৩রা ধও অল-হিজ্জা। পূন্য হিজরার ১০৪১তম বৎসর

প্রভাতে এক ঘটিকা বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যত আকস্মিকভাবে বৃষ্টির সূত্রপাত, ততোধিক ব্যস্ততায় বারিদপূঞ্জ নিচের ধরিত্রীর প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে দক্ষিনাভিমুখী হল। এরপর অচিরেই সূর্যদেবের আবির্ভাব, এবং সম্ভবত প্রভাতের অনুপস্থিতির ত্রুটিপূরণের জন্য তিনি তাঁর সুউজ্জ্বল রৌদ্ররাশিতে ধরণীর কর্দমাক্ত নরম মাটিকে দগ্ধ করতে শুরু করলেন। আমাদের এই ধরণী এখন হাভেলিশহর, যাকে সাধারণ লোকে হালিশহরও বলে থাকে। সেই হালিশহর হুগলী নদীর পূর্ব পাড় বরাবর, বিখ্যাত বন্দেল চার্চের প্রায় বিপরীতে এখন শ্বাসরোধী উত্তাপে দগ্ধ হতে শুরু করেছে। নাম হাভেলিশহর হলে কি হয়, এই শহরে হাভেলি বলে তেমন কোন হর্ম্য নেই, বিশেষত সামান্য দক্ষিণে নদীর পাড় ঘেঁষে সারি সারি মনোরম পর্তুগীজ প্রার্থনাগৃহ যেন হালিশহরকে ব্যাঙ্গ করছে। এই যথাকথিত শহরে তৃণাচ্ছাদিত পথগুলিই রাজপথ; শহরের কেন্দ্রে এক বিশাল প্রাকৃতিক উদ্যানের চারিপাশে ছড়ানো ছিটানো ইঁটমাটির গৃহগুলিই অট্টালিকা। হালিশহর আদতে মুঘল কর আদায় কেন্দ্র,পর্তুগীজরা সহজে এ পথ মাড়ায় না।

হালিশহরের মধ্যস্থিত উদ্যান আজ পাগড়ি শোভিত বাদামী গাত্রবর্ণের শহরবাসীর আকর্ষণের কারণ। উদ্যানের মধ্যে এক বিশাল বিচিত্রবর্ণ তাম্বুর পত্তন হয়েছে; তাম্বুর শীর্ষে বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে মিশকালো মসলিনের উপর রুপালি চন্দ্রকলাখচিত অতিপরিচিত মুঘল পতাকা। প্রভাতী বৃষ্টির মধ্যেই অনেকগুলি গোশকটে মুঘল ওমরাহেরা এই তাম্বুতে এসে পৌঁছেছেন – বৃষ্টিতে তাদের জোব্বা সবিশেষ ভিজেছে। এই মহামতি ওমরাহের দল কাশিম খানের এহেন জবরদস্তিতে মনে মনে যৎপরোনাস্তি রুষ্ট। কিন্তু বাংলার সুবাহদারের সন্মুখে সে বিরক্তি তো আর প্রকাশ করা যায় না, তাই তাদের প্রকাশ্য আচরণে মুঘল শিষ্টতার কোন অভাব নেই। উদ্যানের সবুজ গালিচাসদৃশ মাঠ অশ্বারোহী ও গোশকটের আনাগোনায় বাদামীবর্ণ কর্দমাক্ত গোশালার মত দেখায়। এই কর্দমের মধ্যেই শাহি ভৃত্যের দল যথাবিহিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে অশ্বের রশি হাতে ধরে তাম্বুর অদূরে দন্ডায়মান। তাম্বুর চারিদিকে ভিড় করে আছে সশস্ত্র মুঘল রক্ষী ও সৈন্য। অতি সাধারণ বিচারেও এই রক্ষী, সৈন্য ও ভৃত্যদের সংখ্যা সহস্রের কম হবে না। বৃহৎ তাম্বুটির পাশেই একটি অপেক্ষাকৃত ছোট তাম্বু – তার চিমনী দিয়ে ধূম নির্গত হচ্ছে। কাশিম খান খুবই বিস্তারিতভাবে প্রাতরাশ করতে ভালোবাসেন।

আল্লাহ্ মেহেরবান, সুবাহদার এখানে তবায়েফ আর সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে আসেন নি, আগাহ খান মনে মনে ভাবল। তার খুবই ইচ্ছা যে সে যুদ্ধ পরিকল্পনায় যোগ দেয় কিন্তু কাশিম খানের পুত্র ও সেনাধ্যক্ষ এনায়াতুল্লাহের আপত্তিতে তা সম্ভব হচ্ছে না। পরিবর্তে তাকে খুবই নিম্নমানের কাজ, অর্থাৎ কিনা শাহি তাম্বুর দ্বারপরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মনে যাবতীয় ক্ষোভ আর ঈর্ষা নিয়ে আগাহ আলি তাই দরজায় আড়ি পাতছে – ভিতরে কি মন্ত্রণা চলছে জানবার জন্যে তার দিল বড়ই পরেশান। ভিতর থেকে ভেসে আসা আলোচনা খন্ডাংশ শুনে আগাহ আলির মনে হল বৃষ্টিতে কামানের বারুদ ভিজে যাওয়ায় মুঘল সেনাপতিরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।

‘বারুদের বস্তা ঢাকা দেওয়ার জন্যে আমাদের এক্ষুনি ত্রিপলের ব্যবস্থা করা দরকার,’ এনায়াতুল্লাহকে উত্তেজিতভাবে বলতে শোনা গেল। গতকালই সে হুগলী শহরের নিকটে গোলন্দাজির অভ্যাস করছিল। ‘তাছাড়া কাদামাটিতে কামানের চাকা তো চলতেই চায় না, বসানো হবে কি করে?’

‘ঘ্যান ঘ্যান কোরো না এনায়েত, সমস্যার সমাধান জানলে বল।’ আল্লাহ ইয়ার খানের বিরক্ত কন্ঠস্বর শোনা গেল। আল্লাহ ইয়ার খান মুঘল বাহিনীর প্রকৃত সেনাধ্যক্ষ, স্বয়ং সম্রাট শাহজাহানের দ্বারা নিযুক্ত। দীর্ঘদেহী ও শালপ্রাংশু এই সৈনিক বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। বয়সের ভারে ইষৎ ন্যুব্জ এই সেনাধ্যক্ষই একমাত্র ব্যক্তি যিনি কাশিম খানের পুত্রকে এহেন সম্ভাষণ করতে পারেন। এনায়েত আদতে এক শিক্ষানবীশ ওমরাহ যাকে আল্লা ইয়ার খান প্রশিক্ষিত করে তুলছেন।

কাশিম খান নীরবতা ভেঙ্গে বললেন, ‘আপনাদের ঝুটঝামেলা মিটলে আমরা কি মুঘল সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনা আলোচনা করতে পারি? নাকি আমি একটু খুসরুর রুবায়ৎ পড়ে নেব ততক্ষণ?’

একথা শুনে আল্লাহ ইয়ার খান হাসতে লাগলেন। আরেকজন সেনাপতি, বাহাদুর কামবু, গলাখাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা পাঁচ হাজারী অশ্বারোহী বাহিনী আর দুইশত কামান ইতিমধ্যে হুগলী শহরের কাছেই নিয়োগ করেছি। আরও আট হাজার পদাতিক সৈন্য মকসাসুবায় ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোন জায়গা থেকেই কোন প্রতিরোধের খবর নেই।’

‘নদীর এই পারের কি পরিস্থিতি?’ কাশিম খান জানতে চাইলেন।

‘দুই হাজার অশ্বারোহী, একশত কামান আর চার হাজার পদাতিক।’ বললেন আল্লাহ ইয়ার খান। ‘আক্রমন শুধু হুকুমের অপেক্ষায়।’

‘আদৌ যথেষ্ট নয়!’ মারতিম আফনসোর শুষ্ক, হিসহিসে কন্ঠস্বর শোনা গেল। মারতিম আফনসোকে নিকট থেকে চাক্ষুষ করার তীব্র ইচ্ছাকে কোনক্রমে দমন করে আগাহ আলি তাম্বুর দরজার পর্দার সামান্য ফাঁকে চোখ রেখে দেখতে লাগল। মারতিম আফনসো দীর্ঘদেহী কিন্তু বেতসপত্রের মত ছিপছিপে। তার গাত্রবর্ণ কৃষ্ণাভ আর মুখের উপর আড়াআড়ি ছুরিকাঘাতের দাগ জ্বলজ্বল করছে। মারতিমের দীর্ঘ কৃষ্ণকেশের অগ্রভাগ রঙ্গীন পুঁতি সহ লম্বা বিনুনী করা, দুর থেকে মনে হয় তার মুখমন্ডলের দুপাশে দুটি জীবন্ত সাপ দুলছে। মুখে একধরণের তাচ্ছিল্যের হাসি আর শরীরে মার্জারসুলভ ক্ষিপ্রতার মিশ্রণ তাকে একপ্রকারের ক্রুরতার প্রকাশ দিয়েছে। আগাহ আলির মনে হল স্বয়ং ইবলিশ মারতিমের রুপ ধরে তাম্বুর ভিতর বসে আছে। মারতিম আফনসো পর্তুগীজপক্ষ ত্যাগকারী বিশ্বাসঘাতক কিন্তু মুঘলদের কাছে সে অমূল্য সম্পদ। প্রথমত সে পর্তুগীজ প্রতিরোধের ভিতরের খবর রাখে আর দ্বিতীয়ত পর্তুগীজদের প্রতি তার ব্যক্তিগত জিঘাংসা আছে।

মারতিমের ঘোষণার পর মন্ত্রনাকক্ষে এক অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এল। আগাহ আলি জানে যে আল্লাহ ইয়ার খান মারতিম আফনসোকে তীব্র ঘৃণা করেন। বৃদ্ধ সৈনাধ্যক্ষের কাছে ইমান বা বিশ্বস্ততা সবার উপরে আর বেইমানির একটিই উত্তর – শিরচ্ছেদ। কিন্তু যুদ্ধকালীন কূটনীতিতে এই বেইমানই এখন মুঘলদের পরম মিত্র। তদোপরি মুঘল সুবাহদার কাশিম খান জ্বিনি হাতের তাস বুকের কাছে রাখতে ভালোবাসেন। 

অবশেষে এনায়েতুল্লাই নীরবতা ভঙ্গ করল। কর্তৃত্বের সুরে সে বলল, ‘যথেষ্ট নয় মানে? আমরা কি বাঙ্গালা ভ্রমণে এসেছি নাকি!’

মারতিম আফনসো এনায়েতুল্লাহের দিকে দৃকপাত না করে কাশিম খানের উদ্দেশ্যে বলল, ‘পর্তুগীজ সামরিক দক্ষতা সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণাই নেই। এই মুঘল বাহিনী পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট নয়।’

কাশিম খান ঝুঁকে পড়ে মারতিমকে দেখছিলেন। তাঁর মুখ সর্বদাই সুফিসন্তদের মত ভাবলেশহীন। তিনি শীতল স্বরে মারতিমকে বললেন, ‘আদরনীয় মারতিম আফনসো যদি অনুগ্রহ করে পর্তুগীজ সামরিক দক্ষতার ব্যাপারটি আমাদের একটু বোঝান!’

‘পর্তুগীজরা রক্ষণাত্মক প্রতিরোধে যাবে মনে রাখবেন। এতে ওদের ক্ষয়ক্ষতি সীমিত হবে। কিন্তু উন্মুক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাদের সেন্যরা পর্তুগীজ মাস্কেটিয়ারদের চাঁদমারি হবে।’ বলতে বলতে মারতিম আফনসো উঠে দাঁড়িয়ে কোমরবন্ধ থেকে তার অদ্ভূতাকার অসিটি মুক্ত করল। এই অসি অনাবক্র, এর মাথাটি ত্রিকোণাকার এবং এর ধাতবশরীর সম্পূর্ণ কালো। মারতিম এনায়েতের দিকে ফিরে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘তোমার তরবারি দিয়ে একে আঘাত কর।’

এনায়েত কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে মারতিমের দিকে চেয়ে রইল! এই বর্ণসংকর পর্তুগীজ বিশ্বাসঘাতক কি তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছে? তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে সে তার দীর্ঘ, ইষৎ বক্র, অপেক্ষাকৃত ক্ষীন কিন্তু বিদ্যুতের মত উজ্জ্বল বিখ্যাত মুঘল শিরোহি বাহির করে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ভঙ্গিতে বাড়িয়ে ধরল।

মারতিম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ফের বলল, ‘এস। আঘাত কর দেখি!’

এনায়েত মারতিমের অসিতে বিদ্যুৎগতিতে শক্তিশালী আঘাত করতে উদ্যত  হতেই মারতিম আফনসো মুহূর্তের ভগ্নাংশে বৃত্তাকার উপাংশে নিচ দিক থেকে শিরোহির উপর আঘাত করে বসল। আগুনের স্ফুলিঙ্গের সাথে ধাতব শব্দ মিলিয়ে যেতেই দেখা গেল এনায়েতের শিরোহির অর্ধেক টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। এনায়েত বিস্ফারিত চোখে নিজের  দ্বিখন্ডিত তরবারির দিকে তাকিয়ে রইল।

মারতিম আফনসো স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করতে করত বলল, ‘এই অসির ইস্পাত বিশেষভাবে পান দেওয়া। পর্তুগীজরা একে কলহনা বলে। পর্তুগীজ পদাতিকের সঙ্গে অসিযুদ্ধে মুঘল সৈনিকের জয়লাভের আশা বৃথা। এই কলহনা এক কোপে অশ্বের শিরচ্ছেদ করতে সক্ষম।’

কাশিম খান শিশুর মত আনন্দে করতালি দিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ মারতিম। এই জন্যেই সরাসরি যুদ্ধে মুঘল প্রাণহানির কোন অভিপ্রায় নেই আমার। আল্লাহ আমাদের কামানগুলির উপর করুণা বর্ষণ করুন।’ বলতে বলতে তিনি গোলন্দাজ সেনাপতি আল্লাহ ইয়ার খানের দিকে চাইলেন। 

‘আমাদের কামানের পাল্লা পর্তুগীজ কামানগুলির চেয়ে বেশি। নিরাপদ দূরত্ব থেকে আমারা হুগলীর উপর গোলাবর্ষণ করে আক্রমণের সূচনা করতে পারি।’ আল্লাহ ইয়ার খান চিন্তান্বিত মুখে বললেন। তারপর তিনি যোগ করলেন, ‘অবশ্য তাতে হুগলীর অসামরিক জনতাও মারা পড়বে। আর এই গোলাবর্ষণ দিনকতক চললে, হুগলীর অট্টালিকাগুলির আর বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।’

‘যদি আপনারা আপনাদের কামান আদৌ ব্যবহার করতে পারেন, তবেই।’ বলতে বলতে মারতিম আফনসো এনায়েতের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলল, ‘কেউ যেন বলছিল আমাদের বারুদ জলে ভিজে মিইয়ে গেছে।’

তাম্বুর বাইরে দাঁড়িয়ে আগাহ আলি নিস্ফল আক্ষেপে ছটফট করতে লাগল। ঐ নিষ্কর্মা এনায়েত মুঘলবাহিনীর মেহের, আদিল বা জেবুন্নিসা নামক কামানগুলির শক্তি বা দুর্বলতা জানেই না। এরা কামান নয়, জিব্রাইলের ঘুমন্ত রুপ। যারা এদের চেনে আর ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ করে তাদের হাতে এরা জেগে ওঠে। এই কামানগুলি মুঘল ধাতুবিদ্যার চরম উৎকর্ষের প্রতীক – আলউলমায়েদিন। সঠিক ব্যবহারকারীর হাতে এরা জীবন্ত হয়ে উঠে পর্বত পর্যন্ত ধ্বংস করে দিতে পারে। হায়! যদি এনায়েতুল্লাহ একথা বুঝত! বা ঐ বর্নসংকর বেইমান পর্তুগীজ!

আগাহ আলির মনে আবেগ ও উত্তেজনার এমন দোলাচল চলছিল যে প্রথমে সে তার কাঁধে আলতো টোকা খেয়াল করেনি। তারপর তার কানে এল এক ভৃত্য তাকে ডেকে কিছু বলছে। অনিচ্ছাসত্বেও সে তাম্বুর অন্দরে ঘটে চলা নাটকীয় দৃশ্যাবলী থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে ফিরে তাকাল। মুঘল ভৃত্য তাকে ইশারায় অদূরে দন্ডায়মান এক ব্রাহ্মণের দিকে ইঙ্গিত করে। উপবীতধারী ব্রাহ্মণদের সচরাচর চিনতে অসুবিধা হয় না তার। এই ব্রাহ্মণের অনাবরিত বক্ষদেশে শোভা পাচ্ছে একটি ঘনসন্নিবদ্ধ উপবীত। উন্নতমস্তক ব্রাহ্মণ দৃপ্তগর্বে দাঁড়িয়ে তাকে অবলোকন করছেন। আগাহ আলি লক্ষ্য করল ব্রাহ্মণের মুন্ডিত মস্তকে কোন শিখা নেই।

কিন্তু সে স্তম্ভিত হয়ে গেল যখন ঐ ব্রাহ্মণ তাকে শুদ্ধ পারসী ভাষায় সম্বোধন করে বললেন, ‘মারতিম আফনসো নামে একজনের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা। সে সম্ভবত এই তাঁবুর ভিতরে অপেক্ষা করছে।’ আগাহ আলি সতর্কভাবে ব্রাহ্মণকে পরীক্ষা করতে লাগল। এই ব্রাহ্মণ কে দেখে সাধারণ পূজারি বলে মনে হয় না। মুঘল রাজপুরুষের সমীপে এই ব্যক্তির কোন ভয়ভ্রুক্ষেপ লক্ষিত হচ্ছে না। মারতিম আফনসোকে এ জানল কি করে?

আগাহ আলি ব্রাহ্মণের পথরোধ করে বলল, ‘এই স্থান শাহি দরবার। তোমার এখানে কি কাজ?

মারতিম আফনসো পর্দা সরিয়ে তাম্বুর বাহিরে এসে ব্রাহ্মণের দিকে চেয়ে হেসে বলল, ‘সুস্বাগতম বিপ্রদাস মহাশয়। আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আসুন, ভিতরে আসুন।’ আগাহ আলি চকিতে হস্তস্থিত বল্লম এগিয়ে ধরে তাম্বুর দরজা আটকে বলল, ‘সুবাহদারের ব্যক্তিগত অনুমতি ছাড়া এই দরবারে কোন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। তফাৎ যাও!’

মারতিম আফনসো হা হা করে হেসে বলল, ‘বটে? তাহলে আমরা দুজনেই বরং নিষ্ক্রান্ত হই!’

‘ওদের আসতে দাও আগাহ আলি!’ কাশিম খান তাম্বুর ভিতর থেকে উচ্চকন্ঠে হাঁক দিলেন।

আগাহ আলি বল্লম সরিয়ে পথ ছাড়ল বটে তবে এই সুযোগে তাম্বুর ভিতরে প্রবেশ করে এক কোনায় গিয়ে দাঁড়াল। তাকে কেউ নজর করল না, আপত্তিও এল না।

বাহিরের রৌদ্রের উজ্জ্বলতার পর তাম্বুর ভিতর সব কিছুই আঁধার লাগে। চোখ সইতে আগাহ আলির নজরে এল তাম্বুর মাটিতে এক বিশাল পারসিক গালিচা পাতা। কমবেশি কুড়ি জন মুঘল রাজপুরুষ বা ওমরাহ তাম্বুর ভিতরে উপস্থিত। আগাহ আলি সকলকেই সমধিক চেনে, এই ভিড়ে কাশিম খান, আল্লাহ ইয়ার খান আর বাহাদুর কামবুই প্রকৃত অর্থে যোদ্ধা। বাকিরা শিক্ষানবীশ দলপতি। গালিচার মাঝখানে একটি মখমলের তাকিয়ায় মুখে হুক্কার নল নিয়ে কাশিম খান জ্বিনি উপবিষ্ট। বাকিরা অর্ধবৃত্তাকারে কাষ্ঠপীড়িকায় বসে আছে। এক প্রান্তে শাহি সেরেস্তাদার কাফি খান মসলিনের উপর কালি দিয়ে কিছু লিখছে। মুঘলরা দস্তাবেজ রাখতে অত্যন্ত দক্ষ। মুঘল শাসনে ইসলামিক ঐতিহাসিকরা সারা বিশ্বে সমাদৃত। প্রবেশ করার পর কুড়ি জোড়া চোখ বিপ্রদাসের উপর নিবদ্ধ হল।

মারতিম আফনসো নাটকীয় ভাবে সকলকে অভিবাদন করে বলে উঠল, ‘মহাশয়গণ! হুগলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ হিন্দু পন্ডিত এবং সম্ভবত আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বিপ্রদাস ভট্টের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করাতে পেরে আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি। ইনি সমগ্র হুগলী ও সন্নিহিত অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা এবং মুকুটহীন রাজা।’

সভাস্থিত মুঘল ওমরাহদের মধ্য থেকে গুঞ্জন উঠল। মুসলিম শাসকের দরবারে একজন হিন্দুপন্ডিত ঈগলের দলে রাজহংসের মতই বেমানান। এই যুদ্ধবিগ্রহে একজন অধ্যাপকের কি কাজ? আর মারতিম আফনসো এর হয়ে দরবারই করছে কেন?

কাশিম খান হাত তুলে সভাকে শান্ত করে স্থানীয় কথ্য বাঙ্গালাভাষায় বললেন, ‘প্রণাম গুরুদেব। ম্লেচ্ছদের সংস্পর্শে এসে আপনার জাত গেল না?’ কাশিম খানের বাঙ্গালা স্থানীয়দেরও লজ্জায় ফেলে দিতে পারে।

‘খোদা হাফিজ! কোন অসুবিধা নেই সুবাহদার নবাব। জাত গেলে আমি পুনরুদ্ধার করে নেব। আর ব্রাহ্মণ তো জন্মে হয় না, হয় জ্ঞানে আর প্রাজ্ঞতায়।’ বিপ্রদাস খাঁটি পারসীতে প্রত্যুত্তর করলেন।

ওমরাহদের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। তারা কেউ কোনদিন কোন হিন্দুকে এমন সাবলীল পারসী বলতে শোনেনি। মারতিম বলল, ‘বিস্মিত হবেন না। উনি আমার চেয়ে উৎকৃষ্ট পর্তুগীজ বলে থাকেন।’

কাশিম খান গভীরভাবে এই ব্রাহ্মণকে দেখছিলেন। বাঙ্গালায় তার কম দিন হল না, তিনি বহুদর্শী। কিন্তু এই হিন্দু পন্ডিত একেবারে স্বতন্ত্র। এর দৃপ্ত অস্মিতা আর বেপরোয়া সাহস লক্ষ্যনীয়। মনে হয় ভাগ্যের খেয়ালে এক যোদ্ধা ভুল বংশে জন্মেছে।

‘হিন্দুরা মোসলেমদের কায়দা কানুন ঘোর অপছন্দ করে মহাশয়! উপরন্তু শাসক জাতিকে কে আর পছন্দ করে? সেই গভীর তিক্ততার বাধা আপনি কি ভাবে অতিক্রম করলেন, সেটা আগে জানি। ওকে কেউ একজন একটা আসন দাও! আপনি উপবেশন করুন।’ কাশিম খানের বক্তব্যে সূক্ষ প্রতিস্পর্ধা শাহি তমিজের সাথে ব্যক্ত হল।

বিপ্রদাস অচঞ্চল ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মুখে হাসি বা তিক্ততা কিছুই ছায়া ফেলল না। ‘সুক্রিয়া! আমার দন্ডায়মান থাকার অভ্যাস আছে। আপনাকে জানাতে চাই হিন্দু বলে কিছু নেই।’ বিপ্রদাস শান্ত স্বরে বললেন।

-‘বটে?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ। হিন্দু পারসী শব্দ, সংস্কৃতে পাওয়া যায় না। এই ভূখন্ডে যারা মোসলেম নয় আবার খৃষ্টানও নয় তাদেরকে আপনারা ঐ নামে অভিহিত করেন। ঠিক যেমন ম্লেচ্ছ আপনাদের পরিচয় নয়।’ বিপ্রদাস কাশিম খানের চোখে চোখ রেখে বললেন।

-‘তাহলে আপনি হিন্দু নন?’

‘আমি সনাতনী ব্রাহ্মণ। আমি এক ও অভিন্ন ব্রহ্মার উত্তরসুরী।’ বলতে বলতে বিপ্রদাসের ওষ্ঠের কোনে মৃদু হাসির স্পর্শ লাগল। ‘আপনি একে আল্লাহ বলে জানেন, মারতিম জানে গড অলমাইটি বলে।’

এনায়েতুল্লাহ  ভীতির আপত্তিসূচকভাবে ঘাড় নাড়তে লাগল। ইসলামকে কাফেরদের ধর্মের সঙ্গে তুলনা করাকে সে ঘোর অপছন্দ করে। আর ইসলাম এই দেশে রাজধর্ম, তার সামনে এই লোকটি তো ভিখারির চেয়ে উত্তম কিছু না। ওয়ালিদ কেন এসব হারাম শব্দ শুনে যাচ্ছেন? কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না কারণ কাশিম খান ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাস করেন না।

কাশিম খান শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনাকে বাদশাহির মিত্র মানব কিভাবে?’

বিপ্রদাস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর তিনি সকল ওমরাহদের দিকে দৃষ্টিপাত করে অত্যন্ত কর্তৃত্বপূর্ণ স্বরে বলতে লাগলেন, ‘মিত্র নয়, যাত্রাসঙ্গী। আমার ধারণা বাদশাহ হৃত জমি পর্তুগীজদের থেকে পুনরুদ্ধার করতে আগ্রহী। কিন্তু জমিতে কিছু নেই। আমি মানুষের লুন্ঠিত, নিষ্পেষিত আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে চাই। আমি শাহি মহল থেকে নৃশংশ দাসপ্রথার বিলোপ চাই। বাদশাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ চান, রাজস্ব আদায় চান, নিন। তাতে আমার কোন আপত্তিও নেই, বক্তব্যও নেই। কিন্তু বাঙ্গালার, হুগলীর মাটিতে ফিরিঙ্গিদের দুরাচার চিরতরে বন্ধ করতে চাই। তারজন্য এই মুহূর্তে হুগলীর পর্তুগীজদের নিধন জরুরী।’ বলতে বলতে বিপ্রদাসের দুই চোখ অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার কন্ঠস্বরে বিন্দুমাত্র সংশয়, অনুতাপ বা ভীতির কোন লক্ষণই দেখা গেল না।

‘বাদশাহ পর্তুগীজদের থেকে তাঁর মহান আনুকূল্য ফিরিয়ে নিতে চান, তাদের শাসন করতে চান। কিন্তু মুঘল সেনাবাহিনী পেশাদার যোদ্ধা। তারা ভাড়াটে ঘাতক নয়।’ কাশিম খান নিস্পৃহভাবে বললেন।

-‘বাদশাহ হুগলীর আধিপত্য আর কর আদায় নিয়ে প্রসন্ন থাকুন। কিন্তু বাঙ্গালার বুক থেকে দাসব্যবসা আর নারীধর্ষণের পরম্পরা বন্ধ করতে হলে, পর্তুগীজদের যুদ্ধ করে হারালেই যথেষ্ট নয়, এরজন্য হুগলীর প্রত্যেক পর্তুগীজকে যমের দক্ষিণ দুয়ারে পাঠাতে হবে। আবালবৃদ্ধবনিতাকে। একে গণহত্যা বললেও আমার কিছু যায় আসে না।’

-‘কিন্তু মারতিম? আংশিক হলেও সেও তো পর্তুগীজ। ওর মুন্ডটিও কি আপনার চাই?’

-‘যদি ঐ মুন্ডটি দাসব্যবসা আর নারীধর্ষণের পক্ষে হয়, অবশ্যই। ওটিও চাই!

মারতিম আফনসো শব্দ করে হেসে বলল, ‘সব পর্তুগীজ এক নয়। আর আমি হুগলীর পর্তুগীজ নই। কিন্তু বিপ্রদাস ভট্টের ঘাতককে অবশ্যই প্রথমে আমার কলহনার স্বাদ পরীক্ষা করতে হবে।’

বিপ্রদাস বলতে লাগলেন, ‘আমার লোকেরা হুগলীর অভ্যন্তরে নাশকতামূলক কাজ করছে। আর কিছুদিনের মধ্যে পর্তুগীজ কামানগুলি নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। পর্তুগীজ দাসসৈন্যদলের হিন্দুদের বোঝানোর কাজ চলছে। আপনারা বাইরে থেকে আক্রমণ করলেই হুগলী শহরে আর পর্তুগীজ সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। আমার আদেশের অপেক্ষা মাত্র!’

‘বুঝলাম।’ বললেন কাশিম খান। ‘পরিবর্তে আপনার কি চাই? হুগলী তো কোন রাজ্য নয় যে আপনি রাজা হবেন?’

‘হুগলী শতাব্দী প্রাচীন ভুরশুট রাজ্যের অংশ ছিল একদিন, আকবর বাদশাহ পেদ্রোকে সনদ লিখে দেবার সময় হয়ত বিস্মৃত হয়েছিলেন। হুগলী সেই রাজার কাছেই ফিরে গেলে ন্যায়বিচার হয় না কি? ভুরশুটরাজ কর দিতে তো আপত্তি করেন নি কোনদিন!’ বিপ্রদাস শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘আমি নিশ্চিত করব একজন পর্তুগীজও যেন হুগলী ত্যাগ করে পালাতে না পারে।’

মারতিম ক্রুর হাস্য করে বলল, ‘আর আমি তাদের হুগলীর সলিল সমাধিতে আমন্ত্রণ করব।’

এতক্ষণে আগাহ আলির কাছে হুগলী অভিযানের অতিকায় দুর্বোধ্য ধাঁধা স্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল। হুগলীর মুঘল অবরোধ তাহলে শুধুই খাতায় কলমে, বাস্তবে কাশিম খান কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ছলে এক গণহত্যার আয়োজন করছেন যেখানে পেশাদার যোদ্ধার চেয়ে বেইমান ও বিধর্মীদের গুরুত্ব বেশি। দুই পোত দেশীয় মুর, মারতিম আফনসো আর এই রক্তলোলুপ ব্রাহ্মণ সেই ধাঁধার উত্তর। আগাহ আলি বুঝতে পারল, সন্মূখ সমরের ভয়াবহতাও এই ষড়যন্ত্রের কাছে তুচ্ছ। পরিনত যোদ্ধা হওয়া সত্বেও আগাহ আলির বিবমিষার উদ্রেক হল।

‘এতে আপনার ব্যক্তিগত লাভ?’ কাশিম খান জিজ্ঞাসা করলেন।

‘কিছু না। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে পর্তুগীজ রক্তে স্নান করে তবে আবার শিখা ধারণ করব।’ এই বলে বিপ্রদাস তার কটিবস্ত্র থেকে একটি ছিন্ন শিখা বাহির করে শূন্যে তুলে ধরলেন। ‘আমার দ্রুত কেশবৃদ্ধি হয় নবাব। আপনি কখন আদেশ দেবেন? বললেন তিনি।

কাশিম খান হাতে কবিতার বই তুলে নিতে নিতে বললেন, ‘শীঘ্রই। আর ছয় জোয়ারে খ্বাজা শেরের রণতরী বাহিনী হুগলী প্রবেশ করবে। আর তিনদিন মস্তক মুন্ডন জারি রাখুন ব্রাহ্মণ!’

Loading

সবাইকে বলুন
error: বিষয়বস্তু সুরক্ষিত!