নাট্যমোদী

বাঙ্গালীর স্বল্পচর্চিত বৈশিষ্ট্য গুলির মধ্যে একটি হ’ল নাটক থিয়েটার যাত্রাপালার প্রতি গভীর আকর্ষণ আর অভিনয়প্রীতি। শহর থেকে শুরু করে বাংলার গ্রামেগঞ্জে এমন ঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে বংশধারায় একটিও, নিদেনপক্ষে, শখের অভিনেতা নেই।

বাবার মুখে তাঁর শৈশবের অভিঞ্জতার কথা শুনেছি। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর শৈশব কেটেছিলো। এমনকি আমার কৈশোরেও সেখানে বিদ্যুৎ ছিলো না, খবরের কাগজ আসতো পরের দিন। তবু সেই গাঁয়ে লতায় পাতায় দুর সম্পর্কের তাঁর এক কাকা ছিলেন অভিনয় পাগল। দারিদ্রের সংসার ছিলো তাঁর, বাঁকুড়ার রুক্ষ টাঁড় মাটি ফসল দিতোনা তেমন। কিন্তু ধারদেনা করে, লক্ষীর ভাঁড় ভেঙ্গে, স্ত্রীর অশেষ গঞ্জনা খেয়ে আবার তারই শাড়ী চুরি করে ( ঐ শাড়ী যাত্রায় পুরুষ চরিত্রের ধুতি হিসেবে ব্যবহার হত) ফিবছর একটা হলেও যাত্রা তিনি নামাতেন। ভুঁড়িসহ একখানা পেল্লায় বপু ছিলো ফলে শিবঠাকুরের চরিত্র তাঁর বাঁধা ছিলো।

যাইহোক, বাবার সেই খুড়োমশাই পার্ট করবেন কি, একটা লাইনও মনে রাখতে পারতেন না। প্রম্পট করে মহড়া দিতে দিতে অভিনয়ের দিন এসে হাজির হত, খুড়োমশাই তখনও লাইন গোলাচ্ছেন। ডায়রেক্টার বিরক্ত কিন্তু হরপার্বতী পালায় কি মহাদেব পাল্টানো যায়?
শেষমেশ সাব্যস্ত হল মহাদেবের ডায়লগগুলো টানা প্রম্ট করে যাওয়া হবে আর খুড়োমশাই উইংসের কাছাকাছি কানখাড়া করে পার্ট করে যাবেন।

অভিনয়ের দিন হ্যাজাক আর পেট্রোম্যাক্সের আলোয় স্টেজ ঝলমল, ক্লারিওনেট আর ঝাঁপতাল বেজে উঠলো। ছেলেপুলেদের চোখ গোল, খুড়োমশাই সারাদেহে পাউডার মেখে মাথায় শনের পরচুলা পরে আর ন্যাকড়ার সাপ-বেল্ট সহ সিল্কের বাঘছাল পরে আসরে অবতীর্ণ হলেন। করতালি আর থামে না, মহিলারা খুড়িকে গাঠেলাঠেলি করে হাসেন।

এপর্যন্ত সব ঠিকই ছিলো , গোল বেধে গেল সাপ-বেল্ট নিয়ে। ঘামে সিল্কের বাঘছাল বেল্টসহ ক্রমশই নিচের দিকে নেমে চলে আর মহাদেববেশী খুড়োমশাই নাজেহাল। তীব্র আলো, কানকালা করা বাজনার মধ্যে প্রম্পট করা সংলাপ শুনবার চাপ তার ওপর একহাতে ত্রিশূল আর অন্যহাতে বরাভয়, খুড়োমশাই পার্ট সামলাবেন না বাঘছাল, ভেবে পান না।
অবশেষে মরিয়া হয়ে তিনি ‘ধুত্তেরি তোর বরাভয়’ ভেবে নিয়ে একহাতে সাপ-বেল্ট সামাল দিলেন।

এদিকে হয়েছে কি, যাত্রার চ্যাংড়া ডায়রেক্টার নিজেই প্রম্পটার। উত্তেজনা বশত সে ফিশফিশ করে খুড়োমশাইকে বলে বসলো, পড়ে নাই হাতটি নামাও। তার উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ ছিলো কারন সে অ্যাক্টারকে পোষাকের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলো মাত্র। কিন্তু স্টেজে অন্য ঘটনা ঘটলো।

মহাদেব পার্বতীকে বললেন, কি বার্তা তবে হে প্রিয়ে পার্বতী? কেন তব চন্দ্রবদনে দেখি চিন্তার মেঘ? পড়ে নাই প্রিয়ে পড়ে নাই, হাতটি নামাও।

কিছুলোক না বুঝে হাততালি দিলো, বাকিরা হেসে খুন। খুড়ি বললেন, ঘরে আয় বুড়ো তোর হচ্ছে।

আমার বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন সুনীলকাকু। বাটানগরে মানুষ কিন্তু আদতে ফরিদপুরের লোক। অমায়িক সদাহাস্য এই মানুষটি আমার শৈশবে আমাদের চোখের মণি ছিলেন। পরের গল্পটি এঁর থেকে শোনা।

সুনীলকাকুর জ্যাঠামশাই ছিলেন আরেক নাটকপাগল লোক। গাঁয়ের মুরুব্বি গোছের ছিলেন তার উপরে ভয়ানক রাশভারী। তাঁর দাপটে এলাকায় বাঘেগরুতে একঘাটে জল খেতো। নাটকের সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ চরিত্রটা তিনিই নেবেন সেখানে কোনো কথা চলবে না গোছের একটা ব্যাপার ছিলো।

একবার গ্রামের ছেলেগুলের দল দুর্গাপূজায় ডি এল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নামাবে স্থির করলো। নাটকের ডায়রেক্টার হল তাহির বলে একটি ছেলে। তাহির গাঁয়ের অন্যতম শিক্ষিত ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বি এ পাশ দেওয়া। সে চাইলো নাটকটা ভালোভাবে নামাতে। কিন্তু প্রথম মিটিংএই জ্যাঠাবাবু আলেকজান্ডারের চরিত্রটি নিয়ে নিলেন। তাহিরের আপত্তি ধোঁপে টিকলো না।

নিলেন তো নিলেন, জ্যাঠাবাবু তাহিরের ওপর দিয়ে চলতে লাগলেন। তরুণ তাহির রেগে কাঁই। নাটক ভন্ডুল হওয়ার উপক্রম। তখন গাঁয়ের লোকজন তাহিরকে খুব করে বোঝালো, সারান দ্যাও ভাই, জ্যাঠাবাবু হলেন মান্যিগন্যি লোক নাটকে বেবাক পয়হা দিতাসেন ওঁর সঙ্গে না লাগাই ভাল। বেচারি তাহির আর কি করে চুপ করে গেল।

এদিকে মহড়া জমে উঠেছে, সেলুকাস, চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য সবাই পার্ট তুলে নিয়েছে শুধু জ্যাঠাবাবু কামাই করতে লাগলেন আর তাহির প্রক্সি মারতে লাগলো। জ্যাঠাবাবুকে যত জিঞ্জাসা করা হয় আপনি আসেন না কেন, তত তিনি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, পোলাপানের দল, তরা নাটকের বুঝিসটা কি? যা গিয়া পার্ট মুখস্ত কর, আমি হালার ইস্টেজেই মারুম অহন।

ক্ষুব্ধ তাহির অব্যাহতি চাইলো কিন্থু ফের গাঁয়ের লোক তাকে বাবাবাছা করে বুঝিয়ে ক্ষান্থ করলো।

তারপর এলো নাটকের দিন। যথারীতি জ্যাঠাবাবু সিকান্দার শা হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলেন। ফাঁকি যে তিনি দেন নি বোঝা গেল। শুধু ডি এল রায়ের বিখ্যাত সংলাপকে তিনি শুদ্ধ ফরিদপুরের উচ্চারণে ইমপ্রোভাইজ করে নিলেন।

সত্য হেলুকাস কি বিসিত্র এই দ্যাশ। এহানে দিনের ব্যালা প্রবল সূর্যের আলো আর রাত্রিব্যালা সাঁদের ঝিকিমিকি। স্যাই হুদুর ম্যাহিডনিয়া থিক্যা ময়দা দলার মত দলতি দলতি আইলাম কেউ আমারে ঠ্যাকাতে পারসে? পারে নাই। ক্যাবল সতদ্রুর পারের ওই ফইসকা সোরা অই পুরু হে কিনা আমারে রুখে দিলো?

তাহির মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে চলে গেল কিন্তু দর্শকে খুব হাততালি দিলো।

আমি নিজে সুন্দরবনের নিকটস্থ গ্রামে যাত্রা দেখেছি যেখানে রাজা রাংতামোড়া কাঠের তরোয়াল নিয়ে হুংকার দিচ্ছে, রাজ্য দিবিনে?

না দিবুনি।

দিবিনে?

না দিবুনি।

তবে নাগাও যুজ্যু। তারপর ঠক ঠকাঠক।

আরেকবার সম্ভবত বাসন্তীর কোনো গ্রামে জেনারেটরের আলোয় দেখেছিলাম এক সাধারণ সৈনিককে রাজা স্টেজে অসিযুদ্ধে পরাস্ত করতে পারছেন না। কাঠের তলোয়ার কিন্তু তারই কয়েক ঘা রাজার গাঁটে পড়লো। কাতর রাজা উইংসের দিকে চাইছেন। ভাবটা হল, এমন তো কথা ছিলো না। উইংস থেকে বলা হল, অ্যাই খুদে, কি করিস? শু ।

অ্যাঃ খুদে শুবে!! পাঁচটাকা দিছে। একটাকে লিবে তবে খুদে শুবে।

বাংলার ঘরে ঘরে এমন নাট্যমোদী খুদে আছে। যারা সহজে শুতে চায়না।

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!