সেলফি

সুরবায়া জনি

পঁচাশি থেকে নব্বই সালের মাঝামাঝি সময়ে অঞ্জন দত্তের বেনিয়াপুকুরের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। অঞ্জনের ওপেন থিয়েটার নামে একটা নাটকের দল ছিল, সেই দলে আমার পাড়ার বন্ধু নির্মল অভিনয় করত। সেই সূত্রে অঞ্জনদা, ছন্দাদি (অঞ্জনের স্ত্রী) আর নীল (অঞ্জন-ছন্দার একমাত্র পুত্র) এই পুরো পরিবারটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সেই যোগাযোগ আরও বাড়ে যখন অঞ্জনের নাটকগুলিতে আমার ছোটশ্যালিকা আর মেজশ্যালিকা (তখন অবশ্য তারা শ্যালিকা হয় নি, শুধুই টুম্পা আর পিকু) অভিনয় করতে শুরু করে। এখনও হয়ত অনেকের আলিজীন কিংবা কর্ডলাইন নাটকগুলির কথা মনে আছে। দুটিই ছিল মিউজিক্যাল এবং দুটিই বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আমার তখন অভিনয়ে তেমন উৎসাহ ছিল না, কিন্তু অঞ্জনের বেনিয়াপুকুরের বাড়িতে জমাট আড্ডা, রিহারসাল আর গানের আসর বসত – সেই আকর্ষণ ছিল প্রবল। সেই আড্ডায় নতুন পুরোনো নাটক পড়া হত, আর দেশবিদেশের নাটকের আলোচনাও হত প্রচুর। আলোচনার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতেন ব্রেখ্ট, তিনি অঞ্জনদার প্রিয় নাট্যকার ছিলেন। সেই রকম কোন একটা আড্ডায় ইষৎ মদ্যপ অবস্থায় প্রথম সুরবায়া জনি গানটি শুনেছিলাম। অবশ্য মূল গানটি নয়, অঞ্জন দত্তের করা বাংলা অনুবাদটি। সেইথেকে কমবেশি তিরিশ বছর এই গানটি আমার সঙ্গে রয়ে গেছে।

এই আশ্চর্য গানটি আসলে একটি মেয়ের ভাষ্য। একসময় নাবিকদের জলচর জীবন ছিল নারীসংসর্গবর্জিত; শহরগুলিই ছিল নারীসংসর্গের একমাত্র স্থান , সেখানে তারা প্রেমে পড়ত। সেই প্রেম কখনো সংসার বিবাহে পরিনত হত আবার কখনো বোকাসরল মেয়েগুলিকে মিথ্যে কথা বলে ঠকানোও হত। বহু গল্প উপন্যাস নাটক এই সম্পর্কগুলির টানাপোড়েনের উপর লেখা হয়েছে। গান খুব একটা হয় নি। সুরবায়া জনি গানটি তেমনি একটি মেয়ে ব্রেখ্টের নাটকে গাইছে। আমার কাছে এটা খুব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল।

১৯২৯ সালে এরিখ এঙ্গেলের নির্দ্দেশনায় বার্লিন শহরের শিফব্যুরদাম রঙ্গমঞ্চে হ্যাপিএন্ড নামে যে জার্মান-ইংলিশ মিউজিক্যাল বা সংগস্পিয়েল মঞ্চস্থ হয়, সেখানে এই গানটি জার্মান ভাষায় পরিবেশিত হয়েছিল। নাটকটির রচয়িতা ছিলেন যুগ্মভাবে এলিসাবেথ হাউপ্টমান আর বের্টোল্ড ব্রেখট, যদিও এই নাটকের একটি চরিত্র মঞ্চে কমিউনিস্ট প্যামফ্লেট পড়বে আর তা জার্মান সংবাদমাধ্যমে ঢি ঢি ফেলবে এই ভয়ে নাটকের টিকিটে রচয়িতার ছদ্মনাম ছাপানো হয়েছিল ডরোথি লেন। গানগুলির সুর করেছিলেন কার্ট ওয়েইল আর কথা লিখেছিলেন ব্রেখ্ট স্বয়ং। এ নাটক জার্মানিতে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়, আর দুটি বিশ্বযুদ্ধ পার করে ১৯৫৬ সালে মিউনিখে ফের শুরু হয়। মজার ব্যাপার স্যালভেশান আর্মি আর গ্যাংস্টারদের মধ্যে টানাপোড়েনের এই নাটক, যাতে ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসভঙ্গের গল্প বলা হয়েছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল আমেরিকার ব্রডওয়েতে (১৯৭৭)। গল্পের পটভূমি অবশ্য পাল্টে শিকাগো শহর করা হয়েছিল। যাইহোক এই নাটকের তৃতীয় অঙ্কে লিলিয়ান নামের একটি মেয়ে বিল ক্র্যাকার নামে এক গুন্ডার প্রেমে পড়ে এই গান গাইছে। গানটি, যাকে বলে বিটার সুইট, লিলিয়ানের চোখ জ্বলছে ঘৃণায় অথচ সে চোখে জল কারণ তাকে ঠকিয়েছে জেনেও সে বিলকে ভালোই বাসে। ফ্যান্টম অপেরায় এমন উচ্চকিত মানবিক দ্বন্দ্বের গান শুনেছি, কিন্তু মঞ্চনাটকে?

ব্রডওয়েতে ম্যারিঅ্যান ফেথফুল এই গানের যে সংস্করণটি গাইতেন (কথার সামান্য অদল বদল পাওয়া যায় অন্যত্র) তা হল এই রকম:

I had just turned sixteen that season
When you came up from Burma to stay
And you told me I ought to travel with you
You were sure it would be ok
When I asked how you earned your living
I can still hear what you said to me:
You had some kind of job on the railway
And had nothing to do with the sea

You said a lot, Johnny
All one big lie, Johnny
You cheated me blind, Johnny
From the minute we met
I hate you so, Johnny
When you stand there grinning, Johnny
Take that damn pipe out of your mouth, you rat

Surabaya Johnny
No one’s meaner than you
Surabaya Johnny
My God – and I still love you so
Surabaya Johnny
Why am I feeling so blue?
You have no heart, Johnny
And I still love you so

At the start, every day was Sunday
Till we went on our way one fine night
And before two more weeks were over
You thought nothing I did was right
So we trekked up and down through the Punjab
From the source of the river to the sea
When I look at my face in the mirror
There’s an old woman staring back at me

You didn’t want love, Johnny
You wanted cash, Johnny
But I sewed your lips, Johnny
And that was that
You wanted it all, Johnny
I gave you more, Johnny
Take that damn pipe out of your mouth, you rat

Surabaya Johnny
No one’s meaner than you
Surabaya Johnny
My God – and I still love you so
Surabaya Johnny
Why am I feeling so blue?
You have no heart, Johnny
And I still love you so

I would never have thought of asking
How you’d got that peculiar name
But from one end of the coast to the other
You were known everywhere we came
And one day in a two-bit flophouse
I’ll wake up to the roar of the sea
And you’ll leave without one word of warning
On a ship waiting down at the quay

You have no heart, Johnny!
You’re just a louse, Johnny!
How could you go, Johnny
And leave me flat?
You’re still my love, Johnny
Like the day we met, Johnny
Take that damn pipe out of your mouth, you rat

Surabaya Johnny
No one’s meaner than you
Surabaya Johnny
My God – and I still love you so
Surabaya Johnny
Why am I feeling so blue?
You have no heart, Johnny
And I still love you so

Thank you! Thank you very much!

গানটি রহস্যময়। বিল ক্র্যাকার সুরবায়া জনি নয়, স্পষ্টতই লিলিয়ান বিলের সুমতির জন্য একটি প্রচলিত গান গাইছে। তাহলে সুরবায়া জনি কে? ব্রেখ্ট এ প্রশ্নের উত্তর দেন নি, হয়ত সুরবায়া জনি বিশ্বাসভঙ্গের একটি মিথিক্যাল চরিত্র। কিন্তু তার এমন অদ্ভুত নাম কেন, সে তো গানেই জানতে চাওয়া হচ্ছে! গানে বর্মা, পাঞ্জাব আর সুরবায়া (ইন্দোনেশিয়ার একটি বন্দর শহর) ইত্যাদি স্থাননাম ব্যবহার করার কারণ কি? জনি এইসব স্থানে আরও নারীসংসর্গ করেছে? সে যে মিথ্যেবাদী তাতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ সে আসলে নাবিক আর ভালোমানুষের মেয়েটিকে সে ফুঁসলে নিয়ে গেছে রেলকোম্পানীতে কাজের ধাপ্পা দিয়ে! আক্রোশে ফেটেও পড়ছে মেয়েটি। তাকে ‘you rat’ বলে গালি দিচ্ছে (যদিও ১৯২৯ সালে ব্রেখ্ট জার্মান ভাষায় ‘du hund’ অর্থাৎ ‘তুই কুত্তা’ লিখেছিলেন আর ১৯৮৫তে অঞ্জনদা অনুবাদ করেছিলেন ‘শালা চোর!’)। তবুও মেয়েটি তাকে ভালোবাসে, কামনা করে এমন কি ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়? হায়, নারীর মন দুর্জ্ঞেয়!

যতবার এই গানটি শুনি ততবার বিপন্ন হই। এই গান সঙ্গীতের সৌকুমার্যকে চ্যালেঞ্জ করে অথচ হয়ে ওঠে এক মানবিক সুরবদ্ধ দলিল। প্রেম, যা পীড়নের পরেও টিকে থাকে, তার দিকে অবাক বিস্ময়ে দেখি। এই অদ্ভুত dark emotionএর প্রেরণা ব্রেখ্ট কোথা থেকে পেলেন খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ১৯২৫ সালে জার্মানিতেই লিয়ন ফুখ্তভাগনার ‘কালকুত্তা ফোর মাই’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন ‘ওয়ারেন হেস্টিংস, গভর্নর ফন ইন্ডিয়েন’ কাহিনীর নাট্যরুপ হিসেবে। ১৯১৪ সালে কলকাতার বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের জীবনী আধারিত এই নাটকে ব্রেখ্ট সহসম্পাদনার কাজ করেছিলেন, সেই নাটকের প্রথম অভিনয়ে সুরবায়া জনির মত একটি গান ছিল বলে কথিত। লোকে বলে এই কাহিনী আবার রুডিয়ার্ড কিপলিংএর ‘মেরি, পিটি উওম্যান’ কাহিনীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। একথা যদি সত্য হয় কম্যুনিস্ট ব্রেখ্ট সাম্রাজ্যবাদী কিপলিংএর থেকে ডিক্যাড্যান্ট সাংস্কৃতিক রুপকল্প ধার করতে দ্বিধা করেন নি!

দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে আমি সুরবায়া জনির পিছনে দৌড়ে মরছি। নাটক, সঙ্গীত থেকে সাহিত্য, রাজনীতি ঘুরে জার্মানি, আমেরিকা আর এশিয়া মহাদেশের সম্পর্ক আবিস্কার করতে করতে এখন শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার দ্বারস্থ হয়ে দেখি, হৃদয়াবেগের চেয়ে জটিল আর সুন্দর আর কিছু নেই।

এই গানটি অঞ্জনদা অনুবাদ করেছিলেন অস্পষ্ট মনে আছে এইরকম:

বহু বহুদিন আগের কথা
তুমি বর্মাদেশে এসেছিলে
তখন আমার বয়েস পনেরো কিংবা ষোল
কত স্বপ্ন তুমি দেখিয়েছিলে

সুরবায়া জনি
তোমার মন বলে কিছু নেই
মিছে বলেছিলে জনি
ধাপ্পা দিয়েছিলে জনি
ঠকিয়েছিলে জনি
শালা চোর!

এই গান নতুন করে অনুবাদ করতে চাই। জানিনা পারব কিনা।

ইয়ু টিউবে ‘সুরবায়া জনি’র অনেকগুলি সংস্করণ আছে। আমার পছন্দের গুলোর লিংক দিলাম। প্রথমটা জার্মান ভাষায়, পরেরটা ইংরাজিতে।

Loading

স্বেচ্ছায় রক্তদান

কিশোর বয়স থেকে রক্তদান করা আমার একটি বিশেষ প্রিয় কাজ ছিল। বছরে অন্তত দুবার রক্ত দিতাম, স্কুল কলেজে আয়োজিত রক্তদান শিবিরে। দীর্ঘ কুড়ি পঁচিশ বছর এই দান দাতব্য চলেছে, তারপর বয়সের নিয়মে (কে আর বর্ডারলাইন ডায়াবেটিকের রক্ত সংগ্রহ করতে চায়?) রক্তদান বন্ধ হয়েছে। এখন আমি অল্পবয়সীদের রক্তদান করতে উৎসাহ দিই। আমাদের শৈশব যৌবনে রক্তদান শিবির হত, কিন্তু এখন সর্বত্র দেখি স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির হচ্ছে। এই স্বেচ্ছা কথাটি আমাকে ভাবায়। এক বন্ধুর কাছে এ ব্যাপারে আমার সংশয়ের কথা বলায়, সে হেসে বলল, মানে বুঝলে না? তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তো রক্ত নেবে না!

না তা নেবে না। কিন্তু এই ভাবনাটা একটু বেয়াড়া। পর পর প্রশ্ন সাজিয়ে রাখে। প্রথমত, আমরাও তো স্বেচ্ছাতেই রক্ত দিতুম, মানে আগ্রহ করে উৎসাহ ভরেই দিতাম। এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মানে কি? তবে কি স্বেচ্ছায় দিতাম না? স্বেচ্ছা, ব্যাপারটা ঠিক কি? সেটা কি Free Will? মানে আমার জেনে বুঝে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যাতে আমাকে কেউ বা কোন কিছু প্রভাবিত করে নি?

সত্যিই কি তাই? একটু তলিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝলুম যতটা ভেবেছিলুম ভাবনাটা তারচেয়ে অনেক বেশি বেয়াড়া। তখন বয়স কম ছিল, বুঝে হোক বা না বুঝে, একটা বিশেষ রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক আদর্শ ছিল যা ঠিক করে দিয়েছিল রক্তদান একটি মহান কাজ, সমস্ত সমমনস্ক বন্ধুরা রক্তদান করত, আমি তাদের থেকে আলাদা হতে চাইনি, conform করার তাগিদ ছিল। এমন কি, এখন ভাবলে হাসি পায়, রক্তদান করার মধ্যে একটা chivalry ছিল (তার dictionary মানে যত গোলমেলেই হোক) এমনকি মেয়েদের impress করার উদ্দেশ্যও যে ছিল না সে কথা হলফ করে বলা যায় না। অর্থাৎ সূক্ষ ভাবে হলেও প্রভাবিত হয়েছি, conditioned হয়েছি। যদি এমন ব্যবস্থা থাকত যে কেউ টেলিফোন বুথের মত কোন বুথে চুপচাপ যান্ত্রিকভাবে রক্ত দিয়ে আসতে পারত, কেউ টেরও পেত না, তাহলে কি অমন নিয়ম করে, উৎসাহ করে, বছরের পর বছর রক্ত দিতুম? বলা মুশ্কিল।

স্বেচ্ছা কথাটি গোলমেলে। এতে একটি স্ব আছে, যা আমাদের খুব ভুলিয়ে রাখে আর আমরা মনে করি আমাদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত, সমস্ত বাছাই আমাদের স্বেচ্ছাধীন, সেখানে কোন বহির্প্রভাব নেই।অথচ যারা বিপনন বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত, তা সে টুথপেস্ট বেচাই হোক বা দেশের প্রধানমন্ত্রী, তারা আমাদের বোকামি দেখে খুব একচোট হাসবে। রাষ্ট্র রেগে গিয়ে ফেসবুককে হুমকি দিয়ে বলবে, তুমি প্রভাবিত কোরো না ভায়া, আমি কি বানের জলে ভেসে এলাম নাকি?

স্বেচ্ছা মানে যদি Free Will হয় তাহলে বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটি মোটামুটি বাতিল করে দিয়েছেন। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে সমাজ বা রাষ্ট্র বা নৈতিকতার বোধ Free Willএর উপর গড়ে উঠেছে তা একটি শাস্তিমূলক (punitive), ধর্মবাদী (religiositious), আপাত ন্যায্যতাবাদী (just world viewing) এবং দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী (right wing authoritative) ব্যবস্থায় পরিনত হয়। আমেরিকানরা গড়পড়তা সবচেয়ে বেশি free willএ বিশ্বাসী আর বিশ্বের মোটে পাঁচ শতাংশ জনসংখ্যার এই দেশে পৃথিবীর যত কারাবন্দী মানুষ আছে তার পঁচিশ শতাংশের বাস। কড়া শাস্তি দিয়ে আমেরিকায় কতদূর অপরাধমূলক মানসিকতার সংশোধন হয়েছে খুব পরিস্কার নয়। সম্ভবত তেমন কাজের কাজ কিছু হয় নি। Free Will খৃষ্টধর্মের মূলভিত্তি – ভালো যা কিছু হচ্ছে সব ইশ্বরের অপার মহিমা, খারাপ কিছু হলে, ঈশ্বর তো তোমাকে স্বেচ্ছা দিয়েছেন বাপু, own up responsibility! মোটামুটি সব অ্যাব্রাহামিক ধর্মেরই বাড়বাড়ন্ত এই স্বেচ্ছাধীন নাগরিক রাষ্ট্রে – যতক্ষণ না ধর্মীয় মৌলবাদ এসে গলায় ছুরি ঠেকাচ্ছে।

এই স্ব টি কে? ৩৭ ট্রিলিয়ন ম্যামালিয়ান সেল, যা দিয়ে আমাদের শরীর তৈরী? ২৬ মিলিয়ন নিউরন যা দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক গঠিত? তারা কি আমার free will মানে নাকি? কার ইচ্ছেয় হৃৎপিন্ড ধুকপুক করে, পৌষ্টিকতন্ত্র খাবার হজম করে, সবলদেহ প্রজননক্ষম পুরুষ বা নারীর একে অন্যকে দেখে যৌনতা জাগে? প্রেমে কি স্বেচ্ছায় পড়ি নাকি ভাই? জেনেটিকসই বল বা এপিজেনেটিকস, কার ইচ্ছেয় ঘটে সবকিছু? শুধু রক্তদান স্বেচ্ছায় কি করে হবে? আমাদের পঁচানব্বই শতাংশ DNA ব্যাকটেরিয়ার দান। ব্যাকটেরিয়া আমাদের পরিপাক চালায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি কিছুক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, স্ব টি কে হে বাপু?

আমরা অদৃষ্টবাদী প্রাচ্যদেশীয় গন্ডমূর্খ। স্বেচ্ছাধীনতা আমরা পাশ্চাত্যের থেকে টুকলি করেছি। আমার ভাবনার সূত্র ধরে কেউ মনে করতেই পারেন, তাহলে আমাদের ‘সকলি তোমার ইচ্ছা’ গাইতে গাইতে নৈরাজ্যবাদের দিকে চলে যাওয়াই উচিত। আমি কিন্তু সে কথা বলছিনে। মানে নৈতিক দায়িত্বের ব্যাপারটা গোলমেলে হলেও ভুলবেন না সামাজিক দায়ভার কিন্তু আছে। স্বেচ্ছায় রক্ত না হয় না দিলাম, কিন্তু সত্য গোপন করে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া লালিত রক্ত অন্য কাউকে পাশাতে গেলে পুলিশে ধরবে। Responsible না হলেও আমরা accountable তো বটে!

Loading

লঙ্কা নয় মরিচের ঝাল

সত্যজিৎ রায়ের বায়োগ্রাফি পড়ে শেষ করে দিনদুয়েক বইমুখো হইনি। তারপর মনে পড়ল অনেকদিন ধরে শিবাসিস মুখোপাধ্যায়ের ‘কাহ্ন’ বইটি পড়ার ইচ্ছে ছিল। এটি শরদিন্দুর পরে সম্ভবত সার্থক একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ যার নায়ক চর্যাগীতির বিস্মৃতপ্রায় কবি কাহ্ন পা। কিন্তু বইটি খুঁজে পাওয়া গেল না। না ডিজিট্যাল না মুদ্রিত সংস্করণ। প্রকাশক ছিলেন বোধহয় সপ্তর্ষি, তাদের ঠিকানাও আমার জানা নেই। কিন্তু খুঁজতে গিয়ে পেয়ে গেলাম রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’। আনন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত এই বইটি আমার পড়ার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের। রামকুমার শুরু করেছেন এইভাবে:
“পারলে গোধূলির এই রং গণ্ডূষে শুষে নিত ধনপতি। ওই কেশকালা ফিঙেটির মতো দোল খেত কর্ণের মাথায়। পশ্চিমের কমলা সূর্যের মতো দিনশেষে ডুবে যেত ভ্রমরার জলে। গিরি মাটিরঙে রাঙিয়ে দিত আকাশের কোল। কিন্তু তাকে যেতে হবে সিংহল দেশে, নোনা পথে—রাজার নির্দেশ।”

ভাষার সৌকর্যে এই বইটি অনন্য, বলা চলে ইয়ুরোপীয় প্রভাবে (বা ইংরেজির ধাঁচে) বাংলা গদ্য লেখার পূর্বে মঙ্গলকাব্যের সময় যদি বাংলা গদ্য থাকত, সেটি মোটামুটি এইরকম হতে পারত। এই গদ্য খুব interesting বটে, তবে উপন্যাস হিসেবে ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ যে খুব উৎরেছে তা বলতে পারছি না।

দুটি জিনিষ কৌতূহলোদ্দীপক।
এক, এখন অলস বদনামের ভাগী হলেও বাঙ্গালী চিরকাল এমন ছিল না বোধহয়। রামকুমারের কাহিনীর যদি ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে তাহলে দেখা যাচ্ছে বাঙ্গালী একসময় ব্যবসা বানিজ্যে পটু ছিল (চাঁদ সদাগর), উপরন্তু নৌবানিজ্যেও তার পারঙ্গমতা ছিল।
দুই, পাতা উল্টে পড়লুম: “কটু তৈলে ভাজা হয় বেথুয়া শাক। সুক্তা রন্ধন হয় বাগ্যন, কুমুড়া, কচা, কাঁচকলা, সজিনা, মোচার সঙ্গে মশল্লা মিশিয়ে। সন্তলন হিঙ্গু–জিরা–মেথির। রসবাস–হিঙ্গু–জিরা দিয়ে মুসুরি–মটর সূপ চাপে। ঘৃতে ভাজা হয় পাঁচ সহস্র পলাকড়ি। ঝোল হয় মানকচা, বড়ি, মরিচ ভূষিত কাতল মীনের। খর লবণে আম্র ও শকুল মীনের অম্বল বড়ো পছন্দ সদাগরের।”
বেথো শাকভাজা, সুক্তো, পটলভাজা, মানকচু বড়ি দিয়ে কাতলা মাছের ঝোল, আমশোলের অম্বল, মানে খাওয়াদাওয়া মোটামুটি একইরকম ছিল। তবে লঙ্কা তখনো আসেনি, মরিচের ঝাল।

Loading

সুস্বাগতম !

অনেকের সঙ্গেই ইতিপূর্বে আলাপ হয়েছে। দীর্ঘ দশ বছর ধরে লিখছি। ব্লগ লিখতাম ইউরোপীয়ান জার্নালিস্ট সোসাইটিতে, পরিবেশ সংক্রান্ত লেখালিখি। বিজনেস ইনসাইডেরে লেখা বেরিয়েছিল। বহু বন্ধু হয়েছে পৃথিবী জুড়ে। এখনো তাদের সাথে যোগাযোগ অটুট। তারপর একসময় মনে হল, নিজের ভাষায় লিখি। রম্যরচনা আর প্রবন্ধ লিখতাম সময় পেলেই। কিন্তু স্মৃতিচারণ আর গল্প কবিতায় জড়িয়ে গেছি শুধু বন্ধুদের দাবীতে। ফেসবুক থেকে শুরু করে আমার প্রথম বাংলা ব্লগ অল্প-স্বল্প-গল্পতে তার কিছু কিছু প্রকাশ পেয়েছিল। ততদিনে ধারাবাহিক লেখার কিস্তি সময়মতো না পেলে বহু রাগ অভিমানের ইতিহাস হয়ে গেছে।

হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছাপতে না দিলে বই হয়ে লেখাগুলো কোনদিন বেরোবে না, এমন সম্ভাবনার মধ্যে যে আগাম বিপদের আশঙ্কা আছে, তাকে এড়ানোর জন্যেই পবিত্র অনলাইন। এখানে নতুন পুরোনো যাবতীয় লেখা সংকলন করা হবে। আশা করি দুধের স্বাদ ঘোলে খানিকটা মিটবে। আরো কিছু পরিকল্পনা আছে, দেখা যাক কতদূর যাওয়া যায়।

লেখালিখির জায়গা বলে সচেতন ভাবে ব্লগ খুব মিনিম্যালিস্ট রাখার ইচ্ছে, অন্তত যতদিন না অলংকরণ করার মত কাউকে পাওয়া যাচ্ছে। পাঠক বন্ধুরা কেউ হদিস দিলে চমৎকার হয়। নতুবা পুরোটাই নিজে শিখে শিখে করা।

যারা পড়তে আসবেন, যদি ভাল লাগে , ফিরে জানাবেন। ভাল লাগবে, উৎসাহ পাবো এই আর কি!

আবার পথচলা শুরু। এবার আরো নিশ্চিত ভাবে, আরো ভালবেসে। যারা আমার লেখা পড়তে ভালবাসেন, যারা অপেক্ষা করে আছেন, তাঁরা তো বটেই, যারা নতুন এলেন তাঁদের জন্যেও রইল শুভেচ্ছা।

পবিত্র অনলাইনে স্বাগত!

পবিত্র মুখোপাধ্যায়

মহেশতলা, কলকাতা

৪ ঠা জুন ২০২০

Loading

error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!