পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালী, মনে হয় বাংলাদেশের বাঙ্গালীও বিখ্যাত বিস্কিটের ব্র্যান্ড ব্রিটানিয়ার সঙ্গে পরিচিত। অনেকদিন পর্যন্ত এই বিস্কিট নির্মাতা কোম্পানীটিকে বিদেশী বলে জানতাম। কিন্তু আদতে এই কোম্পানীটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গিরীশচন্দ্র মন্ডল আর নলিন চন্দ্র গুপ্ত নামে দুই খাঁটি বাঙ্গালী। এখানে বলা দরকার বিস্কিট একটি ইউরোপীয় খাদ্য, কালের প্রবাহে এটি বাঙ্গালীর খাদ্যতালিকায় বিস্কুট নামে আপ্তীকৃত হয়েছে কিন্তু একটা সময় প্রতিটি বিদেশী খাদ্যের মত বিস্কুটকেও বাঙ্গালীর খাদ্যতালিকায় স্থান করে নিতে বেশ লড়াই করতে হয়েছে। গোঁড়া হিন্দু বিশুদ্ধবাদীরা খাদ্যাভ্যাসে সামান্যতম বিদেশী প্রভাব পড়লে সমাজে পতিত করে দেবার ভয় দেখাতেন। মজার কথা হল, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও সাধারণ বাঙ্গালী বিস্কুট খেত লুকিয়ে, পাছে জাত যায় এই ভয়ে। এই সময় ১৮৮৭ সালে গিরীশচন্দ্র মধ্য কলকাতায় দেশী বিস্কিটের কারখানা খুলেছিলেন। বছর পাঁচেক বাদে তাঁর পড়শি নলিন চন্দ্র গুপ্ত ঐ ব্যবসায় যোগ দিলে পত্তন হয় ভি এস ব্রাদার্স নামে বিস্কিট কোম্পানীর। কয়েক বছরের মধ্যে এই কোম্পানী চলে যায় দমদমে, গিরীশচন্দ্র সম্ভবত ব্যবসা ছেড়ে দেন, ফলে ১৮৯৭ সালে কোম্পানীর নাম হয় গুপ্ত এন্ড কোং। গোঁড়াদের আপত্তির থেকে খদ্দেরদের বাঁচাতে বিস্কুটের নাম দেওয়া হয় হিন্দু বিস্কুট। স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়ায় হিন্দু বিস্কুটের কাটতি মন্দ হয় নি। কোম্পানী কলেবরে বাড়তে থাকলে ব্রিটিশ রাজপ্রভুর নেকনজরও বাড়তে থাকে। কালক্রমে গুপ্ত এন্ড কোং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটানিয়া বিস্কিট কোম্পানী নামে আত্মপ্রকাশ করে। ততদিনে বাংলার সর্বত্র দেশি বিস্কুটের ছোটবড় কারখানা ছড়িয়ে পড়েছে। আজও এই স্থানীয় বিস্কুট, যার মধ্যে লেড়ো সুবিখ্যাত, বাংলার চা দোকানগুলি আলো করে থাকে।

বাঙালির রোজকার খাওয়াদাওয়ার আরেকটি চিত্তাকর্ষক আইটেম হল পাউরুটি। এখন সর্বত্র আধুনিক বেকারীর প্রচলন হলেও কয়েক দশক আগে পর্যন্ত কলকাতা/ঢাকা ও দুই বাংলার উল্লেখযোগ্য জেলাশহর গুলির পাড়ায় পাড়ায় পাউরুটি কারখানা এক প্রকারের কুটিরশিল্প ছিল। এগুলি উনবিংশ শতাব্দীর loaf ধারায় তৈরি হত, বেশিরভাগই কোয়ার্টার পাউন্ড মাপে মিলত। আমরা sliced bread বলতে যা বুঝি এগুলি তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আজও দুই বাংলার রাস্তার ধারে ডিমটোষ্ট অর্ডার দিলে এই পাউরুটিগুলিই দেখা যাবে। আমি অনেক পরিণত বয়সে জেনেছি যে sliced bread ডিম দিয়ে ভাজলে তাকে ফ্রেঞ্চটোষ্ট বলে।
পাউরুটি বাংলায় পর্তুগীজদের হাত ধরে ঢুকেছিল (একই সঙ্গে গোয়াতেও) সপ্তদশ শতাব্দীতে। পাউ কথাটির উৎপত্তি নিয়ে বহু রকম মত আছে। পাউ কথাটি পর্তুগীজ শব্দ, আবার এই রুটি বানানোর জন্যে আটা/ময়দা পায়ে দলা হত, সেটাও কারণ হতে পারে। কিন্তু ইউরোপিয়ানদের অর্থাৎ ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান, জার্মান, গ্রীক বা ইহুদীদের যে ব্যাগেল, প্যানদলচে, বান ইত্যাদির যে কসমপলিটান ধারা বাংলায় বর্তমান (কেবলমাত্র অভিজাত বেকারী এবং বিখ্যাত হোটেলগুলিতে) তার থেকে পাউরুটি একদম আলাদা কারণ এটি বাঙালি ভদ্রলোকের রোজকার আহার তালিকাভুক্ত। মজার ব্যাপার উনবিংশ শতাব্দীতে রুটি বা ব্রেড বাঙালির কাছে ঠিক বিস্কুটের মত ব্রাত্য ছিল স্রেফ জাত যাবার ভয়ে। ব্রিটিশ রুটি ধর্মান্তকরণের উপলক্ষ বিবেচিত হত (গির্জার প্রার্থনাসভায় “our daily bread” ইত্যাদি)। ইউরোপিয়ান রুটি এইসময় তাদের নিজস্ব কমিউনিটির বাইরে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু একই সময়ে মুঘল নবাবদের অস্তমিত গরিমার কারণে মুসলিম বাবুর্চীদের পসার ক্রমশ কমছিল। বিকল্প জীবিকার সন্ধানে তারাই প্রথম কাঠের আগুনে সেঁকে পাউরুটি (woodfire bread) পত্তন করে যা বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল। ইউরোপিয়ান ব্রেড চলে গেল স্যুপ, স্যান্ডুইচের দিকে আর বাঙালি পাউরুটিকে তার অন্দরমহলে নিয়ে এল ঝোলাগুড়সহ। ১৯২৩ সালে সুকুমার রায় আবোল তাবোলে লিখলেন, “কিন্তু সবার চাইতে ভালো/পাউরুটি আর ঝোলাগুড়।“
পুরো উপমহাদেশে একমাত্র দুই বাংলাতেই রোজকার খাদ্য তালিকায় বা জনপ্রিয় আহারে ইউরোপিয়ান প্রভাব খুব সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। এক দুদশক আগেও কলকাতা শহরের পাড়ায় পাড়ায় চপ কাটলেটের রেষ্টুরাণ্ট দেখা যেত।