
টোলের ছাত্ররা একসঙ্গে সুর করে পড়ছে, একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ। ছাত্ররা সকলেই আট দশ বৎসরের বালক, গণিতের প্রথম পাঠ শতকিয়া পদ্ধতির জন্য এই পাঠ্যাভ্যাস আবশ্যক। প্রাচীন বাংলার গণিত একটি অতিপ্রয়োজনীয় বিদ্যা, এই শিক্ষা ব্যতীত জমিজমার মাপ ও ওজন ইত্যাদি বোঝা যায় না। এর পর ধাপে ধাপে কড়াকিয়া, কাঠাকালি, বিঘাকালি ইত্যদি অধ্যয়ন করা হবে। এবং তারপর শুভঙ্করী ও মানসাঙ্ক। কিন্তু এই শিশুদের পক্ষে আবৃত্তিঃ সর্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী, অর্থাৎ এখন না বুঝে মুখস্থ করাই শ্রেয়। গুরুর তেমনই আদেশ, ছাত্রদের সেই আদেশ পালন করাই হল প্রথা।
টোলের একটি বালক এই ছন্দোবদ্ধ আবৃত্তির সুরে সুর মেলাতে পারছে না। বালকটি শীর্ণকায় ও অন্য বালকদের মতই মুন্ডিতমস্তক। তার উর্দ্ধাঙ্গ অন্যদের মতই নগ্ন, পরনে মলিন খাটো ধুতি। বিপ্রদাস ভট্ট লক্ষ্য করলেন এই বালকটির চক্ষুদুটি আয়ত ও উদাস, যেন সে অন্যমনস্কভাবে কিছু ভাবছে। ভূর্জপত্রের হাতপাখাটি থামিয়ে তিনি হাত তুলে ছাত্রদের থামতে ইঙ্গিত করলেন। সকলে নীরব হয়ে গেল।
বালক, তোমার নাম লোচনদাস, তাই না? বললেন বিপ্রদাস।
দুটি বড় বড় প্রশ্নময় চোখে তাকিয়ে বালক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
বিপ্রদাস স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে তোমার? পাঠে মন নেই কেন?
লোচনদাস সুরেলা শিশুকন্ঠে বলল, তিনে নেত্র কেন? আমাদের তো দুটি নেত্র!
পাঠগৃহে মৃদু গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। লোচনদাসের কি মতিভ্রম হল নাকি? গুরুকে কি কখনো প্রশ্ন করতে আছে? দুএকটি বালক বিড়ম্বনাভরে হেসে ফেলল।
শান্ত হও! বিপ্রদাস ভট্ট উচ্চকন্ঠে বললেন। সকলে পুনরায় স্তব্ধ হয়ে গেল।
আমাদের তিনটি নেত্র। দুটি বাহ্যিক, সকলে ঐ দুটি দেখে তাই ভাবে আমাদের দুটি নেত্র। তৃতীয় নেত্রটি বাহ্যিক নয়, ঐ নেত্রদ্বারা আমরা চাক্ষুষ নয়, দর্শন করে থাকি। এই কথা বলে বিপ্রদাস কিছুক্ষণ নীরব হয়ে রইলেন। তারপর তিনি মৃদু হেসে লোচনদাসকে বললেন, তুমি এই প্রশ্ন করায় আমি প্রীত হয়েছি।
লোচনদাস মাটির দিকে চেয়ে আছে, ফলে বোঝা যায় না সে মনের মত উত্তর পেয়েছে কিনা। বিপ্রদাস কাষ্ঠপীড়িকা থেকে উত্থান করে তার নিকটে গিয়ে মুন্ডিত মস্তকের উপর হাত রেখে বললেন, ঐ দেওয়ালের দিকে দেখ।
লোচনদাস পাঠগৃহের দেওয়ালের দিকে দৃষ্টিপাত করল।
কি দেখছ লোচনদাস?
মাটির দেওয়াল গুরুদেব।
দেওয়ালের পিছনে কি আছে?
লোচনদাস স্বপ্নোত্থিতের মত বলল, সরস্বতী নদী।
দেখে বলছ?
আমি জানি গুরুদেব।
তাহলে জ্ঞানই হল তৃতীয় নেত্র! বিপ্রদাস স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করতে করতে বললেন।
ছাত্ররা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসতে লাগল।
বিপ্রদাস উদ্দীপ্তভাবে বলতে লাগলেন, হাজার হাজার বৎসর ধরে আমাদের দেশের মনীষীরা বিশ্বজগৎকে দর্শন ও অধিগত করেছেন। হাজার হাজার বৎসর ধরে তাঁদের সন্মিলিত জ্ঞানরাশি বিন্দু বিন্দু করে উপনিষদের মধ্যে সঞ্চিত ও রক্ষিত হয়েছে। এই অত্যুৎকৃষ্ট জ্ঞান তাঁরা পাঠাগারের মধ্যে গচ্ছিত না রেখে শ্রুতি, মন্ত্র ও সূত্রের আকারে আমাদের লৌকিক জীবনে বিতরন করেছেন। বাক্যগুলি উচ্চারণ করার সময় বিপ্রদাসের মুখমন্ডল উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
তাহলে ইভা যে বলে প্রতিমা হল পুতুল আর পুতুল পূজো করা নির্বুদ্ধিতা? একটি বালক সরলভাবে হাসতে হাসতে বলল। বিপ্রদাস ভট্টও হেসে ফেললেন। তিনি ভূর্জপত্রের পুথির পৃষ্ঠাগুলি একত্র করতে করতে বললেন, ইভা কি তোমার হুগলীগড়ের বন্ধু?
হুগলীগড় এক বিশাল প্রাচীরবেষ্টিত একতল ভবন, ভবনের ছাতে আছে কয়েকটি পর্যবেক্ষণ মিনার। ভবনের একাধিক প্রবেশপথ আছে, সেগুলি আদৌ গড়ের সিংহদরজাসুলভ মজবুত নয় কিন্তু পর্তুগীজ প্রহরীনিযুক্ত। হুগলী শহরে অনেক পর্তুগীজ অট্টালিকা আছে, সেখানে অনেক স্বর্ণকেশ পর্তুগীজ বাস করে। কিন্তু এই গড়ের মধ্যে থাকে অশ্বারোহী পর্তুগীজ। এমনকি গড়ের মহিলারাও অশ্বারোহনে দক্ষ। তাদের পোষাক বড় অদ্ভুত ও ভারী – বাঙ্গালার আবহাওয়ায় অন্তর্বাসহীন সূতিবস্ত্রই চলনসই, বাঙ্গালী পুরুষ উর্দ্ধাঙ্গে নিরাবরন আর নারী কোনক্রমে বক্ষদেশ আবৃত রাখে – এই পর্তুগীজ রাজপুরুষ ও মহিলাদের দেখে মনে হয় চলন্ত বস্ত্রস্তুপ। এদের শিশুগুলির গার্ত্রবর্ণ অতিশুভ্র, প্রায় রক্তশূন্য তাই স্থানীয় শিশুরা এদের খেলতে নেয় না। ইভা বোধকরি সেই বাধা জয় করে টোলের বালকটির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে। বার্তালাপে তাদের অসুবিধা নেই, হুগলী ও সন্নিহিত অঞ্চলের বাঙ্গালী শিশু কথ্য পর্তুগীজ মাতৃভাষার মতই স্বচ্ছন্দে বলে থাকে।
মাথা তুলে তাকাতে বিপ্রদাসের নজরে এল দ্বারের কাছে একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেও না দেখার ভঙ্গিতে তিনি বললেন, কাল আমরা কালিদাসের সাহিত্য পাঠ করব। বালকেরা সহর্ষে গুঞ্জন করে উঠল – আজকের মত পাঠশালা ছুটি। তারা পোড়ামাটির ফলক ও বসবার আসনগুলি গুছিয়ে নিয়ে হৈ হৈ করে নিষ্ক্রান্ত হতে লাগল। বিপ্রদাস একটি বস্ত্রখন্ডে পুঁথিগুলি বেঁধে পাঠকক্ষের এককোনে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। এই পাঠকক্ষটি মৃত্তিকাদ্বারা নির্মিত, এর চাল খড়ের আর গবাক্ষগুলি বাঁশের চাটাই দ্বারা সুরক্ষিত। কক্ষের একটিই দ্বার, সেটিও বংশনির্মিত এবং আগলহীন। পাঠশালায় গুরুর উপবেশনের জন্য একটি কাঠের পীড়িকা ব্যতীত কিছু নেই – আর চোরেরা পুঁথির দিকে নজর দেয় না। দরজা টেনে বিপ্রদাস বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

প্রখর রৌদ্রে চারিদিক উজ্জ্বল – এখন মধ্যাহ্ন, দীপ্তার্কের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। গভীর নীল আকাশে কোথাও একখন্ড মেঘের আভাস পর্যন্ত নেই। টোলের পাঠগৃহের পিছন দিয়ে বহে যাচ্ছে সরস্বতী নদী। একদা এই নদী সপ্তগ্রাম বন্দরের মূল প্রবেশপথ ছিল, এখন নাব্যতা হারিয়ে সে গরিমাহীন। বিপ্রদাস যেস্থানে দন্ডায়মান সেখান হতে কয়েক ক্রোশ উত্তর পশ্চিমে ত্রিবেনীতে মহতী ভাগিরথীর জলধারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। সরস্বতী চলে গেছে উৎকলদেশের দিকে, যমুনা গেছে পূর্বদিকে আর ভাগিরথীর প্রধান জলধারা দক্ষিনাবর্তী হয়ে বইতে বইতে বেতোড়ের কাছে ফের দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। বিপ্রদাস জানে এর একটি ভাগ আদিগঙ্গা নামে পরিচিত, এই আদিগঙ্গার তীরে আছে প্রাচীন কালীঘাট – এর নিকট ইংরেজ বনিকরা বানিজ্যস্থল স্থাপনের চেষ্টা করছে। আর অন্যভাগটি বহে গেছে এক সুবিশাল জলজ অরণ্যের দিকে। আদিগঙ্গা ও এই অরণ্য দুটিই ভয়ংকর ঠগী ও জলদস্যু অধ্যুষিত অঞ্চল। সনাতন ধর্মের আলোক এই অঞ্চলে পৌঁছায় নি, এখানকার অরণ্যচারী সমাজ অসংস্কৃত, তারা ম্লেচ্ছও নয় আবার সনাতন ধর্মাশ্রয়ীও নয়, লৌকিক দেবদেবী ও সর্পমাতার পূজা করে।
একহাতে রৌদ্রের ছটার থেকে চক্ষু আড়াল করে বিপ্রদাস হুগলী শহরের দিকে তাকালেন। মধ্যদিনের প্রখর তাপে অতিকায় সরীসৃপের মত শহরের কেন্দ্রে পড়ে আছে বিশাল এক বাজার – সেই কর্মচঞ্চল বাজারের থেকে বহু মানুষের কোলাহলের শব্দ এতদুরেও ক্ষীণভাবে শোনা যায়। বৃত্তাকারে বাজার ঘিরে আছে সারি সারি কুটির, তাদের মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালগুলি যেন একটুকু স্থানের জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতা করছে। কুটিরের সেই সমুদ্রের মধ্যে এখানে সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ইষ্টক আর কাষ্ঠনির্মিত পর্তুগীজ হর্ম্য। সেই হর্ম্যগুলির চিমনী থেকে ধূম নির্গত হচ্ছে আর নির্মেঘ আকাশে পাক খেয়ে উড়ছে চিল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলব। অপেক্ষারত লোকটিকে বললেন বিপ্রদাস। সূতির অঙ্গবস্ত্রটি খুলে মস্তক আচ্ছাদিত করে পায়ে খড়ম গলিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। লোকটিও অমনি তাঁর পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। বলিষ্ঠ চেহারার লোকটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় বাবরি চুল। খাটো মালকোচা করে পরা ধুতি আর মাথায় রক্তবর্ণ ফেট্টি দেখে বোঝা যায় এ বাগদি শ্রেনীর মানুষ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাগদিরা ভুরশুতরাজের প্রহরী ও সৈন্যের দায়িত্ব পালন করে। লাঠি আর সড়কি খেলায় দক্ষিণবঙ্গে এদের সমকক্ষ কেউ নেই। আজ এই লোকটি সরাসরি রাজা প্রতাপনারায়নের মহামন্ত্রী কীর্তিমোহনের নিকট থেকে এসেছে।
মহামন্ত্রীমশাই জানতে চান প্রস্তুতি সম্পূর্ণ কিনা। বাগদি লোকটি চাপা গলায় বলল। বিপ্রদাস সতর্কভাবে বললেন, ঘৃণা, ধ্বংস আর রক্তপাতের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ না হলেই মঙ্গল। তবে এখন পরিস্থিতির বিচারে এই প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়েছে।
মুঘল আক্রমণের সাথে সাথেই হুগলীতে অন্তর্দ্রোহ হবে, এই ষড়যন্ত্রের অন্তিম ধাপ হিসেবে কীর্তিমোহন আজকের এই গোপন বৈঠকের ডাক দিয়েছেন। বিপ্রদাসের জিহ্বা শুকিয়ে আসতে লাগল। তিনি বৈয়াকরণ ও আধ্যাত্মিক পন্ডিত – রক্তপাত ও হানাহানি তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু একশ বছরের পর্তুগীজ অবিমৃশ্যকারিতায় সনাতন ধর্মের বিনাশ আসন্ন। এমনকি বাংলার মুসলমান সুলতানেরাও কোনদিন এইভাবে গণধর্মান্তরিতকরণ করেনি। ইসলাম রাজধর্ম বটে কিন্তু মুঘল সুলতান সনাতনধর্মী বাঙ্গালীর অন্তঃপুরবাসী নারীকে বলপূর্বক তুলে নিয়ে যায় না। এই ফিরিঙ্গিদের তুলনায় ইসলাম সহনীয়। আপদ বিদায় করার জন্য এই হিংসা এখন জরুরী।
শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে যে ধুলিময় পথ গেছে তা ক্রমশই জনবহুল হয়ে উঠতে লাগে। এখানের পথের দুপাশে আপনের সারি, সবকটিতেই শাঁখার জিনিষপত্র বিক্রয় হচ্ছে। এইস্থানটি শাঁখারিপল্লী কারণ এখানে সকল গৃহেই শঙ্খবেনের বাস। বিপনীগুলিতে মহিলাদের ভিড়, তারা কোলাহল করে শাঁখা, নোয়া, সিন্দুর আর শাঁখের তৈরী দেবদেবীর মূর্তি কেনাকাটা করছে। ঝোলানো আছে থরে থরে শাঁখের মালা আর কোন কোন বিপনীতে হাতির দাঁতের তৈজসপত্র। বিপ্রদাস জানে ঐ হস্তিদন্তের সামগ্রীগুলি পারসিক বনিকদের। ধূর্ত পারসিক বনিকেরা শাঁখারিদের উৎকোচ দিয়ে তাদের বিক্রয়সম্ভার সাজিয়ে বসেছে।
উগোলি শহরের পত্তন পর্তুগীজরা করেছে বটে, কিন্তু বানিজ্য শুরু হলে বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠিদের লোকবসতি স্থাপন হয় এক বিশৃঙ্খল স্ফূর্তিতে। যেদিকে তাকানো যায় চোখে পড়ে আরবিক, আফঘান, পারসিক ও চৈনিক ব্যবসায়ী স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে ফিরিঙ্গিদেরও দেখা যায়। বিপ্রদাস জানেন এদের সকলেই পর্তুগীজ নয়, এদের মধ্যে মিশে আছে ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসী এমনকি প্রুশীয় মানুষ। যদিও স্থানীয় বাঙ্গালী এই তারতম্য বোঝে না। বোঝা কঠিনও বটে কারণ সকলেই পর্তুগীজ ভাষায় বার্তালাপ করে।
হুগলী শহরের বানিজ্যকেন্দ্রে পল্লীগুলি পেশা অনুসারে বিভক্ত। মোদকেরা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে, তিলিরা তৈলবীজ থেকে তৈল আহরণ করে, গন্ধবনিক সুগন্ধি তৈয়ারী ও বিক্রয় করে। এছাড়া আছে তাঁতি, এরা রেশম,সূতি আর মসলিন বস্ত্র বোনে আর স্বর্ণবেনেরা গড়ে সোনার অলঙ্কার। ভিড়ের মধ্যে আছে বাউরি ভৃত্যের দল যাদের অধিকাংশই দাস। শতাব্দীপ্রাচীন বাঙ্গালার অন্তর্বানিজ্য সুউন্নত ও পরিনত। এই বাজারে কেনাবেচা হয় অঙ্গরাখা, চামর, চন্দনকাঠ ও শঙ্খের সামগ্রী, মশলা এবং দুর্মূল্য মনিমানিক্য। কাঁসারি বানায় কাঁসার বাসন, তৈজসপত্র, লোটা, পানদান, পঞ্চপ্রদীপ, ডাবর। দুই শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের গড়মান্দারনে ভুরশুতরাজারা রাজত্ব করেছেন – অধুনা ভুরশুতরাজ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁদের রাজত্বে উগোলি ছিল একটি অখ্যাত পল্লী, তখন এখানে দিনমানে শৃগাল ডাকত। আজ এই সমৃদ্ধ নগরটির উপর প্রতাপনারায়নের দৃষ্টি পড়েছে, তিনি এইস্থানে রাজধানী স্থাপন করতে চান।
বিপ্রদাস সম্প্রতি একটি পুঁথি লিখছেন, তাঁর মনে পড়ল বাঙ্গালার সমস্ত সমাজেই জমিদার ছাড়াও অন্তত আরও বারোটি শ্রেণী থাকে। বিচারক বা মোড়ল, শাসক বা পোতেল, নিবন্ধীকার বা নায়েব, জমিজমা ও খেতখামারের প্রহরী, সেচের জলের ব্যবস্থাপক, জ্যোতিষী, শকট কারিগর, কুমোর, রজক, প্রামানিক বা নাপিত, স্বর্ণকার আর পন্ডিত বা শিক্ষক। এই বারোটি শ্রেণী তাদের কার্যকারিতার বিচারে বাৎসরিক পারিশ্রমিকরুপে হয় নিস্কর জমি নতুবা ফসলের একটি অংশ লাভ করে থাকে। এই ব্যবস্থাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, ভূস্বামী বা জমিদার তার নিজস্ব গন্ডির মধ্যে স্বাধীন। সমগ্র ভারতবর্ষ এইরুপ স্বায়ত্বস্বাধীন ভূস্বামী বা জমিদারীর এক অতিকায় গোষ্ঠী। এই জমিদারীর প্রজাবর্গ, এমনকি যুদ্ধবিগ্রহের সময়েও, পোতেলদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে। কে রাজা, কে সম্রাট তা নিয়ে প্রজাদের বিন্দুমাত্র শিরঃপীড়া নেই – যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের জমি, জীবিকা, ধর্ম ও নারী নিরাপদ আকাবর বাদশা বা পর্তুগীজ ভাইসরয় যে-ই সাম্রাজ্য শাসন করুক তাদের কিছু যায় আসে না। সাম্রাজ্য বদলে যায়, জমিদারের খাজনার সামন্য ইতরবিশেষ হয়, পল্লীজীবন একইরকম থাকে।
পর্তুগীজ হুগলী এই আবহমানকালের প্রাচীন পদ্ধতির প্রতি একটি গভীর বিপত্তি। প্রথমত পর্তুগীজরা সুদুর ইয়ুরোপ থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতীয় উপকূল, বাঙ্গালা হয়ে ব্রহ্মদেশ পেরিয়ে চীনদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি নৌপরিবাহী বানিজ্যপথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তাদের অধিকাংশ বানিজ্যিক সামগ্রী লুন্ঠনজাত, বাঙ্গালার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই আগ্রাসী বিপননের সন্মুখে অসহায়। দ্বিতীয়ত, ভারত তথা বাঙ্গালার সুনির্দিষ্ট শ্রেণীবিন্যস্ত সমাজব্যবস্থা, যাকে মহতী মুঘল সাম্রাজ্যও সন্মান করে চলে, পর্তুগীজদের চোখে অর্থহীন। পর্তুগীজ পুরুষ নির্বিচারে বাঙ্গালার নারীর দারগ্রহণ করে – সনাতনধর্মী বা মুসলমান, নাপিত বা ব্রাহ্মণ ভেদাভেদ করেনা, সুবক্ষা গুরুনিতম্বিনী বাঙ্গালী নারী উৎকৃষ্ট শয্যাসঙ্গী। দেশময় লুসোবঙ্গীয় শঙ্কর শিশু প্রভু যেসুর গুণকীর্তণ করে ঘুরে বেড়ায়। পর্তুগীজরা বাঙ্গালার জাতিচরিত্র বদলে দিচ্ছে। এই বাজার তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
হাঁটতে হাঁটতে বিপ্রদাস ও তাঁর সঙ্গী বাজারের কেন্দ্রস্হলে এসে পড়লেন। এইস্থানে দুজন চৈনিক ব্যবসায়ী বিশাল পোড়ামাটির গামলায় স্তূপীকৃত শুভ্রবর্ণ কেলাসচূর্ণ বিক্রয় করছে। বিপ্রদাস ঔসুক্যভরে বাঙ্গালায় আমদানীকৃত এই নবতম বস্তুটির বিক্রয় দেখতে লাগলেন। বাঙ্গালার বাজারে আরও দুটি আমদানীকৃত সামগ্রী অত্যন্ত চাহিদা লাভ করেছে – তার একটি হল একপ্রকার শুস্ক পত্রচূর্ণ যা চা নামে পরিচিত। এটি নাকি উষ্ণজলে ভিজিয়ে পান করতে হয়। সম্ভবত এটি একপ্রকারের কবিরাজি মাদক। অপরটি পর্তুগীজদের দান। এটিও শুস্ক পত্রচূর্ণ বিশেষ তবে এটি গঞ্জিকার মত ধূম্রসেবনযোগ্য। বিপ্রদাস শুনেছেন এই ধূমপানে নাকি শরীরে যাবতীয় কামবিকার উৎপন্ন হয়। এর নাম তাবাকু বা তামাকু।
লোকে ভিড় করে চৈনিক বনিকদের নিকট শুভ্র কেলাসচূর্ণ ক্রয় করছে। এই বস্তুটি বিপ্রদাসের চমকপ্রদ মনে হয়। তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন এই চূর্ণ স্বাদে মিষ্ট এবং সহজেই জলে দ্রবীভূত হয়। চৈনিক আমদানীকৃত বলে লোকে এর নামকরণ করেছে চিনি। দামে শস্তা, সহজে গুদামজাত করা ও সংরক্ষণের সুবিধার কারণে এই চিনি বাঙ্গালার চিরাচরিত ঈক্ষুসারকে প্রতিদ্বন্দিতায় ফেলেছে। আশ্চর্যের কথা বিপ্রদাস শুনেছেন চিনিও ইক্ষুসারেরই পরিশোধিত রুপ। কিন্তু ব্যবহারে ও চেহারায় গুড় ও চিনি এতটাই ভিন্ন যে সে কথা বিশ্বাস হয় না। মনে যাই হোক, বাঙ্গালার মোদকরা এই বস্তুটিকে লুফে নিয়েছে বলা যায় – তারা নিত্যনতুন মিষ্টান্নের পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে। সম্ভবত বাঙ্গালীর খাদ্যরুচিও পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
বাগদি লোকটি ভিড় ঠেলে বিপ্রদাসকে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে এনে হাজির করাল। সেখানে একটি বাঁশের চালার গায়ে হেলান দিয়ে দুটি মানুষ অপেক্ষা করছে। বিপ্রদাস দেখলেন তাদের একজন স্বয়ং কীর্তিমোহন।
কোলাহলের মধ্যে চাপা গলায় মহামন্ত্রী বললেন, নাম ধোরো না, অভিবাদনও কোরো না। আমি এখানে গোপনে এসেছি।
চার জন মিলে একটি কুটিরে প্রবেশ করল। বাগদী প্রহরী দ্বাররুদ্ধ করে দিল। কুটিরের নিকোনো মেঝের উপর একটি রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলছে – সেই প্রদীপটিকে ঘিরে চার জন পদ্মাসনে উপবেশন করল।
জয় মহারাজা প্রতাপনারায়ণের জয়! কীর্তিমোহন ঘোষণা করলেন। বাকিরা সমস্বরে জয়ধ্বণি দিল। তারপর কীর্তিমোহন নিম্নস্বরে বললেন, এই শহরে ফিরিঙ্গি চর থিকথিক করছে। যদিও ওলন্দাজেরা আমাদের পক্ষ নেবে বলছে কিন্তু কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। এই সাক্ষাৎকার দীর্ঘায়িত করা যাবে না। এই ব্যক্তির নাম জনার্দন পান্ডা। এ কলিঙ্গরাজ্যের মানুষ, পর্তুগীজ দাসবাহিনীতে অন্তর্ঘাতের জন্য একে আনা হয়েছে। জনার্দন বারুদ বিশেষজ্ঞ।
জনার্দন নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। কীর্তিমোহন বিপ্রদাসের উদ্দেশ্যে বললেন, বিপ্রদাস ভট্ট, তুমি সপ্তগ্রামের বাহ্মণ ও নৈয়ায়িক পন্ডিতদের দলপতি। মহারাজ তোমার উদ্দেশ্যে তাঁর আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন। প্রথম তরবারিটি কোষমুক্ত হওয়ামাত্র সনাতন সমাজ তোমার নিকট কর্তব্য করনীয় জানতে চাইবে। তুমি প্রস্তুত?
বিপ্রদাস তীক্ষ্ণচোখে কীর্তিমোহনের দিকে তাকাল। প্রতাপনারায়ণ সদাচারী রাজা কিন্তু তিনি শিল্প ও সাহিত্যে মগ্ন থাকেন। কীর্তিমোহন তাঁর রাজ্যের মস্তিষ্ক, সবাই জানে আসলে রাজ্যপাট তিনিই পরিচালনা করেন। ভুরশুতরাজ পর্তুগীজদের পাশবিক ক্ষমতার সামনে হীনবল। মুঘল হানার সময়ে তাঁর এমন কাউকে চাই যে রক্তপাত ও শঠতায় পিছপা হবে না – জয়ী হলে সাহিত্যপ্রিয় রাজা হুগলী শহরটি তাঁর রাজত্বে ফিরে পেতে চান।
মহারাজ কি সন্মুখ সমরে অনাগ্রহী? বিপ্রদাস প্রশ্ন করলেন।
সন্মুখ সমর মুর্খামি হবে। কাশিম খান এই যুদ্ধে বাঙ্গালী মুরদের পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। এই মোসলেম দাসেরা পর্তুগীজদের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। দলে ভারী বলে শেষপর্যন্ত তারাই হয়ত জয়ী হবে, কিন্তু পর্তুগীজ তরবারি তাদেরকেও বিনষ্ট করবে। দুপক্ষই আমাদের কাছে কন্টকস্বরুপ, যত হানাহানি করে মরে ততই আমাদের সুবিধা। মহারাজ অযথা লোকক্ষয় করতে যাবেন কেন? কীর্তিমোহন বললেন।
বিপ্রদাস কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর কপালে চিন্তার ভ্রুকুটি। অবশেষে তিনি বললেন, শুনেছি পর্তুগীজ বাহিনীর অধিকাংশই হিন্দুধর্মী দাস? তারাও তো মারা পড়বে!
কীর্তিমোহন হাস্য করতে লাগলেন। মহামন্ত্রী দীর্ঘকায় এবং কৃশ। তাঁর নাসিকাটি ঈগলপাখির চঞ্চুর মত বক্র। কীর্তিমোহনের হাসিটি সাক্ষাৎ শমনের মত। তিনি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, হিন্দুধর্মী? এই দাসগুলি অরণ্যচারী বর্বর। এরা সর্পদেবী মনসার পূজা করে। তুমি এদের ভুরশুতের সুউন্নত ও উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণ্যসমাজের অংশ মনে কর নাকি? এরাও বিনষ্ট হলে মঙ্গল।
বিপ্রদাস অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিবমিষা দমন করতে লাগলেন। অঙ্গুলি স্পর্শ করে আছে তাঁর উপবীত। এই উপবীতের আটটি গ্রন্থি আটটি মানবিক গুণের প্রতীক – সেই গুণগুলির একটিও বংশধারায় অর্জিত হবার নয়। জন্মে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মই ব্রাহ্মণত্বের আধার। কিন্তু পীড়াদায়ক হলেও সত্য এই যে অধিকাংশ ব্রাহ্মণ এই অধিকার বংশানুক্রমিক বলে মনে করে। আর ততোধিক পীড়াদায়ক সত্য হল এখন ধর্মসংস্কারের সময় নয়, নিয়তির নির্দেশে এখন তাঁর স্বধর্ম ও স্বজাতির পরিত্রান প্রয়োজন। কলিযুগ আসন্ন, এইসময় ব্রাহ্মণকেও শঠতা ও হিংসার আশ্রয় নিতে হবে। বিপ্রদাসের মন বিচলিত হতে লাগল।
আজ আষাঢ় মাসের পঞ্চম দিন। সপ্তম দিন যুদ্ধ শুরু হবে। সকলে প্রস্তুত হও। কীর্তিমোহন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন। সাক্ষাৎকার সমাপ্ত।
সকলে উঠে দাঁড়াতে মহামন্ত্রী পাদুকা দিয়ে প্রদীপ নির্বাপিত করে দিলেন।

বাজারের কেন্দ্রস্থলের অদুরে একটি বাঁশের মঞ্চ তৈয়ারী করা হয়েছে। সেই মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি পুরুষ আর একটি নারী। এই ছয় জন হল দাস, তাদের পর্তুগীজ প্রভুরা এদের আরব দাসব্যবসায়ীর নিকট বিক্রয় করতে চলেছে। পুরুষগুলি গবাদি পশুর মত একের পর এক কন্ঠরজ্জু দ্বারা বাঁধা, তাদের চোখে বিহ্বল, ভয়ার্ত দৃষ্টি। নারীর হাত মাথার উপরে তুলে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এই মানুষগুলির পোষাক শতচ্ছিন্ন – এদের শরীরভঙ্গি দেখলে মনে হয় অর্ধমৃত। এই দাসেরা সুন্দরবন অঞ্চলের অরণ্যচারী মানুষ, অসংস্কৃত ও বন্য। কিন্তু বাঙ্গালার দাস অতিউৎকৃষ্ট পণ্য – আফ্রিকা থেকে সুমাত্রা এই বিশাল ভূখন্ডে এরা উচ্চমূল্যে বিক্রয় হয়।
পর্তুগীজ বিক্রয়কারী সংস্থাপক বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠে একটি পাকিয়ে রাখা কাগজ খুলে উচ্চকন্ঠে হিন্দুস্তানী ভাষায় পড়তে লাগল: স্বাধীন পর্তুগীজ বাঙ্গালার গবর্নরের আদেশমতে এবং পর্তুগাল ও স্পেনের পরমবিক্রমশালী রাজা মহামতি ফিলিপের সনদপ্রাপ্ত উগোলিমের নগরপ্রধানের উপর ন্যস্ত ক্ষমতার বলে আজ এইস্থলে ছয়টি বাঙ্গালা দাসের নিলাম ডাকা হইতেছে। নিলামে উপস্থিত আরব ভদ্রমহোদয়গণকে এই মঞ্চে আসিয়া পণ্য যাচাই করিতে অনুরোধ করা যাইতেছে।
মঞ্চের সামনে উপস্থিত জনতার ভিড়ের মধ্য থেকে বিপ্রদাস দেখতে লাগলেন একজন বৃদ্ধ আরবিক বনিক মঞ্চে আরোহন করে বিক্রয়কর্তাকে কিছু ইঙ্গিত করল। পর্তুগীজ বনিক অমনি সেই পাঁচজন পুরুষ বন্দীর ছিন্নমলিন বেশ ছিঁড়ে তাদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিল। হতভাগ্য লোকগুলি শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল আর বৃদ্ধ আরব তাদের পেশী টিপে, চুল টেনে আর দাঁত বাহির করিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। পরীক্ষা শেষ হলে বনিক একটি পশমের বটুয়া খুলে পর্তুগীজ বিক্রয়কর্তার হাতে কিছু মুদ্রা দিল। তখন পর্তুগীজ লোকটি বলে উঠল, অভিনন্দন! এই পাঁচজন পুরুষ দাসকে আরব ভদ্রমহোদয়ের নিকট জনপ্রতি পাঁচ দিনার মূল্যে বিক্রয় করা হইল। বিক্রীত দাসগুলির গলায় বাঁধা রজ্জুতে টান দিয়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হল।
আরেকজন আরবদেশীয় বনিক দ্রুত মঞ্চে উঠে বিক্রয়কর্তার অনুমতি ছাড়াই একটি ছুরিকা দ্বারা নারীদাসীর অঙ্গবস্ত্র কেটে ফেলল। এই নারী পূর্ণযৌবনা, প্রখর দিবালোকে সে অসহায়ভাবে নগ্নশরীরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে রইল, তার জঘনদেশের কৃষ্ণকেশ সকলের দৃষ্টির সন্মুখে উন্মোচিত হয়ে গেল। আরববনিক নির্দয়ভাবে তার স্তনমর্দন করে পরীক্ষা করে তার কেশাকর্ষণ করে পিঠমোড়া অবস্থায় নিতম্বগুলি পর্যবেক্ষণ করে পর্তুগীজ বনিককে কিছু বলল।
উত্তরে পর্তুগীজ বিক্রয়কর্তা নাটকীয়ভাবে বলল, আরব ভদ্রমহোদয়ের জ্ঞাতার্থে জানানো যাইতেছে যে বাঙ্গালার সকল মহিলা দাসী দুর্লভ ফুলের মত। বন্দী অবস্থায় আমাদের নাবিকরা কেবল একবার মাত্র তাদের আঘ্রাণ করে। সুতরাং উহারা প্রায় কুমারীই বলা চলে। আমরা সৎ ব্যবসায়ী। এই কথায় উপস্থিত অশ্বারুঢ় পর্তুগীজ প্রহরীগুলি উচ্চস্বরে হাস্য করতে লাগল।
এমন সময় ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন একটি প্রস্তরখন্ড নিক্ষেপ করল। পাথরটি শূন্যপথ পরিক্রমা করে সজোরে আরববনিকটির কপালে আঘাত করল আর সে আর্তনাদ করে মঞ্চের উপর উলটে পড়ল। দ্বিতীয় পাথরটি ক্ষিপ্ত ভীমরূলের মত শব্দ করে পর্তুগীজ বিক্রয়কারীর মাথা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ চিৎকার করে উঠল আর অশ্বারুঢ় পর্তুগীজ প্রহরীরা অশ্বগুলিকে ভিড়ের দিকে চালিত করার চেষ্টা করতে লাগল। মুহুর্তের মধ্যে মঞ্চের সামনে মহা কোলাহল উপস্থিত হল। চারিদিকে হ্রেষ্বাধ্বণি, পর্তুগীজ হুংকার তার মধ্যে যে যেদিকে পারে পলায়ন করতে লাগল। এক অশ্বারোহী সোজা বিপ্রদাসের দিকে উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে তেড়ে এল। বিপ্রদাস ভট্ট নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁর চোখে পলক পর্যন্ত পড়ল না। অশ্ব তাঁর শরীরের বিপজ্জনক নিকটে এসে থেমে গেল।
দুর হ হতভাগা বিধর্মী! নচেৎ তোর পাপিষ্ঠ উদর তরোয়ালের খোঁচায় ছিদ্র করে দেব। অশ্বের উপর থেকে রক্তচক্ষু পর্তুগীজ প্রহরীটি বিপ্রদাসকে বলল।
বিপ্রদাসের মুখের একটি শিরাও কম্পিত হল না। তিনি অবিচলিত কন্ঠে বললেন, আমি একজন ব্রাহ্মণ ও অধ্যাপক। তোমার নিয়োগকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাই প্রহরী।
প্রহরী তার চর্মপাদুকাসহ পা তুলে বিপ্রদাসের বুকে সজোরে পদাঘাত করল। সেই পদাঘাতের তীব্রতায় বিপ্রদাস মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলেন, তাঁর সুগৌর বক্ষদেশে ক্রুদ্ধ রক্তিম পদচিহ্ন ফুটে উঠল। পর্তুগীজ প্রহরী অশ্ব থেকে অবতরণ করে একহাতে বিপ্রদাসের শিখাটি টেনে ধরে অন্যহাতে তরবারি দিয়ে সেটি কেটে ফেলে বিপ্রদাসের মুখে ছুঁড়ে মারল। তারপর সে ঘৃনার সঙ্গে বিপ্রদাসের গায়ে থুতুনিক্ষেপ করে বলল, এই নে ব্রাহ্মণ! তোর টিকি তোকেই উপহার দিলাম!

চারিদিক নির্জন। বাজারের কেন্দ্রস্থল জনমানবশূন্য। হাওয়ায় পথের ধূলিতে দাসদের বস্ত্র ছিন্নাংশ উড়ে যাচ্ছে। পথের মধ্যে ছিন্ন শিখা হাতে নিয়ে বসে আছেন বিপ্রদাস ভট্ট। তাঁর সর্বাঙ্গ ধূলিধূসরিত কিন্তু চোখদুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। একসময় তিনি স্বগতোক্তির মত করে বললেন, পর্তুগীজ রক্তে মাথা না ধুয়ে শিখা রাখব না। তুমি যে ভগবানের উপাসনা কর, তার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করলাম বন্ধু। মিলিয়ে নিও।