কিশোর বয়স থেকে রক্তদান করা আমার একটি বিশেষ প্রিয় কাজ ছিল। বছরে অন্তত দুবার রক্ত দিতাম, স্কুল কলেজে আয়োজিত রক্তদান শিবিরে। দীর্ঘ কুড়ি পঁচিশ বছর এই দান দাতব্য চলেছে, তারপর বয়সের নিয়মে (কে আর বর্ডারলাইন ডায়াবেটিকের রক্ত সংগ্রহ করতে চায়?) রক্তদান বন্ধ হয়েছে। এখন আমি অল্পবয়সীদের রক্তদান করতে উৎসাহ দিই। আমাদের শৈশব যৌবনে রক্তদান শিবির হত, কিন্তু এখন সর্বত্র দেখি স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির হচ্ছে। এই স্বেচ্ছা কথাটি আমাকে ভাবায়। এক বন্ধুর কাছে এ ব্যাপারে আমার সংশয়ের কথা বলায়, সে হেসে বলল, মানে বুঝলে না? তোমার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তো রক্ত নেবে না!
না তা নেবে না। কিন্তু এই ভাবনাটা একটু বেয়াড়া। পর পর প্রশ্ন সাজিয়ে রাখে। প্রথমত, আমরাও তো স্বেচ্ছাতেই রক্ত দিতুম, মানে আগ্রহ করে উৎসাহ ভরেই দিতাম। এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মানে কি? তবে কি স্বেচ্ছায় দিতাম না? স্বেচ্ছা, ব্যাপারটা ঠিক কি? সেটা কি Free Will? মানে আমার জেনে বুঝে নেওয়া সিদ্ধান্ত, যাতে আমাকে কেউ বা কোন কিছু প্রভাবিত করে নি?
সত্যিই কি তাই? একটু তলিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝলুম যতটা ভেবেছিলুম ভাবনাটা তারচেয়ে অনেক বেশি বেয়াড়া। তখন বয়স কম ছিল, বুঝে হোক বা না বুঝে, একটা বিশেষ রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক আদর্শ ছিল যা ঠিক করে দিয়েছিল রক্তদান একটি মহান কাজ, সমস্ত সমমনস্ক বন্ধুরা রক্তদান করত, আমি তাদের থেকে আলাদা হতে চাইনি, conform করার তাগিদ ছিল। এমন কি, এখন ভাবলে হাসি পায়, রক্তদান করার মধ্যে একটা chivalry ছিল (তার dictionary মানে যত গোলমেলেই হোক) এমনকি মেয়েদের impress করার উদ্দেশ্যও যে ছিল না সে কথা হলফ করে বলা যায় না। অর্থাৎ সূক্ষ ভাবে হলেও প্রভাবিত হয়েছি, conditioned হয়েছি। যদি এমন ব্যবস্থা থাকত যে কেউ টেলিফোন বুথের মত কোন বুথে চুপচাপ যান্ত্রিকভাবে রক্ত দিয়ে আসতে পারত, কেউ টেরও পেত না, তাহলে কি অমন নিয়ম করে, উৎসাহ করে, বছরের পর বছর রক্ত দিতুম? বলা মুশ্কিল।
স্বেচ্ছা কথাটি গোলমেলে। এতে একটি স্ব আছে, যা আমাদের খুব ভুলিয়ে রাখে আর আমরা মনে করি আমাদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত, সমস্ত বাছাই আমাদের স্বেচ্ছাধীন, সেখানে কোন বহির্প্রভাব নেই।অথচ যারা বিপনন বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত, তা সে টুথপেস্ট বেচাই হোক বা দেশের প্রধানমন্ত্রী, তারা আমাদের বোকামি দেখে খুব একচোট হাসবে। রাষ্ট্র রেগে গিয়ে ফেসবুককে হুমকি দিয়ে বলবে, তুমি প্রভাবিত কোরো না ভায়া, আমি কি বানের জলে ভেসে এলাম নাকি?
স্বেচ্ছা মানে যদি Free Will হয় তাহলে বিজ্ঞানীরা এই ধারণাটি মোটামুটি বাতিল করে দিয়েছেন। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে সমাজ বা রাষ্ট্র বা নৈতিকতার বোধ Free Willএর উপর গড়ে উঠেছে তা একটি শাস্তিমূলক (punitive), ধর্মবাদী (religiositious), আপাত ন্যায্যতাবাদী (just world viewing) এবং দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী (right wing authoritative) ব্যবস্থায় পরিনত হয়। আমেরিকানরা গড়পড়তা সবচেয়ে বেশি free willএ বিশ্বাসী আর বিশ্বের মোটে পাঁচ শতাংশ জনসংখ্যার এই দেশে পৃথিবীর যত কারাবন্দী মানুষ আছে তার পঁচিশ শতাংশের বাস। কড়া শাস্তি দিয়ে আমেরিকায় কতদূর অপরাধমূলক মানসিকতার সংশোধন হয়েছে খুব পরিস্কার নয়। সম্ভবত তেমন কাজের কাজ কিছু হয় নি। Free Will খৃষ্টধর্মের মূলভিত্তি – ভালো যা কিছু হচ্ছে সব ইশ্বরের অপার মহিমা, খারাপ কিছু হলে, ঈশ্বর তো তোমাকে স্বেচ্ছা দিয়েছেন বাপু, own up responsibility! মোটামুটি সব অ্যাব্রাহামিক ধর্মেরই বাড়বাড়ন্ত এই স্বেচ্ছাধীন নাগরিক রাষ্ট্রে – যতক্ষণ না ধর্মীয় মৌলবাদ এসে গলায় ছুরি ঠেকাচ্ছে।
এই স্ব টি কে? ৩৭ ট্রিলিয়ন ম্যামালিয়ান সেল, যা দিয়ে আমাদের শরীর তৈরী? ২৬ মিলিয়ন নিউরন যা দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ক গঠিত? তারা কি আমার free will মানে নাকি? কার ইচ্ছেয় হৃৎপিন্ড ধুকপুক করে, পৌষ্টিকতন্ত্র খাবার হজম করে, সবলদেহ প্রজননক্ষম পুরুষ বা নারীর একে অন্যকে দেখে যৌনতা জাগে? প্রেমে কি স্বেচ্ছায় পড়ি নাকি ভাই? জেনেটিকসই বল বা এপিজেনেটিকস, কার ইচ্ছেয় ঘটে সবকিছু? শুধু রক্তদান স্বেচ্ছায় কি করে হবে? আমাদের পঁচানব্বই শতাংশ DNA ব্যাকটেরিয়ার দান। ব্যাকটেরিয়া আমাদের পরিপাক চালায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, এমনকি কিছুক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, স্ব টি কে হে বাপু?
আমরা অদৃষ্টবাদী প্রাচ্যদেশীয় গন্ডমূর্খ। স্বেচ্ছাধীনতা আমরা পাশ্চাত্যের থেকে টুকলি করেছি। আমার ভাবনার সূত্র ধরে কেউ মনে করতেই পারেন, তাহলে আমাদের ‘সকলি তোমার ইচ্ছা’ গাইতে গাইতে নৈরাজ্যবাদের দিকে চলে যাওয়াই উচিত। আমি কিন্তু সে কথা বলছিনে। মানে নৈতিক দায়িত্বের ব্যাপারটা গোলমেলে হলেও ভুলবেন না সামাজিক দায়ভার কিন্তু আছে। স্বেচ্ছায় রক্ত না হয় না দিলাম, কিন্তু সত্য গোপন করে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি বা চিকুনগুনিয়া লালিত রক্ত অন্য কাউকে পাশাতে গেলে পুলিশে ধরবে। Responsible না হলেও আমরা accountable তো বটে!