অথ বৃদ্ধ কথা

অনেকদিন আগে যখন আশুতোষ মুখার্জি রোড ধরে ট্রাম ময়দানে যেত তখন ভবানীপুর থেকে অনেকেই ভোরের ট্রামে ময়দানে প্রাতর্ভ্রমণে যেত। ছেলেপুলেরা যেত গড়ের মাঠে ফুটবল পিটতে আর বুড়ো বুড়িরা গঙ্গাস্নানে যেত দৈনন্দিন পূন্যের সন্ধানে। সেই সময়কার একটি মজার গল্প বলি।

ময়দান হয়ে সাতটা নাগাদ ঘরফিরতি ভিড়ে ট্রামে উঠত এক বুড়ি। তার লোলচর্ম, মলিন সাদা শাড়ি আর শনের নুড়ি চুলে বিশেষত্ব কিছু ছিল না। কিন্তু ভিড় সেকেন্ডক্লাসে সে উঠত ডান হাতে একতাল গোবর নিয়ে। তারপর বাঁহাত নেড়ে খনখনে গলায় বলত, সঁরে যাঁও সঁরে যাঁও। সাঁমনে যেঁতে দাঁও। সামনে লেডিজ সিটে তার গন্তব্য। লোকজন দুদ্দাড় করে সরে পথ দিত, নইলে গায়ে গোবর লেগে যাবে। একদিন এক ছোকরা কন্ডাক্টর সাহস করে বলেছিল, দিদিমা টিকিট কেটেছেন? বুড়ি বলল, গোঁবরের নীচে পাঁচ পঁয়সা আঁছে। তুঁলে নে ভাঁই।

একবার ল্যান্সডাউন মোড়ের একটু আগে রাস্তার ধারে এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন। পরনে ধুতিপাঞ্জাবী, হাতে ঝোলানো ছাতা, বেশ মাষ্টারমশাই মাষ্টারমশাই চেহারা। জুলাইএর দুপুর। কাঠাফাটা রোদ্দুরে জনশূন্য রাস্তা। একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। একটা বেয়াল্লিশের এ হাজরার দিক থেকে গদাইলস্করি চালে আসছিল। এখন হল কি কলকাতার বাস তাদের মর্জি বোঝা দায়। হঠাৎ বাসটি গতি বাড়িয়ে ছুটে এসে মাষ্টারমশাইএর সামনে এসে গতি কমাল। মাষ্টারমশাই হাত তুলেছেন বোধকরি, পগেয়া কন্ডাক্টর তাঁকে কোমর জড়িয়ে বাসে তুলে নিয়ে ধপাধপ করে বাসের গায়ে চাপড় মেরে বলল, চলেই! অমনি বাস একেবারে আপনবেগে পাগলপারা। বৃদ্ধ বেমক্কা টলুনি সামনে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, চলেই! ছোঁ মেরে তুললি যে বড়? দুপুরবেলা দাদুর বয়সী লোককে কিডন্যাপ? চলেই?

বিধান বলে আমার এক বন্ধু ছিল। একদিন সে এসে করুণ মুখ করে বলল, আমার দাদু মারা গেল রে! শুনে সবাই খুশি হয়ে বলল, তাই বুঝি? দাহ করার লোক লাগবে না? বিধান বলল, তোরা যাবি? আমার বাড়ি সেই হরিদেবপুরে।

তাতে কি হয়েছে? হরিদেবপুরে বাড়ি বলে বিধানের দাদুর সদগতি হবে না? আমরা থাকতে?

আটজনের টিম যখন বিধানের বাড়ি পৌঁছুলুম তখন সন্ধে হবহব করছে। আমাদের জামার নীচে গামছা লুকোনো। বেশ গাছপালা ঘেরা বিধানের বাড়ির গেট পার করে ভিতরে ঢুকতেই প্রবল নামসংকীর্তনের আওয়াজ ভেসে এল। মৃত মানুষকে হরিনাম শুনিয়ে কি লাভ ভাবছি এমন সময় বিধান এসে লাজুক লাজুক মুক করে বলল, এখনও যায় নি বুঝলি। প্রাণটা একেবারে মুখের ডগায় এসে ঠেকেছে। যে কোন সময় হয়ে যাবে। তোরা বোস একটু চা ফাএর ব্যবস্থা করি।

চা খেয়ে বসে আছি তো আছিই। মুখের ডগা পার করল না বিধানের দাদুর প্রাণ। প্রথমে উসখুস তারপর ফিসফাস আর তারপর গজগজ করতে লাগল পুরো টিম। কেন এত ডিলে হচ্ছে?

বিধান হাতজোড় করে মাফ চেয়ে বলল, এক্ষুনি হয়ে যাবে গুরু। তোরা রাতটা থেকে যা প্লিজ।

বন্ধুর কথা কি করে ফেলা যায়। রাতের খাবার খেয়ে সবাই বিধানদের একতলা বাড়ির ন্যাড়া ছাতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। তারা গুনে আর মশা মারতে মারতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে।

কাকভোরে ঘুম ভাঙ্গল প্রকৃতির ডাকে। অচেনা জায়গা। ভেবেচিন্তে ছাতের কোনায় রেন ওয়াটার পাইপের কাছে হাল্কা হতে হতে শুনি নীচ থেকে হড়াস হড়াস করে জলের শব্দ। উঁকি দিয়ে দেখি এক অস্থিচর্মসার বৃদ্ধ গামছা পরে কুয়োতলায় স্নান করছে। এক বালতি করে জল তোলে আর মাথায় ঢালে। আরেক বন্ধুর ঘুম ভেঙ্গেছে। সেও আমার পথের পথিক। সে গলা বাড়িয়ে বলল, ও দাদু শুনছেন?

দাদু উপরের দিকে চেয়ে বলল, কে বাবা তুমি?

শুনুন না। এই বাড়ির বিধানের দাদুর তো খুব খারাপ অবস্থা। তিনি কি আছেন না গেছেন?

বৃদ্ধ ঝড়াস ঝড়াস করে বালতির জল মাথায় ঢালতে ঢালতে বলল, নাঃ। এ যাত্রা থেকে গেল।

আমি হতাশ হয়ে বললুম, আপনি ঠিক জানেন? খুব খারাপ অবস্থা ছিল কিন্তু।

বুড়ো কুলকুচি করে বলল, ঠিক জানি। আমিই তো বিধানের দাদু।

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!