সুন্দরবন

কোথা বনবিবি মায়
অভাগীর পুত্র দুখে মহালেতে যায়
কাঙ্গালের মাতা তুমি বিপদনাশিনী
আমার দুখেরে মাগো তরাবে আপনি
তোমার কদমে মাতা সঁপিনু উহারে
রণে, বনে বনবিবি তরাবে বাছারে।

~~~~~ বনবিবি জহুরানামা, মরহুম মুন্শি মুহম্মদ খাতের, ১৮৮০ খৃষ্টাব্দ

বাংলার দক্ষিণে যে সুবিশাল নদীঅরণ্যের দেশ সুন্দরবন নামে অঞ্চল এখন জাতিপুঞ্জ স্বীকৃত world heritage বলে পরিচিত, সেখানের অরণ্যচারী মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে আর বন্যপ্রাণীর সঙ্গে যুঝতে যুঝতে পুঁথি সাহিত্যর জন্ম দিয়েছিল, সেই মঙ্গলকাব্য সদৃশ, পাঁচালী সদৃশ সাহিত্যে হিন্দু আর মুসলমানের লৌকিক দেবদেবীরা হাত ধরাধরি করে আছেন। সেই অরণ্যে একপ্রান্তের দেবতা দক্ষিণরায়, আরেকপ্রান্তের পীর বড়খান গাজি। আর এদের মাথার উপর রয়েছেন এই অরণ্যের আত্মাস্বরুপা মাতা বনচন্ডী বা বনবিবি।

ঔপনিবেশিক পন্ডিতরা যতই বলার চেষ্টা করুন না কেন যে সুন্দরবনে মানববসতি স্থাপনের হোতা হ্যামিলন্টন, রাসেল আর হেনরি, পুরাতাত্বিক প্রমান দেখায় যে অন্তত দুহাজার বছর ধরে মানুষ এই অরণ্যে বাস করার চেষ্টা করে আসছে। সুন্দরবন পুঁথির কেচ্ছা (কিস্যা বা পাঁচালি) সেই অনাবিস্কৃত ইতিহাসের উপর আলোকপাত করে। এই লোকায়ত ধর্মাচার যাতে হিন্দুয়ানী আর ইসলাম মিলেমিশে গেছে এই world heritageর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যার জুড়ি পৃথিবীতে নেই। এই মিশ্র ধর্মাচরণের ইতিহাস আমরা কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল, আব্দুর রহিমের গাজি-কালু-চম্পাবতীর পুঁথি কিংবা মুন্শি মুহম্মদ খাতেরের বনবিবি জহুরানামা থেকে আবিস্কার করি।

সুন্দরবনের উপর অজস্র বই আছে। এর মধ্যে প্রামাণ্য গ্রন্থগুলি যথা W. W. Hunterএর দলিল, দেবীপ্রসাদ জানার শ্রীখন্ড সুন্দরবন এবং শিবশঙ্কর মিত্রর সুন্দরবন সমগ্র অবশ্যপাঠ্য। সুন্দরবন কেবল অভয়ারণ্য, পর্যটনকেন্দ্র বা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ লবনাম্বু উদ্ভিদের বন নয়, এটি একটি স্বল্পপরিচিত, অনাবিস্কৃত অরণ্যচারী সভ্যতার ক্ষেত্রবিশেষ। বাঘ যদি সুন্দরবনের আকর্ষণ হয়, এই অঞ্চলের মানুষ, তার বিচিত্র ভাগ্যতাড়িত সমাজ আর বিলীয়মান লোকসংস্কৃতির মিশেল বাঘের চেয়ে কিছু কম আকর্ষক নয়।

অমিতাভ ঘোষ তাঁর বিখ্যাত বই The hungry tide লেখার পিছনে অনুপ্রেরণার সম্পর্কে বলেছেন, “Part of the idea behind The Hungry Tide was to shine light on this area that is little known within India. But even within Bengal, the Sunderbans is really a kind of area of darkness. People don’t think of it, they don’t write about it, they don’t look at it. This is such a strange thing. For the ordinary tourist, the Sunderbans doesn’t exist.”

এখন মনে হয় little known বললে খুব কমই বলা হবে। শহর কলকাতার সংস্কৃতি গঙ্গার অদূরে অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে সুন্দরবন। সাম্প্রতিক আমফান ঝড়ে সুন্দরবনের লবণাম্বু অরণ্য বিনষ্ট হয়েছে বলে হাহুতাশ শুনতে শুনতে ভাবি, প্রকৃতি যা ভাঙে, গড়েও দেয় প্রায়শই, কিন্তু আমরা আমাদেরই নিজস্ব অতীতকে যখন স্বেচ্ছা নির্বাসন দিই তখন আত্মবিস্মৃতির সেই বিনাশ চিরস্থায়ী হয়ে যায়। নইলে কি করে ভুলে যাই আমাদের দক্ষিণে পড়ে থাকা সেই নদী অরণ্যকে যেখানে একসময় রাজত্ব করেছেন প্রতাপাদিত্য, যার নদী পথে ফিরিঙ্গি জলদস্যুর হাত থেকে লুকিয়ে বেঁচেছি একসময়। এই দুর্গাপুজোর সংস্কৃতি নিয়ে পড়ে থাকা  আর মোটর বোটে চেপে সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়া ‘দোখনে’ বাঙালি আসলে কারা ছিল, তার উত্তর বুকে নিয়ে সুন্দরবন নিশ্চুপ হয়ে আছে। হরিশংকর জলদাস অবশ্য মনে করিয়ে দেন:

আমাদের গায়ে লেগে আছে অনার্য রোদ্দুর
পুরোনো পাথরের স্তূপ দেখে আমরা শনাক্ত করতে পারি প্রার্থনার গৃহ
অথচ অসংখ্য নদী, সমুদ্র সমতল, আমাদের মাছ-ভাতের ঐতিহ্য
সবটাই ধীবরকালের নৃতত্ত্ব।

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!