঙ্গে দেব?
ছেকু বড়বাবুর কানে কানে কি যেন বলতে তিনি বললেন, দরকার নেই। আচ্ছা এ বাড়িতে কে কে মাদুলি পরে?
কুন্তলীনি ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ করে বললেন, কত্তা পরতেন। মানে সপ্তাহখানেক আগে ধারণ করেছিলেন আর কি!
– কালিদাস পাঠকের মাদুলি?
– হ্যাঁ। আপনাকে বলেছি তো!
– আর কেউ পরে?
– আপনে পরেন দেখিছি।
– ধ্যাত। এ বাড়িতে আর কেউ পরে?
– না।
ছেকু বলল, বড়বাবু আগে নকুড়দার ঘরটা –
শিবশঙ্কর হাজরা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। নকুড়বাবু কোন ঘরে থাকতেন, ইয়ে কোন ঘর থেকে ভ্যা- মানে নিরুদ্দেশ হয়েছেন?
শ্যামাচরণ আবার চেঁচাল, অ দাদাবাবুরা, তোমরা কই গেলে গো?
কুন্তলীনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ কানের গোড়ায় চেঁচাচ্ছিস কেন? আছে এদিক ওদিক কোথাও। যা বড়বাবুকে কত্তামশাইয়ের ঘরটা দেখা। তোর কাছে তো চাবি।
ছেকু বলল, ঘরের চাবি শ্যামার কাছে কেন?
ধর্মেন্দ্র আর জিতেন্দ্র সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এসেছিল। জিতেন্দ্র বলল, সেটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার। আপনাকে বলতে যাব কেন?
পা কাঁপছে বলে শিবু হাজরা দেয়ালে হাত দিয়ে ব্যালান্স নিতে নিতে বললেন, না বললে থানায় নিয়ে গিয়ে এজাহার নেব। অঞ্চলপ্রধান জানতে চাইতেই পারেন। এই সময় জিতেন মন্ডল ঘরে ঢুকল, তার হাতে একটা মোটা লাঠি। দশাশই চেহারার জিতেন বড়বাবুর পাশে দাঁড়াতেই ধর্মেন্দ্র বলল, না না তদন্তের স্বার্থে বলতে হবে বইকি। শ্যামা জোর করে চাবি ওর কাছে রেখেছে। বাবার খাস লোক, আমরা কি বলব?
শ্যামাচরণ হাঁউমাউ করে উঠে বলল, আমি কেন রাখতে যাব। গিন্নিমা বললেন তাই রেখেছি। এই নাও চাবি, আমি রাখব না।
ছেকু বলল, আগে ওপরে গিয়ে ঘরের দরজাটি খোল দেখি চাঁদু। চলুন বড়বাবু।
সকলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। নকুড়েশ্বর বারান্দার উপর ভেসে ভেসে বলতে লাগলেন, অসহায় শ্যামাকে ফাঁসানো? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।

শিবশঙ্কর হাজরা নির্বিরোধী কালচারাল টাইপের লোক বলে এলাকাবাসী যতই হাসাহাসি করুক, ছেকুমিঞা দেখল তাঁর একখানা খাসা পুলিসমার্কা মাথা আছে। বড়বাবু নকুড়েশ্বরের ঘরে ঢুকেই চারদিক দেখতে লাগলেন। এমনিতে ঘরখানায় তেমন বিচিত্র কিছুই নেই। বিছানা বালিশ দেখে মনে হয় কেউ সেখানে শুয়ে ঘুমিয়েছে কাল রাতে। খাটের পাশে একজোড়া চটি পড়ে আছে। বালিশের পাশে একটা হাতঘড়ি। খাটের পাশে একটা টেবিলে জলের আধখালি গ্লাস, তার পাশে চশমার খাপ, বিড়ির প্যাকেট আর দেশলাই। টেবিলে হেলান দিয়ে রাখা একটা বেতের ছড়ি। বালিশের পাশে তালগোল পাকানো সম্ভবত একটা ফতুয়া। আলনাতে শার্ট প্যান্ট ঝুলছে। বড়বাবু এইসব দেখতে দেখতে বললেন, কে প্রথম দেখল উনি ভ্যা- মানে নেই?
শ্যামাচরণ লাস্ট পাঁচমিনিট হাতজোড় করে আছে। সে করুণভাবে বলল, এজ্ঞে আমি। আমি কত খুঁজনু, কত ডাকনু, বাবু আপনে কোতায়-
বড়বাবু কথা কেটে বললেন, চোপ। যা জিজ্ঞেস করব তার উত্তর ছাড়া কেউ কিছু বলবে না। আমার গুলিয়ে যায়। তারপর আর কে কে এ ঘরে এসেছে?
শ্যামাচরণ গলাঝাড়া দিয়ে বলল, এজ্ঞে কামিনী।
– সে কে?
ধর্মেন্দ্র বলল, কাজের লোক। ঝাঁট দিতে এসেছিল।
– বুঝেছি। আর কে এসেছিল?
– মা এসেছিল।
– আর?
– শ্যামা বোধহয় সেকেন্ড টাইম এসেছিল।
– ব্যাস? আর কেউ আসেনি?
– না।
শিবু হাজরা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তার হাত পা আর কাঁপছে না। ক্রাইম সিনে তিনি রাজা। ধর্মেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, তুমি আসনি?
– না।
– তোমার ভাই, জিতেন্দ্র?
– না।
– কেন?
জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র চোখাচোখি করল। তারপর জিতেন্দ্র বলল, কেন মানে?
– কেন বুঝছ না? বাবা ঘর থেকে নিরুদ্দেশ, কাজের লোকরা এসে দেখল, মা এল, ছেলেরা এল না কেন? বলতে বলতে শিবু হাজরা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। জিতু ধামু এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তাদের মুখে কথাটি নেই। আলনায় জামাকাপড়গুলোর দিকে দেখিয়ে বড়বাবু বললেন, এগুলো নকুড়বাবুর জামা?
জিতু ধামু সমস্বরে বলল, হ্যাঁ স্যার।
পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে বড়বাবু একটানে কাচলাগানো আলমারী খুলতেই ভিতর থেকে কাগজপত্র ফোয়ারার মত ঝরে পড়ল। আলমারীর ভিতরের অবস্থাও লন্ডভন্ড। ছেকুমিঞা বলে উঠল, একি! এতো চোরের কান্ড!
বড়বাবু বললেন, কাজের লোক কারা?
শ্যামাচরণ ডুকরে উঠে বলল, আমি এরম দেখি নাই স্যার। কত্তামশাইএর আলমারী সবসময় টিপটপ থাকে।
স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ! তালাবন্ধ ঘরে চোর? বলতে বলতে বড়বাবু টেবিলের উপর থেকে শঙ্খবিড়ির বান্ডিল তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন। শ্যামাচরণ এইবার শব্দ করে কাঁদতে লাগল।
– সালাউদ্দিন সাহেব, এই বিড়ির প্যাকেটে কটা বিড়ি থাকে? বললেন বড়বাবু।
ছেকু উঁকি দিয়ে প্যাকেটটা দেখে বলল, কুড়িটা।
– এতে বারোটা আছে। তার মানে –
শ্যামাচরণ ‘অ বাবু গ, আমি বিড়ি রেখে দিয়েছি গ’ বলতে বলতে শিবু হাজরার পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। হাজরা বাবু ‘এই কি হচ্ছে কি, পা ছাড়, কাতুকুতু লাগে’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। এইসব গোলমালের মধ্যে চুঁক করে ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল না, শুধু শ্যামাচরণ একটু কেঁপে উঠল। নকুড়েশ্বর দেখলেন কান্নার চোটে তার সারা শরীর তোলপাড়, সম্ভবত সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। হুড়োহুড়ির মধ্যে তিনি হাতের মাদুলিটা ঠেসে উপরে তুলে ফতুয়ার হাতা দিয়ে ভাল করে ঢাকলেন তারপর ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলেন। বাঃ কাঁদতে তো বেশ লাগে?
বড়বাবু পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, তার মানে তুমি মালিকের বিড়ি ঝাড়ো! এই ঘরের চাবি তোর কাছে থাকে না?
জিতু ধামু সমস্বরে বলল, ছি ছি শ্যামাদা, বাবা তোমায় কত বিশ্বাস করত, তুমি কিনা আমাদের ঘরের লোক, আর তুমিই শেষে বাবার আলমারি হাঁটকেছ? ছি!
কুন্তলীনি ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব দেখছিলেন। তিনি বললেন, শ্যামা তুই বাবুর ঘরে ঢুকেছিলি?
শ্যামা চোখটোখ মুছে বলল, মা কালীর দিব্যি গিন্নিমা, আমি এ ঘরে ঢুকিনি। তবে কে ঢুকেছিল দেখেছি মা!
শিবু হাজরা গম্ভীর গলায় বললেন, তুই তো দেখি দারুণ সেয়ানা! ঘরে কে ঢুকেছিল তুই দেখেছিস?
– হ্যাঁ দেখেছি।
– তাই। কে ঢুকেছিল বল!
– দাদাবাবুরা ঢুকেছিল।
সবাই একমুহুর্তের জন্য চুপ মেরে গেল। তারপর জিতেন্দ্র হাসতে হাসতে বলল, বেশ বেশ! তোমার কাছে চাবি আর আমি ঢুকব ঘরে?
শ্যামাচরণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সে চাবি তো তোমার কাছেও আছে গ দাদা। এস্টোর থেকে একঘন্টা ধরে খুঁজে খুঁজে চাবির নকলটা বার করলে যে?
জিতেন্দ্র পোঁ করে ঘুরে ঘর থেকে পালাতে গিয়ে জিতেন মাহাতোর পেটে গোঁত্তা খেয়ে উল্টে পড়তে যায়, জিতেন এক হাতে তাকে ক্যাঁক করে ধরে ফেলে বলল, আরে দেখে চলবেন তো, এভাবে কেউ মানুষকে ধাক্কা মারে?
শিবু হাজরা চেঁচিয়ে বললেন, জিতেন ওর পকেট দ্যাখ তো!
জিতেন মাহাতো জিতেন্দ্রর পকেট থেকে একটা চাবি বের করে আনতে সে এমন ভাবে সেটার দিকে দেখতে লাগল যেন তার পকেট থেকে আইফেল টাওয়ার বেরিয়েছে। ছেকু মন্ডল বলল, ওটা কি দরজার তালার চাবি?
এক সেকেন্ডে বোঝা যাবে। বলে জিতেন দরজার তালা সেই চাবি দিয়ে খুলে চেক করে নিল।
শিবু হাজরা শ্যামাচরণের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ঢুকে কি করছিল দেখেছিস?
শ্যামা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, সে কথা বলতে বুক ফেটে যায় স্যার –
– বুকের নিকুচি করেছে। বল কি দেখেছিস?
– ওরা বাবুর অত কষ্টের রোজগারের টাকা, বাবু ঐ আলমারীতে রাখেন আর বলেন বুঝলি শ্যামা এই টাকা দিয়ে ছেলেগুলোর জন্যে ভাল ভাল মাছ মাংস-
– আ মোলো যা! কি দেখলি বলবি না বলবিনা?
– ওরা বাবুর আলমারি থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিল!
জিতেন্দ্র চিৎকার করে বলতে লাগল, মিথ্যে কথা স্যার। বানিয়ে বলছে!
– আমি মিথ্যে বলছি? বাবুর চাদরের ভাঁজে দশহাজার টাকা ছিল, তুমি সেগুলো নিলে না?
ধর্মেন্দ্র তখন বলল, না না ছ’ হাজার টাকা! বলে সে ফ্যাকাশে মুখে জিভ কাটল।
শিবু হাজরা উত্তেজনায় প্রায় নাচতে নাচতে বললেন, তবে রে ব্যাটা চোরের অ্যাকমপ্লিশ। আমি সিওর এরাই নকুড়বাবুকে কোথাও চালান করেছে!
কুন্তলীনি বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন। ধর্মেন্দ্র আর জিতেন্দ্র বলতে লাগল, প্রমাণ করতে পারবেন? এভিডেন্স আছে? আর শ্যামা শালা তোমাকে দেখছি দাঁড়াও।
ছেকু মিঞা বলল, আচ্ছা এর সঙ্গে নকুড়দা গায়েব হয়ে যাবার কি কোন সম্পক্ক আছে?
আলবাৎ আছে। এয়ারশিপ ফিউড। বুঝলেন না? বাপ ফুটোকড়ি ঠেকায় না, তাই তাকে হাপিশ করে লুঠপাট। বললেন বড়বাবু।
ছেকু শ্যামাকে বলল, তুই ওদের চোখে চোখে রাখতিস? নকুড়দার অর্ডার?
শ্যামা করুণ মুখে বলল, আমি সামান্য চাকর মানুষ, কত্তা হুকুম করলে কি না করতে পারি?
– পয়সা ঝেড়ে তারপর ঘর হাঁটকাচ্ছিল কেন জানিস?
– সে আমি জানি নে বাবা। তবে বলছিল, বাবা এখন উধাও, সব বাতিল নোটগুলো এনে বাবার বিছানার তলায় রেখে দিই! যাতে লোকে আমাদের সন্দো না করে! বলে শ্যামাচরণ ধূতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে লাগল।
ধর্মেন্দ্র আর জিতেন্দ্র ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল, আর জিতেন মাহাতো নকুড়েশ্বর প্রামানিকের পালঙ্কের গদিতোষক উল্টে উল্টে দেখতে লাগল। শেষে একপরত তোষকের তলা থেকে যখন পাঁচশো আর হাজারের বান্ডিল বেরোতে লাগল, তখন শিবশঙ্কর হাজরা জয়ধ্বণি দিয়ে বললেন, ইউরেকা! জিতেন নোটে হাত দেবে না। সব কি বাতিল নোট?
জিতেন মাহাতো বলল, হ্যাঁ স্যার। সব বাতিল নোট।
জিতেন্দ্র মেঝেতে বসে পড়ে বলল, আমরা এর কিচ্ছু জানিনা। সত্যি বলছি। ধর্মেন্দ্র বলল, চক্রান্ত করে আমাদের ফাঁসানো হচ্ছে!
কুন্তলীনি চেরা বাঁশের মত গলায় বললেন, তাই উনি বলতেন কুন্ত আমার ক্যাশ মিলছে না, ক্যাশ মিলছে না। তোরা এমনি নরাধম?
শিবশঙ্কর হাজরা বললেন, জিতু ধামু তোমরা থানায় চল। এজাহার নেব। এ বাড়ি ছেড়ে কেউ কোথাও যাবে না। শ্যামাচরণ তুমিও না। ফোর্স পাঠাচ্ছি বাড়ি তল্লাশি হবে।
ছেকুমিঞার গায়ে কাঁটা দিল। এতো মনে হচ্ছে খুনখারাবী কান্ড!
জিতু ধামু হেঁটে হেঁটে লাল সুমোতে উঠল। জিতেন মাহাতো তাদের দরজা লক করে দিল। শিবু হাজরা গাড়িতে উঠে বসতেই ভোলা কোথা থেকে ছুটে এসে বলল, এদের অ্যারেস্ট করেছেন স্যার? ছেকু তাকে হাত তুলে থামিয়ে বলল, ইস্টপ। এখানে শুরু করিস না ভোলা।
ভোলা মোটে সে কথা শুনল না, সে চ্যাঁচাতে লাগল, বেশ হয়েছে অ্যারেস্ট হয়েছে। শালারা বড়মানুষের ব্যাটা বলে সর্বহারার গায়ে হাত? এবার তোদের দশবছর সশ্রম কারাদন্ড হলে বুঝবি।
ছেকু মিঞা বড়বাবুকে বলল, আমি আর গিয়ে কি করব?
– আসবেন কিন্তু পরে। উইটনেস স্টেটমেন্ট লাগবে।
– বড়বাবু?
– বলেন।
– শ্যামাচরণের হাতটা দেখেছিলেন কি? খেয়াল করে?
– অ্যাঁ? ওঃ সেই মাদুলি কেস। আরে না মশাই। সব ঝোপে বাঘ দেখবেন না।
ছেকু একবার প্রামানিক ভবনের দিকে দেখল। বড়বাবুই ঠিক বলছেন হয়ত।

সাড়ে সাতটার সময় সদানন্দ জোয়ারদারকে বগলে ব্যাগ চেপে ধরে মগরাহাট শেতলা মন্দিরের সামনে কালিদাস পাঠকের সঙ্গে উত্তেজিতভাবে কথা বলতে দেখা গেল। জগদম্বা মিষ্টান্ন ভান্ডারের ছাত দুটো বড় বিজ্ঞাপনের বোর্ডে প্রায় ঢাকা। একতলার ছাত, সিঁড়িঘরের কাছে টিমটিম করে একটা বাল্ব জ্বলছে। নোংরা ছাতের এককোনে কাঁড়ি করে রাখা ভাঙ্গা কাঠকুটো। মশা কামড়ে কামড়ে কার্তিক সাহা আর এস আই প্রবীর দত্তের লিটার কানেক রক্ত খেয়ে ফেলেছে বোধহয়। জগদম্বার মালিক এক্স পুলিস, সে দয়া করে একটা পেরেক ওঠা বেঞ্চি এনে দিয়েছে তাই নইলে এতক্ষণ রেকি ডিউটি সম্ভব হত না। ছাতে বসে তারা কালিদাস, বোমকালী আর সদানন্দর গতিবিধি নোট করেছে। প্রবীর ফোনে এদের কিছু ভিডিও তোলার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু ব্যাটারী ডাউন হতে রণে ভঙ্গ দিয়েছে। সদানন্দকে দেখে মেজবাবু মোবাইল ফোন বার করে বড়বাবুকে ফোন লাগাল।
– স্যার?
– ওখানে কি খবর হে?
– স্যার কিছু একটা ক্ল্যানডেসটাইন অ্যকটিভিটি হচ্ছে। সিওর।
– সাহা বাংলাতে বল ভাই।
– কালিদাস এখানে একটা ঝাড়ফুঁকের কারবার চালায়, ব্যাকডোরে।
– পুরোনো খবর।
– না স্যার মালদার লোকজন আসে, দরজা বন্ধ করে ধুনি জ্বালিয়ে কাজকম্ম হয়। একটা কাপালিক গোছের লোক আসে।
– ক্রিমিনাল ব্যাপার?
– সেটা দেখতে হবে। তবে আজকে বারুইপুরের একটা ল্যান্ডমাফিয়া এসেছে স্যার। সদানন্দ জোয়ারদার।
– কোন সদানন্দ? ঐ যে যার নামে বস্তিতে আরসনিংএর রিপোর্ট হয়েছিল?
– হ্যাঁ স্যার। সোনারপুরে দুটো গুমখুনের কেসও ছিল। ধরা যায় নি।
– ছাড়। অন্য থানার ব্যাপার। আমাদের এমনিতেই অনেক লোড।
– কালিদাসকে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করব?
– না। এখন ঘাঁটিও না। অঞ্চলপ্রধান বলছে নকুড় প্রামানিকের ভ্যানিশ হওয়ার সঙ্গে কালিদাসের মাদুলির একটা যোগ আছে। ওকে আর একটু ওয়াচ করতে হবে।
প্রবীর দত্ত কাছে এসে মশার কামড়ে গা হাত জ্বালা করার মূকাভিনয় করছে দেখে মেজবাবু বললেন, স্যার?
– স্যার একটা কথা ছিল।
– বল।
– বলছিলাম আজকের মত থানায় ফিরে যাই? মশায় খেয়ে ফেলে দিচ্ছে স্যার।
– আরে হ্যাঁ হ্যাঁ চলে এস। আমি কাল থেকে কালিদাসের পেছনে অন্য লোকের ব্যবস্থা করব। থানাতে এসে জিতু ধামুর এজাহারের কপি রেডি করে দাও।
– ও বাবা। ওদের জেরা করেছেন নাকি স্যার? ধরেছেন মাল দুটোকে?
– সে অনেক গল্প। এসে শুনবে।
ফোন সেরে মেজবাবু এস আই কে ডেকে বললেন, চলুন। এখানের ডিউটি শেষ। প্রবীর হাঁফ ছেড়ে বাঁচার ভঙ্গি করে বলল, কালিদাস?
ওর অন্য ব্যবস্থা হচ্ছে। বললেন মেজবাবু। সদানন্দ ইনোভা চেপে হুশ করে বেরিয়ে গেল।
এদিকে কালিদাস পাঠক ঘরে ঢুকে বোমকালীর সামনে গরুচোরের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। বোমকালী রক্তাম্বর ছেড়ে ধুতি জামা পরে নিয়েছে। সামনে একটা আয়না রেখে সে চুল আঁচড়াচ্ছে। চুলে বেশ তেল টেল মেখেছে বলে তাকে দেখে আর কাপালিক মনে হচ্ছে না। কালিদাস খানিকক্ষণ পা ঘষে টষে মিনমিন করে বলল, সদানন্দ তো শাসিয়ে গেল।
বোমকালী হেঁড়ে গলায় বলল, শাসাবে না? চার মাস ঘুরিয়ে বাতের মাদুলি ধরাচ্ছিলে। মারেনি ভাগ্যি ভাল।
– আমি এখনো পেমেন্ট নিই নি তো।
– চারমাস ঘুরিয়েছ, তার দাম নেই? তাছাড়া আমি মাল ডেলিভারি করে দিয়েছি আমার পয়সা বুঝিয়ে দাও।
– আমি পয়সা কোথায় পাব?
– তার আমি কি জানি?
কালিদাস বোমকালীর উল্টোদিকে উবু হয়ে বসে বলল, আচ্ছা এর কোন কাটান নেই?
– কাটান মানে?
– মানে ধর নকুড়েশ্বরের হাতে মাদুলির অ্যাকশান বন্ধ হয়ে গেল। তাহলে তো ওকে ফের দেখা যাবে নাকি? তখন আমি গিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে-
বোমকালী উচ্ছে খাওয়ার মত মুখ করে বলল, দালালী করে করে এক্কেরে গাধা হয়ে গেছ। দেহান্তরী মাদুলি কি ইলেকট্রিক সুইচ যে টিপবে আর পট করে অফ হয়ে যাবে?
কালিদাস শুকনো মুখে বলল, ও। তা কতদিন অ্যাকশান থাকে?
– অ্যালোপ্যাথি ওষুধ নয় হে। এক্সপায়ারি ডেট নাই।
– তাহলে তো সদানন্দর হাতে পড়লেও ঝামেলা। কাজ হয়ে যাবার পর ও জিনিষ তো উটকো লোকের হাতে থাকলে মুশকিল।
– সদানন্দকে বলা ছিল সাতদিনের মধ্যে কাজ হাসিল করে মাদুলি গঙ্গায় ফেলতে। নইলে ও ভেদবমি হয়ে মরবে।
– সেটাই নকুড়বাবুকে গিয়ে বলি।
– পেলে তো বলবে।
কালিদাস পাঠক কাতরভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, কি গেরোতে পড়লুম রে বাবা। দুদিনের মধ্যে মাদুলি না দিলে সদানন্দ আড়ং ধোলাই দেবে বলছে। এমন মাদুলি কেন যে পরলে ভ্যানিশ হয়ে যায়?
– এমন জানলে আমি অর্ডার নিতুম নে!
বোমকালী চুল ঝুঁটি করে বাঁধা শেষ করেছে। সে একটু ভেবে বলল, একটু ওভারডোজ হয়ে গেছে। এসব জিনিষ অত নিক্তি মেপে হয় না।
– মাদুলি খুলে ফেললে?
– একদম বারণ। খুললে ধারণের গুণ নষ্ট।
– ও বাবা। কিন্তু ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া লোকের মাদুলিও তো ভ্যানিশ, নাকি?
– বলা মুশকিল। এ মাদুলি তিনচারদিনের বেশি পরার কথা নয়। তুমি কদিন আগে দিয়েছ নকুড়েশ্বর কে?
– এক সপ্তাহ।
– তাহলে ভ্যানিশ হবে না তো কি হবে? দেহান্তরী মাদুলি। ও জিনিষ পরে অন্য লোকের উপর ভর করা যায়।
– নকুড়বাবু আর কার উপর ভর করবে?
বোমকালী হঠাৎ বলে উঠল, জয় তারা! একটা উপায় আছে, বুঝলে?
– সেটাই তো জানতে চাচ্ছি এতক্ষণ ধরে!
– মাদুলি যে ধারণ করে সে মাদুলি সমেত ভ্যানিশ হয়। কিন্তু সে যখন অন্যের উপর ভর করে তখন তার হাতে মাদুলি দৃশ্যমান। জয় মা শেতলা!
– ধুস। তাতে কি হল?
– তখন টুক করে মাদুলিটে খুলে নিলেই হল! কালিদাস?
– আজ্ঞে?
– কুলপী যাও। গিয়ে খোঁজ কর কার কার হাতে নতুন মাদুলি উঠেছে।
কালিদাস পাঠক মরিয়ার মত ভাবতে লাগল, এ কাজ কি সম্ভব? কি ভাবে খড়ের গাদার মধ্যে ছুঁচ খোঁজার মত সে মাদুলি খুঁজবে? লোককে বলবেই বা কি? সে চিন্তিত ভাবে বোমকালীকে বলল, এছাড়া পথ নেই?
বোমকালী খ্যাঁকশেয়ালের মত মুখ করে বলল, না। এছাড়া পথ নাই। শোনো হে কালিদাস, এ যে সে জিনিষ নয় বুঝেছ? এ পিশাচসিদ্ধ বস্তু। যত দিন যাবে এর ক্ষমতা বাড়বে। ধারণকারী ক্রমশ প্রেতযোনি প্রাপ্ত হবে। প্রেতযোনি বোঝ? প্রেতযোনি?
কালিদাস কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, নিশ্চয়ই খুব খারাপ জিনিষ। আমাকে ভয় দেখাবেন না। আমার হার্টের ব্যামো আছে।
এইসময় কালিদাসের পকেটে মোবাইল ফোন বাজতে লাগল। সদানন্দ জোয়ারদার ফোন করেছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন ধরতেই ওদিক থেকে সদানন্দ বলল, পুরুতমশাই সাবধানে থাকবেন।
কালিদাস তোতলাতে তোতলাতে বলল, কেন?
– আপনার পেছনে পুলিস লেগেছে।
– অ্যাঁ? কে বলল?
– আমার গাড়ির ড্রাইভারের কাছে খোঁজখবর করেছে।
– সেকি? কেন?
– আমি কি জানি? তবে আমি একমাইল দুর থেকে পুলিসের গন্ধ পাই। আপনাকে ওয়াচ করছে।
কালিদাস পাঠকের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তার মুখে আর কথা সরে না। সদানন্দ বলল, আমি আর আপনার ওখানে যাচ্ছি না। আপনি কাল সন্ধের মধ্যে বারুইপুরে মাল ডেলিভারি দিন। উত্তরে কালিদাস আঁউ বলে একটা শব্দ করল। সদানন্দর ফোন কেটে গেল।
বোমকালী উঠে দাঁড়িয়ে ঝোলা কাঁধে তুলতে কালিদাস সোজা তার পায়ে ডাইভ দিয়ে বলল, বাঁচান বাবা। আমার পিছনে পুলিস পড়েছে।
বোমকালী তড়াক করে সরে গিয়ে বলল, আমি কি করব? তোমার নকুড়েশ্বর কি করেছে দেখ গে যাও। দাও দাও একশ টাকা দাও, আমি যাই।
কালিদাস পাঠক তখন সোজা হয়ে বসে বলল, বেশ! আমি নিজেই পুলিসের কাছে যাই তাহলে।
– পাগলামি কোরো না হে।
– না না আমি যাব। গিয়ে সবাইকার নাম ধাম বলব। মরলে একা মরি কেন?
বোমকালী ঝোলা নামিয়ে রেখে বলল, বোসো। যা করার আজ রাতেই করতে হবে। মাথা ঠান্ডা করে শোনো।

রাত আটটার থেকে সাড়ে নটা পর্যন্ত ছকাপ চা আর গোটা আটেক প্রজাপতি বিস্কুট খেয়ে কালিদাস পাঠকের হাল্কা অম্বল হয়ে গেল। শেষে ঘোষ সুইটসে যখন বোমকালী কালাকাঁদ আর সরভাজার অর্ডার দিচ্ছে তখন সে কাতর গলায় বলল, এখন তো একটু ভাত খেলে হত। এসব খেয়ে খিদে মেরে কি লাভ বাবা?
বোমকালী তার নকল দাড়িটা কালিদাসকে পরিয়েছে পাছে পুলিস চিনে ফেলে। দাড়িটা কালিদাসের পক্ষে সাইজে একটু বড় আর বেদম কুটকুটে। তার উপর তার মাথায় একটা গামছা পাগড়ি করে পরিয়ে চাষীমার্কা সাজাতে চেয়েছে বোমকালী। কিন্তু কালিদাসকে চাষীর বদলে মুসলমান জেলের মত লাগছে। দাড়ির তলায় আঙুল ঢুকিয়ে সে মাঝে মাঝে গলা চুলকোচ্ছে বলে বোমকালী একটু চিন্তায় আছে। সে গলা নামিয়ে বলল, ভাত খেলে ঘুম পাবে না? রাত জাগবে কি করে? একথা শুনে কালিদাসের চোখে জল এল। এমন ফ্যাসাদে সে বাপের জন্মে পড়েনি। অথচ বোমকালীর কথা না শুনলেও বিপদ।
বোমকালী একটু গলা তুলে বলল, নিরুদ্দেশ বললেই হল? নিশ্চই গাঢাকা দিয়ে আছে।
সামনের সিট থেকে একটা হাটুরে মার্কা লোক ঘুরে বোমকালীকে বলল, না না সত্যিই ভ্যানিশ। সকাল থেকে লোকে তন্নতন্ন করে খুঁজছে। থানাপুলিস হয়ে গেল।
বোমকালী খুব রোয়াবের সঙ্গে বলল, দুর দুর। ওসব লোকের বানানো গল্প।
বিশ্বরুপ কাউন্টারের পিছন থেকে বলল, দাদা কি কুলপীর লোক নাকি?
নাহ। আমরা মজিলপুর থেকে আসছি। বলল বোমকালী।
– নকুড়েশ্বর প্রামানিককে চেনেন?
– আরে বন্ধকী গয়না ছাড়াতে এসেছিলুম। এসে শুনি নিরুদ্দেশ।
হাটুরে লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ও গেছে। মনে হয় কেউ গুম করেছে।
বোমকালী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, গেছে বললেই হল? থানায় কমপ্লেন করব। বন্ধকী মাল রেখে দিয়ে চম্পট? খেলা কথা?
বিশ্বরুপ বিজ্ঞের মত হেসে বলল, থানা? থানার বড়বাবু একে কালচারাল লোক তার উপরে মাদুলি ধারণ করে যা নয় তাই করে বেড়াচ্ছে!
বোমকালী টেবিলের তলা দিয়ে কালিদাস পাঠককে কটাস করে চিমটি কাটল। টিমটিতে লাগলেও কালিদাস হজম করে গেল। সে আশ্চর্য হয়ে দেখছে বোমকালীর খেল। সন্ধের থেকে দোকানে দোকানে ঘুরে বোমকালী কত অনায়াসে লোকের থেকে নকুড়েশ্বরের খোঁজ নিচ্ছে অথচ বোঝার উপায়টি নেই। সর্বত্রই নকুড়ের নিরুদ্দেশ নিয়ে বাজার গরম, তার মধ্য থেকে তারা ইতিমধ্যেই ভোলা নামে এক মাছওলা, থানার বড়বাবু আর অঞ্চলপ্রধান ছেকুমিঞার সম্পর্কে যা শুনেছে তাতে এরা নির্ঘাত দেহান্তরী মাদুলি ভিকটিম। বোমকালীর আশঙ্কাই সঠিক। নকুড়েশ্বর না জেনে এর তার উপর ভর করে বেড়াচ্ছেন।
সে তো হল। কিন্তু মাদুলি উদ্ধার হবে কি করে? আগাম বুঝব কি করে নেক্সট ভিকটিম কে? কালিদাস খুঁতখুঁত করছিল।
শোনো হে। দেহ না থাকলেও প্রবৃত্তি থাকে, বুঝলে? মামদো ফেজটুপি পরতে চায়, বেহ্মদত্যি ছোঁয়া বাঁচাতে গাছে ওঠে, মেছোভুত মাছ দেখলে পিছু নেয়। এসব গালগল্প নয়। বোমকালী বলেছিল।
কালিদাসের মুখ শুকিয়ে দাড়ি খুলে পড়ে যায় আর কি! সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, নকুড় তো এখনো ভুত হয়নে বাবা। কেন ভয় দেখাচ্ছেন?
– ব্যাপারটা এক। দেহ না থাকলেও সে এখনো অভ্যেসের দাস। তার মন পড়তে হবে।
– আপনে পড়ে বলুন। আমার মাদুলি ফেরত চাই।
– রাতের বেলা যদি দুটো থালায় ভাত আর রুটি সাজানো থাকে তাহলে তোমাকে কোন থালার উল্টোদিকে পাওয়া যাবে?
– ভাতের থালা।
– যে বাড়িতে, যে বিছানায় নকুড় নাপিত বছর বছর ধরে ঘুমোচ্ছে, রাতের বেলায় সেখানে ছাড়া আর কোথায় যাবে সে?
– কিন্তু তিনি যে অদৃশ্য বাবা! যার শরীর নেই সে শোবে কি করে?
বোমকালী বিচ্ছিরি মুখ করে বলল, তাকে টেনে আনতে হবে শরীরে।
ওরে বাবারে! কি করে? কার শরীরে? কালিদাস হাঁউমাউ করে উঠল। বোমকালী হিংস্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, সে দেখা যাবেখন। আমি বলেছিলুম ভুল মাদুলি চালান করতে? ছাগল কোথাকার!
ঘোষ সুইটস থেকে বেরিয়ে দুজনে ধীরে সুস্থে প্রামানিক ভবন পৌঁছল। বোমকালী সদর দরজা এড়িয়ে পুরো বাড়ি চক্কর মেরে দেখে বলল, পেছনে আগাছার জঙ্গলটা কি নকুড়ের বাগান ছিল?
কালিদাস এ বাড়িতে অনেক বছর আসা যাওয়া করে। নকুড়ের একসময় বাগান করার শখ হয়েছিল। তারপর পাঁচ কাজে বাগানের শখ গেছে আর বাগানটা আগাছার জঙ্গলে পরিনত হয়েছে। বোমকালী তাকে সেই জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেল। রাত দশটা কুলপীতে অনেক রাত। আশেপাশের বাড়ির আলো নিভে গেছে। নকুড়েশ্বরের বাগানে এখন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। শুধু প্রামানিক ভবনের দোতলার ঘর থেকে একটা আলো ক্ষীন হয়ে পড়েছে আগাছার জঙ্গলে। আকাশে একটা নিংলে মত চাঁদ, তাতে আলোর চেয়ে আবছায়া বেশি। কালিদাস অস্ফুট স্বরে বলল, ঐ তো নকুড় বাবুর শোবার ঘর!
বোমকালী ঘরটাকে খানিক পর্যবেক্ষণ করে বলল, রঙ করার ভারা লাগানো আছে দেখছ?
– অ্যাঁ?
– দেখে নাও। ঐটি বেয়ে উঠতে হবে।
– কোথায়?
– নকুড়ের শোবার ঘরে আবার কোথায়?
কালিদাস হাঁকপাঁক করে উঠে বলল, আপনি যে বলেছিলেন মন্ত্র পড়েই হয়ে যাবে?
– ঘরে ঢুকলে তবে না?
কালিদাস ভয়ের চোটে মরিয়া হয়ে বলল, তাহলে চলুন, এক্ষুনি যাই। এসপার কি ওসপার।
বোমকালী একটা কচুর ঝোপের নিচে থেবড়ে বসে বলল, আরে রোসো রোসো। রাত্রির তৃতীয় যামে স্থূলদেহ আর সূক্ষদেহ সবচেয়ে কাছে আসে। এখানে গ্যাঁট হয়ে বস দেখিনি। এখনো ঘন্টা পাঁচেক ওয়েট করতে হবে।
কালিদাস বিড়বিড় করতে করতে কচু ঝোপের নিচে গিয়ে বসল। কচুপাতার আড়ালে তাদের কেউ দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ বাদে কালিদাস ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বাবা?
– বল।
– আমার স্থূলদেহে প্রচন্ড মশা কামড়াচ্ছে। এমন চললে আমি সূক্ষদেহ হয়ে যাব যে বাবা।
– তাহলে তো ল্যাঠা চুকে যায়। সদানন্দ জোয়ারদারের হাত থেকে বাঁচোয়া।
কালিদাস পাঠক দাড়ি খুলে ফেলে গামছা দিয়ে হাত পা ঘষতে লাগল। তার এখন ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

শিবশঙ্কর হাজরা জিতু ধামুকে জেরা করে বিশেষ সুবিধে করতে পারলেন না। তার একটা কারণ হতে পারে তিনি পুলিসি কায়দায় ভয় দেখাতে পারেন না, আর একটা কারণ এও হতে পারে যে জিতু ধামুর মাথায় যে উৎকৃষ্ট গোবর আছে সেখানে ভয় নামক জিনিসটা থাকতেই পারে না। তবে কালচালারাল লোক বলেই বড়বাবুর মাথাখানি সরেস ও পরিস্কার। জেরাতে এটুকু বোঝা গেল যে নকুড়েশ্বরের অপোগন্ড ছেলেদের ছোটখাটো চুরি আর বাপের কামানো পয়সা ওড়ানোর বেশি কিছু করার ক্যালি নেই। দুজনেরই লোক ঠাঙানো, রোয়াবী মেরে বেড়ানো এবং যাবতীয় কাজ পন্ড করার স্বভাব, এবং সেই আদত তারা বেশিটাই কুন্তলীনির থেকে পেয়েছে বলে মনে হয়। শিবু হাজরা লোকের মুখে শুনেছেন এদের বয়সে নকুড়েশ্বর নাকি ন্যাড়াকে চিরুনী বেচে দিতে পারত। এরা যে বাপের নাম ডুবিয়েছে তা পরিস্কার। খুঁটিয়ে জেরাতে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেল যদিও। তারা যখন ভোলা সর্দারকে ঠাঙাতে নিয়েছিল তখন সে নাকি তাদের কাছে নিজেকে বাপ পরিচয় দিচ্ছিল। এ তথ্যটা যাচাই করা সম্ভব হল না কারণ ভোলা এমন কিছু বলেছে বলে মনেই করতে পারছে না।
নকুড়েশ্বর কোন উইল ফুইল করে থাকলেও জিতু ধামু জানে না। মনে হয় তারা বাপের কাছ থেকে লবডঙ্কা পাওয়ার আশঙ্কায় ভীত। নকুড় বহুদিন আলাদা ঘুমাচ্ছেন, ইনফ্যাক্ট তাঁর দোতলার ঘরে তিনি কাউকে তেমন ঢুকতেও দিতেন না। জিতু ধামু সাতকাহন করে শ্যামাচরণের নামে অভিযোগ করছে, তাদের বক্তব্য শ্যামা অতি ধড়িবাজ লোক, সে নকুড়ের খাসচাকর হওয়ার সুবাদে তার ঘরে যথেচ্ছ ঢুকতে পায়, নকুড়ের কোন অনিষ্ট করে থাকলে সে-ই করেছে। তাকে অ্যারেস্ট না করে বড়বাবু কেন তাদের সন্দেহ করছেন এই কথা তারা বার বার বলতে লাগল।
বিছানার তলায় বাতিল নোটে অত টাকা লুকিয়ে রেখেছিল কেন জিজ্ঞাসা করতে জিতেন্দ্র আর ধর্মেন্দ্র মা শেতলা থেকে শুরু করে বাবা দক্ষিণরায় পর্যন্ত সকল দেবতার নামে কিরে কেটে বলতে লাগল এ কাজ তারা করে নি।
তাহলে ঐ ঘরে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকেছিলে কেন? বড়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
দুই ভাইয়ের মধ্যে জিতেন্দ্র একটু ওপরচালাক। সে একটু ভেবে বলল, সকাল থেকে শ্যামা বিভিন্ন ছুতো করে বাবার ঘর বন্ধ করে রেখেছিল স্যার। আমরা তাই দেখতে গেছিলুম ব্যাটা বাবাকে লুকিয়ে রেখেছে কিনা।
– কোথায় লুকোবে? আলমারীতে?
– না না। তা কেন তা কেন?
– আলমারীতো আচ্ছাসে হাঁটকেছ, কি খুঁজছিলে? টাকা?
– না স্যার। ও আলমারীতে তো জরুরী জিনিস থাকে, তাই দেখছিলুম শ্যামা কিছু হাতিয়েছে কিনা।
– কেমন জিনিস? সিন্দুকের চাবি?
জিতু ধামু এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। বড়বাবু বললেন, সত্যি কথা চাপা যায় না হে বাপধনেরা। তোমরা কেন সিন্দুকের চাবি খুঁজছিলে আমি জানি।
– মা কালির দিব্যি বলছি স্যার-
– অ্যাই চোপ। ঐ তোষকের তলায় রাখা টাকা সিন্দুকে চালান করে চাবি হাপিশ করে দেবার তাল। ও সিন্দুক ওয়েল্ডার মিস্ত্রিও কেটে খুলতে পারবে না।
– মা শেতলার কিরে-
– সত্যি কথা বল। ও টাকা বাপের থেকে গেঁড়িয়ে গুপ্তধন বানাচ্ছিলে। নোটবন্দী হতে ফ্যাসাদে পড়েছ।
ধর্মেন্দ্র আর্তনাদ করে বলল, জম্মো থেকে পঞ্চাশ টাকার চেয়ে বেশি বাবার পকেটে দেখিনি কোন দিন স্যার! আপনি বলছেন গুপ্তধন?
পাশ থেকে জিতেন্দ্র বলল, খুব পাতলা ফতুয়া পরতেন তো স্যার তাই পকেটের টাকা বাইরে থেকে দেখা যেত। তাই না রে ধামু?
মালবাবু গনেশ সামন্ত এজাহার লিখছিল। লিখতে তার এমনিতেই খুব কষ্ট হয়। তর উপরে রাতের বেলায় এই দুই বেয়াড়া বজ্জাতের কথা শুনে শুনে লেখা কি চাট্টিখানি কথা? গনেশ সামন্ত বেজায় চটেছিল। তার আর সহ্য হল না, সে বলল, এদের সঙ্গে কথা বলে কেন বেকার সময় নষ্ট করছেন স্যার? আমি এদের মালঘরে নিয়ে গিয়ে কম্বল ধোলাই দিই তারপর আপনি যাখুশি লিখে দেবেন সোনামুখ করে সই করবে।
শিবু হাজরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গনেশরা ওল্ডস্কুল পুলিস, এরা সাইকোলজিকাল প্রোফাইলিং বোঝেই না। এ বড় জটিল কেস। নকুড়েশ্বরের নিরুদ্দেশ হবার পিছনে ফেকুমিঞা একরকম থিয়োরী দিচ্ছে, প্রামানিক ভবনের ভেতরের হাল দেখে মনে হচ্ছে নকুড়েশ্বরের হিমালয়ে গিয়ে সন্নিসী হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়, আর পুলিসি বুদ্ধি সন্দেহ করছে এ গুমখুনের কেসও হতে পারে। যে নিরুদ্দেশ সেও এক বিচিত্র মাল। নিজেই কিছু ফেঁদেছে কিনা কে জানে? গাঁগঞ্জের ক্রাইম এত জটিল হয় না। এইসব ভাবতে ভাবতে তাঁর ছেকুর কথা মনে হল। ছেকু এখন রুলিং পার্টি করলে কি হয়, একসময় ব্যাটা কমিউনিস্ট ছিল। শেখদের বাড়ির ছেলে বলে উচ্চবংশ, মোল্লারা তাকে খুব ধর্মপ্রাণ বানাতে পারেনি কোনদিন। কিন্তু সে কেন টানা বলে চলেছে এই কেসে মাদুলিটা একটা বড় রহস্য সেটা বড়বাবু ঠিক ধরতে পারছেন না। ঐ মাদুলি পরলেই গোলমাল হয়? এসব ঝাড়ফুঁক কি সত্যি?
তোমাদের বাবা কি কোন মাদুলি পরতেন? শিবু হাজরা শুধোলেন।
পরতেন না স্যার। মগরাহাটের শেতলা মন্দিরের পুরুত একটা বাতের মাদুলি দিয়েছিল। বলল জিতেন্দ্র।
– কতদিন আগে?
– হপ্তাখানেক হবে স্যার।
– কোন হাতে পরতেন?
– ডানহাতে। কেন স্যার?
বড়বাবুর ডানহাতের বাহু চিনচিনিয়ে উঠল। নকুড়গিন্নি তাঁর হাতে নাকি মাদুলি দেখেছে! তিনি নাকি ঐ মহিলা ভীমকে জবরদস্ত ঝেড়েছেন! শিবু হাজরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, কি বিচিত্র কেস! এনকোয়্যারি অফিসার নিজে ভিকটিম। এ তো কাউকে বলাই মুশ্কিল। তিনি উঠে পায়চারী করতে লাগলেন। মালবাবু বসে আছে দেখে তিনি বললেন, লেখা কমপ্লিট করে আমাকে দেখান।
হয়ে গেল? গনেশ সামন্ত অখুশি মুখে বলল।
– হ্যাঁ। এজাহারে সই করিয়ে ছোঁড়াদুটোকে বাড়ি পাঠাব। আর হ্যাঁ, টাকা কে কাউন্ট করছে?
– আমিই গুনেছি।
– কত?
– বিশ লক্ষ এগারো হাজার।
– সিজার লিস্ট বানিয়ে তাতে মেনশন করবেন।
– স্যার?
– আবার কি?
– বলছিলুম কি, ছোঁড়াদুটোকে একটু মারব?
– সেকি কেন?
– অনেকদিন কাউকে ঠেঙাইনি স্যার!
– চুপ। কাজ করুন।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিবু হাজরা সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন, মেজবাবু আর এসআই একটা অটো থেকে নেমে থানায় ঢুকল। ওয়াচ ডিউটি ছিল বলে ওরা সোজা কোয়াটারে ফিরেছিল। একটু ফ্রেশ হয়ে রাত করে থানায় এসেছে। মেজবাবু এসে সারাদিনের রেকি ডিউটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে বড়বাবু গম্ভীর হয়ে সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিতে লাগলেন।
ওদের কি লকআপে রাখব? মেজবাবু বললেন।
– না। ওদের ছেড়ে দেব। তুমি গনেশের থেকে এজাহারটা একটু দেখে নাও।
– ঠিক আছে স্যার।
এসআই প্রবীর সিভিক ভলান্টিয়ার বাপির সঙ্গে কথা বলছিল। সে এসে বলল, বাপি বলছে দুটো লোক সন্ধেবেলা থেকে নকুড়েশ্বরের খোঁজ করছে।
মেজবাবু বললেন, আদ্দেক কুলপী এমনিই নকুড়েশ্বরের খোঁজ করে। এখন নিরুদ্দেশ বলে পুরো কুলপী নকুড়বাবুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এটা কি খবর হল?
দত্ত দমে না গিয়ে বলল, এরা কুলপীর লোক নয়। বাপির ফোনে ছবি আছে।
ফোনের ছবিতে একটা ঝুঁটিবাঁধা আর একটা দাড়িওলা লোক বসে বসে কিছু খাচ্ছে দেখা যাচ্ছে।
মেজবাবু আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ, এই তো সেই কাপালিক! ঝুঁটি করেছে বলে অন্যরকম লাগছে। সঙ্গে এটা কে?
প্রবীর দত্ত বলল, কালিদাস পাঠক! দাড়ি লাগিয়েছে।
মেজবাবু বললেন, কাপালিকের দাড়ি!
প্রবীর বলল, চলুন তুলে আনি। ক্রিমিনাল ইনটেন্ট বোঝাই যাচ্ছে।
শিবু হাজরার মাথায় বিদ্যুতের মত একটা প্ল্যান খেলে গেল। তিনি বললেন, না। চেপে যাও।
চেপে যাব? মেজবাবু বললেন।
প্রামানিক ভবন সারভিলেন্স করব। কাউকে বলবে না। আমি, তুমি আর প্রবীর। বললেন শিবু হাজরা।
প্রবীর আর সাহা হাঁ করে বড়বাবুর দিকে চেয়ে রইল। বড়বাবু জিতু ধামুকে গিয়ে বললেন, যাও তোমাদের ছুটি। সোজা বাড়ি যাও।
জিতু ধামু লাফিয়ে উঠে একসঙ্গে বলল, থ্যাঙ্কু স্যার। টাকাটা নিয়ে যাব?
– না। টাকা বাজেয়াপ্ত। নকুড়বাবুর টাকা তিনিই ফেরত নেবেন।
– কিন্তু স্যার-
– কোন কিন্তু ফিন্তু নেই। পুলিসের সঙ্গে কোঅপারেট না করলে সোজা চালান হবে।
– আমরা তো কোঅপারেট করছি স্যার। বললাম তো শ্যামাই আসলে বাবাকে-
– আজ সারা রাত শ্যামার উপর নজর রাখবে। যাও। কাল রিপোর্ট নেব।
জিতেন্দ্র ধর্মেন্দ্র চোখাচোখি করল। তারপর জিতেন্দ্র বলল, দেখব যাতে বাবার ঘরে না ঢোকে, তাই তো?
বড়বাবু রহস্যের হাসি হেসে বললেন, না। দেখবে কখন বাবার ঘরে ঢুকল। আর ঢুকে কি করল।

নকুড়েশ্বর বাতাসে ভেসে ভেসে তাঁর শোবার ঘরের খাটের উপর বসার চেষ্টা করছিলেন। সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তিনি খুব মনমরা হয়ে শূন্যে ঝুলে রইলেন। রাত এগারোটা বেজে গেছে, সারাদিন হাওয়াগিরি করে তিনি ক্লান্ত, তাঁর এখন বেমক্কা ঘুম পেয়েছে। অথচ পালঙ্কে শুতে গেলে তিনি গদিতোষকের মধ্যে দিয়ে গলে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছেন। তাও আবার বেশি জোরে পড়ার জো নেই, তাহলে সিলিং ফুঁড়ে সোজা নিচের গুদামঘরে গিয়ে ল্যান্ড করতে হবে!
সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি, দুপুরের দিকে খুব খিদে পেয়েছিল। বাধ্য হয়ে মাতারা হিন্দু হোটেলে একটা উটকো লোকের মধ্যে ঢুকে একটু ডাল ভাত চচ্চড়ি খেতে গিয়ে সে কি বিপত্তি। একটা কাৎলার পিসের অর্ডার দিতেই দোকানদার এসে বলল, গোঁসাই ঠাকুর কবে থেকে আমিষ ধরলেন? তারপর মাছ মুখে দিতেই সারা শরীর গুলোতে লাগল। গোঁসাই ঠাকুর মাছ খাচ্ছে দেখে দোকানের লোকগুলো মুচকি মুচকি হাসছিল বটে কিন্তু নকুড়ের চোখে জল আসছিল। সত্যি! নিরামিশাষী লোকগুলোর কত কষ্ট! ইচ্ছের দখল নিলেও শরীর তো চলে অভ্যাসে তাই খাওয়া শেষ হবার আগেই তাঁর পেট মুচড়াতে লাগল। কুলপী বাসস্ট্যান্ডে গোঁসাই ঠাকুর পেটে হাত দিয়ে বসে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল আর তিনি পালিয়ে বাঁচলেন।
সেই থেকে খাবার ইচ্ছে আর হয় নি। আর বিড়িতে টান মারার জন্যে ফের শরীর ধারণ করার অনেক ঝক্কি। সন্ধের দিকে রাধামাধব মন্দিরে কিছুক্ষণ কেত্তন শুনে নকুড়েশ্বর মনটা একটু ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন। তাঁর মনে হল জগৎ অনিত্য। এই এতটুকু সময়ের জন্যে শরীরধারণ অথচ সেই সময়ে মানুষ কিই না করে। তিনি নাপিত থেকে আজ গণ্যমান্য হয়েছেন, আর উন্নতি করতে গিয়ে তিনি কত খারাপ কাজই না করেছেন। মানুষ এইজন্যে তাকে এখন খালি ভয় পায়, কেউ ভালোবাসে না। সমাজ তো সমাজ, তার নিজের পারিবারিক জীবনেও একফোঁটা সুখ নেই। দজ্জাল বৌ, অকাল কুষ্মান্ড ছেলে, কর্মচারীরা খালি পয়সা ঝাড়ার তাল করে। শ্যামাও পারলে তাঁর বিড়ির প্যাকেট থেকে বিড়ি ঝাড়ে। এ কি একটা জীবন?
কিন্তু এসবই কুলপীবাজারের শীষেপোরা বাটখারার মত তাঁর নিজস্ব হস্তশিল্প। বড়মানুষ হবার দৌড়ে তিনি একেবারে একা হয়ে গেছেন। আর কালিদাসের মাদুলি পরে তো শরীরটা পর্যন্ত গেল। অথচ এই শরীরের আরামের জন্যে মানুষ কি না করে। টাকা কড়ি, বাড়ি গাড়ি; খালি নিজের আখের গোছানো। নাহ, শরীর ফিরে পেলে তিনি আর এসবে থাকবেন না। যা আছে সব বিলিয়ে দেবেন। গত দুবছর ধরে নকুড় জাতে ওঠার জন্যে রিয়েল এস্টেটে পয়সা লাগাছেন, সেটাও তাঁর বেকার মনে হতে লাগল। পয়সার দরকার নেই তাঁর, নিজের ফ্যামিলিকেই আশ্রয় করবেন তিনি। মরার সময় বউ ছেলে একটু চোখের জল ফেলে যেন।
ভেসে ভেসে জানলার কাছে গিয়ে নকুড়েশ্বর রাস্তা থেকে আসা আলোয় হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাদুলি দেখতে লাগলেন। ধাতুর তৈরী চৌকোমত মাদুলি, কালো কার দিয়ে বাহুতে বাঁধা। কি আশ্চর্য জিনিষ। এইটির জন্যেই তিনি ভ্যানিশ। বগলের কাছে হাত বুলোতে কারের গিঁট্টু হাতে ঠেকল। খোলা যায় এটা? আঙুল দিয়ে টানাটানি করতে গিঁট আলগা হয়ে মাদুলিটা খুলে হাতে চলে এল। নকুড়েশ্বর সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। জানালা দিয়ে ত্যারছা হয়ে আলো আসছে, তাই কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতে গিয়ে নকুড়ের মাথা ঠাঁই করে গরাদে ঠুকে গেল। উঃ বলে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে নকুড় টের পেলেন তাঁর কনুইএর পুরোনো ব্যথাটা ফের চাগাড় দিয়েছে। সারাদিন তিনি এই ব্যথা টের পাননি। জানলার থেকে সরে এসে টেবিলের উপর মাদুলি রাখতে গিয়ে নকুড়েশ্বরের মনে হল কেউ যেন তাঁর ঘাড়ের উপর একমন ওজনের চিনির বস্তা চাপিয়ে দিয়েছে। হাত পা নড়াতে গেলে ভার ভার ভাব।
এমন সময় খট করে কেউ বারান্দার আলো জ্বালল। তারপর শ্যামাচরণ বগলে মশারি নিয়ে ‘আমার হইছে যত মরণ, বাবু নাই তবু ঘর পাহারা দাও’ ইত্যাদি বলতে বলতে ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে একেবারে নিশ্চিন্দিপুরের শিবলিঙ্গের মত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। নকুড়েশ্বর তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কিরে শ্যামা, এখনো ঘুমাসনি?
শ্যামা বিস্ফারিত চোখে বলল,অ বাবু আপনে আধল্যাংটা হয়ে কোথ্থেকে এলেন গ?
নকুড়ের খেয়াল হল কাল তিনি ফতুয়া লুঙ্গি ছেড়ে আন্ডারউয়্যার পরে ঘুমোতে গেছিলেন। টপ করে তিনি মাদুলিটা ডানহাতের বাহুতে চেপে ধরতেই শরীর ফের হাওয়ার মত হালকা হয়ে গেল আর শ্যামাচরণ অঁ অঁ করে ভিরমি খেয়ে মেঝেতে পড়ল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নকুড়েশ্বর ধীরে ধীরে মাদুলিটা হাত থেকে সরাতেই দেখা গেল, একদিনের কাঁচাপাকা দাড়িওলা মুখে নকুড়েশ্বর প্রামানিক খালি গায়ে আন্ডারউয়্যার পরে দাঁড়িয়ে আছেন। নকুড় তখন হাসিমুখে একবার হাতে মাদুলি ঠেসে ধরে বলেন চিচিংফাঁক আর পরক্ষণেই মাদুলি সরিয়ে নিয়ে বলেন চিচিংবন্ধ। এরপর নকুড়েশ্বর বেতো পায়ে সারাঘরে নেচে নেচে, ‘মা তোর কত রঙ্গ দেখব বল’ গেয়ে বেড়াতে লাগলেন। শেষে পায়ে শ্যামাচরণের অচৈতণ্য দেহ ঠেকতে তিনি টেবিল থেকে জল নিয়ে তার মুখে খুব করে ছিটিয়ে বললেন, শ্যামা ওঠ ওঠ। এই দ্যাখ আমি ফিরে এসেছি। তুই বিড়ি চুরি করলেও আমি কিচ্ছুটি বলব না।
শ্যামাচরণ চোখ খুলে হাঁউমাঁউ করে উঠতেই, নকুড় তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বললেন, চুপ চুপ চেঁচাসনি।
বাবু গ। আপনে কি মানুষ না অপদেবতা। এইবলে শ্যামাচরণ ফোঁপাতে লাগল।
– চুপ কর। তোর সঙ্গে পরামর্শ আছে।
– কালই আমাকে ছুটি দ্যান কর্তা, বাড়ি চলে যাই।
– সে যাবিখন। কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস। আমি তোর মাইনে তিনগুন করলুম আজ থেকে। আর বছরে দুহাজার টাকা বোনাস।
শ্যামাচরণ কান্না বন্ধ করে নকুড়েশ্বরকে দেখতে লাগল। তুমি কি সত্যিই বাবু না বাবুর মত দেখতে অন্য কেউ?
নকুড় একগাল হেসে বললেন, নারে পাগল। আমার চিত্তপরিবর্তন হয়েছে।
শ্যামাচরণ মেঝেতে উবু হয়ে বসে বলল, আপনে যে ভেনিস হলেন, তারপর সবাই মিলে আপনারে কত গরুখোঁজা খুঁজলুম বাবু। এদিকে সবাই তালে আছে আপনার ট্যাকাকড়ি হাতাবে। আমি চাকর মানুষ কি আর বলি!
– নারে শ্যামা। ওদের কি দোষ বল? আমিই তো সব আগলে রাখি।
– দাদাবাবুরা আপনের আলমারী হাঁটকেছে।
– হাঁটকাক গে। বাপের আলমারী ছেলেরা হাঁটকাতে পারে না?
– অ বাবু। আপনের হল কি? তোষকের তলে এত টাকা লুইকে রেখেছিল যে?
– ও আমি রেখেছিলুম।
– তবে যে পুলিস বলল, না না আমিই নাকি বললুম – বাবু আমার মাতা ঘুরতেছে।
– আবার অজ্ঞান হলে জুতো শোঁকাব। এখন যা বলি মন দিয়ে শোন। আগে বল জিতু ধামু কোথায়?
– তেনারা তো থানা থেকে ফিরে আসা ইস্তক এই বারান্দায় বসেছিল। আপনের সিন্দুকের চাবি কোথায় আছে শুধোচ্ছিল। তারপর আমাকে ঘর পাহারা দিতে বলে শুতে গেল।
– ও। তা তুই কি বললি?
– আমি কি জানি যে বলব?
– ওদের দোষ নেই রে শ্যামা। সব আমার দোষ। ওরা যখন কেলাস ফাইভে পড়ে তখন ঐ সিন্দুক কিনেছিলুম। ওরা কতবার সিন্দুক দেখার বায়না করেছে।কোনদিন দেখতে দিইনি, জানিস?
– সে আর জানিনে? ঐ সিন্দুক কেনার পরবছর থেকেই তো আপনে গিন্নিমার ঘরছাড়া হলেন।
কুন্তলীনির কথায় নকুড়েশ্বর খুবই বিচলিত হলেন। তিনি লুঙ্গি ফতুয়া পরতে পরতে বললেন, হ্যাঁরে শ্যামা, খুব কাঁদাকাটা করছিল নাকি?
শ্যামাচরণ মাথা নেড়ে বলল, সে জানিনে বাবু। গিন্নিমা কাঁদলেও এত চেঁচায় যে ভয়ে আমি কাছে যাইনে।
নকুড় পায়ে চপ্পল গলাতে গলাতে মনে করলেন থানায় কুন্তলীনিকে খুব জোর দাবড়েছেন। যদিও বড়বাবুকেই কুন্ত দেখেছে, কিন্তু তিনি তো জানেন আসলে কে ঐ দাবড়ানি দিয়েছে। নকুড়েশ্বর প্রামানিকের খুব মনখারাপ হল। তিনি শ্যামাকে ডেকে বললেন, শ্যামা আজ তুই এই ঘরে ঘুমাবি, বুঝলি? আমি নিচে যাচ্ছি।
শ্যামাচরণ অবাক হয়ে বলল, সেকি? আমি তো বারান্দায় ঘুমাই?
– আঃ। যা বলছি তাই কর। শুধু এই ঘরে না। আমার খাটে ঘুমাবি।
– না বাবু। ও আমি পারবনি।
– তোর ঘাড় পারবে। যা বলছি কর। আর আমাদের যেসব কথা হল সেসব কাউকে বলার দরকার নেই। নে আলো নেভা।
নকুড় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন আর শ্যামাচরণ গজগজ করে বলতে লাগল, এই এলুম পাহারা দিতে, আর এখন বলে বাবুর পালঙ্কে ঘুমাও। আমার হইছে মরণ!
রাত সাড়ে এগারোটার সময় কুন্তলীনির একতলার শোবার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। কুন্তলীনি দরজা খুলে নকুড়কে দেখে মাথায় হাত দিয়ে এত্তবড় হাঁ করে মিনিট খানেক চেয়ে রইলেন তারপর ‘অ জিতু অ ধামু’ বলে চেঁচাতে যাবেন, নকুড় তার মুখে হাতচাপা দিয়ে ঠেলে ঘরে ঢুকে বললেন, কুন্ত চেঁচামিচি কোরোনি। আজ আমি তোমার ঘরে শোব।
কুন্তলীনি বড় বড় চোখ করে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, ছেলে দুটোকে ডাকি।
– না। কাল সকালে যা বলার বোলো। আমি এঘরে ঢুকেছি ওরা দেখলে লজ্জায় মরে যাব।
– ভাল হবে। উচিত হবে। তুমি গেছিলে কোতায়, অ্যাঁ?
– কাকদ্বীপ।
– কাকদ্বীপ?
– হ্যাঁ। ওখানে আমাদের গয়নার কারিগর থাকে তার পেমেন্ট করতে।
– মিথ্যে কথা। অত ভোরে? কাউকে না বলে? লাঠি ছাড়া?
নকুড়েশ্বর কুন্তলীনির মুখের দিকে চেয়ে দেখলেন যে ভীষণ চোখ পাকিয়ে থাকলেও সেখানে জল ছলছল করছে। তিনি বললেন, একটু বসতে দেবে নি, কুন্ত?

ঘুমে কালিদাস পাঠকের চোখ লেগে গেছিল। কিন্তু বোমকালীর জব্বর চিমটিতে সে ঘুম ভেঙ্গে চ্যাঁ করে উঠতে গিয়েও পারল না। বোমকালী ভয়ঙ্কর কুটিল চোখমুখ করে কালিদাসের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, গ্যাঁড়াকল পাকিয়ে পায়ে পড়লে বলে এলুম উদ্ধার করতে আর এ শালা খালি ঘুম মারছে! চল ঐ ভারা বেয়ে ওঠ।
কালিদাস চোখটোখ রগড়ে বাঁশের ভারাটা দেখতে লাগল। কি কুক্ষণে নকুড়েশ্বরকে মাদুলি বেচতে এসেছিলুম, ভাবল সে।
ভারা দেখে টেখে কালিদাস বলল, নাহ। ঐ ভারা বেয়ে আমি উঠতে পারব না।
বোমকালী তাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বলল, বাঁশের গাঁটে গাঁটে পা দিয়ে দিব্যি ওঠা যাবে। চল। তারপর তার খেয়াল হল কালিদাস হাত পা চুলকাতে চুলকাতে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। সে তখন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বেশ। তাহলে আমিই বা মশার কামড় খাই কেন। আর পনের মিনিট বাদে আমতলা নামখানা ফার্স্ট বাস এসে যাবে। বাড়ি যাই।
কালিদাস কচুঝোপের মধ্যে শুয়ে পড়ে বোমকালীর পা চেপে ধরে বলল, আমাকে ফেলে যেওনা পিলিজ। আমি বলছিলুম কি, সকাল হলে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করলে হয় না? ধরা পড়লে নকুড়ের ছেলেরা পিটিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবে যে বাবা!
বোমকালী দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, খেলে কচুপোড়া! সোজা গিয়ে শহীদ হব নাকি? ধরে পুলিসে দেবে। যা বলছি কর নইলে মর গে। আর পাঁচমিনিটের মধ্যে তৃতীয় প্রহর শেষ হবে, অশরীরী এই সময় সবচেয়ে দুর্বল। এই চান্স গেলে সব গেল। যাবে কি যাবে না?
কালিদাস ভারা বেয়ে উঠতে গিয়ে হড়কে পড়ল। বোমকালী নিচ থেকে কাঁধ দিয়ে তাকে ঠেসে ধরে বলতে লাগল, নিচের দিকে দেখো না। উপরের আড় বাঁশটা ধর। কালিদাস কোঁকাতে কোঁকাতে বাঁশ বেয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠতে লাগল ফের। মিনিট পাঁচেক ধস্তাধস্তি করার পর তারা দুজনে হাঁফাতে হাঁফাতে দোতলার ছাতের কার্নিশে পা রেখে বারান্দায় উঁকি মারল।
শেষ রাতের বাতাসে নকুড়েশ্বরের ঘরের দরজার পাল্লা দুলছে। অন্ধকারে ঠিক ঠাহর হয় না বটে কিন্তু তাদের দুজনেরই মনে হল লম্বা বারান্দায় কেউ নেই। আবছা মনে হচ্ছে বারান্দার এক প্রান্তে একটা দরজা, সেটাও হাট করে খোলা।
– ঐ দরজাটা কি বাড়ির ভিতরে ঢোকার জন্যে? বোমকালী ফিসফিস করে বলল।
– এত বড় বাড়ির দোতলায় একটা মোটে ঘর?
– না এদিকটা হালে বানানো, ওদিকে তিনতলা বাড়ি।
– তাহলে নকুড় প্রাসাদ ছেড়ে চিলেকোঠায় থাকে কেন?
– তা কি করে জানব? বনিবনা হয় না বোধহয়।
– হুম। চল পাঁচিল ডিঙোও।
বারান্দার পাঁচিল ডিঙিয়ে বোমকালী আর কালিদাস পা টিপে টিপে নকুড়েশ্বরের ঘরের দরজার দিকে যেতে লাগল। কালিদাস পিছন থেকে বোমকালীর জামা টেনে ধরে বলল, বাবা?
– কি হল?
– একটা কিছু গড়বড় লাগছে।
– কি?
– দরজা খোলা কেন?
– আমাদেরই মঙ্গল।
– আর শ্যামাচরণ বারান্দায় মশারি খাটিয়ে ঘুমায়। সে-ই বা কই?
বোমকালী অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। নকুড় যদি না-ই থাকে, তাহলে তার ঘরের দরজা খোলা থাকবে কেন? শ্যামাচরণ কি বাবুর ঘরে ঘুমাচ্ছে? দরজার কাছে গিয়ে বোমকালী ঘরের ভিতরে উঁকি দিল। মেন রোডের লাইট এসে নকুড়েশ্বরের জানলার উপর পড়েছে। সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে নকুড়েশ্বরের বিছানায় শুয়ে কেউ ঘুমোচ্ছে। বোমকালী বকের মত গলা বাড়িয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে লাগল। কালিদাস তার হাঁটুর লেভেলে মাথা নিয়ে ঘরের মেঝেতে কেউ শুয়ে আছে কিনা দেখতে লাগল। মিনিট তিনচারেক ধরে আলোআঁধারীতে চোখ সইয়ে যখন বোঝা গেল ঘরে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি নেই তখন কালিদাস ফিসফিস করে বলল, আর দেরী না করে ঘরে ঢুকি চল বাবা!
বোমকালী পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে চারদিক দেখতে লাগল। আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে পালঙ্কে শুয়ে মাথাটাথা মুড়ি দিয়ে কেউ ঘুমাচ্ছে। ঘরের বাকি আসবাব পত্তর তেমন বোঝা না গেলেও পালঙ্কের পাশে একটা টেবিলে ত্যারছা আলো পড়েছে। সে আলোয় দেখা গেল টেবিলে একটা চশমার খাপ, একটা হাতঘড়ি, একটা জলের গ্লাস, দেশলাই আর বিড়ির প্যাকেট রাখা।
নকুড়কত্তা। কালিদাস ফিসফিসিয়ে বলল।
– তুমি সিওর?
– মনে হচ্ছে তো।
– নাকে হাত চাপা দাও।
– কেন?
– আমি ওষুধ ঝাড়ব। নাকে হাত চাপা দিয়ে মুখ দিয়ে অল্প অল্প শ্বাস নাও।
বোমকালী তার গেঁজের থেকে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধঃর শিশির মত শিশি বার করে ঘুমন্ত মানুষটার চাদরে ছেটাতে লাগল। হাল্কা একটা মিষ্টি গন্ধ ভাসতে লাগল হাওয়ায়। কালিদাসের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভয়ে। সে বলল, আমরাই না অজ্ঞান হয়ে যাই!
এমন সময়ে আহ উহ করে ঘুমন্ত লোক পাশ ফিরে শুল। মুখের উপর থেকে চাদর সরে যেতেই কালিদাস পাঠক প্রায় উল্টে পড়ে আর কি! বোমকালী ঝুঁকে পড়ে মুখ দেখতে লাগল। কালিদাস বলল, আরে এতো শ্যামাচরণ!
– নকুড়ের খাটে?
– তাই তো দেখছি!
– জয়গুরু!
– কি হয়েছে? কি হয়েছে?
– হাতে মাদুলি।
মুহুর্তে কালিদাসের ভয়ভাবনা ভ্যানিশ হয়ে গেল। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাদুলি খুলে নিতে যাবে, শ্যামাচরণ ঘুম ভেঙ্গে উঠে বলল, কে? তোমরা কারা গ?
কালিদাস উরেঃশালা বলে ঝপ করে বসে পড়ে পালঙ্কর তলায় ঢুকে গেল। কিন্তু বোমকালী হাতজোড় করে বলল, স্যার নমস্কার। আস্তে কথা বলবেন সকলে ঘুমাচ্ছে কিনা!
শ্যামাচরণ চোখ পিট পিট করতে করতে বলল, আমার কি মিত্যু হয়েছে? আপনে কি আমায় যমালয়ে নিয়ে যেতে এয়েচেন?
বোমকালী হেসে বলল, নকুড়বাবু আপনি মাদুলি খুলে আমাকে দিয়ে দিন। ও অন্যের জিনিষ।
স্বাভাবিক কথা বার্তা হচ্ছে দেখে কালিদাস পালঙ্কের নীচ থেকে বেরিয়ে এসে বলল, কাকে কি বলছেন বাবা? এতো শ্যামা, নকুড়কত্তার খাসচাকর!
বোমকালী ঝেঁঝে উঠে বলল, তুমি আর বোকোনি বাপু। এর মধ্যে এখন নকুড় রয়েছেন।
শ্যামাচরণের ঘুমের ঘোর কেটে গেছে মনে হল। সে পালঙ্কে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল, না। আমি সত্যি শ্যামাচরণ। কিন্তু ভেনিস হতে আর কতক্ষণ লাগবে?
বোমকালী গম্ভীর গলায় বলল, আমার সঙ্গে চালাকি করে লাভ নেই নকুড়বাবু। অনেক ভর করেছেন, এবার মাদুলি ফেরত দিন। নাকি আমি খুলে নেব?
শ্যামাচরণ পালঙ্কের উপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বললেই হল আর কি! কত্তামশাইয়ের পারমিশন ছাড়া কিছু ফেরত হবে না।
এতক্ষণে কালিদাস নিশ্চিত হল যে শ্যামাচরণের ভিতর নকুড়বাবুই আছেন। শ্যামার এমন সাহস হবেই না। কিন্তু এই বিপর্যয়ের মধ্যেও সে ভাবতে লাগল, এখন যদি জোর করে মাদুলি খুলে নেওয়া হয় তাহলে নকুড়েশ্বর কি শূন্য থেকে গজিয়ে উঠবেন? শ্যামার তখন কি হবে? এরা চেঁচামিচি করে লোক ডেকে তাদের ধরিয়েই বা দিচ্ছে না কেন? টেনশান তো আর সহ্য হচ্ছে না!
বোমকালী ওষুধের শিশি খুলে শ্যামাচরণের দিকে ছেটাতে ছেটাতে বলল, হ্রিং ক্লিং ট্রিং! শ্যামাচরণ দুহাত ছুঁড়ে পালঙ্ক থেকে লাফ মারল। তার হাতের ধাক্কায় শিশি ছিটকে কালিদাস পাঠকের মাথায় গিয়ে পড়ে নাকমুখ দিয়ে তরল পদার্থ গড়িয়ে পড়তে লাগল আর তীব্র মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে উঠল। কালিদাস ‘বাবাগো আমি তো অজ্ঞান হয়ে যাব’ ইত্যাদি বলে ছুটে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে বারান্দায় এক ছায়ামূর্তির সঙ্গে ধাক্কা খেল। ফট করে বারান্দার আলো জ্বলে উঠতেই ধর্মেন্দ্র বলল, ধরেছি ধরেছি!
কোথাও যেন হুইশিল বেজে উঠল আর প্রামানিক ভবনের সদর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শোনা গেল। জিতেন্দ্র বলল, দরজা ভেজানো আছে স্যার সোজা উপরে আসুন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শিবু হাজরা বললেন, কেউ নড়বে না। কাপালিককে কেমন ঝাড়ফুঁক করতে হয় আমি জানি।

জিতেন মাহাতো দুদ্দাড় করে ঘরে ঢুকে বোমকালীর হাত চেপে ধরে বলল, শান্ত হয়ে থাক, তাহলে মারব না। বোমকালী চোখ বন্ধ করে সমাধির মত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর নকুড়বাবুর চিলেকোঠার ঘরে একে একে এসে ঢুকল মেজবাবু, এসআই দত্ত আর ফিল্মি কায়দায় ব্যাটন দোলাতে দোলাতে সবার শেষে ঢুকলেন শিবশঙ্কর হাজরা। চারদিক একপলক দেখে নিয়ে তিনি পায়ের কাঁপুনি লুকোনোর জন্যে টেবিলের কানা ধরে ব্যালেন্স করে শ্যামাচরণকে বললেন, মেঝেতে উবু হয়ে বসতে হবে না, উঠে দাঁড়াও।
শ্যামাচরণ হাত দিয়ে মাদুলি চেপে বসেছিল, পুলিশ দেখে তার ধড়ে প্রাণ এসেছে; উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সে বলতে লাগল, ঐ ঝুঁটিওলাটা মাদুলি ডাকেতি করতে এসেছে হুজুর, ওকে গেরেপতার করেন।
এসআই দত্ত পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বার করে খসখস করে কিসব লিখছিল, সে মুরুব্বির মত বলল, সঙ্গে কেউ ছিল না একা?
-এজ্ঞে কালিদাস পাঠক ছিল। শয়তানটা ঘরে ডাকেত ঢুকিয়েছে হুজুর।
জিতেন্দ্র বারান্দার থেকে বলতে গেল, স্যার এদিকে-
তাকে থামিয়ে হাজরা বললেন, কেউ কথাটি কবে না। এটা ক্রাইম সিন, কেমন? আমরা যা শুধোব খালি তার উত্তর দেবে। সাহা, আমি যে গন্ধটা পাচ্ছি, সেটা তুমিও পাচ্ছ কি?
হ্যাঁ স্যার, পাচ্ছি। ক্লোরোফর্ম। মেজবাবু বললেন। প্রবীর দত্ত নোটবই বগলদাবা করে নিচু হয়ে মেঝে থেকে একটা ভাঙ্গা কাচের শিশি তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, দুশো এমএলের শিশি, তিন চার জনকে কাবু করার পক্ষে যথেষ্ট।
হাজরা বোমকালীকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বললেন, হুম। এবার আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করি। নাম কি হে? খাতায় নাম উঠবে, ভালো নামটাই বল।
বোমকালী সমাধিভঙ্গ করে সরু চোখে বড়বাবুর দিকে চেয়ে রইল। বড়বাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ও জিতেন কথা বলে না যে! জিতেন মাহাতো তখন বোমকালীর দু আঙুলের ফাঁকে তার নিজের আঙুল ঢুকিয়ে চাপ দিতে লাগল। বোমকালীর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, সে ঘসঘসে গলায় বলল, আমার নাম কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী। আঙুলে লাগছে।
-সাকিন?
-কালিনগর, কাকদ্বীপ।
-কালিনগরের কালীকৃষ্ণ, এতো কালিতে কালিতে ছড়াছড়ি, অ্যাঁ? তো এখানে ভারা বেয়ে কি উদ্দেশ্যে বাবা?
-এটা আমার যজমানের বাড়ি।
বারান্দা থেকে জিতেন্দ্র হাঁকপাঁক করে ফের বলতে গেল, স্যার এখানে এরা-
শিবু হাজরা তাকে ধমকে বললেন, বলেছি না, কোন কথা নয়? এখানে সবাই সাসপেক্ট। সবাই চালান হবে এক্ষুনি। তা কালীকৃষ্ণ, তোমার পুরুতমশাই শাকরেদটি কই?
শ্যামাচরণ হড়বড় করে বলল, এজ্ঞে তিনি তো পেথমে কত্তামশাইএর পালঙ্কের নিচে ছেলেন, তারপরে ঐ ডাকেতটার পিছনে ডেঁইড়ে বলতেছেলেন মাদুলি দাও মাদুলি দাও।
শিবু হাজরা মেজবাবুকে বললেন, এদের থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করতে হবে, বুঝলেন? সবকটাকে। কিন্তু কালীদাস পাঠক কি পালাল নাকি? এ কথা শুনে জিতেন মাহাতো নিচু গলায় বলল, বারান্দায় বডি পড়ে আছে স্যার! জিতেনের কথায় হইচই শুরু হয়ে গেল। পুলিশ আর সন্দেহভাজন সবাই এ ওকে ডেকে কিছু বলতে চায়। সেই গন্ডগোলের মাঝে দেখা গেল বারান্দার এক কোনে ধর্মেন্দ্র আর কালীদাস পাঠক একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বসে বসে শিশুর মত ঘুমোচ্ছে। বড়বাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, এ হে হে, এতো পুরো ব্ল্যাকআউট হয়ে গেছে। পাঠককে ক্লোরোফর্মে চোবালো কে?
প্রবীর দত্ত দুজনকে ভালো করে দেখে ক্যারমের স্ট্রাইকার হিট করার ভঙ্গিতে ধর্মেন্দ্র আর কালীদাসের কানের লতিতে মারতে লাগল। একটু স্মেলিং সল্ট হলে ভালো হত, বলল সে। কানে তিন চারটে মোক্ষম টোকা খেয়ে ধর্মেন্দ্রর চোখ খুলে গেল। চোখ খুলেই সে বলল, ধরেছি ধরেছি!
শিবু হাজরা ব্যঙ্গ করে বললেন, ধরেছি ধরেছি, ধরে কেলিয়ে পড়েছি। উঠে বস। কথা আছে। আচ্ছা এরা এখানে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে, কেউ একটু পয়েন্ট আউট করবে তো নাকি?
জিতেন্দ্র হাঁউমাঁউ করে বলল, আমি তো কতক্ষণ থেকে বলতে-
শিবু হাজরা ফের তাকে ধমক দিয়ে বললেন, চোপরও। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি? পুলিশ ওয়ার্কে নাক গলালে নাক মুলে দেব!
ব্যাপারটা কি হল স্যার? নকুড়বাবুকে তো পাওয়া গেল না। মেজবাবু বললেন।
সব পাওয়া যাবে। মাদুলি ধরে টানলে সব বেরিয়ে আসবে। বললেন বড়বাবু। তারপর তিনি শ্যামাচরণকে বললেন, দেখি ডানহাতের হাতাটা বগল অব্দি তোল। শ্যামাচরণের হাতে মাদুলি দেখা গেল। সবাই দুর থেকে বকের মত গলা বাড়িয়ে মাদুলি দেখতে লাগল। দেখা টেখা হলে বড়বাবু বললেন, তুই কি সত্যি শ্যামাচরণ? শ্যামাচরণ হাতজোড় করে বলল, আমি সত্যি শ্যামাচরণ বাবু।
-তাহলে তুই এখনো ভ্যানিশ হোস নি যে বড়?
বোমকালী ফের ঘসঘসে গলায় বলল, মিনিমাম তিনদিন পরে থাকতে হবে। আর মন্ত্রপূত জিনিষ ঠিকমত ধারণ না করলে কাজ নাও করতে পারে।
শিবু হাজরা একবার বোমকালী আর একবার মাদুলির দিকে বার কয়েক দেখলেন। সাংঘাতিক জিনিষ বটে! এটা তো তোর মালিকের জিনিষ, তোর কাছে কি করে এল? বললেন তিনি।
শ্যামাচরণ হাতজোড় করে বললেন, এজ্ঞে বাবু দিয়ে বললেন তোর কাছে রাখ, বলে শুতে গেলেন। তো আমি ভাবনু একটু পরে দেখি। বাবুর পালঙ্কে ঘুম আসছিল না কিনা!
সবাই একেবারে চুপ করে গেল। বড়বাবু খাবি খাওয়া গলায় বললেন, বাবু? মানে নকুড়বাবু? তিনি কবে এলেন?
এই তো সন্ধেরাত্তিরে। এই ঘরে আধল্যাংটা হয়ে উদয় হলেন। বাবু আমার দেবতা গো দেবতা। বলে শ্যামাচরণ ভক্তিভরে প্রণাম করতে লাগল। শিবু হাজরা ধুপ করে চেয়ারে বসে পড়ে ইউনিফর্মের বোতাম খুলে পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, কেউ একটু জল খাওয়াও তো!
নকুড়েশ্বর প্রামাণিক দরজার কাছ থেকে বললেন, জিতু বড়বাবুর জন্যে জল নিয়ে এস যাও। সকলে ভূত দেখার মত নকুড়বাবুকে দেখতে লাগল। নকুড়বাবুর পরনে পাটভাঙা ফতুয়া আর লুঙ্গি। তাঁর হাতে পরিচিত লাঠি। তাঁকে দেখে শিবু হাজরা চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠছেন দেখে তিনি মুচকি হেসে বললেন, বসুন বড়বাবু। পুলিসের কাজ খুব শক্ত। রাত বিরেতে ছোটাছুটি। পালঙ্কে আয়েশ করে বসে তিনি জিতেনকে বললেন, বাবাজির হাত ধরে আছ কেন? উনি তো আমার অতিথি! জিতেন বড়বাবুর দিকে চাইতে তিনি চোখ মারলেন আর অমনি সে বোমকালীর হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল। বোমকালী হাতের আঙুল ম্যাসাজ করতে লাগল।
বড়বাবু সতর্ক গলায় বললেন, আপনি ঠিক আছেন তো? সকলে টেনশন করছে, বাড়ির লোক তো মিসিং ডায়রী করতে গেছিল। নকুড়েশ্বর সরাসরি সে কথার উত্তর না দিয়ে শ্যামাচরণকে বললেন, অ্যাই শ্যামা, তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? যা গিন্নিমাকে খবর দে। চা মিস্টি কি আছে দ্যাখ। ভোর হতে গেল। এতগুলো লোক শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
শ্যামাচরণ ‘এই বলে গেরেপতার এই বলে চা মিষ্টি, আমি যে কোন দিকে যাই’ ইত্যাদি বলতে বলতে নিচে নেমে গেল।
হ্যাঁ কি বলছিলেন যেন? ও মিসিং ডায়রী। আরে আমি এদের না বলে কয়ে ভোরবেলা কাকদ্বীপ গেসলুম বুঝলেন? অনেক পেমেন্ট পড়ে আছে ওধারে। যাই যাই করে যাওয়া হচ্ছিল না। নকুড়বাবু হাসি মুখে বললেন।
শিবু হাজরা বিগলিত হেসে বললেন, বাব্বা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। আপনি খুব টেনশনে ফেলেছিলেন স্যার। পার্টিকুলারলি ম্যাডামকে। নকুড় একটি শঙ্খবিড়ি ধরিয়েছেন ততক্ষণে। বিড়িতে টান দিয়ে তিনি বললেন, তা বটে। তবে সাংসারিক মনকষাকষি তো থাকে। ওসব ভুলে যান। আপনার বদলি তো ডিউ অনেকদিন, না?
শিবু হাজরা হাত টাত ঘষে বললেন, আপনার আশীর্বাদ থাকলে হবে স্যার।
নকুড়েশ্বর খুব নরমগলায় বড়বাবুকে বললেন, যথেষ্ট ঢি ঢি পড়েছে। আপনি কেস ক্লোজ করে দিন বড়বাবু। ছেকুকে আমি বলে দেব।
মেজবাবু নিচু গলায় বড়বাবুকে বললেন, স্যার ক্লোরোফর্ম আর বার্গলারি বলে নোট করেছে দত্ত। নকুড়েশ্বর প্রামাণিক অবাক হয়ে বললেন, ক্লোরোফর্ম, কিসের ক্লোরোফর্ম? শিবু হাজরা যেন আকাশ থেকে পড়ে বললেন, কিসের ক্লোরোফর্ম? কিসের বার্গলারি? দত্ত তোমার নোটবইটা দাও তো। প্রবীর দত্ত নোটবই বাড়িয়ে দিতে, বড়বাবু তার একটা পাতা ছিঁড়ে পকেটে ভরে বললেন, হয়ে গেল।
কথায় কথায় শ্যামাচরণ আর কামিনী ট্রে তে করে ঘোষ সুইটসের কালাকাঁদ আর চা নিয়ে হাজির। বোমকালী লম্বা হাত বাড়িয়ে দুটো চা তুলে একটা জিতেন মাহাতোকে দিয়ে বলল, এই যে। আঙুল তো ভেঙে দিচ্ছিলে বাবা আরেকটু হলে। শিবু হাজরা ‘আবার এসবের কি দরকার ছিল স্যার’ বলতে বলতে একটা কালাকাঁদ মুখে পুরে বললেন, মাদুলিটা একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করবেন স্যার। বলা যায় না।
ও আমি দেখে নেবখনে। কালীদাস কোথায় গেল, কালীদাস? নকুড় এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। কালীদাস পাঠক হাঁ করে ঘুমিয়ে চলেছে। অনেক ডাকাডাকিতে সে একবার হাই তুলে পাশ ফিরে শুল। নকুড় বললেন, থাক থাক। শ্যামা ওকে একটা বালিশ আর চাদর দে। আর বাবাজি আপনি কলতলায় গিয়ে চান টান করুন, ভাত খেয়ে যাবেন।
থানায় ফেরার পথে মেজবাবু বড়বাবুকে শুধোলেন, স্যার নকুড় প্রামাণিককে কেমন অচেনা লাগল না? শিবু হাজরা বললেন, কোত্থেকে এল দেখেছ? নিচ থেকে। মানে বৌএর কাছ থেকে। চেনা অচেনার সার্টিফিকেট ওখানে থাকে ভাই।
নকুড়েশ্বর জিতু ধামুকে ডেকে বললেন, বুড়ো তো হয়েছি, আর বজ্জাতিও কিছু কম করিনি। ভুল কিছু বলনি। জিতু ধামু মেঝের দিকে চেয়ে রইল। দরজায় ঠেস দিয়ে কুন্তলীনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেদিকে চেয়ে নকুড় বললেন, তোমার ছেলেদের যোগ্যতা হয়েছে কিনা জানি না তবে বয়স হয়েছে। জিতু ধামু এই চাবি নাও আর সিন্দুক খোল।
জিতু ধামু মায়ের দিকে দেখতে লাগল। কুন্তলীনি নরম গলায় বললেন, বাপ বলছে। নে।
সিন্দুক খুলতে মোট এগারোটি ব্যাংকের খাতা আর একটা কাঠের বাক্সো পাওয়া গেল। জিতু ধামু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এ ওর মুখ চাওয়াচাউই করে। নকুড় বললেন, ব্যাংকে মোটামুটি আটকোটি টাকা আছে। হাফ তোদের মায়ের আর বাকি হাফ তোদের দুজনের। গয়নার দোকান জিতু চালাবি, কিন্তু তেজারতি মাল সব ডেকে ফেরত দিতে হবে, এক পয়সা নেওয়া যাবে না। লাইনের বাস আছে দুটো। ধামু চালাবি। এই বাড়ি তোদের মায়ের। কাল উকিল ডেকে উইল করে দেব। শ্যামা আজীবন থাকবে, ওর মাইনে যা ঠিক করে দিয়েছি, আমার পরে তোমাদের দিতে হবে।
জিতু ধামু ভেউ ভেউ করে কেঁদে নকুড়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, বাবা মাফ করে দাও। মা শীতলার কিরে, আমরা তোমার পয়সা চাইনে।
কুন্তলীনি চেরা বাঁশের মত গলায় বললেন, মরণ!! এখন ফুটো পয়সা পাবে না। বাপ এখনো বেঁচে। আর আমিও চট করে মরছিনে। এই কথা শুনে জিতু ধামু কাঁদতে কাঁদতে মায়ের দিকে ডাইভ দিল। এবার কুন্তলীনি ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে শুরু করলেন। শ্যামাচরণ ধূতির খুঁট তুলে চোখ মুছতে লাগল।
নকুড় কাঠের বাক্সো খুলে বললেন, এই বাক্সোটা আমার রইল। দেখ এতে কি আছে। বাক্সোতে একটা পুরোনো খুর, গোটা দুয়েক কাঁচি আর একটা চিরুনী আছে দেখা গেল। নকুড় অস্তরগুলোয় হাত বুলিয়ে বললেন, নাপিতের ব্যাটা। এখনো অস্তর ধরলে চুল নামাতে পারি, বুঝলি?
####
বারুইপুরে বছর চারেক বাদে খুব ধুমধাম করে প্রামাণিক আরোগ্যালয় হাসপাতালের উদ্বোধন হল। বহুপুরোনো এক এজমালি সম্পত্তির জমিতে জোয়ারদার রিয়েলকন কোম্পানি এটি খুব যত্ন করে বানিয়েছে। এখানে প্রথমে একটা বহুতল হবে বলে শোনা যাচ্ছিল। লোকে বলাবলি করে কুলপীর নকুড়েশ্বর প্রামাণিক নাকি রাতারাতি মত পাল্টে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নেন। উদ্বোধনে মন্ত্রী সাংসদ আর সিনেমা স্টারজুটি বাদশা অনামিকা এসেছিল। সামনের সারিতে বসেছিলেন সদানন্দ জোয়ারদার। তার পাশে বসে সদ্য প্রোমোশন পাওয়া এএসপি শিবশঙ্কর হাজরা ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানতেন যে সেমসাইড হচ্ছে?
সদানন্দ আকর্ণবিস্তৃত হেসে বললেন, আরে না মশাই। প্রামাণিক মশাই যে আমার মাদুলি পরে বসে আছেন জানলে কি আর পাঠকের পিছনে পড়ি?
-তারপরে জানলেন কি করে?
-প্রথমে প্রামাণিক মশাইয়ের ফোন এল রাতের দিকে। বলেন সদানন্দ ফ্ল্যাট ট্যাট বানিও না, তোমার যা গেছে ভরে দেব। চল হাসপাতাল বানাই।
-ইন্টারেস্টিং তো!
-একদম। আমার প্রথম দিকে তেমন ইচ্ছে ছিল না। প্রামাণিক মশাই বলতে লাগলেন, পয়সার পিছনে অত দৌড়িও না। মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ভালো কাজ। আস্তে আস্তে মন ঘুরে গেল। তারপর জানতে পারলাম দেহান্তরী মাদুলি ভুল করে প্রামাণিক মশাই পরেছিলেন। ওটা পরলে নাকি মানুষ ভ্যানিস হয়ে যায়? সত্যি?
-আরে না! ওসব গ্রাম্য লোকের বানানো গল্প। কি সব কাপালিক টাপালিক।
-বাজে কথা?
-গালগল্প স্যার।
পিছনের দিকে বসে কালীদাস পাঠক এক বুড়োকে তখন বলছে, বাতের ব্যথার চিকিৎসা আছে কাকা। ভুলেও ওসব মাদুলি ফাদুলির দিকে যাবেন না। এই হাসপাতালে দেখান না, এখানে ফিফটি পারসেন্ট সিট ফ্রি।
হাসপাতালের গেটে গাড়ির জটলা। ঝুঁটিবাঁধা বোমকালীকে সিকিউরিটির ড্রেসে চেনা মুশকিল। সে অবশ্য পার্টটাইমে ঝাড়ফুঁক চালিয়ে যাচ্ছে। বারুইপুরেও তার অনেক মক্কেল হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শেষে সবাই জোরাজুরি করে নকুড়েশ্বর প্রামাণিককে কিছু বলতে বলল। নকুড়েশ্বর চারবছরে অনেকটা ঝরেছেন। বাতের ঝামেলাটাও অনেক কন্ট্রোলে। তিনি মাইক ধরে বলতে লাগলেন, কবছর আগে আমি একবার নিরুদ্দেশ হয়েছিলুম। তখন ভেবে দেখলুম, ঘুরে ফিরে বেড়ালেও আমরা অনেকেই কিন্তু আসলে নিরুদ্দেশ। উদ্দেশ্য কি জানা না থাকলে তো তাকে নিরুদ্দেশই বলবে, না কি? তো তখন আমি উদ্দেশ্য ঠিক করেছি। যতদিন পারি মানুষের সাহায্যে লাগব। এই হাসপাতাল যেন সবাইকার সাহায্যে লাগে। আমি বক্তৃতা দিতে পারি না। আপনাদের সবাইকে নমস্কার। সুস্থ থাকুন। অসুখে পড়লে প্রামাণিক আরোগ্যালয় রইল আপনাদের জন্যে।
লোকে পাঁচমিনিট ধরে হাততালি দিল। কুন্তলীনি চোখের জল মুছলেন।
[সমাপ্ত]