সেলফি

অমল ধবল পাল

রাশিয়া নামে একটি দেশ আছে। সেই দেশের সঙ্গে আমার দেশের একটি ইতিহাসও আছে। এখন এমন বয়েস হয়েছে যে রাজনীতি, রাষ্ট্র, বিদেশনীতি এইসব বড় বড় ব্যাপারে উলঝে যাই। আমেরিকা এখন ভারতের নতুন বন্ধু। কিন্তু একদিন রাশিয়া বড় ভাল বন্ধু ছিল মনে হয়। পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেমজালে।

একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় আমেরিকার সেভেনথ ফ্লিট ভারত মহাসাগরে এসে মাস্তানি করছিল। ভারত তখন একটি জিনোসাইডের বিরুদ্ধে লড়ছে। ইউরোপ, আমেরিকা সকলে পাকিস্তানের পক্ষে। সেই দুর্দিনে রাশিয়া বিশ্বপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্বার্থরক্ষা করতে তিনবার ভেটো প্রয়োগ করেছিল। তখন দশ বছরের বালক হিসাবে আমার চোখে জল এসে গেছিল।

আসলে রাশিয়ার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। একেবারে ছোট থেকে পড়ার ঝোঁক ছিল। অবিশ্যি তখন টিভি ইন্টারনেটতো ছিলনা, বই আর রেডিও ছিল পৃথিবীর জানালা। ভোরবেলা স্কুল যাবার আগে দরজার সামনে পড়ে থাকা খবরের কাগজ তুলে দেখতুম ইন্দ্রজাল কমিকস এসেছে কিনা। অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কিনা! তাদের সাথে খুলিগুহা, ওয়াম্বেসিদের গ্রামে ঘুরতাম। মনে মনে ঠিক ছিল বিয়ে হলে কিলাউইর সোনাবেলায় মধুচন্দ্রিমা করব। জানাডু দ্বিতীয় পছন্দ ছিল কারণ হোজোকে মোটে পছন্দ করতাম না। সেই ইন্দ্রজাল কমিকসে যখন ট্রেজার আইল্যান্ড এল আমার ঘরের খাট বিছানা আলনার পেছনে জলদস্যুরা লুকিয়ে থাকতে লাগল।

কিন্তু এইসব ছোটখাটো ব্যাপার। আটবছর বয়সে বাবা কিনে এনেছিলেন রুশদেশের রুপকথা। এ বইএর প্রকাশক ছিল প্রগতি প্রকাশক, মস্কো। বইএর চকচকে পাতা, আশ্চর্য সব ছবি আর সে কি সব গল্প। তখন আমি ইভান হয়ে গেলুম। সেই যে বোকা ইভান বড় বুদ্ধিমান, মনে আছে? সেই ইভান। গোলাপী ফুলো ফুলো গালওলা রাশিয়ার কোন গাঁয়ের মেয়ে ল্যুবা লুব্যুশকা হাত ধরে টেনে নিয়ে এক অত্যাশ্চর্য দেশের সীমাহীন স্তেপের উপর ছেড়ে দিয়েছিল আমাকে, স্পষ্ট মনে আছে। সেই ডাইনি বাবা ইয়াগা, আর সেই যে ইভান ঘোড়ার কান দিয়ে ঢুকে রাজপুত্তুর হয়ে বেরিয়ে আসত সেই দিনগুলি কি যে মনোরম ছিল।

আমি হরিশ চ্যাটার্জি ষ্ট্রীটের খালপাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলতুম: সিভকা বুর্কা, জাদুকা লেড়কা, সামনে এসে দাঁড়া। তখন সেই খালটা একটা ট্রেঞ্চ হয়ে যেত, জেলমাঠের গাছগুলোর উপর রুশী কুয়াশা ঘনিয়ে একাক্কার, আর সেন্ট্রাল জেলের পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে কসাক চাষিদের মত দেখতে লাগত।

কেন এমন হয়েছিল এখন বুঝি। রাশিয়ান সাহিত্য অনুবাদ করতেন সমর সেন, মঙ্গলাচরন চট্টোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, খালেদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ রায় আর হায়াৎ মামুদের মত দিকপালেরা। এই বিশাল, প্রাচীন এবং সংস্কৃতিঋদ্ধ দেশটির মানুষ, গান, গল্প আর নাটক বহুদিন ধরে এই ভূখন্ডের মানুষকে টানছে। আমরাও টেনেছি ওদের। মুকেশের গাওয়া আওয়ারা হুঁ গানটি রাশিয়াতে লোকগীতির মর্যাদা পায়।

কাতায়েভের অমল ধবল পাল পড়ে পেতিয়ার যে বন্ধু হয়ে যাব এতে আর আশ্চর্য কি?

নীচে রইল আমার সেই জলছবি।

Loading

স্রোতের তৃণ

পরিবর্তনের কথা শুনি মাঝে মাঝে। পরিবর্তনের পরিবর্তনের কথাও শুনি। আমাদের এ সম্পর্কে কিছু কিছু অস্পষ্ট ধারণা আছে। কিন্তু পরিবর্তন তো হয়েই চলেছে। The only thing that never changes is the propensity to change।

বিগত এক দশকে দেশে তথা আমাদের রাজ্যের সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তনগুলি হ’ল
১। বিজ্ঞানচেতনার পতন ও ধর্মবাদের উত্থান।
২। ন্যূনতম আয়ের বিধি কিন্তু কর্মসংস্থানের শূণ্যতা।
৩। রাজনীতির দুবৃত্তায়নের পরিবর্তে দুবৃত্তের রাজনীতিতে প্রবেশ।
৪। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অর্বাচীনদের নেতৃত্বে আসা এবং শিক্ষিতদের চাকরীর দাবীতে অনশন।
৫। রাজনৈতিক নেতাদের কৃচ্ছসাধনের গর্বের পরিবর্তে কোটিপতি ক্লাবে প্রতিষ্ঠা।
৬। বুদ্ধিজীবিদের নিরপেক্ষতার পরিবর্তে দলদাসবৃত্তিতে আগ্রহ।
৭। দলমত নির্বিশেষে ব্যক্তিপূজার ঝোঁক।
৮। বিতর্কের পরিবর্তে গালিগালাজ ও ব্যঙ্গ।
৯। সামাজিক বিপ্লবের পরিবর্তে ব্যক্তিগত অধিকারের আন্দোলন।
১০। গণমাধ্যমের অপমৃত্যু ও কর্পোরেট মিডিয়ার শাসন আমল।

পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। আমরা স্রোতের তৃণ, তাই বহমান ধারা টের পাই না।

Loading

কলা ও বিজ্ঞান

কলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে আমরা একটি বিরোধ দেখি। এই বিরোধ সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অনেকে এই বিরোধকে একটি দন্দ্ব হিসেবে দেখেন আর একে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে যে বিরোধ তার সঙ্গে তুলনীয় মনে করেন। এই ধারণাটিও সম্পূর্ণ ভুল। ধর্ম মূলত একটি সামাজিক বিশ্বাস যাতে তথ্য প্রমানের প্রয়োজন নেই, বিজ্ঞানের ভিত্তি তথ্য প্রমানের উপর নির্ভরশীল। এই নিয়ে বিশ্বাসী আর মুক্তমনাদের একটি পুরোনো ঝগড়া আছে। কলার সঙ্গে বিজ্ঞানের এখন কোন সম্পর্কই নেই। মানুষ, যাদের মধ্যে অনেক বিজ্ঞানী এবং কলাবিদ্ আছেন, মনে করে কলাচর্চা আর বিজ্ঞানচর্চা কেউ কারো কাজে আসে না। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে STEM (Science, Technology, Engineering, Mathematics) আর Artsএর মধ্যে একটি দুঃখজনক গন্ডি কেটে দেওয়া হয়েছে। এই বিভাজন সামাজিক compartmentalization তৈরী করে। একসময় শিল্পী ও কলাবিদরা বিজ্ঞানীদের ঝাড়ফুঁক করা ওঝার চেয়ে বেশী মর্যাদা দিতেন না, এখন বাপ মায়েরা ছেলে মেয়েদের STEM পড়াতে না পারলে দুঃখ পান।

কলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে এই বিভাজন সৃষ্টি করতে করতে আমরা ভুলে গেছি, দুটিই উদ্ভাবনমূলক জ্ঞান। আর এই উদ্ভাবনার মূলে আছে কল্পনা। যে কোন পেশাদার বিজ্ঞানীই জানেন যে আবিষ্কার আর সত্যসন্ধানের মূলে আছে গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা। এই অন্তর্দৃষ্টি আসলে মৌলিক কল্পনা। যা ভৌতিকভাবে দৃষ্টিগোচর নয় তাকে হৃদয়ংগম করার চাবিকাঠি হল কল্পনাশক্তি। মজার ব্যাপার হল, শিল্পকলায় এই কল্পনাশক্তিই হল চালিকাশক্তি। লিওনার্দো দ ভিঞ্চি এক প্রবাদপ্রতিম উদ্ভাবক ছিলেন। তিনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন না শিল্পী ছিলেন? নাকি দুইই ছিলেন?

গণিতের চেয়ে বেশি কাল্পনিক আর কিই বা হতে পারে? দুয়ে দুয়ে যে চার হবে সেটি একটি উৎকৃষ্ট কল্পনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। অথবা ধরুন দুটি সমান্তরাল রেখার ধারণা, যারা অসীম দূরত্বে গিয়ে মিলিত হবে। কিংবা এই প্রতিপাদ্য যে একের সঙ্গে আধ, তার সঙ্গে আধের আধ, তার সঙ্গে আধের আধের আধ এইভাবে অসংখ্যবার যোগ করে গেলে দুই পাওয়া যাবে। ভাবুন একবার! এক আর দুইএর মাঝখানে অসীম। অতি উৎকৃষ্ট কল্পনা কি না?

বস্তুতপক্ষে বিজ্ঞানীরা হরদম কলাশিল্পের কাছে হাত পাতছেন। কোয়ার্কগুলির নাম দেখুন, টপ বটম, স্ট্রেঞ্জ চার্ম আর আপ ডাউন। কোয়ান্টাম ক্রোমোডায়নামিক্সে তো রংয়ের ছড়াছড়ি, যেন দোল খেলছে সবাই। আসলে লড়াই নেই কোন। সমস্ত কৃতবিদ্য বিজ্ঞানীরা কলার কোন না কোন একটি শাখার গোপন বা প্রকাশ্য চর্চা করে গেছেন। শুধু শখে মনে হয় না। তাঁদের প্রয়োজন পড়েছিল।

কেমন প্রয়োজন? স্পেশাল রিলেটিভিটির তত্ত্ব আইনষ্টাইন যখন নির্মান করছিলেন তখন সময় কাল সন্ততি (space time continuum) কল্পনা করতে হয়েছিল কেননা ত্রিমাত্রিক ভৌতবিশ্বে মাথা কুটলেও চতুর্থমাত্রা সময়কে এঁকে দেখানো যাবে না। খাতার পাতায় ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিই যথেষ্ট জটিল, চতুর্থ মাত্রা তাহলে আঁকব কি করে। কল্পনায় আঁকব। ফর্মূলাবাদী মন দিয়ে বোঝা যাবেনা যে একটা বলকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে এক সেকেন্ডে আবার লুফে নিলে দুটি স্থানাঙ্কের মধ্যে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল স্পেস গলে যায়। খুব জোরালো কল্পনাশক্তি না থাকলে এও বোঝা মুশ্কিল যে যতবার আমরা রাতের আকাশে আলফা সেঞ্চুরির দিকে তাকাই আসলে আমরা টাইম ট্রাভেল করি। রোদের অমন যে বর্তমান আলো তাও আসলে আটমিনিট অতীতের ইতিহাস।

মানুষ যতই বিজ্ঞান আর কলাশিল্পের মধ্যে তফাত করুক, মূলে তফাত নেই কোন। কল্পনার একটি আধার হল স্মৃতি। এখন নিঃসন্দেহ হওয়া গেছে প্রতিটি দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিই আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর এক একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক। বিজ্ঞানীই বলুন আর শিল্পী সকলেই শেষপর্যন্ত সেই নেটওয়ার্কের সদস্য।

বেসিক সায়েন্সের পাঠ্যক্রমে অন্তত একটি কলার অধ্যয়ন জরুরী।

Loading

কেয়া চক্রবর্তী

কেয়া চক্রবর্তীকে আমি সচক্ষে দেখিনি। তাঁর অভিনয় দেখিনি। জীবনের কোন পর্যায়ে তাঁর সঙ্গে কোন প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ যোগ ছিল না কোনদিন। যে বছর তাঁর মৃত্যু হয়, আমার বয়স ছিল ষোলো। আমার কৈশোরে ঐ বয়সে নাটক থিয়েটার দেখার চল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ছিল না, ফলে জীবিত কেয়ার সম্পর্কে আমার রোমন্থন করার মত সরাসরি কোন স্মৃতি নেই। এই পেজে অনেক প্রণম্য ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষ কেয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁদের জড়িয়ে থাকা স্মৃতি শেয়ার করছেন, সেগুলি পড়ছি এবং সমৃদ্ধ হচ্ছি। আর পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে আমি বা আমার মত যারা কেয়া চক্রবর্তীর সাক্ষাৎ সান্নিধ্য পায় নি, তারা কি এই স্মৃতিতর্পনে ব্রাত্য হয়ে থাকবে? কেয়া চক্রবর্তীর স্মৃতি কি ১৯৭৭ সালে মাঝগঙ্গায় থেমে গেছে? বিতর্ক আর প্রশ্ন থামেনি, কিন্তু কেয়া চক্রবর্তী কি সম্পূর্ণ অতীত হয়ে গেছেন?

আমার পিতৃদেব খুব কম মাইনে পাওয়া সরকারী কর্মচারী ছিলেন। আমার শৈশব কৈশোর তাই দৈনন্দিন লড়াইএ ব্যাপৃত থাকত। কিন্তু তিনি সাহিত্যের ছাত্রও ছিলেন বটে, ফলে লড়াই করা মানুষের যে শিল্পে অখন্ড অধিকার আছে – সেই বোধ ছোট বয়সে হয়েছিল। শৈশব কৈশোরে যা পেতাম তাই পড়তাম, অকালপক্ক বালকেরা যা করে আর কি, আর সেই সূত্রে সংবাদপত্রে নান্দীকারের ভালোমানুষ নাটকের কথা পড়ে জেনেছিলাম কেয়া চক্রবর্তী নামে এক অভিনেত্রী শান্তাপ্রসাদ আর শান্তি বলে দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। এগারো বারো বছরের কথা, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে পত্রপত্রিকায় ‘কেয়া চক্রবর্তী অভিনীত’ ট্যাগলাইনের বিজ্ঞাপন দেখেছি মনে আছে। সেই সময়ে এমনকি সুচিত্রা সেনের একার নামে সিনেমার বিজ্ঞাপন দেখিনি। কেয়া চক্রবর্তীর সবচেয়ে কাছে এসেছিলাম, এখন মনে করে প্রসন্ন হাসি আসে, উত্তর কলকাতার রঙ্গনা থিয়েটার হলের প্রায়ান্ধকার লবিতে। না রক্তমাংসের কেয়া নন, তাঁর সাদাকালো ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম, যা হলের কাচের বাক্সে সাজানো থাকতো। সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন আমার বয়স বারো তেরো হবে বোধহয়, বাবার সঙ্গে তাঁর পুরোনো ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের আড্ডায় যাবার পথে এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এই ছবিগুলো হারিয়েই গেছিল, এখন ফেসবুক ফেরত নিয়ে আসছে।

অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ফেসবুক পেজ। বাম দিকের ছবিতে ক্লিক করে পেজটি দেখুন।

সমস্ত জীবন জুড়ে কেয়া চক্রবর্তীর সন্ধান করেছি। তাঁকে যারা দেখেছেন, এমন কি তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে ছিলেন এমন অনেক মানুষকে আমি চিনি, তাঁদের মুখে কেয়ার কথা শুনেছি, অজস্র লেখা পড়েছি তাঁর সম্পর্কে, তাঁর কাজ সম্পর্কে, তাঁর তীব্র শানিত জীবন সম্পর্কে – এসব থেকে কেয়া চক্রবর্তীকে খানিকটা চেনা বোঝা গেছে। কিন্তু আবার বোঝাও যায় নি অনেক। মানে, কবি শঙ্খ ঘোষকে জিজ্ঞেস করে যদি জানা যেত কেন তিনি লিখেছিলেন ‘আগুন ঝাঁপ দিয়েছে জলে’ বা কবিতা সিংহের কবিতা গুলো কি কেয়ার এপিটাফ?

একটা সময় পর্যন্ত কেয়া চক্রবর্তী এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে বেঁচেছিলেন আমার কাছে। এখন এই অ্যানেকডোটাল লেখা লিখতে লিখতে বুঝতে পারছি, আমাদের মত অনেকের কাছে কেয়া এই প্রশ্নগুলোর মত বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কোনদিন অতীত হবেন না। তিনি কেবল অসামান্যা অভিনেত্রী নন, একরকমের জীবনবোধের আইকন, যাকে যাপন করতে না পেরে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুসরণ করি।

প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে দেখা কেয়া চক্রবর্তীর সাদা কালো ছবি, যাতে তাকে কলাবিনুনী করা আর ডুরে শাড়ি পরা দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক অটুট আছে। তথ্যের ভার তাকে এতটুকু ক্লান্ত করে নি।

[ ফেসবুকের Keya Chakraborty শীর্ষক পেজের অনুমতি সাপেক্ষে পুনঃ প্রকাশিত। ]

Loading

নমকিত পা

১৯৫৯ সালে ফরাসী ভাষায় লেখা জাক ব্রেলের Ne me quitte pas গানটির ইংরাজী তর্জমা করেছিলেন রড ম্যাককুয়েন। তাঁর তর্জমাটি If you go away নামে জনপ্রিয় হয়েছিল। পরে ফ্র্যাংক সিনাত্রা গানের কথাগুলিকে একটু অদলবদল করে গেয়েছিলেন, কিন্তু পপ স্ট্যান্ডার্ড বিবেচিত এই গানটি বহু শিল্পী গেয়েছেন, যাদের মধ্যে নিল ডায়মন্ড, রে চার্লস, টম জোনস, জুলিও ইগলেসিয়াস, ডাস্টি স্প্রিংফিল্ড, বারবারা স্ট্রেইস্যান্ড আর শার্লি বেসি উল্লেখযোগ্য। নিনা সিমোনে আদৎ ফরাসী গানটি তাঁর I put a spell on you অ্যালবামে গেয়েছিলেন। ইংরাজী ছাড়াও এই গানটির একটি ইতালীয় (Non andare via) সংস্করণ গেয়েছেন জিনো পাওলি আর জার্মান (Bitte geh nicht fort) সংস্করণ গেয়েছেন মার্লিন দিয়েত্রিচ। বহুশ্রুত এই গানটি কালোত্তীর্ণ, যদিও জুলিও ইগলেসিয়াস সম্ভবত এই গানটির মর্মবাণীর সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
এই গানটির ফরাসী সংক্ষিপ্তসার হল:
Ne me quitte pas / Il faut oublier / Tout peut s’oublier / Qui s’enfuit déjà / Oublier le temps / Des malentendus / Et le temps perdu / A savoir comment / Oublier ces heures / Qui tuaient parfois / A coups de pourquoi / Le cœur do bonheur / Ne me quitte pas, / ne me quitte pas, / ne me quitte pas

বহুশ্রুত এই গানটি কালোত্তীর্ণ, যদিও জুলিও ইগলেসিয়াস সম্ভবত এই গানটির মর্মবাণীর সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

আর ম্যাককুয়েনকৃত ইংরাজী তর্জমা হল:
If you go away / on this summer day / Then you might as well / take the sun away / All the birds that flew / in the summer sky / When our love was new / and our hearts were high / When the day was young / and the night was long / And the moon stood still / for the night bird’s song / If you go away, / if you go away, / if you go away

But if you stay, / I’ll make you a day / Like no day has been / or will be again / We’ll sail on the sun, / we’ll ride on the rain / We’ll talk to the trees / and worship the wind / Then if you go, / I’ll understand / Leave me just enough love / to hold in my hand / If you go away, / if you go away, / if you go away

একটু দুঃসাহস করে গানটির বাংলা তর্জমা করলাম। কাজটি কঠিন। প্রথমত, ভাষান্তরে গানের ব্যাপ্তি ধরা দুঃসাধ্য, দ্বিতীয়ত সংস্কৃতিভেদে রসহানি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবে তর্জমায় গানের চলনটি রাখার চেষ্টা করেছি, যতি ও লয় হিসাব করে তর্জমাটি গাওয়া সম্ভব। যদিও গানের আরোহন – অবরোহন বিচারে সে দুঃসাহস কেউ করবেন না বলেই মনে হয়।

যদি যেতে চাও,
ফিরে না তাকাও,
মুছে দিয়ে যাও
এ আকাশটাও
পাখিদের গান
রোদ আসমান
নবজাত প্রেম
ভাসিয়ে দিলেম
যৌবন দিন
রাত সীমাহীন
এ স্থবির চাঁদ
স্মৃতি উন্মাদ,
যদি যেতে চাও
যদি যেতে চাও
যদি যেতে চাও

আর যদি, ধরো হাতখানি
আমি তুলে আনি
কোন হিরন্ময় দিন
তুলনাবিহীন
সূর্যের সন্ধান
করি নবধারাস্নান
শুনি বৃক্ষের বাণী
দিই বায়ুকে প্রণামী
তারপরে যাও
যদি যেতে চাও
শুধু প্রীতিটুকু দিও
যা অপরিমেয়
যদি যেতে চাও
যদি যেতে চাও
যদি চলে যাও

Loading

মহেশতলা

আমি কলকাতার পশ্চিমপ্রান্তে মহেশতলায় বাস করি। এই অঞ্চলটি তারাতলার মোড় থেকে জিনজিরাবাজার হয়ে বজবজ পর্যন্ত চলে যাওয়া বজবজ ট্রাঙ্ক রোডের মাধ্যমে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত, যদিও বজবজ-শিয়ালদহ ট্রেনলাইনও এই যোগাযোগের অন্যতম শরিক। মহেশতলা এখন একটি থানা, অতীতে টালিগঞ্জ থানা এই অঞ্চলের দেখভাল করত। অঞ্চলটি আয়তনে বিশাল, বস্তুতপক্ষে মহেশতলা পৌরসভা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম পুরশাসিত অঞ্চল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার শতাব্দী প্রাচীন এই জনপদটি কলকাতা শহর বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলির ইতিহাসে কোন উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে পারে নি। মহেশতলারও পশ্চিমে বজবজ প্রায় দুশো বছরের পুরোনো ও বর্ধিষ্ণু শহরতলী কিন্তু মহেশতলা যে কোথায় অর্ধেক কলকাতা তা জানে না। ভারতবিখ্যাত বাটানগর যে মহেশতলার অংশ সে কথাও অনেকে জানে বলে মনে হয় না।

এই অবহেলার পিছনে দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণটি হল মহেশতলা ঐতিহাসিক ভাবে সমাজের নিম্নবর্গের (অনুপ জাতি) বাসস্থান ছিল – কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলে শিক্ষার তেমন প্রসার হয় নি। বাওয়ালির মোড়লরা, চটা রায়পুরের রায়েরা, আকড়া কৃষ্ণনগরের মুখার্জিরা আর আদি মহেশতলার ব্যানার্জিরা এখানে জমিদারি করেছেন, স্কুল খুলেছেন, মন্দির স্থাপন করেছেন কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের কূপমন্ডুকতা তেমন পাল্টাতে পারেন নি। এই এলাকায় ওয়াচেন মোল্লা (যার নামে মোল্লার গেট) কিংবা সুবিদ আলির মত স্বনামধন্য, দাতা, বিদ্যোৎসাহী আর সমাজ সচেতন মানুষ ছিলেন, কিন্তু উদাসীন আলস্যে মহেশতলার মুসলমানেরা হিন্দুদের থেকে কিছু কম যান না। মহেশতলার মানুষ একসময় স্বচ্ছল ছিল কিন্তু কোনকালে উদ্যোগী বা উচ্চাকাঙ্খী ছিল না।

কোন সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এখন বহুতল আবাসন হচ্ছে – এতে এই অঞ্চলের জনভিত্তি পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু এখানকার সাবেক মানুষের বনিয়াদি উন্নয়ন কতটা হবে সন্দেহ।

দ্বিতীয় কারণটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার পালাবদলে পাল্টে পাল্টে গেছেন কিন্তু মহেশতলার জন্য কেউ বিশেষ কিছু করেন নি। কিছু নলকূপ, গ্রামের কিছু রাস্তার মেরামতি ইত্যাদিতেই এখানকার মানুষ খুশি, সুতরাং তাঁরাও দিনগত পাপক্ষয় করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে মহেশতলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও উন্নত নিকাশী ব্যবস্থা নেই, রাস্তাঘাট অতিসঙ্কীর্ণ, এলাকায় বড় কোন হাসপাতাল নেই এমনকি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বজবজ ট্রাঙ্ক রোড যা নাকি মহেশতলার ধমনী, দশকের পর দশক ধরে অনুন্নত আর বেআইনিভাবে দখল হয়ে পড়ে আছে। কোন সুসংহত পরিকল্পনা ছাড়াই এখানে এখন বহুতল আবাসন হচ্ছে – এতে এই অঞ্চলের জনভিত্তি পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু এখানকার সাবেক মানুষের বনিয়াদি উন্নয়ন কতটা হবে সন্দেহ।

অথচ মহেশতলার স্বল্পপরিচিত আকর্ষনীয় ইতিহাস আছে। এখানকার ভূমিপূত্ররা কলকাতার এলগিন রোডে বা বালিগঞ্জে বসতি স্থাপন করে মহেশতলাকে ভুলে যেতে পারেন কিন্তু মনে রাখতে হবে এখানকার ব্যানার্জিহাটের ব্রাহ্ম মুখুজ্যেবাড়িতে দেবেন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ বহুবার অতিথি হয়েছেন। এখানকার শিব আর কালীমন্দিরগুলি শতাব্দী প্রাচীন। মনে রাখতে হবে মহেশতলার পাঁচ মসজিদ বৌদ্ধ, হিন্দু আর মুসলিম সংস্কৃতির বিরল মিশ্রন। মনে রাখতে হবে মহেশতলার ইতিহাস কলকাতা শহরের অনেক অঞ্চলের চেয়ে কিছু কম সমৃদ্ধ নয়।

চব্বিশ পরগনার একটি পরগনার আদি নাম ছিল মাগুরা। সেই মাগুরা পরগনায় মহেশতলা ছিল একটি গ্রাম। সেই গ্রামের পাশে চিংড়িপোতা গ্রাম থেকে কটক রোড (দেড়শো বছর আগে যে নামে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড পরিচিত ছিল) ধরে সারেঙ্গাবাদ যাওয়ার পথে পড়ত একশ একর বিস্তৃত গুমোরজলা। সেই জলাভূমির একাংশ বুজিয়ে হয়েছে বিশাল আবাসন। শীতকালে অনেক রাত করে গাড়ি চালিয়ে ইডেন সিটির কাছে এলে জলা থেকে কুয়াশা ভেসে এসে গাড়ির আলোর সামনে অশরীরি নৃত্য করে। সে কি আমাদের কিছু বলতে চায়?

Loading

হৃদয়ভাঙ্গা গান

হৃদয়ভাঙ্গা গান, যাকে আমরা heartbreak song বলে জানি, সঙ্গীতের একটি প্রাচীন ধারা। এটি ঠিক জঁর নয়, কোন বিশেষ গায়নরীতিতে এই ধারা আবদ্ধ নয়, বরং ধ্রুপদী থেকে লোকসঙ্গীত হয়ে জনপ্রিয় আধুনিক গানের মধ্যে এই ভাবধারাটি বহমান। প্রেম-ভালোবাসার উপাখ্যানগুলিতে বিরহ বা বিয়োগব্যাথার উল্লেখ মানুষকে নিশির ডাকের মত ডাকে, সেই unrequited love অনেক সময় মিলনের আনন্দের চেয়েও প্রিয়তর হয়ে ওঠে। আশ্চর্যের কথা এই গানগুলি শুনলে মনে হয় প্রেম পীরিতি যেন একটি উদাসীন প্রবাহ, যা নিরন্তর বয়ে চলেছে – কিছুটা নিষ্ঠুর আর উদাসীন – যার মধ্যে ভেসে ডুবে মানুষ আকুল হয়ে সেই গান গাইছে। এখানে প্রেমিকের চেয়ে প্রেম বড়। হয়তো ধারণাটি ভুল নয় : তোমরা যে বল দিবস রজনী, ভালোবাসা ভালোবাসা; সখী ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলি যাতনাময়?
Careless love সেই রকম এক হৃদয়ভাঙ্গা গান। বহুপুরোনো প্রচলিত এই গানটির উৎস এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও blues সংস্করণরুপেই গানটির সর্বাধিক জনপ্রিয়তা, কিন্তু লোকগীতি থেকে শুরু করে jazz, country এমনকি পপসঙ্গীত হিসেবেও এই গানটি বার বার গাওয়া হয়েছে। যেহেতু স্রষ্টার দাবী নেই, ফলে অহরহ গানের কথা বদলেছে কিন্তু এর অপূর্ব মায়াবী সুর রয়ে গেছে অপরিবর্তিত আর ভালোবাসার বিচ্ছেদবেদনার মূল ভাবটিও রয়ে গেছে একই রকম। বেসি স্মিথ, মেরিলিন লি, পীট সিগার আর জর্জ লুইসের মত দিকপাল শিল্পীরা এই গানটি বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার গেয়েছেন। আর গেয়েছেন এডি আর্নল্ড, বিং ক্রশবি, রে চার্লস, বব ডিলান, জনি ক্যাশ এবং জোন বেজ। ইয়ু টিউবে careless love লিখে সন্ধান করলে এত সংস্করণ আসে যে শুনে শুনে শেষ হয় না। জনপ্রিয়তার নিরিখে ম্যাডেলিন পেরো এগিয়ে রইলেও তাঁর সংস্করণটির বাণী অনেকাংশেই শীলিত বা sophisticated: Love, oh love, oh careless love/ you fly through my head like wine/ You’ve wrecked the life of many a poor girl/ And you’ve spoiled the life of mine; গানটি যেন এক নারীর ব্যক্তিগত যন্ত্রণার আলেখ্য। আমার বরং প্রচলিত বাণীটি, যেটি তুলনায় সরল আর মরমিয়া, সেটিই বেশি ভালো লাগে।

Love, oh love, oh careless love
Can’t you see what your love’s done to me?
It made me roam, to leave my happy home
Oh love, oh love, oh careless love

Love, oh love, oh careless love
This is all that I can take
I’m just like a gypsy
I’m roaming around and I just can’t chase the blues way

Well you tied me to your apron strings
Yeah you tide me to your apron string
You said that you loved me but it didn’t mean a thing
Love, oh love, oh careless love

Love, oh love, oh careless love
Can’t you see what your love has done to me?
Well you said that you loved me but you know it didn’t mean a thing
Oh come on love, oh love, oh careless love

অনেক নামীদামী শিল্পীই গেয়েছেন এই গান। কিন্তু আমার ভালো লাগে ঘরের ছেলে অর্ক মুখার্জির গাওয়া গানটি। ইয়ু টিউবেই আছে এর একটি সংস্করণ, যেখানে অর্ক একটা পার্কে বসে দুলে দুলে ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে গানটি গাইছেন আর দীপ্তাংশু সংগত করছেন গীটারে। আমার ভালো লেগেছে কারণ অর্ক গায়নরীতিতে লোকসঙ্গীতের আদল নিয়েছেন – শীলিত মার্জনা পরিত্যাগ করে নিলাজ সহজিয়া ভাব পরিগ্রহ করেছেন। সেই আকুল সুরে কোন অচেনা দেশের অজানা নদী উপত্যকায় জিপসী মেয়ের চিকন কালো চোখে হারিয়ে যাবার গল্প আছে যেন। যদিও এসব ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার, তবুও একবার শুনে দেখলে ভালোই লাগবে মনে হয়।

এই গানের অনুবাদ করিনি। আমার মুর্শীদ শাহ আব্দুল করিম এমন একখানি গান লিখে রেখেছেন আমাদের জন্যে। সেখানে মিসিসিপি আর পদ্মা এক হয়ে বইছে। পারলে সে গানও শুনে নিন।

কেন পিড়িতি বাড়াইলা রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
কেমনে রাখিব তর মন
আমার আপন ঘরে বাদী রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
পাড়া পড়শী বাদী আমার
বাদী কালন নদী
মরম-জ্বালা সইতে না’রি
দিবানিশি কাঁদি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
কারে কি বলিব আমি
নিজে অপরাধী
কেঁদে কেঁদে চোখের জলে
বহাইলাম নদী রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
বাউল আব্দুল করিম বলে
হল এ কী ব্যাধি
তুমি বিনে এ ভুবনে
কে আছে ঔষধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
কেন পিড়িতি বাড়াইলা রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি…

Loading

দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে

ফেসবুকের দেওয়ালে কি লিখব-র চেয়ে কি লিখব না, সেই ধারণাটি বেশী মজবুত হওয়া উচিত। নীরবতারও স্বতন্ত্র অর্থ আর প্রয়োজনীয়তা আছে। অনেকে ভাবেন, দেয়াল আমার, আমার যা খুশী তাই লিখব, অনেকে এই ধারণাটি রক্ষাকবচের মত ব্যবহারও করেন, বিশেষত সমালোচিত হলে। কিন্তু ধারণাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়।

প্রথমত; বিদ্বেষমূলক, হিংস্র, আগ্রাসী বা অশ্লীল বক্তব্য (লেখা বা ছবি) এমনিতেই ফেসবুকের নিজস্ব নিয়মে অপসারণযোগ্য। আপাতদৃষ্টিতে তেমন বোঝা না গেলেও এইজাতীয় একটি censoring ফেসবুকে হয়েই থাকে। ফেসবুক একটি জনসংযোগ মাধ্যম, এখানে যে কোন postকেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে ধরে নেওয়া হয়, এমনকি নিজের দেওয়ালেও। কারুর আপত্তিজনক মনে হলে report করার ব্যবস্থাও আছে। এর সঙ্গে ভারতীয় সংবিধানবিধির প্রকাশ্য আচরণ ও বত্তব্য প্রকাশের নিয়মনীতিগুলিও সরাসরি জড়িত। সুতরাং অনেকদুর উদারতা থাকলেও প্রকাশ্য জনসংযোগ মাধ্যমে কি লেখা হবে তার নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে।

এ তো গেল সরাসরি অসৎ উদ্দেশ্যে দেওয়া postএর কথা। কিন্তু এমন অনেক post আছে যেগুলিকে এই গোত্রে ফেলা না গেলেও, সামাজিকভাবে ক্ষতিকর বলে মনে হয়। এইখানে ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে পড়ে কারণ মুক্তসমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এর সঙ্গে জড়িত। তবে স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচার এক নয়, স্বাধীনতা নিতে গেলে দায়িত্বশীল হতে হয়। যুক্তিগ্রাহ্যতা, সহনশীলতা এবং স্বচ্ছতা সেই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমার প্রকাশিত মত বা বত্তব্য যদি অন্যের আবেগ বা ধারণাকে challenge করে তাহলে সেই বক্তব্য প্রকাশের সংগত ও সুচিন্তিত কারণ থাকতে হবে এবং অবশ্যই আমাকে বিরুদ্ধ মত শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার দেয়াল, আমি যা খুশি লিখব, ভালো না লাগলে অন্যত্র যাও গোছের যুক্তি আসলে কোন যুক্তি হতে পারে না।

প্রকাশ্যে শুধু মত নয়, ঠাট্টা, তথ্য বা অনুভূতি বিনিময়ও content হিসেবে শেষপর্যন্ত জনসম্পত্তি। কেবল মাত্র দুজনের বা কয়েকজনের ব্যক্তিগত চৌহদ্দি নয়। তার জন্যে private message আছে।ফেসবুকের প্রকাশিত post গুলির নিরিখে কাউকে বিচার করার সময় তাই সে কোন কোন বিষয়ে নীরব সেটাও দেখা জরুরী। আর তাহলেই কি লিখব আর কি লিখব না-র ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Loading

বুদ্ধিজীবী

আলোচনাচক্রে এই প্রশ্নটি বার বার ওঠে। কে বুদ্ধিজীবি?

আমাদের সমাজে, বিশেষত বাংলায়, এই শব্দবন্ধগুলি অতিপরিচিত। বিদ্বজ্জন, সুশীল সমাজ আর বুদ্ধিজীবি। বামশাসনের অবসানের পর, ‘বাম ও গণতান্ত্রিক কলাকুশলী’ ইত্যাদির স্থানে এখন বিদ্বজ্জন, সুশীলসমাজ আর বুদ্ধিজীবিরা এসে বসেছেন। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল পুরস্কার, সম্বর্ধনা দিয়ে এমন বিদ্বজ্জন, সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবি প্রতিপালন করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বুদ্ধি ও মেধার বিষয়ে একধরণের জাতীয় শ্লাঘাবোধ আছে, ফলে এই বিদ্বজ্জন, সুশীলসমাজ ও বুদ্ধিজীবিরা আপাত নিরপেক্ষতার আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য চালিয়ে দেওয়ার কাজে অত্যন্ত ব্যবহারযোগ্য।
এই ব্যবহারযোগ্য রাজনৈতিক অস্ত্রের একেবারে কেন্দ্রস্থলে আছেন বুদ্ধিজীবিরা। বিদ্বজ্জন বা সুশীলসমাজও বুদ্ধিজীবিদেরই নামান্তর। তথাকথিত বাম ও অসাম্প্রদায়িকরা দক্ষিণপন্থীদের ব্যঙ্গ করে বলেন, তোমাদের তো কোন বুদ্ধিজীবি নেই হে!

তাই জানতে কৌতূহল হয়, কে বুদ্ধিজীবি? আমিতো সাদাচোখে দেখি বেশিরভাগই খ্যাতিজীবি, সম্বর্ধনাজীবি বা প্রশংসাজীবি। এর সঙ্গে বুদ্ধির কি সম্পর্ক?
সম্ভবত বুদ্ধিজীবি কথাটি শ্রমজীবির বিপরীতার্থক অর্থে এসেছে। নতুবা জীবন ধারণের জন্য শ্রম আর বুদ্ধি দুই-ই লাগে তো! আর সঠিক অর্থে ধরলে বুদ্ধি যাদের জীবিকার মূল তাদেরকেই বুদ্ধিজীবি বলা উচিত, যেমন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ডাক্তার বা গোয়েন্দা। আমার তো একজন কবির তুলনায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে বেশি বুদ্ধিজীবি বলে মনে হয়!!
তাহলে ঠিক ভুল ঠিক করে দেওয়া, সামাজিক নীতি নির্দ্ধারক বলে স্বঘোষিত, সম্বর্ধনা ও পুরস্কার পালিত কিছু ব্যক্তিকে বুদ্ধিজীবি বলে চালিয়ে দেওয়া হলে, অসংখ্য সাধারণ নাগরিক, যারা জীবনের প্রতি স্তরে বুদ্ধি বেচে খাচ্ছে, মানবে কেন?

Loading

সদগুরু

আমার বন্ধুরা আর সুমনা (সেও নিশ্চয়ই বন্ধু) সদগুরুর বক্তব্য খুব মন দিয়ে শোনে। তাদের কথায় আমি বুঝতে পারি ইশা ফাউন্ডেশনের কর্মকান্ড এবং সদগুরুর ব্যাখ্যাগুলিতে তারা মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত। যেহেতু বন্ধুদের দ্বারা আমিও প্রভাবিত হই, আমি সদগুরুর ভিডিওগুলি মন দিয়ে দেখতে শুরু করি।

মানুষ অনেক রকমের হয়। কেউ কেউ সহজেই মুগ্ধ হয়, অনুপ্রাণিত হয় – যেন তারা মুগ্ধ হবে বলে ঠিক করে রেখেছে। কেউ আবার সম্পূর্ণ বিপরীত, কোন কিছুই তাদের সহজে উদ্বেল করে না, সন্দেহ আর প্রশ্ন করা তাদের ধাত। আমি মুগ্ধ হই প্রকৃতির অপার বিস্ময়ে, সম্ভাবনায় আর জীবনের গভীর ব্যপকতায়, সৃষ্টির চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া বৈচিত্রে আর মহাজাগতিক প্রাকৃতিক নিয়ম ছন্দের অপূর্ব ছন্দবদ্ধতায়। গুরু মানে যদি এমন কেউ হয় যে আমার চোখ থেকে, চৈতণ্য থেকে অন্ধকার দুর করে দেবে, তাহলে এই প্রকৃতি বা জীবন আমার গুরু। গুরুবাবাজীতে আমার মোটে বিশ্বাস নেই, তাদের আমি সন্দেহের চোখে দেখি। আমি সহজেই কোন মানুষকে শ্রদ্ধার আসন দিতে পারি না, দীর্ঘদিন তার কাজকর্ম, বুদ্ধি ও চেতনা এবং উৎকর্ষের একটি সম্যক ধারণা হলে তবে আমি মানুষে মুগ্ধ হই। এইরকম একটা দ্বন্দ্ববাদী মন নিয়ে শুরু হয়েছিল সদগুরুকে আমার অনুধাবণ করার চেষ্টা।

সদগুরু আমার দেশের অতিপ্রাচীন অধ্যাত্মবাদকে একটি ধর্মবিহীন, নিরীশ্বরবাদী মোড়কে পেশ করছেন দেখে আনন্দিত ও কৌতুহলী হলাম। চেতনার বিকশিত স্তরে মানুষের জ্ঞান বা wisdom প্রসারিত হয়, তখন তার কথাগুলি মানুষের বোধ বিবেচনাকে আলোড়িত করে, এমন মানুষকে আমি বলি evolved being । প্রাথমিকভাবে সদগুরুকে আমার evolved being বলে মনে হয়েছে। আমি তার panel discussion গুলিও মন দিয়ে শুনেছি, এমনকি যেখানে Michio Kakur মত পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখকও উপস্থিত ছিলেন। কাউকেই সদগুরুর বক্তব্যকে খন্ডাতে দেখিনি। এসত্বেও সদগুরুকে আমার বিখ্যাত পাশ্চাত্য অতীন্দ্রীয়বাদী আধ্যাত্মিকদের মত লাগে নি, Allan Wattsএর মতও না। তাঁর আধ্যাত্মিকতার মধ্যে কোথাও একটা আমার দেশের সুপ্রাচীন এবং প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া জীবনদর্শনের ভিত্তি আছে বলে মনে হয়েছে, সেই ভিত্তিভূমিটি আমি সন্ধান করছি।

ড্যান ডেনেটের মত জড়বাদী দার্শনিকরা মানুষের চৈতণ্যকে মস্তিষ্কের বিপুল জটিলতাসঞ্জাত একপ্রকারের ইল্যুশন বা মায়াকল্পনা বলে দাবী করেন। তাঁদের মতে চৈতণ্য বা conciousness আসলে একপ্রকারের মায়া যা মস্তিষ্ক সামাজিক বিবর্তনের প্রয়োজনে তৈরী করেছে। এই মতটিও বিবেচনাধীন তবে আমার এরকমও মনে হয় জেনেটিক বিবর্তন বা সামাজিক বিবর্তন যদি এমন মায়ার জন্ম দিয়েও থাকে তবে তা এখন বাস্তবিকতার অংশ, ম্যাজিক বা ধাপ্পা নয়।

সদগুরুকে আমি পরীক্ষা করছি। ফল এখনো বেরোয় নি।

Loading

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!